বিশ্ব বাঘ দিবস: বাঘ বৃদ্ধিতে আমাদের করণীয়

Published : 29 July 2019, 02:00 PM
Updated : 29 July 2019, 02:00 PM

২৯ জুলাই বিশ্ব বাঘ দিবস। সেই প্রেক্ষিতেই বাঘ রক্ষায় করণীয় কিছু পদক্ষেপ নিয়ে এ লেখাটির অবতারণা।

বর্তমানে পৃথিবীতে ৩৮৯০ টি বাঘ আছে বলে ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড লাইফ ফান্ড (WWF) জানিয়েছে। তারমধ্যে সর্বাধিক বাঘ রয়েছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যা সংখ্যায় ২২২৬ টি। বাংলাদেশ বাঘের সংখ্যার দিক থেকে সপ্তম স্থানে রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে বাঘ সংখ্যা ১১৪টি। এছাড়া নেপালে ২৩৫টি, ভুটানে ১০৩টি, থাইল্যান্ডে ১৮৯টি, মালায়শিয়াতে ২৫০-৩৪০টি, রাশিয়াতে ৫৪০টি, চীনে ৫০টি, লাওসে ১৭টি ও ভিয়েতনামে ৫টি বাঘ রয়েছে।

গত এক দশকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে ভারত, নেপাল, রাশিয়া ও ভুটানে। WWF এর তথ্য মতে ২০০৬ সালে ভারতের বাঘ সংখ্যা ছিল ১৪১১ টি যা ২০১০ সালে বেড়ে হয় ১৭০৬ টি এবং ২০১৪ সালের গণনা অনুযায়ী সংখ্যা হয় ২২২৬টি। অন্যদিকে ভুটানে ২০১০ সালে বাঘের সংখ্যা ছিল ৭৫টি যা ২০১৪ সালের গণনা অনুযায়ী দাঁড়ায় ১০৩টিতে। নেপালে ২০০৯ সালে বাঘ সংখ্যা ছিল ১২১টি, যা ২০১৮ সালের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ২৩৫ টিতে। ২০০৫ সালের গণনা অনুযায়ী রাশিয়ার বাঘ সংখ্যা ছিল ৪২৩টি, যা ২০১৫ সালের মধ্যে হয় ৫৪০টি। অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০০৪ সালে যেখানে বাঘ সংখ্যা ছিল ৪৪০টি, সেটি ২০১৫ সালের তথ্যমতে অতিশয় হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় ১০৬টিতে। তবে সম্প্রতি ২০১৮ সালের গণনা অনুযায়ী বাঘ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১৪টিতে। অর্থাৎ এই সময়ের মধ্যে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে মাত্র ৮টি- যা আশানুরূপ নয়। বাঘ সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি না পাওয়ার নানাবিধ কারণের মধ্যে রয়েছে- সুন্দরবনে অবাধ চলাচল, বাঘ-মনুষ্য কনফ্লিক্ট, খাদ্যের অভাব ইত্যাদি। তবে জিনগত কিছু কারণও রয়েছে। সুন্দরবনে বাঘ সংখ্যা সীমিত হওয়ায় প্রজননে জিনগত বৈচিত্র্য সাধিত হচ্ছেনা। একই সাথে অল্প সংখ্যক বাঘ থাকায় এদের মধ্যে ইনব্রিডিং তথা নিকট সম্পর্কের প্রাণিকুলের মধ্যে ক্রস হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল, ফলে এক প্রকার মারণ জিন প্রকাশ পাওয়ার আশঙ্কা থাকে যা মরণশীলতা তথা শাবক মৃত্যুহার বৃদ্ধি আশঙ্কা প্রবল করে।

এমতাবস্থায় মনুষ্য ও প্রাকৃতিক কারণসমূহের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জেনেটিক্যাল সম্পর্কিত বিষয়টিকেও গুরুত্ব সহকারে ভাবা প্রয়োজন এবং বিলুপ্তের শঙ্কায় থাকা ঐতিহ্যবাহী এই প্রাণীটির জিনগত বৈচিত্র্য আনয়ন প্রয়োজন। জীনগত বৈচিত্র্য সাধনের মাধ্যমে হেটারোজেনিসিটি বৃদ্ধি করতে পারলে বাঘ সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়।

কিন্ত আমরা কিভাবে সুন্দরবনে বাঘের হেটারোজেনিসিটি বৃদ্ধি করতে পারি? এক্ষেত্রে কার্যকরী পদ্ধতি হতে পারে রি-ইন্ট্রোডাকশান। এই পদ্ধতিতে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বিশেষজ্ঞদের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের বিভিন্ন উৎস (চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্ক) থেকে বাছাইকিত বাঘ নিয়ে এদের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে সংখ্যা বৃদ্ধি করে এবং প্রজননকৃত এই বাঘগুলোকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রথমে আধা-বন্য পরিবেশে নির্দিষ্ট স্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে, পরবর্তীতে অবস্থা বিচারে এদেরকে বন্য পরিবেশে ছাড়ার মাধ্যমে জিনগত বৈচিত্র্য সাধন করা যেতে পারে। বর্তমানে কয়েকটি দেশে রি-ইন্ট্রোডাকশান প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের সকল চিড়িয়াখানা ও সাফারি পার্কের বাঘের মধ্যে সমন্বয়পূর্বক আদান-প্রদান করে প্রজননের  মাধ্যমে জীনবৈচিত্র আনয়নের প্রথম ধাপ সম্পন্ন করে পরবর্তীতে তা পর্যায়ক্রমে বন্য পরিবেশে ছেড়ে  জিনগত বৈচিত্র্যের মূল উদ্দেশ্য সাধনের দ্বারা বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি সম্ভব। উল্লেখ্য যে, জিনগত বৈচিত্র আনয়ন বাঘের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ও পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে বেঁচে থাকতে সাহায্য করবে।

কেবল জিনগত বৈচিত্র্য আনয়নের মাধ্যমেই বাঘের বিলুপ্তি রোধ সম্ভব হবেনা। এছাড়াও সুন্দরবনের বাঘকে রক্ষা করতে আমাদের স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে।

আমাদের করণীয়:

১।  সুন্দরবনের ভেতরে জনসাধারণের প্রবেশ সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে।

২। বনে যদি মানুষের বসবাস থেকে থাকে তবে তাদের সুন্দরবন থেকে সরিয়ে করে অন্যত্র পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

৩। সুন্দরবনে মধু, কাঠ, গোলপাতা সংগ্রহ এবং মাছ শিকার বন্ধ করতে হবে। এসবের উপর নির্ভরশীল জনসাধারণকে নবায়নযোগ্য জ্বালানি এবং কৃত্রিম উপায়ে মধু, গবাদিপশু ও মাছ  চাষের প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করতে হবে। এছাড়া প্রতিটি পরিবারে বায়োগ্যাস স্থাপন করতে হবে।

৪। সুন্দরবন ঘেঁষে লোকালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে মানুষ এবং বাঘসহ অন্যান্য বন্যপ্রাণীকে পরস্পরের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে হবে। এছাড়া সুন্দরবন ঘেঁষে লোকালয়ের মধ্যবর্তী স্থানে সোলার প্যানেল স্থাপন করে লোকালয়ে বাঘের প্রবেশ কমানো যেতে পারে।

৫। সুন্দরবনের যেসকল এলাকা অপরাধপ্রবণ এবং অবৈধভাবে মানুষের চলাচল বেশি সেইসব এলাকাকে সিসিটিভি স্থাপন করে সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণের আওতায় আনতে হবে।

৬। বাঘের পর্যাপ্ত খাদ্য চাহিদা নিশ্চিত করতে সুন্দরবনের কাছাকাছি হরিণ ও শূকর এর খামার করে; শূকর, হরিণের বংশ বাড়িয়ে তা  সুন্দরবনে বাঘের জন্য প্রেরণ করতে হবে।

৭। সুন্দরবনের লবণাক্ততা দূর করার জন্য এবং সুপেয় নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করার জন্য প্রাকৃতিক জলাধারের ব্যবস্থা করতে হবে।

৮। বাঘের আক্রমণে নিহত ও আহত মানুষ ও গবাদিপশুর জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।

বাংলার জীববৈচিত্র্য ও  প্রাকৃতিক বিপর্যয় রক্ষার্থে বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চলকে বাঁচাতে সুন্দরবন এবং বাঘকে বাঁচানোর কোনো বিকল্প নেই। তা না হলে বন উজাড় হবে, অতিরিক্ত জোয়ারভাটার কারণে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হবে, মাটিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাবে।ফলে ফসল উৎপাদন যাবে কমে, বাড়বে দারিদ্রতা।