আলিফ লাইলা-৪: সখি গবেষণা কারে কয়!

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 28 July 2019, 09:20 AM
Updated : 28 July 2019, 09:20 AM

[পূর্বকথা: তথাকথিত চরিত্রহীনা এক বেগমের পরকীয়ায় যারপরনাই নারাজ হয়ে হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতলের আদেশ দেবেন। কয়েক বৎসরে বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালো শত শত যুবতী কন্যা। ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি স্বজাতির প্রতি করুণাপরবশ হয়ে বোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে নিজে থেকেই বাদশা শাহরিয়ারকে নিকাহ করেন। জীবনের শেষ রাতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক ছোটবোন দিনারজাদি একেকটি সওয়াল পুছেন আর বড়বোন শেহেরজাদিও কালবিলম্ব না করে সওয়ালের জওয়াব দিতে শুরু করেন। কিন্তু ভোরের আজান হওয়া মাত্র জওয়াব বন্ধ করে নকশি লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েন দুই বোন। সওয়াল-জওয়াব শুনতে শুনতে বাদশাহ মজা পাচ্ছিলেন, জ্ঞানগম্যিও কমবেশি হচ্ছিল বৈকি। সুতরাং পর পর তিন দিন মৃত্যুদণ্ড বাতিল হয় শেহেরজাদির। আজ সেই সওয়াল-জওয়াবের চতুর্থ রাত্রি]

'প্রিয় দিদি আমার। সম্প্রতি বাংলাদেশে দুধে অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ে তুলকালাম হচ্ছে। এ ঘটনার আগাপাশতলা একটু বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে বলবে কি?' অবশ্যই বলবো বোন দিনারজাদি, বিশেষ করে যেহেতু এই ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এরও সম্পর্ক আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা 'হয় না, হয় না' শুনতে শুনতে মহাবিরক্ত হয়ে ফার্মেসি বিভাগের এক সদ্যপ্রাক্তন অধ্যাপক আ.ব.ম ফারুক এক গবেষণা করেই বসলেন। ঢাকা শহরের বিভিন্ন দোকান থেকে তরল দুধের নমুনা সংগ্রহ করে তিনি এবং তাঁর গবেষক দল সেই দুধে পেয়ে গেলেন কমপক্ষে তিন রকমের অ্যান্টিবায়োটিক। পেয়েই তিনি এক সাংবাদ সম্মেলন ডাকলেন। সাংবাদিকেরা একে তো (চট্টগ্রামের ভাষায়) 'উলাইল্যা' (হৈচৈ, আনন্দ করতে যে এক পায়ে খাড়া) বুড়ি, তার উপর 'পইরগে ঢোলর বাড়ি'। খবর ছড়িয়ে পড়তে দেরি হলো না। অধ্যাপক ফারুকের নিজের ডিপার্টমেন্ট সাফ জানিয়ে দিল, এই গবেষণার সঙ্গে ফার্মেসি বিভাগের কোনো সম্পর্ক নেই। এদিকে প্রাণী ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব গেলেন খেপে। এই খেপচুরিয়াস সচিব অধ্যাপককে উপদেশ দিলেন তাঁর গবেষণা প্রথমে কোনো পিয়ার-রিভিউড জার্নালে প্রকাশ করতে এবং তারপর জনসমক্ষে প্রকাশ করতে। সরকারের পক্ষ থেকে অধ্যাপক ফারুককে মামলার ভয়ও দেখানো হলো।

ইতিমধ্যে অধ্যাপক ফারুকের পক্ষে সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপক সমর্থন প্রকাশিত হলো। আ.ব.ম. ফারুকের নিরাপত্তা দাবি করে এক প্রতিবাদ সমাবেশ করলেন ঢাবি অধ্যাপকদের একটি দল টি.এস.সি. এলাকায়। পরের সপ্তাহে অধ্যাপক ফারুক আবার দুধের নমুনা সংগ্রহ করলেন। এবার পাওয়া গেল চার ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক। উচ্চ আদালত সরকারি সংস্থাকে এক সপ্তাহের মধ্যে একই পরীক্ষা আবার করে অধ্যাপক ফারুকের গবেষণার ফল যাচাই করার নির্দেশ দিলেন। পরে জানা গেল, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আছে কি নেই যাচাই করার মতো যন্ত্রপাতি নাকি সরকারি সংস্থার হাতে নেই, কখনও ছিল না।

দিদি, যদি আড়ং, মিল্কভিটা ইত্যাদি কোম্পানির দুধ কেনা বন্ধ করে দেয় লোকজন, তবে তো এই সব কোম্পানীর সঙ্গে জড়িত হাজার হাজার কর্মচারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও দুধখামারি বেকার হয়ে যাবে। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতির ক্ষতি হতে পারে। সুতরাং মন্ত্রণালয়ের সচিব খেপে তো যেতেই পারেন। এখন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব বিভাগের হর্তাকর্তাবিধাতারা জাতিধর্মনির্বিশেষে সরকারি দলের সমর্থক। সরকার না আবার গোস্বা করে, এই ভয়ে ফার্মেসি বিভাগের দলদাস প্রধান তো বিবৃতি দিতেই পারেন। আবার যদি আসলেই অ্যান্টিবায়োটিক থাকে এই সব নামীদামী কোম্পানির দুধে তবে জনস্বার্থে এই গবেষণার ফল প্রকাশ করে জনাব ফারুকও কি সঠিক কাজ করেননি? হাইকোর্টও গবেষণার ফল পুনর্যাচাইয়ের নির্দেশ দিয়ে কোনো ভুল করেছে বলে কি তোমার মনে হয়? অধ্যাপকেরাই বা কেন তাদের এক সহকর্মীর সৎকর্মের প্রতি সমর্থন জানাবেন না? দিনারজাদি গড় গড় করে অনেকগুলো প্রশ্ন করে যায়।

প্রিয় দিনারজাদি! প্রথম কথা হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিক বাংলাদেশের কোন খাবারে নেই? বুকের দুধ, গরুর দুধ, মুরগির মাংস, মাছ– সব কিছুতে অ্যান্টিবায়োটিক কিংবা মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর উপাদান থাকার কথা। ডাল-সবজিতেও নাকি আছে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান। এর কারণ কী? আজ থেকে কুড়ি বছর আগে যখন ফার্মের মুরগি চাষ করা শুরু হয়, তখন সংক্রামক রোগে ব্যাচের পর ব্যাচ মুরগি মারা যেতো। কত কত মুরগি-খামারি দেউলিয়া হয়ে গেছে। এখন তো আর মুরগি-মড়কের কথা শোনা যায় না। এর কারণ মুরগির শরীরে ঢোকানো হয় অ্যান্টিবায়োটিক। গরুকেও সুস্থ রাখতে অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া হয় নিশ্চয়ই। কতটা অ্যান্টিবায়োটিক দেওয়া যাবে, তার একটা সহনীয় মাত্রা নিশ্চয়ই আছে। যে অ্যান্টিবায়োটিক গরুর শরীরে ব্যবহার করা হয়, সেটা মানুষের শরীরে ব্যবহৃত অ্যান্টিবায়োটিক থেকে আলাদা।

শুনেছি, দুধে যে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে সেটি প্রাণীদেহে ব্যবহার্য অ্যান্টিবায়োটিক নয়, মানবদেহে ব্যবহার্য অ্যান্টিবায়োটিক। এর মানে হচ্ছে, কোনো কোনো অসাধু খামারি মানুষের অ্যান্টিবায়োটিক গরুকে খাওয়াচ্ছে। মানুষের ব্যবহার্য মেয়াদ-উত্তীর্ণ সালফাগুনডিন ট্যাবলেট হামানদিস্তায় গুড়া করে একটু বেশি ডোজে গরুকে খাওয়াতে নিজের চোখে দেখেছি আমি ছোটবেলায়, চট্টগ্রাম অঞ্চলে। কী কারণে (দাম কম বলে, নাকি সহজলভ্য বলে) খামারিরা কিংবা কোয়াক পশুচিকিৎসকেরা মনুষ্য অ্যান্টিবায়োটিক গরুকে খাইয়ে থাকেন, সেটা আমাদের জানতে হবে।

মিল্কভিটা কিংবা আড়ং অনেকখানি দুধ কিনে মধ্যস্বত্বভোগী দালালদের কাছ থেকে। দালালরা দুধ কিনে গৃহস্থদের কাছ থেকে। এই হাজার হাজার উৎসের মান নিয়ন্ত্রণ করা কি আদৌ সম্ভব? যে দেশে ট্র্যাফিক লাইট দিয়ে গাড়ি চালানো যায় না, যে দেশে মানুষ ফার্মেসি থেকে ফটাফট অ্যান্টিবায়োটিক কিনে পটাপট গিলে, কোনো ডোজ মানে না, সে দেশে গরুর অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ন্ত্রণ করা মুশকিল হওয়ারই কথা।

'দুধ কি এখনও খাওয়াচ্ছেন বাচ্চাদের?' জিগ্যেস করা হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকাকে। 'ইশ! দুধেও বিষ! না আমার দুই ছেলেকে আমি বাজারের দুধ খাওয়াই না। গ্রাম থেকে দুধ আনাই। ভবিষ্যৎ বংশধরদের কথা ভাবতে হবে না?' 'আপনি তো ভাবছেন, কিন্তু আপনার হবু বেয়ানও কি ভাবছেন? তিনি যদি মিল্কভিটা কিংবা আড়ং দুধ খাওয়ান, তবে তো আপনার নাতি-নাতনির শরীরেও অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স ঢুকে যাবে মায়ের শরীর থেকে, কিংবা মায়ের দুধ থেকে। যত সতর্কই আপনি হন না কেন, আপনি নিরাপদ নন, অন্ততপক্ষে আপনার সন্তান নিরাপদ নয়।'

দুধের যে স্যাম্পল ব্যবহার করেছেন অধ্যাপক ফারুক, সেগুলো পাস্তুরাইজড দুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাস্তুরাইজ করা হলে অ্যান্টিবায়েটিকের কার্যক্ষমতা অর্ধেকের মতো ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কথা। আমাদের এখন জানতে হবে, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক যে পরিমাণে আছে, যে অবস্থায় আছে সেটা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক কিনা। অধ্যাপক ফারুক সেটা বলেননি। গবেষণা করলে হয়তো বলতে পারতেন। গবেষণা ঠিকঠাকমতো হয়েছে কি হয়নি, কী করা উচিত ছিল, এসব খবর জনগণকে দেবার কথা ছিল ফার্মেসি বিভাগের। তা না করে তারা গবেষণার সঙ্গেই সম্পর্কচ্ছেদ করলেন। গবেষণার সঙ্গে সম্পর্ক আছে কি নেই, তোমাদের কাছে কেউ জানতে চেয়েছিল? এই সব অপেশাদার শিক্ষক-গবেষক, দলবাজি যাদের কাছে গবেষণার চাইতে বড়, তাদের দিয়ে আর যাই হোক, র‌্যাংকিং হবে না।

ভগ্নী দিনারজাদি! বাঙালি সব কিছুকে গবেষণা মনে করে। ব্লাড টেস্টে যখন সুগার পাওয়া যায় সেটাও কি গবেষণার ফল? প্যাথোলজিক্যাল টেস্টকে যদি কেউ গবেষণা বলে, তবে বুঝতে হবে গবেষণা জিনিষটাই সে বোঝে না। অধ্যাপক ফারুকও অবশ্য এক সাক্ষাৎকারে স্বীকার করেছেন, তাঁর কাজটা গবেষণাপদবাচ্য নয়। দুধে পানি মেশানো হয়েছে কি হয়নি জানতে মানুষ যা করে, তিনি নাকি অনেকটা তাই করেছেন।

'তাহলে তোমার মতে গবেষণা কী?' দিনারজাদি জানতে চায় শেহেরজাদির কাছে। গবেষণা হচ্ছে জ্ঞান অর্জনের এমন একটি পদ্ধতি যাতে বিশেষ একটি কল্পানুমান প্রমাণের উদ্দেশ্যে প্রথমে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এবং তারপর সংগৃহীত তথ্যকে সুবিন্যস্ত করা হয়। তৃতীয় পর্যায়ে এই সুবিন্যস্ত তথ্যের ভিত্তিতে গবেষক-বিজ্ঞানী একটি ভুলপ্রমাণযোগ্য সাধারণ সূত্র রচনা করার চেষ্টা করেন। এই সাধারণীকরণের নাম তত্ত্ব রচনা। কোনো তত্ত্বই সত্য প্রমাণ করা যায় না, শুধু ভুল প্রমাণ করা যায়। যে মুহূর্তে একটি তত্ত্ব জনসমক্ষে প্রকাশিত হয়, সেই মুহূর্ত থেকে সেই ব্যক্তি এবং অন্য সব বিজ্ঞানী সেই তত্ত্বটিকে ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করে। ভুল প্রমাণিত হলে, তত্ত্ব সংশোধিত হয় কিংবা পরিত্যক্ত হয়। পরিত্যক্ত তত্ত্ব বহু যুগ পর পুনরায় ব্যবহৃত হতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, ভুলপ্রমাণযোগ্য সাধারণীকরণের নাম বিজ্ঞান। জ্ঞান-অর্জনের এই বিশেষ পদ্ধতির নাম গবেষণা।

দুধের কোন ব্যাচের কোন স্যাম্পল নেওয়া হবে, কীভাবে নেওয়া হবে, কতদিন পর পর নেওয়া হবে ইত্যাদি হচ্ছে তথ্য সংগ্রহের বিভিন্ন প্রাথমিক শর্ত। একবার অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া গেলেই যে সব সময় পাওয়া যাবে এমন কোনো কথা নেই। সুতরাং দৈবচয়ন বা সুনির্দিষ্ট চয়নের মাধ্যমে স্যাম্পল নিতে হবে এবং পরীক্ষা করে দেখতে হবে, সেই দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আছে কিনা। পর পর কমপক্ষে তিন বার নিতে হবে একই শর্ত মেনে। এভাবে তথ্য সংগ্রহ ও বিন্যস্ত করার পরই শুধু দুধে অ্যান্টিবায়োটিক থাকা সম্পর্কে সাধারণীকরণ করা যাবে কিংবা সাধারণ সূত্র রচনা করা যাবে। সেই অ্যান্টিবায়োটিক মানবদেহের জন্যে ক্ষতিকর কিনা সেটা ভিন্ন একটি গবেষণার বিষয়।

ধর্মের যেমন নিয়মকানুন থাকে, ধর্মের অনুসারীদের একটা সমাজ থাকে, তেমনি বিজ্ঞানচর্চারও নিয়মকানুন আছে, আছে বিজ্ঞানীদের সমাজ। দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের সন্ধান করা যদি তথাকথিত গবেষণা হয়ে থাকে, তবে বিজ্ঞানচর্চার নিয়ম মেনে প্রথমেই সেটা প্রকাশ করা দরকার ছিল পিয়ারদের সামনে, কারণ তাঁরাই শুধু জানবেন, গবেষণার যাবতীয় শর্ত মেনে এই গবেষণা করা হয়েছে কিনা, ঠিকঠাকমতো নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে কিনা। পিয়াররা যদি সন্তুষ্ট হন, তবে গবেষণার ফলাফল কোনো গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশ করা যেতে পারতো। তখনই এবং শুধু তখনই বলা যেতে পারতো যে গবেষণা একটা হয়েছে বটে। গবেষণা সাংবাদ সম্মেলন করে বলার মতো কোনো বিষয় নয়। জনস্বাস্থ্যের বিষয় জড়িত– এই অজুহাতে তড়িঘড়ি করে গবেষণার নিয়ম ও সংস্কৃতি না মেনে যা খুশি তাই করা কোনো গবেষককে মানায় না। গবেষণা হাতে-কলমে শিখে যারা ডক্টর হন, তারাও অনেক সময় গবেষণার নিয়ম মানেন না, পি.এইচ.ডি না করা 'জনাব'-দের কথা বলা বাহুল্য।

দুধে যে অ্যান্টিবায়োটিক আছে সেটা কি বাঙালিরা এতদিন জানতো না? মুরগিতে, মাছে, ডিমে ক্ষতিকর উপাদান আছে, থাকবেই। তুমি যখনি ব্যাপক পরিসরে উৎপাদনে যাবে তখন এসব ক্যামিকেল তোমাকে ব্যবহার করতেই হবে। কোটি কোটি জনতার প্রোটিন-চাহিদা বুকের দুধ, দেশি গরুর দুধ কিংবা দেশি মুরগি দিয়ে মেটানো যাবে না। সিদ্ধান্ত তোমাকেই নিতে হবে: এ মুহূর্তে অনাহারে-অর্ধাহারে-অপুষ্টিতে মরবে, নাকি বিশ বছর পর ক্যান্সারে মরবে। যে কোনো বুদ্ধিমান লোক, শেষের অপশনটাই বেছে নেবে। বাঙালিরাও তাই করেছে। মাঝখান থেকে ক্ষতি হয়েছে লেজেহোমো এরশাদের। অ্যান্টিবায়োটিকের হুজুগে বেচারার মৃত্যুটা মনোযোগই পায়নি। হাজার দুধ খামারির ক্ষতির কথা বলা বাহুল্য।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অধ্যাপক-বিজ্ঞানী, বিজ্ঞানের নিয়মনীতি যাঁর জানার ও মানার কথা, তিনি তা মানেননি এবং সেজন্য তাঁর কোনো আফসোসও নেই। একজন সচিব, যিনি গবেষণার কিছুই বোঝেন না, তিনি অধ্যাপককে বলেন, কীভাবে গবেষণা করতে হবে। গবেষণা সম্পর্কে কিছুই জানার কথা নয় যে প্রতিষ্ঠানের, সেই উচ্চ আদালত কর্তৃপক্ষকে বলে দিয়েছে গবেষণা কত দিনে করতে হবে। এক দল সরলপ্রাণ অধ্যাপক যাঁরা কোনটা গবেষণা, কোনটা নয় জানার কথা, তাঁরা একটি সাধারণ প্যাথলজিক্যাল টেস্টকে মহাগবেষণা বলে ধরে নিয়েছেন এবং টেস্টটা ঠিকঠাকমতো করা হয়েছে কিনা সেটা বিচার করে দেখারও প্রয়োজন বোধ করেননি। 'কাকে নিয়ে গেছে কান' বলে কেউ ভুল করেছে বলেও যদি আপনার মনে হয়, তবে সেই কান-ছিনতাইকারী কাকের দিকে ঢিল ছোঁড়ার পূর্বে (নিজে অপারগ হলে, অর্থাৎ যন্ত্রপাতি না থাকলে) আপনি অন্য কাউকে দিয়ে নিজের কান ধরিয়ে পরীক্ষা করিয়ে নিলেই তো পারেন, কান স্বস্থানে অবস্থান করছে কিনা। বাংলাদেশে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে গবেষণার করুণ অবস্থা পরিষ্কার বোঝা যেতে পারে এই একটি ঘটনা থেকে। গবেষক-অধ্যাপক-আমলা-বিচারক-জনতা– সবার আচরণে শিশুতোষ আনাড়িপনা সুস্পষ্ট। বাঙালির চরিত্রদ্রষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথ গীত রচনা করেছিলেন: 'সখি! গবেষণা কারে কয়? র‌্যাংকিং এ জন্মে হবার নয়!'

প্রিয় দিনারজাদি, তুমি যেন ভেবে বসো না আমি দুধের মান পরীক্ষার বিপক্ষে। শুধু দুধ কেন, যে কোনো খাদ্য এমনকি বাতাসও, অর্থাৎ যা কিছু আমরা শরীরে গ্রহণ করি, নিয়মিত পরীক্ষা করতে হবে। গবেষণা অবশ্যই করতে হবে খাদ্যের মান নিয়ে, তবে যেনতেন ভাবে নয়, নিয়ম মেনে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলা চলবে না, কারণ জনগণ অসুস্থ, স্বাস্থ্যহীন হলে রাষ্ট্রের র্দীঘকালীন, অদৃশ্য, অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। দুধ একটি শিশুখাদ্য। দুধে ভেজাল থাকলে শিশুর ক্ষতি হবে এবং শিশুর ক্ষতি মানে রাষ্ট্রের, ধরিত্রীর ভবিষ্যতের ক্ষতি।

রাত শেষ হয়ে আসছে। একটি চুটকি দিয়ে শেষ করি। অধ্যাপক ফারুকের 'গবেষণা' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে এক অতিউৎসাহীর খায়েস হলো, সেও দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আছে কিনা গবেষণা করে দেখবে। কল্পনাবিলাসী বাঙালির জন্য গবেষণা মোটেও কঠিন কোনো কাজ নয়। আগের দিন রাতে অনেকখানি দুধ গিলে নিয়ে পরদিন নিজের stool নিয়ে হাজির হলো সে ঢাকার পপুলার বা ল্যাব এইডে। প্যাথলজিস্ট পরীক্ষা করে রিপোর্ট দিল: It'stoolate! অর্থাৎ এটা বিশেষ ধরনের একটা stool যেটা আনতে গিয়ে অনেক late হয়েছে। সুতরাং উচ্চ আদালত যেমনটা বলেছে, আবার বিষ্ঠা পরীক্ষা করাতে হবে। এবার সব নিয়মকানুন মেনে, অধ্যাপক ফারুক ও পিয়ারদের সামনে সেই সচিবের নিজের হাতে 'হেগে' পাঠাতে হবে এই বিষ্ঠা, যেহেতু ইওরোপের এই শহরটি এই বিশেষ পরীক্ষার জন্য মশহুর।

[বাদশা এবং দিনারজাদি অট্টহাস্যে মুখরিত হলেন। ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলে এবং ভোরের আযানও শোনা গেলে শেহেরজাদি পূর্বরাত্রির মতোই মুখে কুলুপ আঁটলেন এবং দুই বোন ফজরের নামাজ পড়ে নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। বাদশা শাহরিয়ারও বেরিয়ে গেলেন ফজরের নামাজ পড়তে এবং অতঃপর রাজকার্যে। বাদশার মন খারাপ হয়ে গেল, কারণ আজ রাতে দুধে অ্যান্টিবায়োটিকের ফালতু প্যাঁচাল শুনতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ না আসার একটি কারণও জানা হয়নি। অনুসন্ধিৎসু বাদশাহ শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড পঞ্চম রাত্রি পর্যন্ত স্থগিত করতে বাধ্য হলেন।]