ডেঙ্গু মহামারী আকার নিয়েছে অথচ সরকার ঝাঁপিয়ে পড়ছে না

স্বদেশ রায়
Published : 23 Dec 2011, 06:12 AM
Updated : 25 July 2019, 12:34 PM

ডেঙ্গু যে মহামারী আকার নিয়েছে এ নিয়ে এখন আর কারও কোন প্রশ্ন নেই। অতিশয়োক্তি না করেও বলা যায়, অধিকাংশ ঘরে এখন ডেঙ্গু রোগী। এ বছর যে সাউথ ইস্ট এশিয়া ও সাউথ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে ডেঙ্গু (যা প্রকৃত অর্থে বলা হয় ডেঙ্গি) মহামারী আকার নেবে সেটা এক বছর আগেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে বলা হয়েছিল। সে বিষয়ে কোন সচেতনতামূলক ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যে নেয়া হয়নি- সেটা এখন প্রমাণিত।

আমাদের ঢাকার দুই মেয়র যাই বলুন না কেন, তারা ব্যর্থ হয়েছেন। তারা এই এক বছর বসে ছিলেন। এখন এসে শুধু কথা বলছেন। তাদের এ আচরণ শেখ হাসিনার উন্নয়নের ও দেশ পরিচালনার দর্শনের সঙ্গে যায় না। শেখ হাসিনা যেভাবে ভবিষ্যত চিন্তা করে দেশের উন্নয়ন করছেন সেখানে তার মেয়ররা এক বছর আগে জানার পরেও ডেঙ্গু রোগ প্রতিরোধ অর্থাৎ মশা মারা ও প্রতিটি নাগরিককে সচেতন না করে মূলত খালেদা জিয়ার রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শনই অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ কোন দায়িত্ব পালন না করা। তাই এখন শুধু মেয়র দু'জনকে বলা যায় আপনারা দয়া করে শেখ হাসিনার মেয়র হোন। কথা কম বলুন- বিপদ থেকে, মহামারী থেকে বাঁচানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ঝাঁপিয়ে পড়ুন।

অন্যদিকে ডেঙ্গু এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া এখন বিষয়গুলো দাঁড়িয়েছে এমন যে- ডেঙ্গু রোগী নতুন করে যাতে কম হয়, এডিস মশা দ্বারা কম মানুষ আক্রান্ত হয় সে ব্যবস্থা করা। আর যারা ইতোমধ্যে আক্রান্ত হয়েছেন তাদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা। এই কাজটি কোন ক্রমেই মেয়রদের নয়। কাজটি সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের। তবে ডেঙ্গু যে মহামারী আকার ধারণ করেছে তাতে আর বিষয়টি শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একার পক্ষে সম্ভব নয়। গোটা সরকার ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে এবং দেশের মানুষকে বাঁচানোর জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। প্রধানমন্ত্রী দেশে নেই। তিনি এখন চিকিৎসাধীন। তিনি দেশে থাকলে হয়ত ইতোমধ্যে সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিতেন। তার অতীতের কাজ সেটাই বলে। তবে বিদেশ থেকেও তিনি সব সময়ে সিদ্ধান্ত দেন। আমরা জানি না সরকার থেকে, বিশেষ করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে তাঁকে মূল সত্যটি জানানো হয়েছে কিনা? তাকে সত্য বলা হয়েছে কিনা যে, ডেঙ্গু মহামারী আকার নিয়েছে। যদি তাঁকে সত্য বলা না হয়ে থাকে, তাহলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও তার পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব এখন অবিলম্বে প্রধানমন্ত্রীকে সত্য জানানো।

পাশাপাশি এ মুহূর্তে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের, গোটা সরকারের ও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল ও দায়িত্ববান বিরোধী দলগুলোর অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রথমত এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় অধিকাংশ হাসাপাতালে ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হতে পারছে না। তারা প্রয়োজনীয় সিট বা কেবিন পাচ্ছে না। অবিলম্বে সরকারের একটি সমন্বিত কমিটি করে তার মাধ্যমে সরকারী ও বেসরকারী সকল হাসপাতালকে মনিটরিং ও সেখানে কিছু নতুন ব্যবস্থাপনা চালু করতে হবে। অর্থাৎ সকল হাসপাতালে অন্য রোগীদের চিকিৎসার জন্য যে সব বিশেষায়িত সিট বা কেবিন আছে সেগুলোর একটি অংশ এ মুহূর্তে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য ছেড়ে দিতে হবে। তেমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিটকে বড় করা হয়েছে। সেখানে আলাদা করে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য কোন ওয়ার্ড বা অনেক ওয়ার্ড খোলা সম্ভব কিনা সেটা দেখতে হবে। এ ছাড়া সরকারকে এ মুহূর্তে সকল বেসরকারী হাসপাতালের জন্য একটি সার্কুলার জারি করতে হবে যে- দেশে যেহেতু ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছে এবং মানুষ মারা যাচ্ছে- তাই মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ডেঙ্গু রোগীদের নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময় চিকিৎসা দিতে হবে। বেশি অর্থ নেয়া যাবে না। তার জন্য যদি বেসরকারী হাসপাতালগুলোকে সরকারের পক্ষ থেকে কোন অর্থ দিতে হয় সেটা দিয়েও সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যাতে করে যে কেউ, যে কোন হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে। একজন দরিদ্র মানুষও যেন প্রয়োজনে স্কয়ার বা ইউনাইটেড হাসপাতালের মতো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য সরকারের পক্ষ থেকে অবিলম্বে বেসরকারী হাসপাতালগুলোর মালিকদের সঙ্গে বসতে হবে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এসব কাজ কয়েক ঘণ্টার মধ্যে শেষ করতে হবে।

কারণ, মনে রাখা দরকার, প্রতিদিন এই রোগে মানুষ মারা যাচ্ছে। এছাড়াও ঢাকা শহরে সিটি কর্পোরেশনের কতকগুলো হাসপাতাল আছে সেগুলো ঠিকমতো চালু নেই। এগুলো কীভাবে জরুরি ভিত্তিতে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দেয়ার মতো পর্যায়ে নেয়া যায় সে ব্যবস্থা করতে হবে। এসব ক্ষেত্রে আরও ঘাটতি হিসেবে দেখা দেবে চিকিৎসকের। ডেঙ্গু চিকিৎসা করার মতো পর্যাপ্ত চিকিৎসক আমাদের নেই। তবে এটা সত্য আমাদের বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার আছেন যারা ডেঙ্গু চিকিৎসায় প্রায় শতভাগ সাফল্য ইতোমধ্যে দেখিয়েছেন। তাদের মাধ্যমে সাধারণ চিকিৎসকদের সাত দিনের একটি ট্রেনিং করিয়ে নেয়া যেতে পারে বা এক্ষেত্রে ডাক্তারই আমাদের থেকে ভাল বলতে পারবেন কীভাবে এটা করা সম্ভব। যেহেতু ডেঙ্গু মহামারী আকার ধারণ করেছে সে কারণে সারাদেশের ডাক্তারদের একটি সমন্বয় দরকার। কোথাও কোন ক্রিটিক্যাল রোগী থাকলে তারা যেন পরামর্শ দিতে পারেন। ডা. আব্দুল্লাহ ইতোমধ্যে বাংলাদেশের ডেঙ্গু চিকিৎসার পথিক্রম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তাই তাকে প্রধান করে সারাদেশে ডেঙ্গু চিকিৎসার একটি সমন্বয়ক চিকিৎসক কমিটি করা দরকার এবং ওই কমিটি বা সেল যাতে সার্বক্ষণিক কাজ করতে পারে তার ব্যবস্থা নেয়া দরকার।

এরই পাশাপাশি রয়েছে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলসহ সব রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব। বন্যা বা অন্যান্য মহামারীতে তারা যেমন তাদের কর্মী নামিয়ে দেন, এক্ষেত্রেও তাদের একই কাজ করতে হবে। মানুষকে মোটিভেট করতে এসব রাজনৈতিক কর্মীরা প্রতিটি বাসায় বাসায় যাবেন। পাশাপাশি বাসা বাড়িতে বা আশপাশে যাতে এডিস মশা জন্মাতে না পারে এ জন ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়নসহ সব ছাত্র ও যুব সংগঠনকে অবিলম্বে এ কাজে তাদের কর্মীদের নামিয়ে দিতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গু আর শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক নেই গোটা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাই সারাদেশে তাদের এ কাজ করতে হবে। তাদের এই কাজের সহযোগিতার জন্য দেশের বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপকে এ মুহূর্তে এগিয়ে আসতে হবে। বন্যা বা মহামারীতে তারা খাদ্য, পোশাক এমনি নানা সামগ্রী ত্রাণ হিসেবে দেন। এবার তাদের এসব ছাত্র ও যুব কর্মীদের হাতে তুলে দিতে হবে বাজারে যেসব ইনসেক্ট কিলার সামগ্রী রয়েছে সেগুলো। যার মাধ্যমে তারা বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে এডিস মশা মারার ব্যবস্থা করতে পারে। এর সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-যুবকদের প্রতিটি পাড়ায়, মহল্লায় ও এলাকায় গড়ে তুলতে হবে রক্তদাতা গ্রুপ। তাদের সকলের রক্তের গ্রুপ শনাক্ত করে তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে প্রতিটি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীকে রক্ত দেয়ার জন্য। কারণ, একজন ডেঙ্গু রোগীকে বাঁচাতে প্রচুর রক্ত দরকার হয়। আমার সহকর্মী ফিরোজ মান্নার কন্যাকে বাঁচাতে ষোলো ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়েছে। ২০০০ সালে আমার পরিচিত একজনকে বাঁচাতে ২৫ ব্যাগের ওপর রক্ত জোগাড় করতে হয়েছিল। তাই এক্ষেত্রে প্রতিটি সংগঠনের ছাত্র-যুবকরা যাতে এগিয়ে আসতে পারে তার ব্যবস্থা রাজনৈতিক দলগুলোকে করতে হবে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে কোন কোন পরিবারের সকলে বা অধিকাংশ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাদের সেবা দেয়ার কেউ থাকছে না। হাসপাতালের সীমিত সংখ্যক নার্সও হিমশিম খাচ্ছে।

এ কাজে ছাত্র সংগঠনগুলোর ছাত্রীদের এগিয়ে আসতে হবে। তাদের ওই সব রোগীকে সেবার ভার নিতে হবে।
সর্বোপরি ডেঙ্গু এখন মহামারী আকার নিয়েছে। তাই কারও আর বসে থাকার সময় নেই। বরং সকলের সিদ্ধান্ত হোক আর একজনও মারা যাবে না ডেঙ্গুতে। আর এ কাজে প্রথমেই ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে সরকারকে। যা এখনও পর্যন্ত ঘটেনি।