বেবী মওদুদ: বঙ্গবন্ধু কন্যার অকৃত্রিম সুহৃদ 

ওমর ফারুক চৌধুরী জীবন
Published : 25 July 2019, 11:47 AM
Updated : 25 July 2019, 11:47 AM

তিনি আর আট-দশটা নারীর মত নন। সমসাময়িক নারী সমাজের মত গৃহকোণে আটকে থাকেননি। তৎকালীন মধ্যবিত্ত সমাজের মানসিকতায় সংস্কারপন্থী ও চিন্তাভাবনায় ছিলেন আধুনিক। তবে সময়কে তিনি ছাড়িয়ে যাননি একেবারেই। বিশেষ করে রক্ষণশীল সামাজিকতায় তিনি প্রবল বিশ্বাসী ছিলেন। যে সময়ে বেগম রোকেয়ার নারী জাগরণী বাণীতে মুসলিম সমাজ উজ্জীবিত, উদ্বুদ্ধ হয়েছে এবং নারী শিক্ষায় উদ্যোগ গ্রহণ করছে সেই সময়েই জন্ম নেন বেবী মওদুদ।

দেশবরেণ্য সাংবাদিক থেকে সাংসদ বনে যাওয়া এই নারী ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন সোমবার, কলকাতার পার্ক সার্কাসের থিয়েটার রোডে একটি তিন তলা বাড়ির ফ্ল্যাটে জন্মগ্রহণ করেন। 'জীবনের পাতায় পাতায়' স্মৃতিকথায় তার জন্মমুহূর্ত সম্পর্কে লিখেছেন, "সেদিন খুব বৃষ্টি হচ্ছিল, যাকে বলে মুষলধারে। মায়ের শরীরটা সকাল থেকেই খারাপ লাগছিল বলে দাইকে খবর দেওয়া হয়েছিল। আমার মায়ের যখন প্রসব ব্যথা ওঠে, খুব কষ্ট হচ্ছিল। একতলার ফ্ল্যাটে থাকতেন কবি সুফিয়া কামাল। তাকে খবর দেওয়া হলে তিনি কাছে বসেন এবং দোয়া-দরুদ পড়ে ফুঁ দেন। তার পরই আমার জন্ম হয় এবং আমাকে প্রথম কোলে নিয়ে স্নেহচুম্বন করে আশীর্বাদ করেন।" তার পোশাকি নাম আফরোজা নাহার মাহফুজা খাতুন হলেও সবার কাছে তিনি 'বেবী আপা' হিসেবে পরিচিত। তিনি নিজেই তার নাম সম্পর্কে লিখেছেন- "কলকাতায় আমার জন্মের পর মা আমাকে বেবী জনসন পাউডার মাখাতেন। সেটা দেখে আমার বড় ভাই আমাকে বেবী বলে ডাকতে শুরু করে। আমার ডাক নাম হয়ে যায় 'বেবী'। তবে আকিকা দিয়ে বাবা আমার নাম রাখেন আফরোজা নাহার মাহফুজা খাতুন। এত বড় নাম আমার ভালো লাগতো না বলে বড় হয়ে লেখালেখি করতে এসে আমি নিজেই আমার নাম বেবী মওদুদ রাখি।"

বাবা বিচারপতি আবদুল মওদুদ ও মা হেদায়েতুন নেসা। ছয় ভাই, তিন বোনের মধ্যে তৃতীয় বেবী মওদুদ ছোটবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণীতে পড়া অবস্থায় পত্রিকায় লিখালিখি শুরু করেন। যেকারণে মানসিক দৃঢ়তা ও সাহস বৌদ্ধিক চর্চায় সমান অবদান রাখতে রাখতে রঙিন হয়ে উঠলেন রাজনৈতিক আলোয়। বর্তমান স্বার্থান্ধ সময়ে বেবী মওদুদ ছিলেন ব্যতিক্রমী এক মানুষ। তিনি যেভাবে ভাবেন, সেভাবে খুব কমসংখ্যক নারীই ভাবেন। তার চিন্তা চেতনায় সবসময় মানুষের মঙ্গল আর মমত্বময় বাংলাদেশ। ষাটের দশকে এ অঞ্চলে সাংবাদিকতা পেশায় নারীদের আনাগোনা খুবই কম ছিল। যে সময়ে নারীরা পুরুষ সঙ্গী ছাড়া ঘর থেকেই বের হত না তখনো ব্যতিক্রম ছিলেন বেবী মওদুদ।

সামাজিক বাঁধা ডিঙ্গিয়ে তিনি সাহসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন সাংবাদিকতার পেশায়। এবং এই পেশায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। নারী সাংবাদিকতার ধারণাটাই তিনি পাল্টে দিয়েছেন। যেখানে নারীরা এই পেশায় টিকতে পারবেনা বা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে না, এমন ধারণা পোষণ করতেন সেখানে তিনি বিপ্লব সাধন করেছেন। তিনি পার্থিব জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে আয়ত্ত করে নিয়েছেন মানবিকতার মহৎ গুণগুলো। তাই তার কথা ও কাজে প্রাধান্য পেয়েছে বঞ্চিত মানুষের কথা। তার ভাষায় 'আমার কাছে মানুষই প্রথম এবং মানুষই প্রধান। জীবন দর্শন এমনই ছিল বলে, তিনি হয়েছিলেন দেশের সংবাদ ও সাংবাদিকতা জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, এক অগ্রপথিক।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে অনার্সসহ মাস্টার্স করা বেবী মওদুদ পেশাগত জীবনে কাজ করেছেন অনেক পত্রিকায়। সাপ্তাহিক ললনা, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক মুক্তকণ্ঠ ও বিবিসিতে তিনি কাজ করেন। সাপ্তাহিক বিচিত্রার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। এখানে উল্লেখ্য, এই সাময়িকীর সম্পাদক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ রেহানা।  বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার বাংলা বিভাগটি গড়ে তুলেছেন প্রধান বার্তা সম্পাদক হিসেবে। তিনি অনলাইন নিউজপোর্টাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স সম্পাদক ছিলেন। সাংবাদিকতা জীবনে তার এই দীর্ঘপথ চলায় একজন নারী হিসেবে পেশাগত দায়িত্ব পালনে অনেক অপ্রীতিকর উপদেশ ও বিধিনিষেধের মধ্যে পড়তে হয়েছে। কিন্তু তার এই সাহসী পথচলা থেমে থাকেনি। তিনি লড়াকু মানসিকতায় এগিয়ে গেছেন দুর্দান্তভাবে।

মহান মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৬৭-৬৮ সময়ে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করার আগে রোকেয়া হল ছাত্রী সংসদের সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন তিনি। নব্বইয়ের দশকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনে জোরালো ভুমিকা রাখেন। নবম জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি এবং লাইব্রেরি কমিটির সদস্য হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেন। সংসদ সদস্য হওয়ার কোনো ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষা তার মধ্যে ছিল না। তিনি সবসময় একজন সাংবাদিক হিসেবে এদেশের রাজনীতিতে, সমাজে যতোখানি সম্ভব কাজ করা যায় তা নিয়েই চিন্তা করতেন। সাংসদ হওয়ার পর গ্রামীণ নারীদের ভালবাসা পেয়ে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন।

বেবী মওদুদ ছিলেন প্রচারবিমুখ, নির্লোভ ও নিরহংকারী মানুষ। স্বামী দৈনিক সংবাদের বার্তা সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. হাসান আলী ১৯৮৫ সালের এপ্রিল মাসে আকস্মিকভাবে প্রয়াত হলে শুরু হয় তার লড়াকু জীবন। দুই সন্তান রবিউল হাসান অভী ও শফিউল হাসান দীপ্ত-কে নিয়ে শুরু করেন কঠিন জীবন যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পাশাপাশি আরো এক যুদ্ধে তিনি লিপ্ত হন, সেটা ছিল ছিল সমাজ, দেশকে বদলে দেয়ার যুদ্ধ। মাথা উঁচু করে বাঁচার চেষ্টা করেছেন তিনি। এক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও ছিলেন অত্যান্ত দৃঢ়চেতা।

সাংবাদিকতা ও লেখালেখি একই সমান্তরালে চলতে থাকে। কিশোরদের জন্য প্রচুর লেখালেখি করেছেন। শিশুসাহিত্যিক হিসেবেই তার খ্যাতি সবচেয়ে বেশি। তিনি লিখেছেন, 'গণতন্ত্রের মানসকন্যা শেখ হাসিনা', 'বাংলাদেশের নারী বাংলাদেশের চলচ্চিত্র', 'বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার', 'নিভৃত যতনে', 'আমার রোকেয়া', 'চিরন্তন প্রতিকৃতি রোকেয়া', 'শেখ মুজিবের ছেলেবেলা', 'মনে মনে' (ছোট গল্প), 'দুঃখ-কষ্ট-ভালোবাসা' (উপন্যাস), 'সষি পুষি টুষি' (ছড়া) ইত্যাদি।

তার শিশুতোষ বই গুলো হল; 'দীপ্তর জন্য ভালোবাসা', 'টুনুর হারিয়ে যাওয়া', 'শান্তর আনন্দ', 'এক যে ছিল আনু', 'মুক্তিযোদ্ধা মাণিক', 'আবু আর বাবু' এবং 'কিশোর সাহিত্য সমগ্র'। এছাড়া জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' সম্পাদনায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

কট্টর বাঙালি ও জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন বেবী মওদুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি করার সময়ে বেশ সখ্য গড়ে উঠে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাথে। অথচ তাদের দুইজনের রাজনীতির ধারা ছিল ভিন্ন। দু'জন দুই ধারার রাজনীতি করলেও তাদের সম্পর্কে কখনও ফাটল ধরেনি বরং সম্পর্ক গভীর হতে থাকে। ১৯৮১ সালের ১৭মে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হয়েই দেশে ফিরেন শেখ হাসিনা। তারপর থেকেই বঙ্গবন্ধু কন্যার সার্বক্ষণের সাথী ছিলেন বেবী মওদুদ। এভাবে একে অপরের প্রতি আন্তরিকতা আরো বৃদ্ধি পায়। শেখ হাসিনার সুখ-দুঃখের সাথী হিসেবে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। তিনি বলেছিলেন, "সারাদিন রাজনীতি করার পর সন্ধ্যায় হাসিনা কারও সঙ্গে গল্প করতে চান, কিন্তু রাতের বেলায় তো কোনো পুরুষ রাজনৈতিক নেতা বা কর্মীর সঙ্গে আড্ডা মারতে পারেন না। এ কারণেই আমি তাকে সঙ্গ দিতাম। কোনো কোনো দিন ভোর পর্যন্ত গল্প চলত।" একারণেই দুই বান্ধবী হয়ে উঠেন একে অপরের বিশ্বস্ত। নানান ঘাত প্রতিঘাত পেড়িয়ে তাদের বন্ধুত্বের যাত্রা অব্যাহত থাকে।

দীর্ঘদিন ধরে দুরারোগ্য ব্যাধি ক্যান্সারে ভোগার পর ২০১৪ সালের ২৫শে জুলাই মাত্র ৬৬ বছর বয়সে পরপারে পাড়ি জমান এদেশের নারী, সাংবাদিক, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করা সকলের প্রিয় সাংসদ, সাংবাদিক, কবি ও লেখক বেবী মওদুদ।

শুভ্রবসনের নির্মোহ বেবী মওদুদ আজকের দিনের ক্ষমতা ও লালসার রাজনীতিতে হতেন বড্ড বেমানান। ক্ষমতার খুব কাছাকাছি থেকেও তিনি কখনো আত্মসম্মান বিসর্জন দেননি। অত্যন্ত সাদাসিদে জীবন-যাপনে অভ্যস্ত বেবী মওদুদ কোন ধরনের সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করেননি। বঙ্গবন্ধু কন্যা, দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রতি তিনি যে গভীর ভালোবাসা ও মমত্ব দেখিয়েছিলেন দৃশ্যত তা যেন রক্তের সম্পর্কের চেয়েও বেশি। প্রয়াণ দিবসে বঙ্গবন্ধু কন্যার এই অকৃত্রিম বন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা।