নানা রঙের রেঙ্গুন

আনিসুর রহমান
Published : 23 July 2019, 02:26 PM
Updated : 23 July 2019, 02:26 PM

বেনিয়া ব্রিটিশদের খপ্পরে পরাধীন নিখিল বঙ্গে একটা কথা প্রচলিত ছিল রঙিলা রেঙ্গুনে বাংলা মায়ের কোন সন্তান একবার গেলে আর স্বদেশে ফেরে না। রেঙ্গুনের মেয়েদের রূপে, মুখে, ঠোঁটে হাসি আর ভাবের এমনই জাদু। তবে বঙ্গসন্তান শরৎচন্দ্র কিন্তু বছর তের রেঙ্গুনে রেলওয়ে বিভাগে কেরানির চাকরি করে স্বদেশে ফিরেছিলেন ঠিকই। যদিও তিনি বিয়ে করেছিলেন রেঙ্গুনেরই এক মেয়েকে। সে ঘটনা তার রচিত গল্প উপন্যাসের মতই নাটকীয়তায় ভরা।

তিনি ১৯১৬ সালে রেঙ্গুন থেকে বাংলায় ফিরে আসেন। তিনি তার রেঙ্গুনজীবনে শহরের উপকণ্ঠে পোজডং অঞ্চলে কারখানার মিস্ত্রিদের তল্লাটে বসবাস করতেন। তার বাসার নিচে শান্তি দেবী নামে এক ব্রাহ্মণ মিস্ত্রির কন্যা বাস করতেন। মেয়েটির পিতা তার সঙ্গে এক মদ্যপের বিয়ে ঠিক করলে শান্তি দেবী শরৎচন্দ্রকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে অনুরোধ করেন। শরৎচন্দ্র মেয়েটিকে বিয়ে করেন। তাদের একটি ছেলে সন্তানও হয়। শান্তিদেবী ও ছেলেটি তার এক বছর বয়সে প্লেগ রোগে মারা যায়। এর অনেক কাল পরে শরৎচন্দ্র ভাগ্যান্বেষী এক ব্যাক্তির অনুরোধে তার চৌদ্দ বছরের কন্যা মোক্ষদাকে বিয়ে করেন। তার নাম পাল্টে রাখেন হিরন্ময়ী দেবী। তারা নিঃসন্তান ছিলেন। শরৎচন্দ্রের উল্লেখযোগ্য লেখাগুলোর মধ্যে রামের সুমতি আর বড়দিদি উপন্যাস রেঙ্গুনে থাকার সময়ে লেখেন। শরৎচন্দ্রের সময়কার সেই রঙ্গিলা রেঙ্গুন পরাধীন ব্রিটিশ ভারতের অংশ ছিল ১৮৮৪ থেকে ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত।

আর ১৯১৬ থেকে ১৯২৬ সাল অবধি ধারণা করা হয় বাঙালির বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রেঙ্গুনে পা রাখেন তিনবার। তার মধ্যে ১৯২৪ সালের সফরটি ছিল নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। সেসব কথা বলবার আগে রেঙ্গুন সম্পর্কে আমার মতো অনেক আমআদমীর মনে কতগুলো সাদামাটা প্রশ্নের উদয় হয়, সেগুলো উল্লেখ করতে চাই:

১। রঙ্গিলা রেঙ্গুনের সেই রঙ কী আজও আছে?
২। রেঙ্গুনের মানুষ বাংলাদেশ সম্পর্কে কী ভাবে? কতটুকু জানে?
৩। আরাকান বা রাখাইন প্রদেশ কিংবা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী নিয়ে তাদের কী ভাবনা?
৪। ব্রিটিশ লেখক জর্জ অরওয়েল (যিনি বার্মায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের পুলিশ কর্মকতা ছিলেন- যিনি ১৯৮৪ সালে বার্মার দিনগুলি (বার্মিজ ডেইজ) নামে বই লিখেছেন। তার সম্পর্কে তাদের আগ্রহ কতটুকু?
৫। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কেই বা তাদের আগ্রহ কতটুকু?
৬। চীনের দানবীর থাকা সম্পর্কে তারা কী ভাবছে?
৭। রাশিয়াকে নিয়েই বা তাদের কী ধারণা?
৮। সর্বোপরি অং সান সুচিকে নিয়েই তারা কী ভাবছে?
৯। মায়ানমারের ভবিষ্যত নিয়ে তাদের কী আশা ভরসা?
১০। জনমনে সেনাবাহিনীর অবস্থান কী?
১১। বার্মা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের ভূমিকা কী?
১২। বেঙ্গুনে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমের কী হালচাল?
১৩। বার্মার অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি কোনদিকে?
১৪। গণতন্ত্র নিয়ে তাদের মোহভঙ্গ কি ঘটেছে?

মনের মাঝে এরকম অনেক প্রশ্ন নিয়ে সুইডিশ আর্টস কাউন্সিলের আর্থিক সহযোগিতায় লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন এর মায়ানমার কেন্দ্রের আমন্ত্রণে, কবিতা, গল্পের ধারণা আর নাটকের সংলাপ গঠন বিষয়ে ধারাবাহিক কয়েকটা বক্তৃতা দেওয়ার উদ্দেশে সপ্তাহখানিকের জন্যে রেঙ্গুনে পৌঁছে রেঙ্গুন শহরের প্রাণকেন্দ্রে চায়না টাউনখ্যাত একটা এলাকায় চায়না টাউন ক্যাফেতে কয়েক তরুণের সঙ্গে বসে আড্ডা দেবার সুযোগ হল।

আয়োজক কর্তৃপক্ষই তারুণ্যের দলটিকে আমার সঙ্গে দিয়েছিলেন রাতের রেঙ্গুন ঘুরিয়ে দেখাবার জন্যে। তরুণদের একজনের নাম সাই অঙ মিন থুন, যিনি সঙ্গীতের শিক্ষক এবং একটি সঙ্গীতদলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি একপর্যায়ে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, মায়ানমার সম্পর্কে আমি কিভাবে জানি?

আমার জবাবটা এরকম- বিদ্যালয়ে পাঠ্য বইয়ে জেনেছি বার্মা আমাদের দক্ষিণ পূর্ব সীমান্তবর্তী দেশ। যাদের সঙ্গে আমাদের তিনটি যৌথ বা আন্তঃসীমান্ত নদী রয়েছে যেমন সাঙ্গু, মাতামুহুরী আর নাফ। আমাদের লেখকরা যেমন রবীন্দ্রনাথ রেঙ্গুন ভ্রমণ করেছেন; শরৎচন্দ্র রেঙ্গুনে থেকেছেন। তারপর পড়েছি জর্জ অরওয়েলের লেখালেখি। ১৯৭১ সালের শুরুর দিকে এবং ১৯৬০ এর দশকে বার্মার নাগরিক উ-থান্ট জাতিসংঘের মহাসচিব থাকাকালে বাংলাদেশের পক্ষে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। ব্রিটিশ ভারতে বঙ্গের সঙ্গে বার্মাও একটা অংশ ছিল, সবশেষে আরাকান রাজসভার সঙ্গে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত লেখক আলাওল যোগসূত্র আর হাল আমলের রোহিঙ্গা সঙ্কটের কথা বলতেই আমি লক্ষ করলাম প্রশ্নকারী তরুণের মুখে কালো ছায়াপাত। কথা আর এগুলো না। এরপর আমিও যথার্থ হয়ে গেলাম কোন বিষয়ে প্রশ্ন করতে বা আলোচনার সূত্রপাত করতে।

এবার ফিরে আসি রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে। ১৯২৪ সালে রেঙ্গুন সফরকালে তৎকালীন নিখিল ভারত-বঙ্গ-বার্মার গভর্নর হারকোর্ট বাটলার রবীন্দ্রনাথের সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছিলেন; বার্মার রাজনৈতিক নেতারা জুবিলি হলে রবীন্দ্রনাথকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন আর বাঙালি সংস্থা  সোনেবাহলে তাঁকে সংবর্ধনা দিয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ ওইসময় রেঙ্গুনের প্রতীক সুইদাগন প্যাগোডা পরিদর্শন করে এর তাৎপর্য আর ভাবগাম্ভীর্যে মুগ্ধ হয়ে বৌদ্ধদের তীর্থস্থানটিকে আনন্দযজ্ঞের প্রতিনিধিত্ব, একাকিত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, নীরব না হলেও শান্তির আরাধ্য বলে উল্লেখ করেন।

রবীন্দ্রনাথের পরিদর্শনের ৯৫ বছর পরে রেঙ্গুন তরুণবেষ্টিত বৌদ্ধদের তীর্থস্থান পরিদর্শন করে আমারও তাই মনে হয়েছে। এই তীর্থস্থানের সামনে হাজির হয়েই নানা নৃগোষ্ঠীর মায়ানমারবাসীর হাজারে হাজারে ভিক্ষু সমবেত হয়ে জেনারেলদের কাঁপন ধরিয়েছিল বছর কয়েক আগে। ফলে সুচি মুক্তি পেলেন দেশটাও গণতন্ত্রের ছিটেফোঁটা পেয়েছিল। নির্বাচন হল। শেষতক সুচি ১৫ সনে বার্মার সরকার প্রধান হলেন। কার্যত ক্ষমতা জেনারেলদের হাতেই রয়ে গেল। দেশটির মানুষ দুধের সাধ ঘোলে মেটালো।

রেঙ্গুনে আমার লেখক সহকর্মী বন্ধু আর সাধারণ মানুষের সঙ্গে আলাপ করে আর টুকিটাকি প্রশ্ন করে জেনে গেলাম সুচি ছিল তাদের শেষ ভরসার জায়গা, শেষ আশা আর স্বপ্ন। সেই সুচি তাদের নিরাশ করেছেন। সুচির সামনে সুযোগ এসেছিল। শুরুতেই তিনি যদি সাহস করে অবধারিত প্রয়োজনীয় সংস্কারের উদ্যোগ নিতেন, তাহলে কাজের কাজ করতেন। তিনি তা না করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আফসরফায় অভ্যন্তরীণ শক্তিরক্ষায় মনোযোগী হলেন। প্রকারান্তরে জেনারেলদের ভয় কেটে গেল। তারা নিজেদের ক্ষমতার গুটি হাতছাড়া হবার সঙ্কট উৎরে ওঠেন। এর মাধ্যমে সুচি নানা নৃগোষ্ঠীর মানুষের স্বপ্ন ভঙ্গ করে ক্ষমতাহীন একটা পুতুল সরকার প্রধানে পরিণত হয়েছেন। অবস্থা এরকম সুচিই শেষ। ২০২২ সালের নির্ধারিত নির্বাচন নিয়েই শঙ্কা দেখা দিতে পারে। আর ওই নির্বাচনে সুচির দল ভাল করবে সে নিশ্চয়তা নাই। সেনাসমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি ডেভেলপমেন্ট পার্টি (সংক্ষেপে ইউএসডিপি) ভাল করে বসতে পারে।

নিরাপত্তা পরিষদে জেনারেলদের বিরুদ্ধে প্রস্তাব ওঠায় মায়ানমারের মানুষ আশা করেছিল এবার বুঝি একটা সুযোগ এসে গেল জেনারেলদের শায়েস্তা করার। কিন্তু চীন আর রাশিয়ার ভেটো ক্ষমতা প্রয়োগের কারণে সে আশায় গুড়ে বালি। কিন্তু চীন আর রাশিয়ার স্বার্থ কী এখানে? তাদের কথায় মায়ানমারের বেসামরিক অর্থনীতির হালহকিকত চীনের নিয়ন্ত্রণে। তাদের বিশাল বিনিয়োগ রাখাইন রাজ্যে; প্রাকৃতিক সম্পদ উত্তোলন। এখানে ভারতও ভাগ বসিয়েছিল। কিন্তু পেরে উঠেনি, তাদের স্থাপনা চীনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আর সামরিক কেনাকাটার প্রায় পুরোটাই রাশিয়ার কব্জায়। দুই শক্তিধর দেশই স্বার্থের দুইটা দিক কড়ায়গন্ডায় বুঝে নিয়ে গদগদ। আর এজন্যে বেসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের চেয়ে জেনারেলরাই সুবিধের; দর কষাকষি লাগে না। জেনারেলরা চীন আর রাশিয়ার স্বার্থ দেখছে। আর চীন-রাশিয়া জেনারেলদের রফা করছে।

আমার প্রশ্ন ছিল- তাহলে রোহিঙ্গা সমস্যার কি কোনই সমাধান নাই? তাদের সাফ উত্তর- সেরকম অলৌকিক কোনও সমাধান তারা দেখছেন না। শুধু রোহিঙ্গা কেন গোটা দেশটাই জেনারেলদের খপ্পরে। এক একটা দীর্ঘমেয়াদী স্থায়ী রূপকল্পও রয়েছে। যেমন- প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় কেবল মূলধারার মায়ানমারের বৌদ্ধরাই ভর্তি হতে পারে। অন্য ধর্মের বা অন্য নৃগোষ্ঠীর কেউ এখানে ভর্তি হতে পারবে না। কাগজে কলমে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকলেও আত্মসংবরণের মাত্রা ব্যাপক। লাখ লাখ তরুণ বেকার। অনেকের জীবন শ্রমদাসের মত। নিম্ন মজুরি, কায়িকশ্রমের কাজ কিংবা বঙ্গসন্তানের মত বিদেশে পাড়ি জমিয়ে মজুরগিরি।

তবুও এক কালের রঙিলা বার্মার মানুষের জীবনে রঙ অনুপস্থিত নয়। গোটা শহর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জনপদ। ছিনতাই রাহাজানি নাই। নাই কোনও ঠগবাজ। খাদ্যে ভেজাল, অফিস আদালতে ঘুষের লেনদেন নেই। তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে প্রকাশ্যে কোনও অতি উৎসাহী মোক্তার, সংসদ সদস্য বা পুলিশ কর্মকর্তা বাধা দিতে ছুটে আসেন না।

এই শহরে আছে মুসলমান, আছে মসজিদ, আছে গির্জা, আছে খ্রিস্টান, আছে শতশত নৃগোষ্ঠী আর গোত্রের মানুষ। কেউ কারো বাড়া ভাতে ছাই দেয় না। নাই তেমন সামাজিক অপরাধ। যে যার সাধ্যমত টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত। কেউ এখানে হাত পাতে না- না ভিক্ষা করতে, না ঘুষ পেতে। সারা রেঙ্গুন শহরে কোথাও কোন ভিক্ষুক নাই। এখানে ধনী ও গরীবের ব্যবধান আছে। তবে তা দৃশ্যত অতটা কুৎসিত নয় যতটা জঘন্য আর কুৎসিত আমাদের ঢাকা শহরে। এখানে মদ বিয়ার বিক্রিতে কড়াকড়ি নাই। তাই বলে সারারাতের রেঙ্গুনে পথে পথে মাতাল নাই বা মাতলামি করে সংসদ সদস্য বা জেনারেলদের পুত্রদের গাড়িচাপা দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার উদাহরণ নাই।

সেই রেঙ্গুনে জর্জ অরওয়েলের বার্মা বিষয়ক বইগুলো ইংরেজি আর বার্মিজ ভাষায় থরে থরে সাজানো। তারা শরৎচন্দ্রের নামও জানে না। যদিও রবীন্দ্রনাথ দারুণ জনপ্রিয়। তার বই বার্মিজ ভাষায় অনুদিত ও সমাদৃত। কথা প্রসঙ্গে আমার এক বন্ধু বার্মিজ লেখক আর সম্পাদক জানালেন- বাঙালি লেখকদের বার্মা বিষয়ক যাবতীয় সাহিত্য তারা বার্মিজ ভাষায় অনুবাদ করার উদ্যোগ নিবেন।

রেঙ্গুনের মানুষ আজকের ঢাকা বা আজকের বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। সে সুযোগও নাই। অথচ জীবনযাত্রা, জলবায়ু আর সংস্কৃতির অনেক কিছুতেই আমরা কত কাছাকাছি। ঘা ঘেঁষে থেকেও আমরা কত দূরের। আর চীন এবং রাশিয়া কত দূরের হয়েও এত কাছের। রাজনীতি আর কূটনীতিকে তাদের নিজনিজ জায়গায় রেখেও পর্যটন বাণিজ্য, আর সংস্কৃতিতে দুটি দেশ কাছে আসার অবারিত সহজ এক সুযোগ কাজে লাগানোর কোন উদ্যোগ কী কোন দিক থেকে আছে? সেরকম উদ্যোগ নিতে দৃশ্যত আর অদৃশ্য বাধাগুলো কি দূর করা যায় না? তাতে লাল-লাল-নীল-নীল বাতির নয়ন জুড়ানো ঢাকার সঙ্গে রঙিলা রেঙ্গুনের জীবন, ভাব আর রঙের লেনদেন হলে মন্দ কি?