মুক্তমত বাধাগ্রস্ত প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সর্বত্র

এম এম খালেকুজ্জামানএম এম খালেকুজ্জামান
Published : 22 July 2019, 02:03 PM
Updated : 22 July 2019, 02:03 PM

মাধরুভাগান (অন্যঅংশ নারী) উপন্যাস- এর রচয়িতা তামিল লেখক পেরুমল মুরুগন। সন্তানহীন দম্পতিদের সন্তান কামনার আশাপূরণে অপরিচিত পুরুষের সাথে সম্মতির ভিত্তিতে যৌন সংসর্গের যে আবহমানের লোকাচার স্থানীয় ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত, তার প্রেক্ষিতে এক সন্তানহীনা নারীর চিরন্তন দ্বিধা ও দোলাচলের সংবেদনশীল চিত্রায়ণ করেছিলেন লেখক পেরুমল মুরুগন মাধরুভাগান উপন্যাসে।

তামিলনাড়ুর নামাক্কাল জেলার তিরুচেঙ্গোদে শিবের অর্ধনারীশ্বর মূর্তির পূজা উপলক্ষে এই যৌন সংসর্গের আয়োজন। জেলার অনগ্রসর জাত কোঙগু ভেল্লালা-র গোত্র প্রধানদের অপছন্দ হওয়ায় ক'বছর আগে প্রকাশিত তার উপন্যাস মাধরুভাগান-এ বর্ণিত এই আখ্যানের কারণে তাকে চরম হয়রানি-হেনস্থা করা হচ্ছিল। 'আপত্তিকর' অংশটি উপন্যাস থেকে বাদ দেওয়া, ভবিষ্যতে বিতর্কিত কিছু না লেখার মুচলেকা সই করেও তার রেহাই মেলে নাই। তার উপন্যাস পোড়ানো হয়, নামাক্কাল শহরে হরতালও পালিত হয়। জেলা-প্রশাসনও গোলযোগকারীদের পরিবর্তে লেখককেই আপস করতে চাপ দেয়। মুরুগন তার এ যাবত প্রকাশিত যাবতীয় লেখালেখি 'প্র্রত্যাহার' করেন, প্রকাশকদেরও তা বিক্রি করতে মানা করেন। অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদিদের ধারাবাহিক আক্রমণ ও অপমানে এক সংবেদনশীল তামিল লেখক অভিমানে নিজের 'মৃত্যু' ঘোষণা করলেন এভাবেই। এই 'মৃত্যু' লেখক হিসাবে নিজের আত্মহননের ঘোষণা।

স্থানীয় সমাজপতিদের ধারণা, পেরুমল মুরুগন তার উপন্যাসে এই গোপন লোকাচারের কথা প্রকাশ করে অনগ্রসর জাতের সমাজকে অসম্মান করেছেন। এর প্রায়শ্চিত্ত হিসাবেই তাকে বিতর্কিত অংশ বাদ দিতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, এই অনাসৃষ্টির সাথে বিজেপি কিংবা আরএসএসের প্রাদেশিক নেতৃত্ব কোনও ভাবে নিজেদের না জড়ালেও, স্থানীয় সংগঠনগুলি প্রত্যক্ষভাবে সক্রিয় থেকেছে। অধুনা এই জাত-গর্বী অসহিষ্ণুরাই ক্রমে শক্তিশালী হয়ে চোখ রাঙ্গাচ্ছে। এই ঘোষণা শোনা যাচ্ছে যে, হিন্দু ভাবাবেগে আঘাতকারী কোন লেখক তামিলনাড়ুতে ঠাঁই পাবে না।

পাশ্চাত্যে যখন ব্যঙ্গপত্রিকা 'শার্লি এবদো'-র উপর অসহিষ্ণু ধর্মোন্মাদদের নৃশংস হত্যালীলার বিরুদ্ধে ধিক্কারে বিশ্বের কোটি-কোটি মানুষ ঐক্যবদ্ধ, তখনই পাশ্চাত্যের তুলনায় পশ্চাত বলে ভারতের তামিলনাড়ুর নামাক্কাল জেলায় অসহিষ্ণু হিন্দুত্ববাদীদের ধারাবাহিক আক্রমণ ও অপমানে এক সংবেদনশীল তামিল লেখকের 'মৃত্যু' ঘোষণা তেমন অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারেনি।

কিন্তু মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি অসহিষ্ণুতা এবং অপছন্দের মতকে চাপা দেয়া কিংবা তার পোষণকারীদের দমন করার স্বৈরতান্ত্রিক প্রবণতা কেবল যে শাসক শ্রেণিরই একচেটিয়া, এমন নয় বরং যে-কোনও সঙ্ঘবদ্ধ গোষ্ঠী এখনো সামাজিক স্তরে এই ধরনের হিংসাত্মক দাপট দেখিয়ে চলেছে।

ডেনিশ পত্রিকা জিল্যান্ডস-পোস্টেনে মহানবী (সা:)-এর কার্টুন ২০০৫ সালে প্রথম যখন প্রকাশিত হয়, তখন বিশ্বের নানা প্রান্তে, বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোয়, প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ৫০ জনের মতো মানুষের প্রাণহানি ঘটে বিভিন্ন দেশে।

শার্লি এবদোকে সেই একই পথের অনুসারী আখ্যায়িত করা অতিরঞ্জন মনে হবে না কারণ তারা বছরের পর বছর ধরে ইসলাম ধর্ম, ইসলামের মহানবী (সা.) এবং ধর্মীয় আচরণ নিয়ে অশ্লীলতাপূর্ণ কার্টুন ছেপে ফ্রান্সের সংখ্যালঘু মুসলমানের মনে আঘাত দিয়ে আসছে। নিজেদের ধর্মের নানা আচার উপাচার নিয়েও তারা বিভিন্ন সময় কার্টুন ছেপেছে শার্লি এবদো ।প্যারিসে ব্যঙ্গ পত্রিকা শার্লি এবদোর দপ্তরে দুই জঙ্গিবাদী ইসলামপন্থীর হামলায় ১০ জন কার্টুনিস্ট সাংবাদিক এবং পুলিশের দুই সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনা সারাবিশ্বকে স্তম্ভিত করে দিয়েছিল ।

পত্রিকা যাই লিখুক আর প্রচার করুক তা আপনার-আমার যত অপছন্দেরই হোক না কেন, সেটাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য ভয়ংকর সব আগ্নেয়াস্ত্রে সজ্জিত হয়ে এর দপ্তরে হানা দিয়ে হত্যাকাণ্ড চালানো কোনো মানদণ্ডেই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দায় ফরাসি ভাষার ঘোষণা 'জে সুই শার্লি' আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে 'আমি শার্লি ' উচ্চারণ করে প্রটেস্ট র‌্যালি নিয়ে পথে নেমেছিল বিশ্ববিবেক প্যারিস থেকে ফ্লোরেন্স, কোলন থেকে ব্রাসেলস।

দেশে দেশে জনগণের এমন স্বতঃস্ফূর্ত সহমর্মিতা যে বার্তা পৌঁছায় তা হলো, আমরা সবাই শার্লি এবদোর পক্ষে। যদিও সাপ্তাহিক সেই পত্রিকা কার্টুন স্যাটায়ারের আড়ালে সমাজের বিভক্তি ও অসঙ্গতি তুলে আনার সাথে সাথে মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে ইচ্ছাকৃতভাবে খোঁচা দেওয়ার যে চর্চা তা সমর্থন করছি এমন সরলীকরণ হলে বিপদের কথা।

কারণ মত প্রকাশের স্বাধীনতারও একটা সীমা থাকা উচিত, এমনটা মনে করেন পোপ ফ্রান্সিসও। শার্লি এবদো হত্যাকাণ্ডের দিন কয়েক পর শ্রীলঙ্কা থেকে ফিলিপিন্স সফরে যাওয়ার পথে ক্যাথলিক মিরর, রয়টার্সকে সাক্ষাৎকার দেন পোপ। শার্লি এবদো নিয়ে প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, 'মত প্রকাশের স্বাধীনতার মানে কারো ভাবাবেগকে আঘাত করা বা কারো ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করার স্বাধীনতা নয়।'

পোপের পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন আলবার্তো গ্যাসপারি। পোপের নানা সফর আয়োজন করেন তিনিই। তাকে দেখিয়ে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, 'এই যে আমার বন্ধু গ্যাসপারি। যদি উনি আমার মায়ের নামে কোনো খারাপ কথা বলেন, তা হলে একটা ঘুষি অবশ্যই ওনার প্রাপ্য। সেটা স্বাভাবিক নয় কী!' তার কথায়, 'কাউকে খুঁচিয়ে তোলা উচিত নয়। অন্যদের বিশ্বাসকে অপমান করার অধিকার কারো নেই। কারো ভাবাবেগ নিয়ে মশকরা করা যায় না।'

যদিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তিনি স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, ঈশ্বরের নামে খুনোখুনির পক্ষপাতী তিনি নন। পোপের কথায়, 'ঈশ্বরের নাম করে কাউকে আঘাত করা, যুদ্ধ করা বা খুনোখুনি কখনোই সমর্থন করা যায় না। এটা প্রত্যেক ধার্মিকই জানে।'

সাধারণ ধার্মিক মুসলিমরাও যে জঙ্গিদের বিরোধী তা স্মরণ রাখতে বলেন পোপ। তিনি বলেন, 'এ ধরনের উস্কানির ফলে মর্মাহত হয়ে ধার্মিক ব্যক্তি জঙ্গিবাদের সমথর্কে পরিণত হতে পারে।' প্রসঙ্গত, পোপ ফ্রান্সিসকে নিয়েও বেশ কিছু ব্যঙ্গচিত্র ছাপা হয়েছে শার্লিতে। কিন্তু তা নিয়ে তিনি কখনো কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাননি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'দেখুন, কেউ আমাকে নিয়ে ব্যঙ্গ করলে ক্ষমা করার অধিকার আমার আমার আছে। কিন্তু যিশুখ্রিস্টকে নিয়ে ব্যঙ্গ করলে কোটি কোটি খ্রিস্টান একইভাবে মর্মাহত হবে।'

লেখক চান কোনো বাধা ছাড়াই তার নিজস্ব উপলব্ধির কথা তিনি বলবেন, তবে তাকে সচেতন থাকতে হবে যে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার সঙ্গে দায়িত্ববোধের শর্তও জড়িত। স্বাধীনতা তত দূর পর্যন্ত বিস্তৃত, যত দূর পর্যন্ত প্রসারিত হলে তা অন্যের অধিকার ক্ষুণ্ণ করবে না। চিন্তার ও মতের ভিন্নতা তিনি সহ্য না করে প্রতিপক্ষের অবস্থানকে তিনি উপহাস ও কটূক্তিমূলক আক্রমণে জর্জরিত করবেন-এমনটি অনভিপ্রেত। কারণ এমন অবিবেচনা প্রসূত স্বাধীনতা চর্চার পরিণাম হবে চিন্তা ও মত প্রকাশের জন্য অরাজকতা সৃষ্টির অন্যরূপ।

কোনো ব্যক্তি বা ধর্মীয় গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সহিংসতার উসকানি বা ঘৃণা-বিদ্বেষ ছড়ানো সাংবাদিকতার নীতিবিরুদ্ধ বলেই বিবেচনা করা হয়।যে ধরনের সংবাদ বা পরিবেশনা নিরীহ মানুষের জীবনহানির কারণ ঘটাতে পারে, তা প্রকাশ করা দায়িত্বশীলতার পরিচয় বহন করে না।বিবেক ও অরাজকতার চর্চা পাশাপাশি চলতে পারে না। স্বাধীনতা মানেই দায়িত্ব সচেতনতা- এটা সব সংবাদপত্রেরই মৌল নীতি।

ইউরোপীয় অধিকাংশ দেশেই সম্প্রতি একটি আইন পাস করা হয়েছে- যার ভাব হচ্ছে, খ্রিস্টধর্ম বা সার্বজনীন কোনো প্রতীককে বিতর্ক-সমালোচনার লক্ষ্যে পরিণত করে কোনো লেখক, রচয়িতা কোন কিছু প্রকাশ করতে পারবে না,যদি করেন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কঠোর শাস্তি বরণ করতে হবে।

মত প্রকাশে পাশ্চাত্য যে স্বাধীনতা ভোগ ও প্রয়োগ করছে তাতে মুসলিমদের কোন আপত্তি নাই। আপত্তি তখনই যখন তথাকথিত বাকস্বাধীনতার নামে ইসলাম বিদ্বেষের অবাধ চর্চা করা হয়। এই প্রবণতা দেখে নোয়াম চমস্কি বলেছিলেন- ব্যঙ্গচিত্র ও বিদ্রুপাত্মক রচনায় পাশ্চাত্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে জাতিবিদ্বেষী ও বর্ণবিদ্বেষী মনোভাব বরাবর প্রচ্ছন্নভাবে প্রকাশ করে আনন্দ পায়। কিন্তু ইসরাইল ও ইহুদী নিয়ে এই ধরনের ব্যঙ্গাত্মক রচনার বিনিময়ে পশ্চিমা কার্টুনিস্টরা পাশ্চাত্য জনগণের বা নেতৃত্বের আক্রমণ থেকে রেহাই পান না। ইসরাইলি ও ইহুদিদের সঙ্গত সমালোচনা করার অপরাধে লেখক ও প্রকাশকেরা পাশ্চাত্যে কতখানি বিপাকে পড়তে পারেন তার এক নজিরের সাথে খোদ শার্লি এবদোর নামও জড়িয়ে আছে।

ওই পত্রিকায় কথিত ইহুদি ধর্মকে অবমাননার জন্য ক্ষমা না চাওয়ায় মরিস সান নামের এক প্রবীণ কার্টুনিস্টকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। ইহুদি ধর্মের প্রতি নূন্যতম ব্যঙ্গ বা সমালোচনা যদি গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে মুসলমানদের ধর্ম বিশ্বাসকে আঘাত করে নবীদের নিয়ে বিদ্রুপাত্মক কাজ গ্রহণীয় হওয়ার প্রশ্নই উঠে না।

আপাত এক মেরু বিশ্বে পশ্চিমের শত্রুুর জায়গা নিয়েছে অথবা শত্রুুর জায়গায় বসানো হয়েছে ইসলামকে। একদা ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসলামকে হনন করতে আয়োজনের শেষ নাই। কখনো সামরিক কখনো মানসিক বা বুদ্ধিবৃত্তিক অস্ত্র দিয়ে। যদিও হনন নয় বরং সকলের সহবস্থানই নিশ্চিত করবে শান্তি ।