প্রিয়া সাহার শাস্তি চাই

Published : 21 July 2019, 01:42 PM
Updated : 21 July 2019, 01:42 PM

সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখার সুযোগ এসেছিল। সেখানে ছিলেন ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলংকা অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো থেকে আসা অংশগ্রহণকারিরা। আরও ছিলেন আফ্রিকা ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি দেশের মানুষ। সেখানে আমার বক্তব্যে যখন বলি, বাংলাদেশের 'ধর্ম যার যার উৎসব সকলের' এই স্লোগানটির কথা তখন শ্রোতারা অবাক হয়ে শোনেন। যখন আমি পয়লা বৈশাখের মতো অসাম্প্রদায়িক জাতীয় উত্সবের পরিচয় তুলে ধরি তখন সকলে মুগ্ধ হন। যখন বলি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, আমাদের রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল ইসলামের কথা, যখন বলি লালন শাহের মানব ধর্মের কথা, বাঙালির হাজার বছরের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির কথা তখন শ্রোতারা মুগ্ধ হন। আমার বক্তব্যের পর একজন ভারতীয় এবং একজন পাকিস্তানি বক্তা তার বক্তব্যে আমার কথার সূত্র তুলে ধরে বলেন, এশিয়ার দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ এক অনন্য সুন্দর উদাহরণ। বুকটা গর্বে ভরে যায় তখন।

আমরা যারা প্রবাসে আছি, যারা অর্থ উপার্জন করে দেশে পাঠাচ্ছি তারা চাতক পাখির মতো বাংলার মাটি, বাংলার জলের জন্য, দেশের একটু স্পর্শ পাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করি। আমরা এখানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে নেই। আমরা এখানে কেউ শ্রমিক, কেউ ছাত্র, কেউ শিক্ষক, কেউ প্রকৌশলী, চিকিৎসক বা অন্যান্য পেশায় আছি। আমরা এদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাই না। আমরা আমাদের সবুজ রঙের পাসপোর্টটিকে ভালোবাসি।

হ্যা, দেশে অনেক রকম সমস্যা আছে। আমাদের মধ্যে ধনী-গরীবের ব্যাপক বৈষম্য আছে। আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রবল। আমাদের দেশে শিশুরা ধর্ষণের শিকার হয় (সেটা হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষেই হয়)। আমাদের ভিটামাটি থেকে ক্ষমতাশালী ধনীরা উচ্ছেদ করে। দরিদ্র হিন্দু যেমন ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হয়, তেমনি দরিদ্র মুসলিমও হয়। উপেনদের কি কোন জাত আছে? ধনী যেমন শোষক, দরিদ্র তেমনি নিপীড়িত। এখানে ধর্মের প্রশ্ন অবান্তর। পূর্ণিমা যেমন সহিংসতার শিকার হয়েছে তেমনি সুবর্ণচরের মুসলিম গৃহবধূও কি সহিংসতার শিকার হননি? আমাদের পাহাড়ের জনগোষ্ঠি, সমতলের দলিত ও সাঁওতাল সম্প্রদায়ও অনেক সময়ই নিপীড়ণের শিকার হচ্ছেন যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এসবই জানি এবং মানি। কিন্তু তারপরও নিকট ও দূর প্রতিবেশী অন্য অনেক দেশের সঙ্গে তুলনাতেই বাংলাদেশ যে অনেক ভালো আছে, এগিয়ে যাচ্ছে একথা কি কেউ অস্বীকার করতে পারি?

এবার আসি প্রিয়া সাহা প্রসঙ্গে। তিনি ধানমণ্ডির মতো একটি অভিজাত এলাকায় থাকেন। নিজে একটি এনজিও চালান। তার স্বামী দুদকের পদস্থ কর্মকর্তা। তার দুই সন্তান আমেরিকায় লেখাপড়া করছে। যদি প্রশ্ন করি- তার সন্তানদের বিদেশে পড়ানোর মতো টাকা তিনি পেলেন কোথায়? এই দরিদ্র জন্মভূমি কি তাকে কম দিয়েছিল? শুনলাম তার গ্রামের বাড়িঘর আগুনে পোড়ানো হয়েছিল। সেটা কি তিনি হিন্দু হওয়ার কারণে নাকি অন্য কোন ব্যক্তিগত শত্রুতায়? ঢাকায় আমার নিজের পিতা পিতামহের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত বাড়িও তো (আমি মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও) পাঁচ বছর ধরে দখল বুঝে পাচ্ছি না, কিন্তু সেটা কি বাংলাদেশের দোষ? এসব সমস্যার তো আইনি সমাধান আছে। নাকি?

প্রিয়া সাহা তার দুই কন্যাকে যুক্তরাষ্ট্রে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য অথবা অন্য কোন ব্যক্তিগত সুবিধা পাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের কাছে নিজের জন্মভূমির বিরুদ্ধে এমন কাঁদুনি গেয়ে নালিশ করলেন কেন তা তিনিই জানেন। তিনি ৩ কোটি ৭০ লাখ সংখ্যালঘু নিখোঁজ বা গুম (ডিসঅ্যাপেয়ার্ড এর বাংলা করলে এটাই দাঁড়ায়) হয়েছে বলে নালিশ করলেন। এও বললেন 'আমাদের রক্ষা করুন, সাহায্য করুন'। ৩ কোটি ৭০ লাখ কি মুখের কথা? বাংলাদেশে ৩ কোটি ৭০ লাখ জনগোষ্ঠিকে কোথায় গুম করা হয়েছে? কবে গুম করা হয়েছে? কারা গুম করেছে? ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যাও তো ত্রিশ লাখ। যুদ্ধের সময়ও তো বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লাখ মানুষ দেশ ছাড়েনি বা গুমও হয়নি। এরকম একটি ভয়াবহ মিথ্যা কথা তিনি কার প্ররোচনা, কোন ষড়যন্ত্রের অংশ হিসাবে বললেন? তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা তো বটেই তাকে জিজ্ঞাসাবাদও করা দরকার বৈকি। এদেশে বিদেশি শক্তিকে ডেকে এনে কার লাভ হবে?

প্রিয়া সাহার এই ঘটনা আমাকে অতীতের উমি চাঁদ, মীর জাফরদের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। নবাব সিরাউদ্দৌলার শাসন ব্যবস্থায় প্রচুর ত্রুটি ছিল সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ডেকে এনে মির জাফর দেশকে পরাধীনতার ফাঁদে ফেলে দিয়ে চিরদিনের জন্য ঘৃণিত হয়েছেন। প্রিয়া সাহারা নব্য মীর জাফর কিনা তা খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

প্রিয়া সাহা 'হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদে'র সাংগঠনিক সম্পাদক। এই সংগঠনটির নামকরণে আমার ব্যক্তিগত আপত্তি রয়েছে। এই সংগঠনটি শুধু হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের কেন? এটা তো হওয়া উচিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পরিষদ। যেখানে মুসলিমসহ সকল অসাম্প্রদায়িক চেতনার মানুষ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ ও সমাজ গঠনের জন্য কাজ করতে পারেন। তিনি সংগঠনের পক্ষ হয়ে ওই সম্মেলনে যাননি। নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে গেছেন ও নিজের ব্যক্তিগত মত বলেছেন। বুঝলাম, কিন্তু ওই সংগঠন থেকে তাকে বহিষ্কার করা প্রয়োজন নয় কি? নইলে কিন্তু ওই সংগঠনটি তাদের দায় এড়াতে পারবে না।

শুধু প্রিয়া সাহা নারী বা হিন্দু সম্প্রদায়ের বলে তাকে ফেইসবুকে অনেকে গালাগাল করছেন। এটা কিন্তু ঠিক নয়। তিনি প্রিয় সাহা, প্রিয় ইসলাম হলেও আমি তাকে নিন্দাবাদ জানাতাম।

বাংলাদেশ শত বাধা বিপত্তি সত্ত্বেও কিন্তু এগিয়ে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে আমরা আগের তুলনায় অনেক স্থিতিশীল। নারীর ক্ষমতায়নও কিন্তু হচ্ছে। আমাদের অনেক সমস্যা রয়েছে। কিন্তু তাই বলে বিদেশের মাটিতে বিদেশি রাষ্ট্রপতির কাছে নিজের দেশের বিরুদ্ধে নালিশ করার মতো ধৃষ্টতা ও বেইমানি প্রিয়া সাহা কিভাবে করলেন?

কেবল রাজনৈতিক আশ্রয় লাভ ও কিছু ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা পাওয়া, উন্নত দেশে আরাম আয়েশে থাকার লোভে বাংলাদেশের অনেক নাগরিক ও কুবুদ্ধিজীবী এই কাজটি করে চলেছেন। এমনকি ব্লগার হত্যার সেই সময়টাতে এমন অনেক তরুণ ও মধ্য বয়স্ক দেশ ছেড়ে বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়েছেন যারা জীবনে কখনও এক কলম লেখেননি বা ব্লগের ধারে কাছেও ছিলেন না। ফেইসবুকে দুচারটি গরম স্ট্যাটাস দিয়েও অনেকে বিদেশে আশ্রয় প্রশ্রয় পেয়েছেন যাদের জীবনের কোন ঝুঁকিই এদেশে ছিল না। এরা ক্রমাগত বিদেশের কাছে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছেন। এদের মধ্যে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জামাতি, আওয়ামী, বিএনপি সবদলের বা কোন দলের নয় এমন অনেকেই আছেন। বাংলাদেশকে একটি মৌলবাদী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করার বহু চেষ্টা বিদেশি শক্তিরা করেছে। কোন ছুতায় এদেশে নাক গলাতে পারলে তারা সুবিধা লাভ করতে পারে।

প্রিয়া সাহার মতো বেইমান, মীর জাফররা বিদেশি শক্তির হাতে আরও অযুহাত তুলে দেয়। এদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে সচেতন হতে হবে। এদের বিচার করতে হবে। তবে ফেইসবুকে এদের ধর্ম ও লিঙ্গ পরিচয় তুলে গালাগাল করলে কিন্তু এদের অসত্য কথারই সত্যতা প্রমাণ হতে থাকে। তাই দয়া করে এ কাজটি না করে ব্যক্তি প্রিয়া সাহার সমালোচনা করুন, নারী বা কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের পরিচয় তুলে সমালোচনা অশালীন বাক্য ব্যবহার করবেন না।

সকল জাতি সম্প্রদায় নির্বিশেষে বাংলাদেশ আমাদের অতি প্রিয় দেশ। আমাদের মহান জন্মভূমি। এদেশকে এগিয়ে নিতে হলে সকল ভেদাভেদ ভুলে মীরমদন মোহনলালদের একত্রে কাজ করতে হবে।

প্রবাসে কঠোর খাটুনির মধ্যে বাংলাদেশ নামটিই আমাদের কানে সুধাবর্ষণ করে। বাংলাদেশের  সবুজ রঙের পাসপোর্টটির দিকে তাকালে শস্য শ্যামলা বাংলাদেশের জন্য, সোনার বাংলার জন্য মন উদাস হয়ে যায়। ইচ্ছা করে একছুটে মায়ের কোলে চলে যাই। দেশে ফেলে আসা প্রিয়জনদের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা, উপহার যখন পাঠাই তখন নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে আসে।

বাংলাদেশের যত কিছু সমস্যা আছে, এমনকি সরকারের বিরুদ্ধেও যত কিছু বলার আছে তা দেশের ভিতরেই সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। আমাদের আইন আদালত প্রশাসন এসব সমস্যার সমাধান করার জন্য যথেষ্ট। প্রিয়া সাহার যদি কোন নালিশ থাকতো তাহলে তিনি সেটা সর্বোচ্চ পর্যায়ে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানাতে পারতেন। কিন্তু '৩ কোটি ৭০ লাখ গুম' এমন উদ্ভট, বানোয়াট, ভয়াবহ মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং বিদেশি প্রেসিডেন্টের কাছে ভিক্ষুকের মতো ভাবভঙ্গিতে তাকে এদেশে সাহায্য করতে বলে তিনি  বাংলাদেশকে ছোট করেছেন, প্রবাসীদের অপমান করেছেন, দেশের সকল নাগরিককে বেইজ্জত করেছেন। আমি তার কঠোর শাস্তি দাবি করি। একজন দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে আমি এ দাবি জানাই। স্বর্গাদপি গরিয়সী আমার প্রিয় মাতৃভূমির এই অপমান আমি এবং আমার মতো অসংখ্য দেশপ্রেমিক সহ্য করতে রাজি নয়। মাতা, মাতৃভাষা ও মাতৃভূমি প্রত্যেক মানুষের পরম শ্রদ্ধার বস্তু। এই তিনের প্রতি যার ভালোবাসা নেই, শ্রদ্ধা নেই সে মানুষ নামের অযোগ্য।