আমরা কি প্রিয়া সাহার প্রতি সুবিচার করছি?

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 22 Dec 2011, 03:58 PM
Updated : 21 July 2019, 01:25 PM

আচ্ছা, কোনো ইস্যুতে ক্ষমতাবান কারো কাছে নালিশ করা কি অপরাধ? নিজ দেশে 'প্রতিকার' না পেয়ে বিদেশিদের কাছে 'নালিশ' জানানোটা তো আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। এরশাদের শাসনামলে আওয়ামী লীগ-বিএনপি, বিএনপির শfসনামলে আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি কি বিদেশিদের কাছে সরকারের বিরুদ্ধে নালিশ জানায়নি? বিএনপি কি এখনও তা করছে না? কিন্তু সেসব ঘটনা যদি 'অপরাধ' না হয়, তাহলে প্রিয়া সাহার অভিযোগটাকে এত বড় করে দেখা হচ্ছে কেন?

এর আগে আমরা দেখেছি, আওয়ামী-লীগ-বিএনপি বিভিন্ন দেশের অনেক ছোট-খাটো কর্মকর্তার কাছেও নালিশ জানিয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। সেসব কর্মকর্তার হয়তো তেমন কোনো ক্ষমতাই ছিল না। লজ্জাশরমের মাথা খেয়ে তবু নালিশ করা হয়েছে।

সেই মার্কিন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রিয়া সাহার অভিযোগ দাখিল মোটেও নতুন কিছু নয়। আর ওই অনুষ্ঠানটিই ছিল অভিযোগ বা নালিশ জানানোর। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মীয় নেতা ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে তার অফিসে কথা বলেছেন। এর আয়োজক আমেরিকান সরকার। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন দেশের ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুরা তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। সেখানে চীনের একজন মুসলিম সংখ্যালঘু চীনের মুসলমানদের অবস্থার কথা বলেছেন। প্রিয়া সাহা বলেছেন হিন্দু সংখ্যালঘুদের কথা। হ্যাঁ, তার বক্তব্যে হয়তো পরিসংখ্যানগত ভুল ছিল। কিন্তু এদেশে সংখ্যালঘুরা এক ধরনের সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের শিকার, অনেক ক্ষেত্রে কেবল ধর্মপরিচয়ের কারণেই নির্যাতিত, নিরবে অনেকেই দেশ ত্যাগ করছে, দেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী ক্রমহ্রাসমান- এসব কি মিথ্যে?

আবেগের আতিশয্যে অনেকেই দেখছি, প্রিয়া সাহার বিরুদ্ধে যা খুশি তাই বলছেন। অনেকে আবার এই সুযোগে নিজেদের অন্তরে পুষে রাখা সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষটাকেও ঝালিয়ে নিচ্ছেন। 'মালাউনরা বরাবরই এমন', 'দেশেরটা খায়, বিদেশে টাকা জমায়', 'ইন্ডিয়ার দালাল', 'দেশদ্রোহী', আরও নানা অসভ্য ও অভব্য বিশেষণে জর্জরিত করে চলছেন। এই প্রতিক্রিয়া দেখেও কিন্তু বোঝা যায়, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের প্রতি আমাদের দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের মনোভাব কতটা সুশীল!

হ্যাঁ, ব্যক্তিগত আমি এ ধরনের ঘটনায় ট্রাম্প বা অন্য কারো কাছে নালিশ জানানোর বিরুদ্ধে। তাতে কোনো লাভ হয় বলে মনে হয় না। আমেরিকার স্টেটস ডিপার্টমেন্ট প্রতিবছর বিশ্বের প্রতিটি দেশের জাতিগত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রতিবেদন তৈরি করে। সেই প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চিত্রও স্থান পায়। বলাবাহুল্য, এখানে প্রতিবছর যে চিত্রটি উঠে আসে রাষ্ট্রের জন্য তা মোটেও সম্মানজনক নয়। তারপরও প্রতিবছর এই প্রতিবেদন বের হয়। হিন্দু-বৌদ্ধ-ক্রিস্টান ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকেও এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। কিন্তু সেই প্রতিবেদন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কারো কারো সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বলে দেখেছি, তাদের মধ্যে এ বিষয়ে তেমন কোনো মাথা ব্যথা নেই। বরং দুচারজন সংখ্যালঘু নির্যাতন, কয়েকটা রেপ, কিছু জায়গাজমি দখল-কিছু মানুষকে বিতাড়ণ-এগুলো যথেষ্ট 'সহনীয়' পর্যায়ে রয়েছে বলে তাদের মধ্যে এ ধরনের পরিতৃপ্তিই লক্ষ করা যায়!

এদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ইস্যুটি ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে কখনই পাত্তা পায় না। সবার এক কথা, এদেশে সংখ্যালঘুরা অনেক ভালো আছে। ভারতে কি হচ্ছে? আমেরিকায় কি হচ্ছে? চীনে উইঘুর সম্প্রদায়ের প্রতি কী আচরণ করা হচ্ছে? যেন ওইসব ঘটনা ঘটছে বলে বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুদের নির্যাতিত হওয়াও 'সঙ্গত!'

কথা হলো, অন্য দেশে সংখ্যালঘুদের প্রতি খারাপ আচরণ দিয়ে কি বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ করা হবে? আমাদের দেশের সংখ্যালঘুরা কী আসলেই ভালো আছে? আমরা কি আমাদের দেশের সংখ্যালঘুদের প্রতি ভালো আচরণ করছি? তাদের অধিকার-মর্যাদা-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারছি? ভারতে মুসলিমদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন হয়, সেটা বাংলাদেশি হিন্দুদের অপরাধ? এসব ব্যাপারে আমাদের দেশে সব সময়ই এক ধরনের 'উগ্রতা' দেখা যায়।

ধর্মীয় এবং জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন-নিপীড়ণ আমাদের দেশে একটি সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। কারণে-অকারণেই তাদের উপর হামলা হয়, আক্রমণ হয়। তাদের জীবন অনিরাপদ করে তোলা হয়। তাদের সম্পদ লুটপাট করা হয়। জায়গাজমি জবরদখল হয়ে যায়। আতংক ও উৎকণ্ঠার মধ্যে বেঁচে থাকতে হয়। এটা কোনো মানুষের জীবন নয়। ভোটের সময় হামলা-আক্রমণের ঘটনা মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। প্রতি নির্বাচনের আগে-পরেই সংখ্যালঘুদের উপর হামলার ঘটনা ঘটে থাকে।

২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার আগে-পরে এই হামলা-আক্রমণের ঘটনা অতীতের সকল রেকর্ড অতিক্রম করেছিল। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এটাই যে, প্রতিটি হামলা-নির্যাতনের সঙ্গে বিএনপি এবং জামায়াত-শিবির জড়িত থাকলেও কাউকেই তখন গ্রেপ্তার করা হয়নি, আইনের আওতায় এনে একজনকেও শাস্তি দেওয়া হয়নি।

২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আশা করা হয়েছিল ২০০১ সালে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার প্রতিটি ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত হবে এবং প্রকৃত আপরাধীদের শাস্তি বিধান করা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো মহাজোট সরকারের আমলেও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর, আরও স্পষ্ট করে বললে বৌদ্ধ ও হিন্দু সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস আক্রমণের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। কোনো ক্ষেত্রেই দুষ্কৃতকারিরা উপযুক্ত শাস্তি পেয়েছে এমন কোনো প্রমাণ দেওয়া যাবে না। ক্ষেত্রবিশেষে দুএকটি মামলা হয়েছে, দুএকজনকে গ্রেপ্তারও হয়তো করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকেছে। ফলে সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ করা, তাদের জীবনকে বিপন্ন করে তোলা, ত্রাসের মধ্যে তাদের বসবাসে বাধ্য করা যেন তাদের 'নিয়তি' হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধরা কিন্তু বাংলাদেশে এখনও চলছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে (জানুয়ারি থেকে এপ্রিল) দেশে হত্যার শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ২৩ জন৷ হত্যাচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০ জন৷ হত্যার হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন এবং শারীরিক আক্রমণের শিকার হয়েছেন ১৮৮ জন৷ ধর্ষণ এবং যৌন হয়রানির শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন এবং সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৫ জন৷ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও বাড়ি ঘরে লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি, বাড়ি ঘর ও জমি জমা থেকে উচ্ছেদ হয়েছেন ১৬২ জন, দেশত্যাগের হুমকি পেয়েছেন ১৭ জন৷ ১০৪ জন ধর্মান্তরিত হয়েছেন, ২৯টি মন্দির ও মঠে হামলা হয়েছে, ৪৩টি মূর্তি ভাঙচুর করা হয়েছে এবং জবর দখলের ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি৷ এর বাইরে অপহরণ, ধর্মস্থান দখল, মূর্তি চুরির মতো ঘটনারও অভিযোগ করা হয়েছে৷

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের মতে, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ঘটনা ঘটেছিল ১,৪৭১ টি৷ ২০১৭ সালে হয়েছিল ১,০০৪টি৷ ২০১৮ সালে ৮০৬টি৷

দেখা যাচ্ছে, সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা আমাদের দেশে এক চলমান প্রক্রিয়া। প্রিয়া সাহা যে ভাষায়, যে সব তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে যার কাছে অভিযোগ দাখিল করেছেন, সেটা হয়তো অনেকের কাছেই গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি। কিন্তু তাই বলে বাংলাদেশ সম্প্রীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত হয়েছে- এটাও তো সত্য নয়। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু পরিবারগুলো যখন আক্রান্ত হয়, তখন আমরা কজন তাদের পক্ষে দাঁড়াই? 'ভারতের মুসলমানদের দিকে তাকান, হিন্দুরা সেখানে কি না করছে'- এইতো আমাদের হিন্দুদের প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অনুভূতির ভাষা! কাজেই প্রিয়া সাহাকে আমরা দোষ দিই কোন যুক্তিতে?

আর প্রিয়া সাহার পুরো তথ্যই যে কাল্পনিক বা বানোয়াট, সেটাই বা বলি কীভাবে? আমাদের দেশে 'মিসিং পপুলেশন-এর বাংলা করা হয় 'হারিয়ে যাওয়া মানুষ'। আবার অনেকে এটাকে 'গুম হয়ে যাওয়া' বা 'গুম করে দেওয়া' হিসেবেও চালিয়ে দেন। প্রিয়া সাহা ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান 'ডিসঅ্যাপেয়ার' বলে উল্লেখ করেছেন। তার এই 'ডিসঅ্যাপেয়ার' আর আবুল বারাকতের গবেষণায় ব্যবহৃত 'হারিয়ে যাওয়া' হিন্দুর সংখ্যাটা কতো? ১৯৭১-২০১৩ অবধি ৪২ বছরে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে তাদের আগের সংখ্যার এক-চতুর্থাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। ২৮% ভাগ থেকে ৮% শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে।

অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাতের গবেষণা গ্রন্থ 'অ্যান ইনকোয়ারি ইন টু কজেস অ্যান্ড কনসিকোয়েন্সেস অফ ডিপ্রাইভেশন অব হিন্দু মাইনরিটিজ ইন বাংলাদেশ থ্রু দ্য ভেস্টেড প্রপার্টি অ্যাক্ট' বইয়ে দেখা যায়, ১৯৬৪ সাল থেকে অদ্যাবধি প্রতি বছর ১ লাখ ৯৬ হাজার ২৯৬ জন হিন্দু 'হারিয়ে যাচ্ছেন' এদেশ থেকে। প্রতিদিন হারাচ্ছেন ৫৩৮ জন মানুষ। আবুল বারাকাতের এই তথ্যের বিপরীতে প্রিয়া সাহার তথ্য কি একেবারেই মিথ্যে?

হ্যাঁ, ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্তে কিছু অসঙ্গতি আছে। আর বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এ ধরনের তথ্য উপস্থাপন করা, অভিযোগ জানানো, প্রতিকার চাওয়া মোটেও ঠিক কাজ নয়। এই প্রবণতা অবশ্যই নিন্দনীয়। বিদেশিদের কাছে নালিশ করার, প্রতিকার চাওয়ার এই নেতিবাচক 'রাজনৈতিক-সংস্কৃতি'র অবশ্যই অবসান হওয়া উচিত। কিন্তু প্রিয়া সাহাকে নিয়ে বর্তমানে যা হচ্ছে, যেভাবে পুরো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মুণ্ডুপাত করা হচ্ছে, সেটাই বা কতটা বাস্তবসম্মত, তাও ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।