অপ্রিয় প্রিয়া

কবির য়াহমদ
Published : 23 Dec 2011, 10:03 AM
Updated : 20 July 2019, 07:22 AM

বাংলাদেশি নারী প্রিয়া সাহা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। এই সাক্ষাতে তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের প্রসঙ্গে কথা বলেছেন। এই বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এসেছে, আলোচনা হচ্ছে; এবং এই আলোচনা সমালোচনার পর্যায়ে।

প্রিয়া সাহার কয়েক সেকেন্ডের সেই বক্তব্য হতে পারত সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ক বাংলাদেশের বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি, কিন্তু সেটা হয়নি মূলত অতিরঞ্জিত তথ্য ও বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রচ্ছন্ন আহ্বানের কারণে। আর এই কারণে মূলত তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় বইছে। তবে এই সমালোচনা যতটা পরিশীলিত হওয়ার কথা ছিল সেটা হয়নি, চলে গেছে ব্যক্তি ও ধর্মীয় পর্যায়ে। এই ইস্যুতে একটা পক্ষ হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছে।

গত ১৭ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের ওভাল অফিস বিভিন্ন দেশের কয়েকজন ধর্মীয় সংখ্যালঘুর দুর্ভোগের কথা শোনেন ট্রাম্প। সেখানে বাংলাদেশের প্রিয়া সাহা ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন চীন, পাকিস্তান, কিউবা, আফগানিস্তান, বাংলাদেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে যাওয়া মিয়ানমারের বাস্ত্যুচ্যুত নাগরিকও। সেখানে বাংলাদেশি প্রিয়া সাহা ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে অভিযোগ করে বলেন, "আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি। সেখানে ৩৭ মিলিয়ন (৩ কোটি ৭০ লাখ) হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টানকে গুম (disappear) করা হয়েছে। এখনো সেখানে ১৮ মিলিয়ন (১ কোটি ৮০ লাখ) সংখ্যালঘু জনগণ রয়েছে। দয়া করে আমাদের সাহায্য করুন। আমরা আমাদের দেশ ত্যাগ করতে চাই না। আমি আমার ঘর হারিয়েছি, আমার জমি নিয়ে নিয়েছে, আমার ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কিন্তু সে সবের কোনো বিচার নেই"। ট্রাম্প জানতে চান কারা এসব করছে? জবাবে ওই নারী বলেন, "সবসময় উগ্রবাদী মুসলিমরা এই কাজ করছে। সবসময় তারা রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে এই কাজ করে"।

দুর্ভোগের অভিযোগ শুনে দুঃখিত ট্রাম্প সঙ্গে সঙ্গে প্রিয়ার দিকে অভয়ের হাত বাড়িয়ে দেন। ট্রাম্পের বাড়িয়ে দেওয়া এই হাতে কতখানি আশ্বাস আর কতখানি আশাবাদী হয়েছেন প্রিয়া সাহা সেটা জানা না গেলেও তার আকুতি যে ট্রাম্প প্রশাসন পর্যন্ত পৌঁছেছে ওতেই হয়ত সন্তুষ্টি তার। কিন্তু তার এই ব্যক্তিগত সন্তুষ্টি দেশবাসীর কাছে তাকে অপ্রিয় এক মানুষে পরিণত করেছে।

প্রিয়া সাহার এই অভিযোগ নিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন কী করবে, কিংবা কী করার ক্ষমতা রাখে সে আলোচনার দরকার মনে করছি না। এর কারণ মূলত বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে এর আগেও ইঙ্গ-মার্কিনিসহ অনেকের পক্ষ থেকে নানাভাবে নাক গলানোর চেষ্টা চললেও সেটা ফলপ্রসূ হয়নি। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া, জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক নেতাদের ওপর সরকারের নানা পদক্ষেপের বিরুদ্ধে পশ্চিমা দেশগুলো নানা সময়ে নানান কথা বললেও সেগুলোকে খুব বেশি গুরুত্ব দেয়নি শেখ হাসিনার সরকার। এর বাইরে আছে বাংলাদেশের আরেক আলোচিত গ্রামীণ ব্যাংক ও ড. মুহাম্মদ ইউনুস ইস্যু যেখানে সরকারের অভিযোগ শান্তিতে এই নোবেলবিজয়ী বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিদেশে অপপ্রচার চালাচ্ছেন। ড. ইউনুসের সঙ্গে মার্কিনিদের ভালো যোগাযোগ থাকার কথা শোনা গেলেও কথিত সেই অপপ্রচারগুলোও বেকায়দায় ফেলতে পারেনি সরকারকে, যদিও ড. ইউনুসের পক্ষ থেকে অপপ্রচারের অভিযোগের কথা বারবার অস্বীকার করা হয়েছে।

বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে অতিরঞ্জিত তথ্য মার্কিন প্রেসিডেন্টের কাছে উপস্থাপন করে অদ্যকার আলোচিত এই নারী আর যাই করুন সুবিবেচনার কাজ করেননি। বাংলাদেশের ৩ কোটি ৭০ লাখ ধর্মীয় সংখ্যালঘু disappear কিংবা গুম হয়েছেন এই তথ্য তার এই নালিশের আগে কেউ সেভাবে উপস্থাপন করেছে বলে জানা নাই। ফলে কোন সূত্রে তিনি এই সংখ্যার উল্লেখ করলেন সেও এক প্রশ্ন। তবে সংখ্যা উল্লেখে অতিরঞ্জনের আশ্রয় নিলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা কোনভাবেই মিথ্যা নয়। রামু কিংবা নাসিরনগরের সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো অথবা সংসদ সদস্য সেলিম ওসমান কর্তৃক শিক্ষক শ্যামল কান্তিভক্তকে নির্যাতনের ঘটনা মানুষ এত সহজে ভুলে যায়নি।

এই নির্যাতন, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের ঘটনা কিংবা প্রিয়া সাহার বাড়িতে হামলার ঘটনা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। এগুলো বরং ধারাবাহিক। হয়ত সমাজের একটা অংশ অতি-ধর্মে আসক্ত হয়ে এইসব করছে, কিন্তু সরকার-প্রশাসন এইসব দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সেও প্রশ্ন! তারপরেও বলা যায় এইসব নির্যাতনের সমর্থক দেশের অধিকাংশ লোক নন। এটা সম্প্রীতির উদাহরণ।

এখানে উদ্বেগ ও হতাশার ব্যাপার হচ্ছে প্রিয়া সাহা সংখ্যালঘু ইস্যুতে ট্রাম্পের সাহায্য চেয়েছেন। এই চাওয়ার মধ্যে সৎ উদ্দেশ্য দৃশ্যমান হয়নি। নালিশের সুরে নত মস্তকে করা এই অভিযোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণের আকুতি যে ব্যক্তিত্বহীনতার স্মারক তা তার চেহারাতেই ছিল স্পষ্ট।

প্রিয়া সাহার পরিচয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের (এনজিও) শীর্ষ ব্যক্তি। এছাড়াও তিনি সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা বিষয়ক পরিচিত সংগঠন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক। এই সংগঠনের একমাত্র সাংগঠনিক সম্পাদক তিনি নন, আবার ট্রাম্পের সঙ্গে তার এই সাক্ষাৎ সংগঠনের পক্ষ থেকেও নয়। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন বলে দাবি করেছেন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের রানা দাশগুপ্ত। একটি গণমাধ্যমকে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় রানা দাসগুপ্ত প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে সাংগঠনিক বক্তব্য হিসেবে মানতেও নারাজ। ফলে ধরে নেওয়া যায় ব্যক্তি প্রিয়া সাহার বক্তব্যের দায় তার নিজের; এটা যেমন হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের বক্তব্য নয়, তেমনি নয় দেশে থাকা অগণন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের।

প্রিয়া সাহা দেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা বলেছেন। তার সেই বক্তব্যে সৎ উদ্দেশের ঘাটতি ছিল, ছিল ভুল তথ্যও। তিনি যে ভঙ্গিতে ট্রাম্পের সাহায্য চেয়েছেন সেটা আপত্তিকর। তার এই সাহায্য চাওয়া কিংবা ভুল তথ্যের সমালোচনা হচ্ছে, হোক। তবে সমালোচকদের অনেকেই যেভাবে এই বিষয়টিকে দেখছেন তাতে মনে হয় দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনাগুলো মিথ্যা! আদতে তা নয়।

বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ- এটা সত্য। এবং এও সত্য যে এখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়ে আসছে। প্রিয়া সাহার বক্তব্যের সমালোচনা আমরা করছি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের কাছে তিনি এভাবে দেশকে ভুল তথ্যে উপস্থাপন করে সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে ট্রাম্প প্রশাসনের সাহায্য চেয়েছেন এই কারণে। তার আকুতি ভঙ্গিমা আমাদেরকে পীড়া দিয়েছে।

এনজিও ব্যক্তিত্ব প্রিয়া সাহার তথ্য, ভঙ্গি ও বক্তব্য ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশকে ছোট করেছে। তিনি ভুলভাবে ভুল তথ্য দিয়ে আমাদেরকে লজ্জায় ফেলে দিয়েছেন। এই লজ্জা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্ষোভে রূপান্তরিত হয়েছে। ক্ষোভকালীন যোগাযোগ মাধ্যম আবেগে বুঁদ অদ্য; আবেগটা উবে গেলে যেন সংখ্যালঘু নির্যাতন বন্ধে ধর্মীয়-দুর্বৃত্তদের বাধ্য করতে এবং সরকার-প্রশাসনকে ধর্মনিরপেক্ষ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার মত প্রেক্ষাপট তৈরির সামাজিক আন্দোলনের পথরেখাটা দেখিয়ে দেয়। আর এটাই হতে পারে প্রিয়া সাহার প্রতি আমাদের মধুর প্রতিশোধ!