মেট্রোরেল-নির্মাণ কাজের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকে লক্ষ রাখুন

মাহবুবুল হক
Published : 18 July 2019, 09:55 AM
Updated : 18 July 2019, 09:55 AM

ঢাকার প্রধান কয়েকটি সড়কে রিকশা চলাচল বন্ধ করা হয়েছে যানজট নিরসনের উপায় হিসেবে। মিরপুর রোডের গাবতলী থেকে ধানমন্ডি সাতাশ নম্বর রোডের সংযোগ পর্যন্ত এবং প্রগতি সরণির কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মালিবাগ। এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। রিকশার থাকা-না-থাকা মানবিক নাকি নাগরিক বিবেচনা, সড়কের শৃঙ্খলাজনিত নাকি শৃঙ্খলারক্ষার ব্যর্থতাজনিত, পরিবেশবান্ধব নাকি ঐতিহ্যিক স্বীকৃতি– এসব বিতর্ক অনেককাল ধরেই চলছে। এই বিতর্ক থেমেও যাবে। এরই মধ্যে রিকশাচালক-মালিকদের সাথে বৈঠকের তৎপরতা চলছে। সমাধান যা-ই হোক সড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা জরুরি। কিন্তু ঢাকা-উত্তরের তথা মিরপুর ১২ নম্বর থেকে রোকেয়া সরণি, ফার্মগেট-শাহবাগ-মতিঝিলগামী মানুষের প্রতিদিনের জীবনে যে ভোগান্তি দুবছর আগে শুরু হয়ে এখনও চলছে এবং যার হাত থেকে আশু পরিত্রাণ নেই তার সমাধান ভাববে কে? এই সড়কপথের মাঝখানে ও দুপাশে অনেকটা জায়গা জুড়ে চলছে মেট্রোরেলের কাজ। মিরপুরবাসীর জন্য এই দুর্ভোগ শুরু হয়েছে আরও দুবছর আগে। আগারগাঁও থেকে কাজ শুরু হয়েছে গত বছরের ডিসেম্বর থেকে। ফলে পুরো মেট্রোরেলগামী সড়ক ব্যবহারকারীদের বর্তমান অবস্থা অত্যন্ত করুণ। এই মুহুর্তে ঢাকার সবচেয়ে অমানবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে এই অংশে অথচ জনদুর্ভোগ কমানোর বা এড়ানোর কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপ সরকার বা মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষের নেই। মেট্রোরেলের কাজের অগ্রগতির সুবিধার্থে এবং ভবিষ্যতের সুদিনের আশায় এই এলাকার মানুষ যে কষ্ট সহ্য করছে শুধুমাত্র কয়েকটি আপ্তবাক্যে তা শেষ হয় না। আমরা জানি, দুর্ভোগের কথা উঠলেই সব মহল থেকে 'এত বড় একটি কাজ সফল করতে কষ্ট একটু করতে হবেই', 'সকলের সহযোগিতা প্রয়োজন', 'জ্যাম কমাবে মেট্রোরেল'– এ জাতীয় বক্তব্যই শুনতে হবে। কিন্তু বাস্তবপক্ষে এইসব আশ্বাসের আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় বিপুল উদাসীনতা, অব্যবস্থাপনা আর বিশৃঙ্খলার প্রশ্রয়। ২০১৭ সালে পৃথক দুটি গবেষণার ফলাফলে জানানো হয়েছিল, ঢাকায় যানজটে প্রতিদিন নষ্ট হয় ৩২ লক্ষ (বিশ্বব্যাংক) থেকে ৫০ লক্ষ (বুয়েট) কর্মঘণ্টা। নিঃসন্দেহে এই সংখ্যা এখন অনেক বেশি হবে। আরেক গবেষণা জানান দিচ্ছে, যানজট কবলিত ঢাকায় মূল সড়কগুলোতে গাড়ি চলাচলের স্বাভাবিক গতি ঘণ্টায় মাত্র ৭ কি.মি যা এখন আরও কমেছে বলে মনে হয়। এসব পরিসংখ্যান দিয়েও জনদুর্ভোগের প্রকৃত চিত্র অনুমান করা যায় না, ভুক্তভোগীই কেবল তা জানে।

২০১৮ সালে মেট্রোরেলের কাজ যখন শুরু হয়, তখন নানা আশংকার মধ্যেও মিরপুরবাসী দেখেছে রোকেয়া সরণির বড় অংশ রেল-প্রজেক্টের মধ্যে চলে গেলেও ট্রাফিক পুলিশ আর এমআরটি কর্মীদের তৎপরতায় রাস্তায় গাড়ি চলাচল ছিল অনেকটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেড় বছরের মাথায় বর্তমানে পরিস্থিতির ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। মেট্রোরেলের কাজ আগারগাঁও ছাড়িয়ে এখন মতিঝিল পর্যন্ত বিস্তৃত। এক অর্থে ঢাকা শহরের যান চলাচলের ভাগ্য এখন এমআরটি কর্তৃপক্ষের দখলে। মিরপুর থেকে মতিঝিল– দিনের যে-কোনো সময় এই সড়কে চলাচল এখন বিভীষিকার মতো। এমনকি রাত বারোটায়ও অনেক স্থানে যানজট লেগে থাকে।

মেট্রোরেলের কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলতে হবে এ বিষয়ে দ্বিধা নেই, জনগণও এ কারণে সৃষ্ট দুর্ভোগ মেনে নিচ্ছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, জনদুর্ভোগ কমানোর জন্য সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে? দৃশ্যত, কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি। উপরন্তু কাজের প্রথম দিকে নেয়া উদ্যোগগুলো উধাও হয়ে গেছে। এই বিশেষ সড়কের জন্য যে বিশেষ উদ্যোগ ও মনোযোগ থাকা দরকার, দুঃখের বিষয়, তা কোথাও দৃশ্যমান নয়। ঢাকার অন্যান্য সড়কের মতো এখানেও গণপরিবহণের স্বেচ্ছাচারী চলাচল, যত্রতত্র উঠানো-নামানো-থামা-ঘুরানো-প্রতিযোগিতা চলছেই, এখানেও ফুটপাত অস্থায়ী বাজার-দোকান-পাটের দখলে, সংকীর্ণ হয়ে যাওয়া রাস্তায় চলছে ভ্যান-রিকশা-ঠেলাগাড়ি– এমনকি উল্টোপথে। এই চরম অব্যবস্থাপনা এবং সড়কে যান চলাচলের ধীরগতির কারণে মিরপুর-১২ থেকে রোকেয়া সরণি হয়ে যাতায়াতকারী গণপরিবহণ আশংকাজনকভাবে কমছে। এই রাস্তায় এটি জনদুর্ভোগকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে যা সামনের দিনগুলোর জন্যও উদ্বেগের। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, গন্তব্যে যেতে পাবলিক বাস পাওয়াই কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাইড-শেয়ার, সিএনজি অটোরিকশা এই রাস্তা এড়িয়ে চলার কারণে সেদিক থেকেও কোনো সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে না।

একদিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবধারিত যানজট অন্যদিকে গণপরিবহণের স্বল্পতা দুই সংকটের মধ্যে পড়ে উত্তর-ঢাকার জনসাধারণের যে বেহাল দশা তা থেকে উদ্ধার করার কোনো আপৎকালীন ব্যবস্থা কোনো কর্তৃপক্ষই নেয়নি এ যাবৎ। এর ফলে জনসাধারণকে বেশ কিছু পরোক্ষ ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়-ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যেমন–

১. কষ্টকর হয়ে গেছে ব্যক্তিগত অফিস-প্রতিষ্ঠান চালানো, রাস্তার দুপাশের মার্কেট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা গুটাতে বা স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছে ২. শিক্ষার্থীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের দিকে লক্ষ রেখে বাধ্য হয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিবর্তন বা নির্বাচনের মতো গুরুতর সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে ৩. প্রতিদিন ৪/৫ ঘণ্টা যানজটের ভোগান্তি ব্যক্তিগত ও পারিবারিক জীবনকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এসব ক্ষতির কোনোটিই কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়। দীর্ঘমেয়াদি মানসিক ও পারিবারিক ক্ষতি যা কেবল যাতায়াতের দুর্ভোগের মাপকাঠিতে বিচার করা যাবে না। সাধারণ মানুষ এ পরিস্থিতি থেকে এক ফু-এ উদ্ধার পাবে না জানি। কিন্তু এসব মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের লাঘব করা কিংবা সেই চেষ্টার প্রতি ইতিবাচক উদ্যোগ নেয়া নিশ্চয়ই খুব বাড়তি চাওয়া নয়।

মানুষের দুর্ভোগ লাঘবের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব বিবেচনা করা যায়– ১. সকাল ৮টা থেকে ১২টা ও বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত মিরপুর-১২ থেকে খামারবাড়ি পর্যন্ত সকল ভ্যান-রিকশা-কাভার্ড ভ্যান চলাচল নিষিদ্ধ করা। ২. রাস্তার পূর্ব ও পশ্চিম পাশের এলাকার বিদ্যমান স্থানীয় রাস্তাগুলোকে যান চলাচলের উপযুক্ত করা ৩. মেট্রোরেলের কাজ হচ্ছে যেসব রাস্তায় সেখানে দুপাশে সকল প্রকার অবৈধ পার্কিং, বাজার ও ভ্রাম্যমাণ হকার ব্যবসা কঠোর হস্তে দমন। ৪. পর্যাপ্ত গণপরিবহণ চলাচল নিশ্চিত করা ।

এ ছাড়াও ফুটপাতকে দখলমুক্ত রেখে সাধারণ মানুষের হাঁটার ব্যবস্থা করতে পারলে অনেক দুর্ভোগ বা দুশ্চিন্তা লাগব হবে নিঃসন্দেহে। আশা করি, কর্তৃপক্ষ মেট্রোরেলের কর্মযজ্ঞে আক্রান্ত সড়কের যান চলাচল ব্যবস্থাপনায় আরও কার্যকর ভূমিকা নেবে।