বানান ‘সংস্কার’ নয়, দরকার ‘ধারণক্ষমতা’ সংস্কার

Published : 17 July 2019, 10:13 AM
Updated : 17 July 2019, 10:13 AM

বাংলা ভাষায় বানান জটিলতা নিয়ে ত্যক্ত বিরক্ত কেউ কেউ বানান 'সংস্কার'এর কথা বলে থাকেন। তাদের যুক্তি হলো, বাংলায় বিভিন্ন শব্দের 'বিচিত্র' বানান মনে রাখাটা বিরাট এক ঝক্কির ব্যাপার। হ্রস্ব ই-কার, দীর্ঘ ঈ-কার, হ্রস্ব উ-কার, দীর্ঘ ঊ-কার, স, ষ, শ, জ, য, ন, ণ এসব প্রতীক ও বর্ণের ব্যবহারে ভাষা লিখতে গেলে বেশির ভাগ মানুষ ভজঘট পাকিয়ে ফেলে। শুদ্ধ বানানে বাংলা লেখা সম্ভব হয় না।

প্রতীক আর বর্ণের এ বৈচিত্র্য এবং শব্দের বানানে তার ব্যবহার প্রথম প্রথম ভাষা লিখতে আসা যে কোনো শিক্ষার্থীর কাছেই জটিল মনে হতে পারে। তারা বানানও ভুল করতে পারে। তবে ক্রমাগত ব্যবহার ও চর্চার মধ্য দিয়ে তা একসময় আত্মস্থ হয়ে যায়। এরপর আর মনেই থাকে না এ প্রতীক ও প্রায় সমোচ্চারিত বর্ণগুলো আলাদা কোনো সমস্যার সৃষ্টি করছে।

সমোচ্চারিত বর্ণ প্রায় প্রতিটি ভাষাতেই আছে। পৃথিবীতে সবচেয়ে চালু ভাষা ইংরেজিতেও রয়েছে। `C', `Q' এবং `K' বর্ণ তিনটি বাংলায় ক-এর মতো উচ্চারিত হয়। `C' অনেক সময় বাংলা স-এর কাজ করে থাকে। 'G' গ-ও হয়, আবার কোনো সময় জ-ও হয়। আবার একটা শব্দ 'সাইকোলজি' লিখতে প্রথমে 'P' লাগানো হয়, নিউমোনিয়ার ক্ষেত্রেও সে 'P'। সুতরাং বর্ণজটিলতা কিংবা বিপাক সব ভাষাতেই লেগে আছে। সবচেয়ে প্রচলিত আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিতে মনে হয় সবচেয়ে বেশি। প্রথম প্রথম তো আপনি বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারবেন না, 'U' বর্ণটার উচ্চারণ কখন 'আ', কখন 'উ' আর কখন 'ইউ' হয়? নিয়মিত শিখন এবং চর্চার মধ্য দিয়েই সেটা আপনার কাছে ধীরে ধীরে পরিচিত হয়ে ওঠে। এমন পরিচিত যে, শব্দ শুনলেই আপনার বোধই বলে দেবে শুরুতে আ ধন্যাত্মক একটা শব্দ 'ইউ' নাকি 'এ' দিয়ে লিখতে হবে। অন্যান্য বহুল প্রচারিত ভাষাও নিশ্চয় এর ব্যতিক্রম নয়। বাংলা বানান যাদের কাছে জটিল কিংবা ভজঘট পাকানো মনে হয়, তারা ক্রমচর্চা ও অনুশীলনের মধ্য দিয়ে তা কাটিয়ে উঠতে পারবেন।

বানানে ত্যক্ত বিরক্তরা দেখি অবলীলায় সংস্কারের কথা তুলে বসেন। অতীতে বানান সংস্কারের কিছু অত্যুৎসাহী চেষ্টা করা হয়েছিল মনে আছে। একবার এক পত্রিকায় (নাম মনে নেই, আর পত্রিকাটিও অকালে পটল তুলেছিল) দেখেছিলাম, ঈ-কার ছাড়া লিখতে। যেমন নদি, বির, ধির, তির— এসব। আরেক বার দেশের একজন প্রথিতযশা সম্পাদক নিজের পত্রিকায় ঋ-কার বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন। 'ক্রিকেট'কে 'কৃকেট', 'প্রিয়'কে 'পৃয়', 'ফ্রি'কে 'ফৃ' লিখতে শুরু করেছিলেন। ব্যাপারটা একটা উপদ্রবের মতো শুরু হয়েছিল। ভাগ্যিস, সম্পাদক পরে পত্রিকাটা ছেড়ে বেঁচেছিলেন। পত্রিকা আছে, পত্রিকা অফিসটাও আছে, কেবল নিজের উদ্ভট বিপ্লবীপনা নিয়ে নিজেই আউট হয়ে গেছেন। বাংলা বানান ছোটখাট হলেও একটা টর্নেডোর মধ্য দিয়ে গিয়েছিল তখন। ভাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও দাঁড়াতে পারেনি পত্রিকাটা। ওটার পতনের মূলে সম্পাদকের অনেক আহাম্মুকির মধ্যে বানানবিষয়ক আহাম্মুকিরও একটা ভূমিকা ছিল হয়তো। মোট কথা, পাঠক, শিক্ষিত/স্বল্পশিক্ষিত কেউই তার পণ্ডিতমন্যতাকে পাত্তা দেয়নি।

সব ভাষারই আপন আপন বৈশিষ্ট্য আছে, প্রকৃতি আছে। ভাষা কেউ তৈরি করেনি, ভাষা গড়ে উঠেছে  মানুষের বোধ আর চেতনার সাথে। মানুষ যত বুদ্ধিমান হয়েছে, ততই তার ভাষা সহজ থেকে জটিল হয়ে উঠেছে। মানুষের জটিল জীবন যাপন, বেঁচে থাকার প্রক্রিয়া, যুথবদ্ধতা, ভালবাসা, কামনা, স্পৃহা, আকাঙ্ক্ষার পরিসর যত বেড়েছে, ততই তার ভাষার গতিময়তা, নিবিড়তা, গভীরতা এবং জটিলতাও বেড়েছে। মনের গভীরতা, অভিজ্ঞতা যত বেড়েছে, ভাষাও তা ধারণ করার জন্যে ততটা জটিল হয়ে উঠেছে। তবে সে জটিলতা ভাষাকে ব্যাহত করে না, বরং তার ধারণক্ষমতা ও বিচিত্রতা স্পষ্ট করে তোলে। যে ভাষাভাষী মানুষের জ্ঞানের গভীরতা, বুদ্ধির ব্যাপ্তি কিংবা বোধের পরিপুষ্টি নেই, সে  ভাষাও কালক্রমে মৃত্যুবরণ করে। পৃথিবীতে সমৃদ্ধ জাতির ভাষা কখনো মরে না, মারা যায় অনুন্নত জনগোষ্ঠীর ভাষাই। সমৃদ্ধ জাতির ভাষা তার সর্বগ্রাসী  ক্ষুধা ও ধারণ ক্ষমতা নিয়ে যুগে যুগে বলীয়ান হয়ে ওঠে।

ভাষা যে সংস্কারের বিষয় নয়, সেটা সংস্কৃত কিংবা ল্যাটিন ভাষার দিকে তাকালেই বোঝা যায়। সংস্কৃত হলো একটি ঐতিহাসিক ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা এবং হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের পবিত্র দেবভাষা। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে রচিত পাণিনির ব্যাকরণে এই প্রামাণ্যরূপটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপে লাতিন বা প্রাচীন গ্রিক ভাষার যে স্থান, বৃহত্তর ভারতের সংস্কৃতিতে সংস্কৃত ভাষার সেই স্থান। ভারতীয় উপমহাদেশ, বিশেষত ভারত ও নেপালের অধিকাংশ আধুনিক ভাষাই এই ভাষার দ্বারা প্রভাবিত।

সংস্কৃতের প্রাক-ধ্রূপদী রূপটি বৈদিক সংস্কৃত নামে পরিচিত। এই ভাষা ঋগ্বেদের ভাষা এবং সংস্কৃতের প্রাচীনতম রূপ। এর সর্বাপেক্ষা প্রাচীন নিদর্শনটি খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দ নাগাদ রচিত। এই কারণে ঋগ্বৈদিক সংস্কৃত হলো প্রাচীনতম ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগুলোর অন্যতম এবং ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের (ইংরেজি ও অধিকাংশ ইউরোপীয় ভাষা যে পরিবারের সদস্য) আদিতম সদস্য ভাষাগুলোর অন্যতম।

সংস্কৃত সাহিত্যের ভাণ্ডার কাব্য ও নাটকের ঐতিহ্যশালী ধারাদুটি ছাড়াও বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, দার্শনিক ও হিন্দু শাস্ত্রীয় রচনায় সমৃদ্ধ। হিন্দুদের ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে সংস্কৃত হলো আনুষ্ঠানিক ভাষা। এই ধর্মে স্তোত্র ও মন্ত্র সবই সংস্কৃতে লিখিত। কয়েকটি ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আজও কথ্য সংস্কৃতের ব্যবহার প্রচলিত রয়েছে এবং সংস্কৃত ভাষাকে পুনরুজ্জীবিত করার নানা প্রচেষ্টাও করা হয়ে থাকে।

কিন্তু আসল কথা হলো বৈজ্ঞানিক, কারিগরি, দার্শনিক ও হিন্দু শাস্ত্রীয় রচনায় সমৃদ্ধ  সংস্কৃত ভাষা পুনরুজ্জীবিত হয়নি। দেবভাষার পবিত্রতা রক্ষার নামে প্রচলিত ভাষার ওপর কাঁচি চালিয়ে সনাতনী পণ্ডিতরা যে ভাষাটার জন্ম দিয়েছিলেন, কালক্রমে সেটি কেবল পুঁথিপত্তরেই স্থান লাভ করেছে। লোকের মুখে আর ঠাঁই পায়নি। অথচ যেসব ভাষাকে ছেঁকে ছেনে সংস্কৃত তৈরি করা হয়েছিল, সে সব ভাষা ক্রমাগত প্রাকৃতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপে টিকে আছে গণভাষা হিসেবে।

ভাষাকে যদি ধরি বহমান ঝরনা হিসেবে, তাহলে তার স্বাভাবিক চলমানতায় বাধা হয়ে দাঁড়ানো ঠিক হবে না। সে উপলাকীর্ণ পথ পেরোবে নিজের স্বচ্ছন্দ ধারায়। এঁকে যাবে, বেঁকে যাবে তবু আপন শক্তিতে সে খুঁজে নেবে নদীর বুক, তারপর বিলীন হবে মহাসমুদ্রে। বাংলাভাষার ক্ষেত্রেও তাই।

তবু কিছু মানুষের অস্বস্তির শেষ নেই। নিজের ভাষাকে অপূর্ণ ভেবে তারা পরের ভাষাকে সামনে রেখে নিজের ভাষার গায়ে কাঁচি চালাতে চান, সংস্কার চান। আমার মনে হয়, বাংলা  ভাষার বানান 'সংস্কার' নয়, দরকার তাদের  'ধারণ' সংস্কার।

তবে এটা ঠিক যে, পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। পরিবর্তনের স্রোত ব্যাহত করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। ঈশ্বরীয় কিংবা বঙ্কিমী বাংলায় এখন আর সাহিত্য লেখা হয় না। কপাল কুণ্ডলার সাথে দেবদাসের ভাষাগত পারম্পর্য  বিচার করতে গেলে অন্তর্পরিবর্তনটা সহজেই চোখে পড়বে। মনে হয় না, এই পরিবর্তনটা করা হয়েছে। করা হয়নি, সেটা ভাষার ক্রমপরিবর্তনধর্মিতার অলক্ষ্য সূত্রেই ঘটে গেছে। এক সময়ের 'পূর্ব্ব', 'সূর্য্য', 'বর্ত্তমান', 'পর্য্যন্ত', বাড়ী, গাড়ী, শাড়ী—এসব বানান তো এখন লেখা হয় না। নিজেদের অজান্তেই এসব শব্দের বানান পাল্টে গেছে। পরিবর্তনের জন্যে কাউকে উঠে পড়ে লাগতে হয়নি।

কথায় কথায় অন্য ভাষার উদাহরণ টানা হয়। এটা ঠিক নয়। অন্যের মা শিক্ষিত, সুন্দর আর বাকপটু বলে আমি আমার কালো, অসুন্দর ও ঠিক মতো কথা বলতে না পারা মাকে পাল্টে ফেলব নাকি? কিংবা পাল্টাতে না পারলেও তার সংস্কার করে তাকেও অন্যের মার মতো করে তোলার চেষ্টা শুরু করব নাকি? ধরলাম, তাই শুরু করলাম। তারপর ফলটা কী দাঁড়াবে? আমার কালো কুচ্ছিৎ অশিক্ষিত মা কি অন্যের মায়ের মতো স্মার্ট, সুদর্শন আর প্রিয়ভাষী হয়ে উঠবে এবং তাকে কি আমার জন্ম থেকে দেখে আসা মা মনে হবে?

আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, মা তো মা-ই। মাকে কেন অন্যের মায়ের সমান্তরালে দাঁড় করিয়ে তার রূপ-গুণের বিচার করতে হবে? তথাকথিত সুবিধে-অসুবিধের নামে তার শরীরে ছুরি-কাঁচি চালাতে হবে!

ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন লাগে। খুব একটা স্বস্তিকর নয় কিন্তু।