লিমনকে নিপীড়ন করে সুনাম ক্ষুন্ন করছে র‌্যাব

শাহরিয়ার কবীরশাহরিয়ার কবীর
Published : 9 Feb 2014, 06:23 PM
Updated : 18 July 2012, 04:09 PM

ঝালকাঠির লিমন নামের একটি কিশোরের ওপর একটি রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বর্বরতার কথা গত কয়েক মাসে দেশজুড়ে আলোচিত হচ্ছে। নিঃসন্দেহে এটি মানবাধিকারের গুরুতর লঙ্ঘন। আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র অর্জন করেছি অনেক ত্যাগের বিনিময়ে। এই রাষ্ট্র হবে মুক্তবুদ্ধির চেতনায় লালিত। এই রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার সুরক্ষিত থাকবে। রাষ্ট্রটি হবে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক। এখানে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিটির সঙ্গে সাধারণ একজন কৃষকের অধিকারের কোনও পার্থক্য থাকবে না। এ সবই হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিসংগ্রামের চেতনার তাৎপর্য। তাই লিমনের মতো একটি প্রায় কিশোরের ওপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আমাদের ব্যথিত করে। একটি পা হারানোর পরও ছেলেটি সাধারণ মানুষের সহযোগিতা পেয়ে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করছিল। এইচএসসি পরীক্ষায়ও অংশ নিল। আমরা যখন ভাবছিলাম লিমন এবার সব ধরনের অপবাদ থেকে মুক্ত হবে তখনই আবার ওর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হলো নতুন করে। প্রায় নীরবেই রাষ্ট্রীয় একটি বাহিনী কাজটা করে ফেলল।

ব্যক্তিগতভাবে আমার দাবি হলো, র‌্যাবের যে সব কর্মকর্তা লিমনের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে, তাদের উপযুক্ত বিচার করতে হবে। আর অবশ্যই খুব দ্রুত এই কিশোরটির ওপর থেকে যাবতীয় অভিযোগের পাহাড় সরিয়ে নিতে হবে। সরকারকেই কাজটা করতে হবে। কারণ লিমন রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শিকার। রাষ্ট্রকে এখন ওর ওপর নিপীড়ন চালানোর জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পাশাপাশি লিমনের পুনর্বাসনের পুরো দায়িত্ব নিতে হবে।

এ সব ঘটনা র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান নামের সরকারি সংস্থাটির সুনাম ক্ষুন্ন করছে ব্যাপকভাবে। এই বাহিনীটি একসময় জঙ্গীবাদ দমনের কাজে বিরাট ভূমিকা রেখেছিল। ওদের সাহায্য ছাড়া বাংলা ভাই বা আবদুর রহমানদের ধরা যেত না। তবে ২০০১-২০০২ সালে গঠনের সময় র‌্যাবকে ফ্যাসিস্ট বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে তখনকার ক্ষমতাসীন বিএনপি-জামাত জোট সরকার। অপারেশন ক্লিন হার্টের নামে ব্যাপক জোর-জুলুম চালিয়েছিল তারা। মাঝখানে গত কয়েক বছরে র‌্যাব কিছু কাজের মাধ্যমে সুনাম অর্জন করেছে। এখন আবার লিমনের মতো কিশোরের ওপর নিপীড়ন চালিয়ে ওদের অর্জিত সুনাম নষ্ট করছে। এটা আমাদের কাছে মোটেই কাক্সিক্ষত নয়।

তাই বলে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো কোনও মানবাধিকার সংগঠন আমাদের দেশীয় বিষয় নিয়ে মন্তব্য করতে পারে না। আমার যদি মাথাব্যথা করে তবে তো আমি ওষুধ খাব। মাথাব্যথা সারাব। মাথাটাই কেটে ফেলব না। র‌্যাবসহ সরকারি যে কোনও সংস্থা যদি নিজেরাই মানবাধিকার লঙ্ঘন করে থাকে তবে তাদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনতে হবে। প্রয়োজনে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। তাছাড়া জনগণের সাংবিধানিক অধিকার, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তাদের প্রশিক্ষিত করে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। যে কোনও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে এই মনোভাব তৈরি করতে হবে যে তারা জনগণের সেবক। নিপীড়ক হতে পারে না। মনে রাখতে হবে, আমাদের পুলিশবাহিনী দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছে বলেই কিছু কিছু ক্ষেত্রে র‌্যাবের মতো বাহিনীর প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল। তার মানে এই নয় যে বাহিনীটি যা খুশি তাই করবে।

আবার আমি বলব না যে বাহিনীটি বিলুপ্ত করা যাবে না। এই বাহিনীর কর্মকান্ড থাকবে কি থাকবে না সে ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো কোনও মানবাধিকার সংগঠন এসে এ ব্যাপারে সরকারকে সুপারিশ দিতে পারে না। এটা আমাদের সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন।

দেশে আমরা সচেতন নাগরিকরা রয়েছি। সরকারকে কোনও পরামর্শ বা দাবির কথা দেশের মানুষ বলবে। দেশের ভেতর থেকেই বিষয়টা আসতে হবে। সরকার যেখানে ব্যর্থ হবে, সেখানে আমরা তাদের সচেতন করব। আন্দোলন করব। জনমত তৈরি করব। দায়ী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। হ্যাঁ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো সংগঠনগুলো যে কোনও দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ, জনমত তৈরি বা তদন্ত প্রতিবেদন দিতে পারে। এর চেয়ে বেশি কিছু করার এখতিয়ার তাদের নেই।

এই আন্তর্জাতিক সংগঠন দুটো বাংলাদেশে গত জোট সরকারের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিল। তাদের এই ভূমিকার কথা মনে রেখেই বলতে হচ্ছে, আজ যদি তারা এভাবে কথা বলে তাহলে তাদের গ্রহণযোগ্যতাই নষ্ট হবে। কারণ আমরাও তো বলতে পারি, ইরাক-আফগানিস্তান-পাকিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে গণহত্যা চালিয়েছে, সাদ্দাম হোসেনকে যেভাবে প্রকাশ্যে বর্বরভাবে হত্যা করিয়েছে– এ সব কি মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়? শুধু এ সব দেশে কেন, গোটা বিশ্বেই যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সাহায্যে গণহত্যা চালাচ্ছে ও মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে আমরা কি তাই বলে মার্কিন সামরিক বাহিনীগুলোকে বিলুপ্ত করার কথা বলব? ওরা যা করছে তার তুলনায় আমাদের দেশে র‌্যাব তেমন কিছুই করেনি।

এই কথার মাধ্যমে আমি কিন্তু কোনও অন্যায়কে ন্যায্যতা দিতে চাচ্ছি না। স্পষ্টভাবেই বলছি, আমি লিমনের মতো অসহায় নিরপরাধ মানুষের ওপর কোনও ধরনের রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন আর দেখতে চাই না। বিচার-বহির্ভুত হত্যা, নিরাপত্তা হেফাজতে হত্যা ইত্যাদি বিষয়গুলোর তদন্ত করে দোষী কর্মকর্তাদের দ্রুত বিচার করতে হবে। দেখুন, আমরা এমন একটি দেশে বাস করি যেখানে ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয়েছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পরের সবচেয়ে নৃশংস গণহত্যা। তার বিচার আমরা এতদিনে শুরু করেছি মাত্র। আমরা এ দেশকে একটি সত্যিকারের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, মুক্তবুদ্ধিচর্চার পীঠস্থান এবং মানবাধিকার পরিস্থিতির দিক দিয়ে গোটা বিশ্বের জন্য আদর্শ স্থানে পরিণত করতে চাই। সে জন্য ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা ও নির্যাতনের মতো নৃশংসতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার বিচার করতে হবে। পাশাপাশি বর্তমানে বা অতীতে সংঘটিত সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনারও বিচার চাইতে হবে।

আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। হতে পারি দরিদ্র। তবু রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব আমরাই। যে কোনও আন্তর্জাতিক সংগঠনের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আমাদের সবসময়ই সোচ্চার থাকতে হবে। কোনও সার্বভৌম রাষ্ট্র, কোনও মর্যাদাসম্পন্ন জাতি তাদের অভ্যন্তরীন বিষয়ে অন্যদের হস্তক্ষেপ মেনে নিতে পারে না।

আমাদের দেশে আরেকটি বড় সমস্যা হলো দায়মুক্তি দিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশে বড় একটা সময় স্বৈরশাসকরা ক্ষমতা দখল করে রেখেছে। বিএনপি-জামাতের মতো দলগুলো বারবার ক্ষমতায় এসেছে। এরা সবসময় গণহত্যা-হত্যাকান্ড-মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনায় দায়ী পক্ষকে দায়মুক্ত করেছে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার পর সামরিক সরকার ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে হত্যাকারীদের দায়মুক্ত করেছিল। ২০০১-২০০২ সালের অপারেশন ক্লিন হার্টের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদেরও ইনডেমনিটি দিয়েছিল বিএনপি-জামাত জোট সরকার। এই চর্চাটা বন্ধ করতে হবে। এ সব বিষয় নিয়ে আমি কখনও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো সংগঠনগুলোকে কথা বলতে দেখিনি।

আমাদের নিজেদেরও এ জন্য দুটো কাজ করা জরুরি। প্রথমত, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে মানবাধিকার সম্পর্কে প্রশিক্ষিত করা ও তাদের মধ্যে জবাবদিহিতার বিষয়টি তৈরি করা। তাহলে তারা বুঝতে পারবে যে তারা জনগণের সেবক মাত্র। দ্বিতীয়ত, কিছু দৃষ্টান্ত তৈরি করতে হবে। ২০০১ সালে মুনতাসীর মামুন ও আমাকে ধরে নিয়ে নিপীড়ন করা হয়েছিল। আমরা মামলা করেছিলাম। সে মামলায় আমরা বলেছিলাম, ক্ষতিপূরণের টাকা দায়ী কর্মকর্তারা নিজেদের পকেট থেকে দেবেন। রাষ্ট্রীয় তহবিল থেকে দেওয়া হলে তা তো আমারই টাকা হবে। তাহলে তাদের শিক্ষা হবে না। এ রকম দুয়েকটি ঘটনায় দোষী ব্যক্তিরা শাস্তি পেলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কেউ আর সাধারণ মানুষের ওপর নিপীড়ন চালাতে সাহস পাবে না।

বুঝতে হবে, মানতে হবে যে, সাধারণ কৃষকের রক্তে দেশটা স্বাধীন হয়েছে। ওই কৃষকদের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকার রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নির্বাহী ব্যক্তির চেয়ে কোনও অংশে কম নয়।

শাহরিয়ার কবীর: লেখক, সাংবাদিক ও মানবধিকারকর্মী।