রবীন্দ্রনাথের গানে চরম সব সত্য থাকে। তাঁর একটি গানে আছে মরণ বলে আমি তোমার জীবন তরী বাই। জন্মানোর পর আপনি কি ডাক্তার হবেন না ইঞ্জিনিয়ার হবেন না সেনা শাসক হবেন কেউ বলতে পারে না। কিন্তু একটা কথা সবাই জানে জন্মিলে মরিতে হয়। সেনা শাসক, জাতীয় পার্টির নেতা, ক্যারিশমেটিক সবচেয়ে বিতর্কিত নিন্দিত ও আলোচিত সরকার প্রধান এরশাদ মারা গেছেন। তিনি যে মারা যাচ্ছেন এটা মোটামুটি সবাই জেনে গিয়েছিলো। কিন্তু কবে বা কখন তা নিয়ে ছিলো জল্পনা কল্পনা। একটা কথা সবাই স্বীকার করেন এমন আনপ্রেডিক্টেবল লিডার বা এমন রহস্যজনক চরিত্র দেশের রাজনীতির ইতিহাসে আর কখনো দেখা যায়নি।
তাঁর মৃত্যুর আগেও গুজব ছিলো তিনি নাকি শুক্রবারে মরতে চেয়েছিলেন। ধর্মীয় হিসেবে এই দিনের গুরুত্ব আছে বলে হয়তো। তখন শোনা গিয়েছিলো সেদিনই তাঁর লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়া হবে। আবার শুনলাম সেদিন বাংলাদেশের খেলা বলে তা না কি করা হয়নি। তবে কয়েকদিনের মধ্যে যে হবে বা হতে যাচ্ছে সেটা জানতো সবাই। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে চিরবিদায় নিয়েছেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। সাধারণত আমরা পরলোকে পাড়ি দেয়া মানুষদের নিয়ে কোন কথা বলি না। মানে কোন কটু কথা বা সমালোচনা করি না। কিন্তু সেটা সাধারণ মানুষের বেলায় প্রযোজ্য হলেও কিছু কিছু মানুষের বেলায় তা খাটে না। তা মানা সম্ভবও না। ইনি তেমন একজন শাসক।
আমাদের সোনালী যৌবন কেড়ে নেয়া স্বৈরাচার। মনে আছে তাঁকে হটানোর আন্দোলন কতটা বেগবান ছিলো। আর তার বাহিনীর অত্যাচার ছিলো কতটা নির্মম। দেশের এখন মৃতপ্রায় সংস্কৃতি আর শিল্প জগত চাঙ্গা রেখেছিলেন এরশাদ। বাপরে বাপ। কবিতা গান নাটক আর লেখায় তাঁকে তুলোধুনো করে কী শান্তি ছিলো তখন। আমার বয়স তিরিশও পেরোয়নি। সে সময় চট্টগ্রামের মুসলিম ইউনিষ্টিউট হলে জমজমাট এক কবিতা আসরে এরশাদ ও তাঁর হঠাৎ পাওয়া পুত্র নিয়ে ব্যঙ্গাত্মক একটি স্বরচিত সুপার হিট কবিতা পাঠ করেছিলাম। ধারনা ছিলো না সেটি এমন প্রিয়তা পাবে। ব্যস কয়েকদিন বাড়ী থেকে পালিয়ে থাকতে হয়েছিল। এটাতো কোন ঘটনাই না। পার্বত্য জনপদের এক স্কুল টিচার লিখেছিলেন নতুন বাংলাদেশ গড়বো মোরা নামের এক নিরীহ কবিতা। কেমন করে জানি সেটা হয়ে গেলো তাঁর। আর সেটা বহাল রাখতে গিয়ে ঐ মাস্টারকে দেশ ছাড়া করেছিল বাহিনী। ভাগ্যিস জানে বেঁচে গিয়েছিলেন মাস্টার।
তাঁর নয় বছরের শাসনকালে পজেটিভ কিছু ছিলো না এমন না। যেমন উপজেলা, অবকাঠামোর উন্নয়ন। তিনি তোষামোদী আর স্তাবকতার ভেতর ডুবে থাকতে ভালোবাসতেন। আজ যারা ভোল পাল্টে আওয়ামী লীগ তাদের বেশীর ভাগই সেদিন ঘি মাখন নিয়ে তাঁর পদসেবায় ব্যস্ত ছিলো। ঢাকায় বন্যা হবার পর এরশাদ জায়গা জায়গায় ঘুরে বেড়ালেন আর পয়দা হয়ে গেলো এক গান। তোমাদের কাছে আসার চেষ্টা আমার এমন এক গান চলতো রাতদিন। মনে হতো কোনো এক ত্রাণকর্তা নাজেল হয়েছে দেশে। রুমানিয়ার পতিত কমিউনিষ্ট নেতা চসেস্কু গদীচ্যূত হবার ক'দিন আগে এসেছিলো ঢাকায়। এটা বললাম এই কারণে যেদেশে যত শয়তান একনায়ক আর স্বৈরাচারী সব ছিলো তাঁর দোস্ত।
ব্যক্তিগতভাবে আমার বিশ্বাস তিনি তাঁর আগের সেনাশাসক জেনারেল জিয়ার চাইতে উত্তম। এই কারণে যে ব্যক্তিগতভাবে এরশাদ ছিলেন একজন অসাম্প্রদায়িক ও উদারমনের শাসক। নিজে লিখুন আর ফজল শাহাবুদ্দীনের মত কবি লিখে দিক কবিতা ভালোবাসতেন। বঙ্গভবনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তোড়েও কবিতার আসর বসাতেন। সে কারণে তাঁর অতিথি হয়ে এসেছিলেন সমরেশ মজুমদার। বুদ্ধদেব গুহ ছিলেন তাঁর প্রিয় লেখক। কিন্তু ঐ যে স্বভাব। খাইয়ে দাইয়ে আর উল্টা পাল্টা ভিডিও দেখিয়ে সমরেশ মজুমদারকে দিয়ে লেখালেন আজগুবি কাহিনী। যাতে নাকি স্পষ্ট প্রমাণিত এরশাদ নূর হোসেন হত্যার ব্যাপারে দায়ী ছিলেন না। কতটা সত্য মিথ্যা জানি না তবে তিনি এসব পারতেন। পারতেন আরো অনেক কিছু।
আমি তখন চন্দ্রঘোনায় কাজ করতাম। এরশাদ আসবেন বলে হৈ হৈ রব। এলেন এসে চলেও গেলেন। যাবার পর রটে গেলো সেখানকার এক সামান্য দারোয়ান নাকি তাঁর কাণ্ড দেখে মূর্ছা গিয়েছিলেন। কারণ? তখন ছিলো রোজার মাস। এরশাদ সেদিন রোজা ছিলেন না। তাঁকে ডাব কেটে পেঁপে কেটে খাওয়ানো দারোয়ান ভদ্রলোক সভায় গিয়ে শুনলেন তিনি কসম করে বলছেন আজ তিনি উপোস ছিলেন। এমন ঘটনা একটা না। বৃষ্টিহীন খরার সময় আবহাওয়া দপ্তরের আগাম বার্তা সম্বল করে তিনি ঘোষণা দিতেন প্রার্থনা হবে। যাতে মনে হতে পারে তাঁর প্রার্থণার কারণে বৃষ্টি নেমে আসতো।
সবচেয়ে মারাত্মক ছিলো দুটি কাজ। নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশে হঠাৎ করে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করে তিনি দেশ ও জাতিকে আজীবনের জন্য এক গ্যাঁড়াকলে ফেলে দিয়েছেন। যা থেকে মুক্তির উপায় নাই। তেমনি বিতর্কিত বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন। এতে বিজ্ঞান যতটা ততটাই দূরভিসন্ধি। যে কারণে আজকাল রবীন্দ্রনাথ নজরুল কারো জন্ম মৃত্যু দিন উভয় বাংলায় একসাথে পালিত হতে পারে না। এরশাদ আমাদের জাতীয় জীবনের আরো একটি মারাত্মক বিপদ টেনে এনেছিলেন। শেষদিকে যখন দেখলেন পরিণাম ভয়াবহ তখন পরিকল্পিতভাবে দাঙ্গা লাগিয়ে দিলেন। সে দাঙ্গাই বাংলাদেশের এখন অবধি একমাত্র দাঙ্গা। আশ্চর্যজনকভাবে এমন দুর্ঘটনা ঘটিয়ে তিনি গিয়েছিলেন নোয়াখালী গান্ধী আশ্রমে।
চরম স্ট্যান্টবাজ এরশাদ ছিলেন রমনী মোহন। এ জায়গাটায় তাঁকে স্যালুট করতেই হবে। এত নারী তাঁর জন্য কেন পাগল হয়েছিল? তিনি চাইলেই তারা রাজী হবে এটা ঠিক মানা যায় না। বরং তাঁর কথাই সত্য মনে হয় যে তারাই তাঁর কাছে আসতো, তিনি যেতেন না। জীবনভর নানা নাটকে নিজেকে লাইম লাইটে রাখতে পারাটা কম কিছু না। আমাদের দেশে বেশকিছু রসিক ভাঁড় নেতা আছেন। এরশাদ এদের নিয়ে খেলেছেন আজীবন। কাজী জাফর থেকে মওদুদ আহমেদ বা শাহ মোয়াজ্জেম থেকে আ স ম রব সবাই ছিলো তাঁর খেলার পুতুল। সে পুতুলগুলোর কেউ কেউ এখনো পাপেট ।
এরশাদের আরেকটা দিক ছিলো চমক দেয়া। এই সেদিনও নির্বাচনে যাবেন কি যাবেন না, নিজে দাঁড়াবেন কি দাঁড়াবেন না এসব বিষয়ে এমন চমক দিতেন যে জাতির পিলে চমকে যেতো। বিশেষ করে তাঁর মিত্র বা দুশমন কেউই বুঝতো না কি করতে চলেছে জাতীয় পার্টি। নিজেকে হাস্যকর করে হলেও তিনি এসব বজায় রাখতেন। এই বাড়ীতে তো এই হাসপাতালে আবার এই কেবিনে তো এই গলফ কোর্সে। এমন চটকদার যে আওয়ামী লীগের নির্ঘুম রাতের সময় ঘোষণা দিলেন মতিঝিলে আসা হেফাজতীদের তাঁর দল পানি সরবরাহ করবে। বড় জটিল আর বড় রহস্যময়ভাবে করলেন পাকিস্তানপন্হীদের উপকার আর সারাজীবন শুনলাম তিনি নাকি ছিলেন ইন্ডিয়ান লবিং এর লোক।
একটা কথা মনে পড়ছে। আমি যেদিন অভিবাসন নিয়ে সিডনি আসি সেদিন দুপুরের খবরে দেখলাম তিনি জেলখানা থেকে বেরিয়ে সংসদে ভাষণ দিচ্ছিলেন। বারবার জোর দিয়ে বলছিলেন কারো সাধ্য নাই তাঁকে ফাঁসি দেয়। কারো সাধ্য নাই তাঁর বাহিনী বেঁচে থাকতে তাঁকে আবার জেলে পুরে। কথাটা কিন্তু সত্যি করে দেখিয়েছেন তিনি। উল্টো বেগম জিয়া জেলে যাবার পর বলেছিলেন তিনি যে গাছ পুঁতে এসেছেন তার ফল খেতে।
অস্বীকার করা যাবে না গদীচ্যূত হবার পরপরই রংপুরের সব কটা আসন থেকে বিপুল ভোটে জেতা এরশাদ নির্বাচনে হারেননি কোনদিন। তাঁর দল থাকবে কি থাকবে না রওশন এরশাদ জি এম কাদের কে হবেন আগামী নেতা এসব নিয়ে যাই বলি না কেন পার্টি না থাকলেও এরশাদ থেকে যাবেন। নিন্দিত এরশাদও থাকবেন ইতিহাসে। তাঁর মা জননী ছেলের নাম শুনে ভড়কে গিয়ে জানতে চেয়েছিলেন হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ কে? তিনি জানতেন তাঁর এই পুত্র পেয়ারার নাম এরশাদ হুসাইন।
এভাবেই নিজেকে একাধারে বিতর্কিত আবার নিজের ক্যারিশমায় উজ্জ্বল ও নিন্দিত এরশাদ চিরবিদায় নিয়েছেন। গুড বাই জেনারেল।