বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা প্রসঙ্গে

সৈয়দ আশরাফ উদ্দিন
Published : 16 July 2019, 08:10 AM
Updated : 16 July 2019, 08:10 AM

বিজ্ঞানের একটি অন্যতম ক্ষেত্র জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ আকাশের দিকে তাকিয়েছে এবং বিস্মিত হয়েছে। প্রথমদিকে মহাকাশের গ্রহ- নক্ষত্রদের গতিবিধি নির্ধারণই ছিল মুল বিষয়। কেননা নক্ষত্রদের অবস্থান জেনে সমুদ্র যাত্রা এবং সময় গণনা করা হত। এভাবে প্রয়োজনের তাগিদে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিভিন্ন সভ্যতায় প্রসার লাভ করে। কিন্তু  তখনো এদের আসল স্বরূপ ও ব্যাপ্তি উম্মোচিত হয়নি। উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকে পদার্থবিজ্ঞান এর ব্যাপক চর্চা শুরু হতে থাকে। মানুষ ক্রমেই পদার্থের ভৌত ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করতে শুরু করে। আর এই জ্ঞান যখন মানুষ মহাকাশে বিচরণশীল বস্তদের স্বরূপ উম্মোচনে ব্যবহার করে তখন থেকেই জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান এর জন্ম।

আজ জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান এর পদ্ধতি প্রয়োগ করে মহাবিশ্বের সৃষ্টিলগ্নের কাছাকাছি সময়ের ছবি আমাদের সামনে ভেসে উঠেছে, আবিষ্কার হয়েছে আমাদের সৌরজগতের মত আরও অনেক সৌরজগৎ। এসব আবিষ্কার একদিকে যেমন আমাদের জ্ঞান বৃদ্ধি করছে, তেমনি বিজ্ঞানের অন্যান্য শাখায়ও জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান-এর পদ্ধতি কাজে লাগছে। এসবের সামগ্রিক সুফল আমাদের সামাজিক জীবনে এসেছে।

আমাদের দেশের অনেক তরুণ-তরুণী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে পড়ালেখা ও গবেষণা করছে। তাদের  অনেকের গবেষণাপত্র খ্যাতিমান সাময়িকীগুলোতে প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের দেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কোন পড়ালেখা ও গবেষণার ক্ষেত্র এখনও তৈরি হয়নি। অথচ অনেক উন্নয়নশীল দেশ এ বিষয়ে সরকারি উদ্যোগে কাজ করছে। পার্শ্ববর্তী ভারত, চীন, এমনকি থাইল্যান্ড এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করে যাচ্ছে। এসব দেশ তাদের নিজ নিজ বিজ্ঞানীদের বিদেশ থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্র তৈরি করে দিচ্ছে। আমরা অনেক পিছিয়ে আছি।

বাংলাদেশ গেজেট-এ প্রকাশিত জাতীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নীতি ও কর্মপরিকল্পনা-২০১২ এর তথ্য অনুযায়ী ২৪৮ টি করণীয় বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। আনন্দের সংবাদ হল যে, জ্যোতির্বিজ্ঞান এর মধ্যে রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ৭৮ নম্বর করণীয় বিষয় হল "জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা ও জাতীয় মানমন্দির স্থাপন করা"। আর ১৪১ নম্বর করণীয় বিষয় হল "জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক স্নাতক কোর্স পরিচালনা ও  স্নাতকোত্তর গবেষণার সৃষ্টি করা"। কিন্তু এই দুই করণীয় বিষয়গুলো এখনও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হই নাই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে কাজ করতেন মেঘনাদ সাহা। এখানে থেকেই তিনি জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান এর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ করেছেন, আর তা হল সাহা'র আয়নন তত্ত্ব। জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান এর প্রতিটি ছাত্রকে এই তত্ত্ব পড়তে হয়। সুতরাং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি দায়িত্ব থেকে যায় জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্র তৈরি করা, যা তারা সহজেই করতে পারে। তদ্রূপ দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও এগিয়ে আসতে পারে। স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাল নজরুল ইসলাম তত্ত্বীয় কসমোলজি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানের কাজ করেছেন। এছাড়া, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে মফিজ উদ্দিন প্লাজমা জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করেছেন।

আমাদের দেশের অনেক ছাত্র-ছাত্রীরা জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে কাজ করতে অত্যন্ত উৎসাহী। এদের অনেকেই দেশে থেকে গবেষণা করেত চায়। অথবা বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে কাজ করতে চায়। এদের জন্য আমরা কি করব?

সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখনই যেটা করতে পারে, তা হল তাদের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান এর একাধিক কোর্স চালু করা। যারা জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী হতে চায় তারা এই কোর্সগুলো পড়বে। এরপর তারা স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্যায়ে একটি প্রজেক্ট বা থিসিস করতে পারে। জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে ব্যবহারিক জ্ঞান লাগে, সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বা অদূরে ছোট বা মাঝারি আকারের মানমন্দির স্থাপন করা যেতে পারে।

এ বিষয়গুলোতে পাঠদান এর জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক এখনই আমাদের রয়েছে। তারা এড-হক ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে পারে। বিদেশ থেকে আমরা পোস্টডক্টরাল ফেলো আনতে পারি যা আমাদের দেশের গবেষণাকে বহুধাপ উপরে নিয়ে যাবে। আবার আমাদের দেশ থেকে ছাত্র ছাত্রীরা বিদেশে গিয়ে প্রশিক্ষণ লাভ করে পারে। এভাবে একটি ভিত্তি তৈরি হলে একটা বড় মাপের মানমন্দির স্থাপন করা যেতে পারে। এর পর একটি সার্বজনীন গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে যেখানে আগ্রহী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গবেষণায় অংশগ্রহণ করবে।

একজন জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে আমি মনে করি বাংলাদেশের এখনই জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষা ও গবেষণা শুরু করা উচিত। আমরা যারা গবেষক ও শিক্ষক হিসেবে দেশের বাইরে আছি, আমরা দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে কাজ করতে এখনই তৈরি আছি। আশা করব মাননীয় সরকার এবং দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞান এবং জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞান বিষয়ের প্রসারে এগিয়ে আসবে।