মৃত্যু, এরশাদ ও শিশু স্বৈরাচারী

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 14 July 2019, 07:40 AM
Updated : 14 July 2019, 07:40 AM

মৃত্যু অমোঘ, অনিবার্য। সব মানুষকেই একদিন মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হয়। মানুষ মরে গেলে তার সঙ্গে অন্য সবার জাগতিক লেনদেন শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তার কর্মের দায় কী শেষ হয়? বেঁচে থাকাকালে যে মানুষটি কাজকর্ম অসংখ্য মানুষের জীবনের জন্য মহাক্ষতির কারণ হয়েছিল, মৃত্যুতেই কী তার সব কিছু চুকেবুকে যায়? জীবিতকালে যার কর্ম ও পদক্ষেপ অসংখ্য মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল, মরে গেলেই কী সে নিষ্কলুষ হয়ে যাবে? মৃত্যুর পর আমরা কী তাকে ক্ষমা করে দেব? তার জন্য শোক করব?

হ্যাঁ, এই প্রশ্নগুলো মাথায় আসছে এরশাদের মৃত্যু-সংবাদ পাবার পর। গত কয়েকদিন ধরেই তিনি মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন। কৃত্রিমভাবে তাকে শেষ কয়েক ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। আজ চিকিৎসকরা তার 'লাইফ-সাপোর্ট' তুলে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে সমালোচিত-নিন্দিত ব্যক্তিটির নব্বই বছরের জীবনের। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির একটা 'ইতিহাসের' পরিসমাপ্তি ঘটল। যদিও সেই ইতিহাসটি মোটেও গৌরবের নয়, বরং কলঙ্কের।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এরশাদকে আমরা কীভাবে মূল্যায়ন করব? তার অল্পকিছু সমর্থক ছাড়া তেমন কেউই এরশাদের ব্যাপারে ইতিবাচক কিছু বলতে পারবেন বলে মনে হয় না। বাংলাদেশের রাজনীতিকে যারা কলুষিত করেছেন, তাদের মধ্যে এরশাদ নিঃসন্দেহে অন্যতম শীর্ষ ব্যক্তিত্ব। শিল্পী কামরুল হাসান তার মৃত্যুর খানিক আগে যাকে 'বিশ্ববেহায়া' হিসেবে চিত্রিত করেছিলেন।

১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তারের সরকারকে হটিয়ে সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ লে. জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ক্ষমতা দখল করেন। ওই দিন বেতার ও টেলিভিশনে প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, জনগণের ডাকে সাড়া দিতে হয়েছে। তাছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প ছিল না। তিনি বাংলাদেশে দ্বিতীয়বারের মতো সামরিক শাসন জারি করে নিজেকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ঘোষণা করেন। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়লেও কোনো কিছুকে তোয়াক্কা করেননি সাবেক এই সেনাপ্রধান।

দায়িত্ব গ্রহণ করেই এরশাদের প্রথম আক্রমণটা আসে শিক্ষার উপর। এরশাদের শিক্ষামন্ত্রী ড. মজিদ খান ১৯৮২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর একটি নতুন শিক্ষানীতির প্রস্তাব পেশ করেন। ১ম শ্রেণি থেকেই আরবি ও ২য় শ্রেণি থেকে ইংরেজি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব করা হয়। সাম্প্রদায়িকতা, বাণিজ্যিকীকরণ আর সংকোচনের এই শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ ভাবে গর্জে ওঠে। ১৯৮৩ সালের ১৪ ও ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশের সঙ্গে ছাত্রদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কমপক্ষে পাঁচজন ছাত্র নিহত ও শতাধিক আহত হন। এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রথম বলি হলেন জয়নাল, কাঞ্চন, মোজাম্মেল, জাফর ও দীপালি সাহা। এরশাদের সেনাশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সেই প্রথম রক্ত ঝরে ঢাকার রাজপথে।

এর পর ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করতে এরশাদ সামরিক গোয়েন্দাদের ব্যবহার করে নানা পদ্ধতি প্রয়োগ করেন। ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, বিভিন্ন সংগঠন থেকে নেতা ভাগিয়ে এনে দল গঠন, টাকা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিয়ে, ভয় দেখিয়ে ছাত্র নেতাদের কব্জা করতে চাওয়া, নাশকতামূলক ঘটনা ঘটানো ইত্যাদি অনেক কিছুই করা হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত তার কোনো কৌশলই কাজে আসেনি। এক সময় ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে বাধ্য হয়ে তিনি তাঁর ছাত্র সংগঠন 'নতুন বাংলা ছাত্র সমাজ' বন্ধ করে দেন।

এরশাদের দুষ্কর্ম আর অপরাধের কোনো শেষ নেই। একটি নির্বাচিত সরকারকে উচ্ছেদ করে সংবিধান লঙ্ঘন করে ক্ষমতা দখল করা ছিল এরশাদের প্রথম অপরাধ। এরপর একের পর এক তিনি তার অপরাধের পাল্লা ভারী করেছেন। দমন-পীড়ন, নির্যাতন বিভিন্ন দলের নেতাকর্মীকে নির্বিচার গ্রেপ্তার ইত্যাদির মাধ্যমে গায়ের জোরে বিরোধী মত দমনের ক্ষেত্রে তিনিই ছিলেন বাংলাদেশে চ্যাম্পিয়ন। এরশাদের নয় বছরের শাসনে রাজনৈতিক দলগুলো ভাঙনের শিকার হয়। গোটা রাজনীতিকে কলুষিত করে নিজের দল গঠন চূড়ান্ত করেন তিনি। তাঁর গণবিরোধী ও বিতর্কিত সব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ছাত্র সংগঠন থেকে শুরু করে সমাজের সব স্তরের মানুষ রাজপথে সোচ্চার ছিল। এতে অসন্তুষ্ট ছিলেন এরশাদ। নয় বছরে শত শত মানুষকে তিনি হত্যা করেছেন। ১৯৮২ থেকে ১৯৯০ সাল ছিল স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে এদেশের ছাত্রজনতার প্রতিরোধ লড়াই ও রক্তদানের ইতিহাস। নূর হোসেন, জেহাদ, আর ডা. মিলন প্রমুখ এরশাদের দুঃশাসনের নির্মম বলি।

১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি চট্টগ্রামে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভায় এরশাদের নির্দেশে গুলি চালিয়ে পুলিশ ২৪ জনকে হত্যা করে। এর আগে ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ১৫ দলের নিশ্চিত বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে এরশাদ একটা যেন-তেন সংসদ প্রতিষ্ঠা করে টিকে যাওয়ার ধান্দা করেছিলেন। কিন্তু সংসদের ভেতরে এবং বাইরে এরশাদবিরোধী আন্দোলন তীব্ররূপ ধারণ করায় শেষ পর্যন্ত তিনি পিছু হঠতে বাধ্য হন।

১৯৯০ সালের ডিসেম্বরে ছাত্রজনতার প্রতিরোধ ও বিক্ষোভে দেশ উত্তাল হয়ে ওঠে। সে সময় ক্ষমতায় থাকার শেষ চেষ্টা হিসেবে আবার সামরিক আইন জারি করে এরশাদ ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন। তিনি সেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন দমন করতে জেলখানা থেকে থেকে চিহ্নিত সন্ত্রাসী, টোকাই এবং কুখ্যাত সন্ত্রাসী অভি বাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দেন। পুলিশি প্রটেকশনে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করেন। এই সন্ত্রাসী বাহিনীর হাতেই ২৭ নভেম্বর চিকিৎসক নেতা ডা. শামসুল আলম মিলনের মৃত্যু ঘটে। ডা. মিলন যখন রিক্সায় করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন তখন তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটে। সেনাবাহিনী এরশাদকে জানিয়ে দেয়, সমস্যার সমাধান করতে না পারলে এরশাদকেই তার দায় নিতে হবে, সেনাবাহিনী নিরপেক্ষ থাকবে।

কোথাও কোনো ভরসা না পেয়ে অবশেষে ডিসেম্বর মাসের চার তারিখে জেনারেল এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দেন এবং ৬ ডিসেম্বর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন।

প্রায় নয় বছরের এরশাদ শাসনের মূল দিক ছিল ক্ষমতার এককেন্দ্রীকরণ, প্রশাসনিক বা প্রতিনিধিত্বের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকাশ রোধ করা এবং দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ। এই প্রবণতাগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে আগেও ছিল। এরশাদের পূর্বসূরি জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে  এর কিছু লক্ষণ দৃশ্যমান হয়। কিন্তু এরশাদের আমলে এই প্রবণতাগুলো সরকার ও শীর্ষ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তির লক্ষ্য হিসেবেই প্রতিভাত হয়। সে কারণে ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি সারা পৃথিবীতে 'রিচেস্ট প্রেসিডেন্ট অব দ্য পুওরেস্ট কান্ট্রি' (সবচেয়ে গরিব দেশের সবচেয়ে ধনী প্রেসিডেন্ট) পরিচয়ে পরিচিত হন।

এরশাদের অসংখ্য দুষ্কর্মের একটি ছিল সংবিধানে 'রাষ্ট্রধর্ম' যোগ করা। ১৯৮৮ সালের ৫ জুন চতুর্থ জাতীয় সংসদে সংবিধানের অষ্টম সংশোধনী পাস হয়। সেই সংশোধনীতে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়। এর মাধ্যমে কার্যত দেশের ভিন্ন ধর্মের নাগরিকদের 'দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক' বানিয়ে দেওয়া হয়।

দুর্নীতি দমনের অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করে তিনি দেশটিকে একটি তস্করতন্ত্র বা ক্লেপ্টোক্র্যাসিতে পরিণত করেছেন। স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে জেনারেল জিয়াউর রহমানের পদাঙ্ক অনুসরণ করেই পুনর্বাসিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের প্রকাশ্যে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছেন। পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন।

বন্দুকের নলের জোরে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদ গোটা দেশকে জিম্মি করে রেখেছিলেন। জিয়া, মোশতাক ও বিচারপতি সায়েম কর্তৃক জারি করা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার কোনো পদক্ষেপ নেননি। দুর্ভাগ্যজনক যে, জাতির জনকের ওই সব আত্মস্বীকৃত খুনিকে রাষ্টদূত পদে থাকতে দিয়ে যে অন্যায় তিনি করেছিলেন, তার জন্য তাঁকে শাস্তি ভোগ করতে হয়নি। এরশাদের বিচার এবং শাস্তি হয়নি জাফর, জয়নাল, মোজাম্মেল, কাঞ্চন, দীপালি সাহা, শহীদ নূর হোসেন, ডাক্তার মিলন, জেহাদ, নিমাইসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যার জন্য।

বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, তীব্র ছাত্রগণআন্দোলনের ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরও দীর্ঘ প্রায় ত্রিশ বছর এরশাদ দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করে গেছেন। কখনও বিএনপি, কখনও আওয়ামী লীগের পক্ষে গিয়ে বাগিয়ে নিয়েছেন 'মুক্তজীবন'-এর অধিকার। কারণ বিচারপতি সাহাবুদ্দিন এবং পরে বেগম খালেদা জিয়ার আমলে তার বিরুদ্ধে যে মামলাগুলো দেওয়া হয়, সেগুলো ঠিকঠাকভাবে চললে এরশাদকে আমৃত্যু জেলখানায় কাটাতে হতো। কিন্তু তার সৌভাগ্য, আর আমাদের দুর্ভাগ্য যে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির কারণে এদেশে সেটা সম্ভব হয়নি। একজন স্বৈরাচারী সারাজীবন চরম ঔদ্ধত্য দেখিয়ে রাজনীতির আসরে 'মহাবাজিগর' হয়ে 'ডুগডুগি' বাজিয়ে গেলেন। পৃথিবীর আর কোনো দেশে পতিত কোনো স্বৈরাচারী শাসকের রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হওয়ার দৃষ্টান্ত আছে বলে আমার জানা নেই। কিন্তু বাংলাদেশে এরশাদ এবং তার দল জাতীয় পার্টি দাপটের সঙ্গেই টিকে আছে। নব্বই-পরবর্তী গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত শাসকরাই সেই সুযোগ করে দিয়েছেন। সেটা কতটা ঠিক আর কতটা অসঙ্গত সে আলোচনাটা যেমন চালিয়ে যেতে হবে একই সঙ্গে এরশাদের স্বৈরশাসন বা অপশাসন নিয়ে আলোচনাটাও চালু রাখা চাই। মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে যেন একজন স্বৈরাচারী শাসকের যাবতীয় পাপ ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে না যায়!

এরশাদের সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য হলো, তার পরে যারা রাষ্ট্র চালিয়েছেন তারা এরশাদকে 'শিশু-স্বৈরাচারী'তে পরিণত করেছেন। এ ব্যাপারে নিজেরাই 'বড়ো' হয়ে উঠেছেন! বিষয়টিও আরও বিস্তারিতভাবে আলোচনা হওয়া দরকার। ইতিহাসে কার কী ভূমিকা, সেটা যথযথভাবে মূল্যায়ন না হলে আমাদের ইতিহাসের অভিশাপ বহন করতে হবে।