বেড়ে উঠি সন্তানের সঙ্গে

স্বদেশ রায়
Published : 11 July 2019, 11:50 AM
Updated : 11 July 2019, 11:50 AM

জীবনে একবার যেমন পিতা-মাতা ও শিক্ষকের হাত ধরে বেড়ে উঠতে হয়। তেমনি জীবনে আবার বেড়ে উঠতে হয় সন্তান বা সন্তানদের হাত ধরে। সন্তান পিতা-মাতারই সৃষ্টি কিন্তু সে ভিন্ন প্রজন্ম, তার সময়, তার চার পাশ তার ভেতরের চাহিদা সবই ভিন্ন। তাই সে বেড়ে উঠবে নতুন আরেকটি প্রজন্ম হিসেবে। এই সময়ে বাবা-মা যদি সন্তানকে তার প্রজন্মের মতো করে তৈরি করতে চায় তাহলে স্বাভাবিক একটি প্রচ্ছন্ন কনফ্লিক্ট তৈরি হয় অবচেতনভাবে সন্তান ও বাবা মায়ের সঙ্গে। অবচেতনভাবে দূরত্ব তৈরি হয়। আর একজন সন্তানের জন্য, তার জীবনের জন্য সব থেকে ভয়ঙ্কর হচ্ছে বাবা মায়ের সঙ্গে দূরত্ব। সাধারণত আমরা মনে করি, সন্তান যখন বাবা-মায়ের কথা শোনে না তখনই মনে হয় সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। বাস্তবে এটা আংশিক সত্য, বাবা-মায়ের সঙ্গে অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের পরেও সন্তানের সঙ্গে বাবা মায়ের দূরত্ব থাকে। এই দূরত্ব হয়, বাবা-মা ও সন্তানের ভেতর প্রজন্মের গ্যাপ আর চিন্তা চেতনার গ্যাপ।

প্রকৃতি তার নিজস্ব ধারায় নতুনকে একটি নতুন চিন্তা দেবে, নতুন ভাবনা দেবে, তার জন্য একটি নতুন ভবিষ্যত দেবে। তাই তো প্রকৃতি চির নতুন। এ কারণে একজন সন্তান তাই সে যেই হোক না কেন, সে বেড়ে উঠবে তার সময়ের সঙ্গে, নতুন বা ভবিষ্যতমুখী হয়ে। বাবা-মায়েরা তাকে তাদের নিজস্ব জগতে অর্থাৎ তাদের সময়ের জগতে টেনে আনার চেষ্টা করে হয় তাকে বন্ধ্যা একজন মানুষ তৈরি করে, না হয় তাকে বিপথে যেতে বাধ্য করে। আর এই বন্ধ্যা মানুষ তৈরি করার ফলে সমাজ ও রাষ্ট্র এগোয় না। রাষ্ট্র এখন যতই সমাজকে গ্রাস করুক না কেন, সমাজের নিজস্ব বা সয়ম্ভু একটি শক্তি আছে। এই শক্তির কারণে সমাজকে কখনই কোন রাষ্ট্র শতভাগ গ্রাস করতে পারবে না। কারণ, সমাজের বয়স অনেক দীর্ঘ, তার শেকড় অনেক গভীরে প্রোথিত। অন্যদিকে পৃথিবীর সব রাষ্ট্রের বয়স অনেক কম। তাই সমাজকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, গ্রাসও করতে পারবে না। সমাজ হাজার হাজার বছর ধরে প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত হয়ে যেভাবে বেড়ে চলে, তাকে কোন মতবাদ দিয়েও শতভাগ গ্রাস করা যায় না। আমরা নিজেরা যেমন এই সমাজের একটি উপাদান আমাদের মনে রাখা দরকার আমাদের সন্তানরাও তেমনি একটি। আর সমাজ বা প্রকৃতি নিজহাতে ঠিক করে দিয়েছে, আমরা কিছু সময় বেড়ে উঠব, পিতা-মাতার হাত ধরে, কিছু সময় নিজ পায়ে আর সে সময়ে অনেকখানি পরিবর্তিত হব সন্তানের সঙ্গে। আর আমাদের পরিবর্তিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সন্তানও তার নিজস্ব রূপ পাবে এই পৃথিবীতে।

বাবা-মা যখন এভাবে সন্তানের সঙ্গে বেড়ে ওঠে, তখন সন্তানের আর দশজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর মতোই বা তার থেকে আরও ঘনিষ্ঠতম বন্ধু হয় বাবা-মা। বাবা-মা যখন সন্তানের বন্ধু হয় তখন তারা জানতে পারে প্রতি মুহূর্তে সন্তানের মনের চাহিদা। সন্তান যখন বুঝতে পারে তার মনের গানটি মা-বাবার মনে দোলা দিচ্ছে তখন সে আনন্দিত হয়। আর আনন্দিত মানুষ মানেই সুন্দর মানুষ। এই সুন্দর মানুষটি তখন ওই গানের ভেতর সুন্দরতম উপাদানগুলো খোঁজে। এমনিভাবে প্রতিটি কাজের সঙ্গী হয়ে, ভালবাসার মানুষ হয়ে আমরা সন্তানকে নিয়ে যেতে পারি আনন্দ সুন্দর এক জগতে। এখানে বাবা-মায়ের শিক্ষা খোঁজা দরকার প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতি কিন্তু সর্বোচ্চ স্বাধীনতা ও আনন্দের মধ্যে কোথায় যেন একটি ছন্দ দিয়ে সকলকে বেঁধে রেখেছে। বাবা-মাকেও তাই তার সন্তানকে বাঁধতে হয় ছন্দ দিয়ে, শাসন দিয়ে নয়। গানের ছন্দ, কবিতার ছন্দ যেমন কখনই গান বা কবিতাকে সুর লয় থেকে দূরে নিয়ে যেতে পারে না বরং সুমধুর এক বাঁধনে তাকে বেঁধে রাখে। সন্তানকে তেমনি ছন্দ দিয়ে বেঁধে রাখলে সে সুমধুর বাধনে বাধা থাকে। আর এখানেই আমরা বড় একটা ভুল করি, আমরা সন্তানকে স্নেহের বাধনে বাঁধতে গিয়ে কোথায় যেন ছন্দ হারিয়ে শেষপর্যন্ত অনুসরণ করি জেলখানার জেলারকে বা থানার দারোগা পুলিশকে। এমনকি ভালবাসার যে আতিশয্য তাও এক সময়ে জেলখানার কঠোরতায় রূপ নেয়। যেমন সন্তানকে ভাল রেজাল্ট করানোর জন্য এখন আমরা যে ইঁদুর দৌড়ে আছি, এখানে মা-বাবা সবাই এক একজন তৃতীয় বিশ্বের জেলখানার জেলার না হয় থানার দারোগা। সন্তানকে ভাল শিক্ষা দেবার নামে, প্রতিযোগিতায় প্রথম তৈরি করার জন্য তার শিশুকালেই যে তার মন থেকে সব আনন্দগুলো চুষে নিচ্ছি, তার ভেতরের কুসুমগুলোর পাপড়ি যে ছিঁড়ে ফেলছি সে দিকটা আমরা কেউ দেখছি না। আবার কোন কোন বাবা মা আছেন, সন্তানের মোটেই কাছে না যাবার ফলে, নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে বা সন্তানের সঙ্গে বেড়ে ওঠার তাগিদ না থাকায় সন্তানের মনের ভেতরের আনন্দের ফুলগুলো ফোটাতে ব্যর্থ হচ্ছে। বাবা-মা হিসেবে তার ভেতর যে আনন্দের ফুল ফোটানোর দায়িত্ব ছিল সেটা করা হচ্ছে না।

তাই অনাদরে যে ফুল ফুটছে আর জেলখানা বা থানার দারোগার অধীনে যে ফুল ফুটছে দুই নানাভাবে নানান আকার নিচ্ছে। পাচ্ছে না তাদের আনন্দ কুসুমিত বিকাশের পথ। যে কারণে তারা চলে যাচ্ছে, সমাজের নানান ভ্রান্তির পথে। কেউ বা ধর্মের নামে মানুষ হত্যা করতে যাচ্ছে। কেউ রাজনীতির নামে একে অপরকে দা দিয়ে কোপাচ্ছে। ধর্ম নিয়েও ব্যবসা হয়, রাজনীতি নিয়েও ব্যবসা হয়। এই দুইয়ের সমাজ জীবনে যেমন প্রয়োজনও আছে তেমনি বর্তমান পৃথিবীতে এই দুই নিয়ে ব্যবসা চলছে বেশি। কেন এই দুই নিয়ে ব্যবসা চলছে সে প্রসঙ্গ লিখতে গেলে এই লেখা ভিন্ন দিকে চলে যাবে। তাছাড়া আকারও অনেক বড় হয়ে যাবে। তবে সংক্ষেপে এটুকু বলা যায়, পৃথিবী এ মুহূর্তে সামাজিক ও রাজনৈতিক এক পরিবর্তনের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। পৃথিবী এ মুহূর্তে মহাভারতের কুরুক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে। এখানে কেউ যদি অর্জুনের মতো দিব্য চোখ পায়, সে দেখতে পাবে, সকলে স্বজন হত্যায় উন্মত্ত। কেউ হয়তো দ্রৌপদির মতো বলবে একটা মহাযুদ্ধ হোক যদি তাতে শান্তি আসে। কিন্তু পৃথিবী তার হাজার বছর পথ চলায় দেখেছে অস্ত্র দিয়ে কোন যুদ্ধই শেষ পর্যন্ত শান্তি আনে না। সেখানে স্বজন হত্যা হয়। আর মায়ের কোল খালি হয়। বোনের আব্রু নষ্ট হয়।

তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ নয়, মানুষের প্রয়োজন যার যার নিজের জীবনে যুদ্ধ করা। নিজের জীবনে যদি আনন্দ প্রতিষ্ঠার জন্য, সুন্দরকে প্রতিষ্ঠার জন্য মানুষ যুদ্ধ করে তাহলে সেই এক একটি জীবনের যুদ্ধই মহাযুদ্ধ। এই মহাযুদ্ধে যেমন নিজের জীবনে আনন্দ ও সুন্দরকে বিকশিত করতে হয়, তেমনি সন্তানের সঙ্গে বেড়ে ওঠে, সন্তানকে জেনে, সন্তানকে জানিয়ে তার জীবনে আনন্দ, সুন্দরকে বিকশিত করতে হয়। সন্তানের জীবনে আনন্দ ও সুন্দরকে বিকশিত করতে হলে তাকে শুধু প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে বেড়ে ওঠার আনন্দের মধ্যে রাখলে চলবে না। ওই প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়ে সে যেন আনন্দ কলায় প্রবেশ করতে পারে সে পথেও তাকে নিয়ে যেতে হবে। আমাদের রাষ্ট্র আমাদের সমাজে আনন্দ কলায় প্রবেশের পথ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে সব সময়। কিন্তু রাষ্ট্রকে এ পথ খুলতে প্রতিটি বাবা ও মাকে এগিয়ে আসতে হবে। তারা যদি তাদের সন্তানকে বইয়ের জগতে নিয়ে যেতে চায়, গানের জগতে নিয়ে যেতে চায়, নিয়ে যেতে চায় নানান আনন্দ সৃষ্টির ভুবনে। সন্তানের হাত ধরে একটা মুহূর্ত নদীর দিকে তাকালেও সন্তান দেখতে পায় নদীর জল কি অবিরাম ছুটে চলেছে সাগরের দিকে। অর্থাৎ বৃহতের সঙ্গে জীবনকে মেলানোর কী উদ্দাম ইচ্ছে! একটি মুহূর্ত যদি শহরের বন্দি দশা থেকে একটু বাইরে গিয়ে নির্মল বাতাসের ভেতর দাঁড়ায় সন্তানের দুপাশে বাবা ও মা, সন্তান উপলব্ধি করবে বাতাস কীভাবে বাবা ও মায়ের মতো চারপাশ ভরে আছে। অর্থাৎ আমি মানুষ আমাকেও বাতাসের মতো মানুষের চারপাশে ভরে থাকতে হবে। অথচ আমার উপস্থিতির প্রকাশ সেখানে বড় নয়। এভাবেই তো সুন্দর ও আনন্দের শিক্ষা আসবে। আর আসলে বাবা ও মা যদি এভাবে সন্তানকে বাতাসের মতো চারপাশ ভরে রাখতে পারে তাহলে আমাদের সন্তানদের নষ্ট রাজনীতি, ধর্ম ব্যবসা এগুলো গ্রাস করতে পারে না। সন্তান হয় না নয়ন বন্ড, সন্তান হয় না ফরাজী, কখনোই হবে না আমাদের সন্তান ধর্ষক। কখনোই হবে না জঙ্গী। মানব জীবনের প্রতি পরতে ধর্ম পালন করতে হয়। সন্তানের সঙ্গে বেড়ে ওঠাও পরম ধর্ম বলেই মেনে নিতে হবে জীবনে। ওই সব বন্ড, ধর্ষক বা জঙ্গিদের বাবা মায়ের ব্যর্থতাই সব থেকে বেশি। রাষ্ট্র, রাজনীতি, ধর্ম ব্যবসা এদের ছোবল থেকে বাঁচিয়ে সন্তানকে মানুষ করতে হবে, যেমন করে প্রকৃতিতে প্রতিটি জীব অনেক ছোবল থেকে বাঁচিয়ে তার নিজ নিজ সন্তানকে বড় করছে, লালন করছে।