ড. মাসুদ মাহমুদের নামটি গণমাধ্যমের কল্যাণে ইতিমধ্যে অনেকেই জেনে গেছেন। নিজের ক্যাম্পাসে তার শরীরে কেরোসিন ঢেলে দেয়া হয়েছে। তার সৌভাগ্য যে শেষ পর্যন্ত সেই কেরোসিন মাখা শরীরে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়নি। আগুন ধরিয়ে দিলে তাকেও হয়তো নুসরাতের পরিণতি ভোগ করতে হতো! কিন্তু সেটাই কি বেশি ভালো ছিল না? এভাবে বেঁচে থেকে অপমানে দগ্ধ হয়ে তিলে তিলে মরার চেয়ে আমাদের এই পোড়ার দেশে আগুনে পুড়ে মরে যাওয়াটাই কি অধিক কাঙ্ক্ষিত নয়?
ভদ্রলোকের সম্পর্কে যতই জানছি, ততোই অবাক হচ্ছি। এমন একজন প্রবীণ অধ্যাপককে কী করে এভাবে অপমান-অপদস্থ করা যায়? পুরো বিষয়টা শোনার পর শরীরটা অবশ হয়ে যাচ্ছে! কোথায় চলেছি আমরা? কোথায় চলেছে আমাদের স্বদেশ? স্রেফ স্বার্থের জন্য একজন প্রবীণ শিক্ষকের প্রতি ছাত্র-শিক্ষকরূপী কিছু ইতরের এ কোন পৈশাচিক আচরণ!
ড. মাসুদ মাহমুদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে চার দশক অধ্যাপনার পর সদ্যই অবসরে গেছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত খ্যাতিমান। তাঁর প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীরা সবাই ছিল তাঁর মুগ্ধ অনুরাগী। তিনি দারুণ পড়াতেন। তাঁর হিউমার ছিল সুবিদিত। এমন সব 'উইটি' কথা বলতেন খুব গম্ভীর বিষয় পড়ানোর সময়ও না হেসে উপায় থাকতো না। আপাদমস্তক জ্ঞানপিপাসু এই মানুষটি ক্লাসরুমের বাইরে কখনোই নিজেকে মানাতে পারেননি। শেষ বয়সে ক্লাসরুমে পারলেন না!
অবসরের পর তিনি ইউএসটিসি নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান করেছিলেন। মাস তিনেক আগে সেখানকার ২২জন ছাত্রছাত্রী (যদিও পরে জানা গেছে তাদের বেশিরভাগেরই স্বাক্ষর নকল করা হয়েছে) তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে যে তিনি ক্লাসে যৌনতা বিষয়ক অপ্রাসঙ্গিক আলোচনা করে তাদের বিব্রত করে থাকেন। এই অভিযোগ এক সরকারদলীয় ছাত্রনেতার হাত ধরে পৌঁছায় শিক্ষা উপমন্ত্রীর কাছে, যিনি অধ্যাপক মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্তের নির্দেশ দেন পুলিশ প্রশাসনকে। তার পর থেকেই তাকে নিয়ে একটি বিশেষ মহলে রসালো আলোচনা শুরু হয়।
কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উন্মোচিত হয় এক ভিন্ন ষড়যন্ত্রের আখ্যান। জানা যায় তিনি ইউএসটিসিতে যোগদানের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পাঠদানে অদক্ষতার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করেন। এই কমিটির প্রধান ছিলেন ড. মাসুদ। চাকরিচ্যুতদের ক্ষোভ এসে পড়ে তাঁর ওপর। এর সঙ্গে যোগ হয় ক্লাসে অনুপস্থিত থাকা ও শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে পরীক্ষা দিতে না-পারা কিছু শিক্ষার্থী। এই দুই পক্ষ মিলে বেশ কিছুদিন ধরেই ড. মাসুদের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের আন্দোলন গড়ে তোলার ব্যাপারে প্ররোচিত করছিলেন। একটি রাজনৈতিক সংগঠনের কিছু কর্মীকেও নাকি এই প্রচেষ্টায় অর্থের বিনিময়ে যুক্ত করা হয়। এসব চেষ্টার ফলশ্রুতিতেই শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক মাহমুদের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও ক্লাসে অবান্তর প্রসঙ্গ পড়ানোর অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু হালে পানি পায়নি সেই অভিযোগ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের তদন্ত কমিটিও অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায়নি।
এই ব্যর্থতার পর ষড়যন্ত্রকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তারা সরাসরি আক্রমণ করে ড. মাহমুদের ওপর। ড. মাহমুদের ভাষায়: ''ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যানের কক্ষে ছিলাম আমি। হঠাৎ করে কয়েকজন ছাত্র এসে ঢুকল। ওদের একজন আমাকে বলল, ''ওঠো মিয়া, বের হও, তোমার চাকরি নাই…।'' ওদের চেহারায় আক্রোশ আর কথা বলার ধরন দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম কিছু একটা পরিকল্পনা করে এসেছে ওরা। আমি দ্রুত বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একজন আমার হাত ধরে ফেলল, "না, এইভাবে চলে গেলে হবে না, মাপ চাইতে হবে, যা করেছ, তার জন্য সবার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।"
আমি চেয়ারম্যানের কামরা থেকে বেরিয়ে লিফটের দিকে এগিয়ে গেলাম। ওরা কয়েকজন আমার সঙ্গে উঠে পড়ল লিফটে। নিচতলায় নামার পর ধাক্কা দিতে দিতে আমাকে ওরা নিয়ে গেল বাইরে। ক্যাম্পাসের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারিদের সামনে একজন শিক্ষককে ওরা কেউ ধাক্কা দিচ্ছে, কেউ জামার কলার ধরে টানছে… ভাবতে পারেন! আটষট্টি বছর বয়স আমার…, কর্মজীবনে শিক্ষকতা ছাড়া আর কিছুই করিনি…। কিছু ছাত্র আমার সঙ্গে এই আচরণ করতে পারল! একজন ছাত্র আমার গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিল…। এই স্মৃতি সারাজীবন ভুলতে পারব আমি?''
একজন শিক্ষকের সঙ্গে যে আচরণ করা হয়েছে, তা সত্যিই আমাদের মাথাকে হেঁট করে দেয়। সামান্য স্বার্থ ও সুবিধার জন্য আমারা কত নীচে নামব? আর এ ব্যাপারে মন্ত্রী কিংবা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের ভূমিকাই বা এমন হবে কেন?
অনেকেরই অভিযোগ, শিক্ষার্থীদের একটা গ্রুপ যখন মাসুদ মাহমুদের বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের কাছে যায়, তখনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তপক্ষের হাতে এর সুরাহার দায়িত্ব দিতে পারতেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে পাশ কাটিয়ে পুলিশকে তদন্ত করতে বলার কারণে এই উশৃঙ্খল তরুণরা উৎসাহিত হয়েছে, তারা মনে করেছে উপমন্ত্রী নওফেলের সমর্থন তাদের দিকে আছে। পরবর্তী সময়ের ঘটনাপ্রবাহে তার প্রমাণও পাওয়া যায়। উশৃঙ্খল শিক্ষার্থীরা দিনের পর দিন প্রবীণ এই শিক্ষককে নাজেহাল করে গেছে, কেউ তাদের থামতে বলেনি। তারই ধারাবাহিকতায় গায়ে কোরোসিন ঢেলে দেবার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। মন্ত্রী নওফেলের উচিত অবিলম্বে শিক্ষক অবমাননার এই ঘৃণ্য ঘটনার অবসান ঘটানো এবং অপরাধীরা যেন শাস্তি পায়, তা নিশ্চিত করা। তা না হলে তিনি নিজেও এই ঘটনায় একজন অভিযুক্ত হিসেবে বিবেচিত হবেন।
এখানে আরেকটি কথা। সাহিত্যের ক্লাসে নরনারীর সম্পর্ক নিয়ে কথা উঠতেই পারে। এ বিষয়ে কথা বলা যাবে না এমন নিয়ম জারি করা হলে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্লাসে এনাটমি ফিজিওলজির পাঠদানও প্রশ্নের সম্মুখীন হয়ে পড়বে। আমরা জানি ইডিপাস রেক্স, হ্যামলেট ও সানস অ্যান্ড লাভার্সের মতো পৃথিবীখ্যাত বইয়ে মা ও ছেলের মধ্যে আকর্ষণের বিবরণ বা ইঙ্গিত রয়েছে; নবোকভের লোলিটায় রয়েছে বাবা ও মেয়ের সম্পর্কের কথা। এসব আলোচনা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে না হয়, তবে হবে কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুম হলো সীমানাবিহীন আলোচনার একটি জায়গা। এখানে যদি আমরা এটা আলোচনা করা যাবে, ওটা যাবে না, এটা শ্লীল, ওটা অশ্লীল-এমন সীমারেখা টেনে দিই, তাহলে সেটা কী বিশ্ববিদ্যালয়ের মৌলিক ধারণার পরিপন্থী নয়? তবে কী আমরা বিশ্ববিদ্যালয় কনসেপ্টের কবর রচনা করে মুক্তচিন্তার চর্চার পরিবর্তে কিন্ডারগার্টেন শিক্ষায় মনোনিবেশ করব?
আমরা অনেকেই প্রতিবাদের নামে হুজুগে মাতি। যখনই যৌনতা কিংবা যৌন হয়রানির কোনো বিষয় সামনে আসে আমরা কোনো কিছু না-জেনে না-বুঝেই অনেকে অসহিষ্ণু হয়ে যাই। তখন অনেকের কাছে অপরাধটা গৌণ হয়ে প্রতিবাদটাই বড় হয়ে দাঁড়ায়। তাই রাস্তায় আহতকে সাহায্য করার লোকের দেখা না পেলেও হাসপাতালে মৃত মানুষের জন্য ভাঙচুর করার লোকের অভাব হয় না। যাঁরা সেই প্রতিবাদে অংশ নেন, দেখা যায় তাঁরা অনেকে মূল ঘটনাটা জানেনই না। অর্থাৎ ব্যাপারটা আদৌ প্রতিবাদ নয়, বরং এক রকমের প্রতিশোধ! একটি ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে আমরা যে যার নিজের নিজের প্রতিশোধ নিয়ে চলি। শিক্ষকরা এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন।
এই হিংসাত্মক প্রতিক্রিয়ার নিন্দা জানানো আজ খুবই জরুরি। একজন শিক্ষককে প্রকাশ্যে অপমান করা, তুই-তোকারি করা, গায়ে কেরোসিন ঢেলে দেওয়া-এগুলো কোনো সভ্য মানুষের কাজ নয়। আমাদের বোধহয় বলার এবং ভেবে দেখার সময় হয়েছে, এমন ঘৃণ্য আচরণ কেন? কেন এই আদিম প্রতিশোধ?
আমরা অন্যায়ের প্রতিবাদ অবশ্যই করব (যেটা সচরাচর করি না)। কিন্তু কিসের প্রতিবাদ করছি, আর কী চাইছি, সেটা যেন পরিষ্কার থাকে। না হলে তার ফল কারও পক্ষেই শুভ হবে না।
ড. মাসুদ মাহমুদের ব্যাপারে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজের ভূমিকা খুবই হতাশাব্যঞ্জক। একজন শিক্ষককে এভাবে অপমান-অপদস্থ করা হচ্ছে, অথচ আমাদের দেশের শিক্ষক সমিতিগুলো নীরব। নিজেদের বেতন-ভাতা বাড়ানোর আন্দোলন ছাড়া এই দেশের শিক্ষক সমিতিগুলোর যেন আর কোনো ভূমিকা নেই। একজন শিক্ষককে অন্যায়ভাবে হেনস্থা করা হচ্ছে, এ ব্যাপারে যেন দর্শক হওয়া ছাড়া তাদের আর কিছু করার নেই! ধিক এমন শিক্ষক সমিতিকে!
ড. মাসুদের ঘটনাটি বর্তমান পর্যায়ে আসার পেছনে ক্ষমতাসীনদের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যাবে না। এটা 'ক্ষমতার নীতি'ও বটে। ক্ষমতাসীনরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শান্তি-শৃঙ্খলা ফেরাতে যত্নবান হবেন বা ছাত্র-শিক্ষকদের নিয়ে দলবাজির অনাচার দমন করবেন-এমনটা দুরাশামাত্র। দলবাজি আর দলতন্ত্র এখন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে। রাজনীতিকের অনুগামী মাস্তানরা সরাসরি শিক্ষা প্রশাসনের অলিন্দে হাজির হয়ে চেয়ার দখল করে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। কালের নিয়মে শাসকের পতাকা হয়তো এক দিন বদলাবে, কিন্তু শিক্ষার পরিসরে নীতিহীন গুন্ডামির এই নতুন ধারা বদলানো নিঃসন্দেহে কঠিন। তাতে অবশ্য ক্ষমতাসীনরা সন্তুষ্ট হয়ে মনে মনে বলতে পারেন, যা করে গেলাম, তা 'স্থায়ী বন্দোবস্ত' হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হবে!
হবেও হয়তো! এখন যে বিকৃতিতেই সুখ! ক্ষমতাসীনদের এই বিকৃতি সম্ভবত আরও বেশি! আর বেঁচে থাকারও মানে বদলে গেছে। নিজের সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বাঁচা নয়, আমাদের এখন অন্যের মন যুগিয়ে চলে কেবলই 'খাঁচায় বাঁচা!'