হায় সেলুকাস, আওয়ামী নেতার মুখে জামায়াতের কথা!

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 5 July 2019, 03:24 PM
Updated : 5 July 2019, 03:24 PM
রাজনীতিতে আদর্শ বলে যে এখন কিছু আর নাই সেটা সবাই জানেন। কিন্তু কতটা নাই? সম্প্রতি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের যে বক্তব্য তাতে রীতিমত চমকে উঠেছি। সাধারণ সম্পাদক যখন কিছু বলেন তখন তো ধরে নিতেই হবে এটা তাদের দলের কথা । তাই যদি হয় আমাদের প্রশ্ন তো মাথাচাড়া দেবেই। আওয়ামী লীগের সম্পাদক তো তাজউদ্দীনও ছিলেন। সেই তাজ যিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মুকুট। এই দলের নেতা আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ওবায়দুল কাদেরের আগে দলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের পুত্র সৈয়দ আশরাফ। এদের একজনও বেঁচে থাকলে এই বক্তব্যের পর কী করতেন জানিনা, তবে অনুমান করি আত্মহননের পথ বেছে নিলেও অবাক হতাম না।
এই বক্তব্যের পেছনে কী কী কারণ কাজ করেছে? ভিডিওতে দেখলাম দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযানের শুরুতে এমন বক্তব্য দিয়েছেন ওবায়দুল কাদের। ধন্যবাদ তাকে। রাখঢাক করেননি। সরাসরি বলেছেন সাতচল্লিশ বছর পর কে স্বাধীনতা বিরোধী আর কে দালাল তা নিয়ে তর্ক করার কোন কারণ দেখেন না তিনি। কারো পরিবারে যুদ্ধাপরাধী থাকলেও সেটা বিবেচনায় না আনারও পরামর্শ দিয়েছেন। এটা আমি মানি যে জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক বড়। কোন দাগী দালাল বা রাজাকারের সন্তান যদি মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অনুগত হয়, পিতা বা পূর্বসূরীর কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে মাপ চেয়ে সঠিক পথে ফিরে আসে সেটা নিশ্চয়ই আমলে নেওয়ার মতো ঘটনা।
আমি কম্বোডিয়া গিয়েছিলাম যুদ্ধাপরাধী আর লড়াই করে স্বাধীনতা পাওয়া দেশটিকে জানতে। নমপেনের যাদুঘর দেখা এক ধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একদিকে যেমন ভয়াবহতার সব প্রমাণ, আরেকদিকে আশ্চর্যজনকভাবে ঝোলানো সে দেশের দালালদের মার্জনা বা মাপ চাওয়ার দলিলপত্র। যেখানে তারা অতীতের জন্য মাপ চেয়ে শুদ্ধ পথে ফিরে আসার করুণা চেয়েছে। এমন যদি হতো আমরাও নিশ্চয়ই ভেবে দেখতাম। কিন্তু কাদের নিশ্চিতভাবে জানেন, আমাদের রাজাকার বা যুদ্ধাপরাধীরা তা করেনি। তাদের বংশধর বা উত্তরাধিকারের ভেতরও তেমন কোন কিছু করার প্রমাণ নাই। বরং আমরা দেখছি যে যায় লংকায় সেই ই রাবন। যে যখন যেখানে, সেখানেই মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ বিরোধী চক্রান্ত।
প্রশ্ন দিয়েই শুরু করি। এটাই যদি আওয়ামী লীগের ভাষ্য হয়, তো এই সেদিন  দেশব্যাপী এত আলোড়ন তুলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি দেবার কী দরকার ছিল? যাদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, তাদের পাপ বা কৃতকর্ম তো সেই সাতচল্লিশ বছর আগের কাজ। সেগুলো কেন তামাদি মনে হয়নি? একের পর এক তাদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এখন বলছেন সেসব অতীত নিয়ে কথা বলার কী আছে! এই দ্বিচারিতার মানে কী? দেশব্যাপী যে আন্দোলন শাহবাগের গণজাগরণ নাস্তিক ট্যাগ খাওয়া যুবকগুলোর মৃত্যু সব কী তাহলে খেলা? না কোনও পাতানো ছক? এ প্রশ্ন তো এখন উঠতেই পারে। ট্রাইবুনালে যারা জানবাজী রেখে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিয়েছেন, যারা বিচারক- তারা সবাই ভুল? এ এক আশ্চর্য সমাজ। এ এক অদ্ভুত দেশ আমাদের।
মানুষ মনে করে আওয়ামী লীগ ই মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দল। সেটা এতিহাসিকভাবে সত্য। কিন্তু এসব কথাবার্তার মাধ্যমে প্রমাণ হয় একসময় হয়তো দলটিও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করতে পারে। যে বিষয়টা কিছুতেই মাথায় ঢুকছে না এমন বক্তব্য প্রকাশ্যে দেয়ার আগে কাদের সাহেব কি একবারও ভাবেননি? তার দলের সভাপতি কী এ বিষয়ে কিছুই জানতেন না? এমন এক ধরনের আত্মঘাতী কথা বলার আগে সম্পাদক নিশ্চয়ই এর গুরুত্ব ও প্রতিক্রিয়া নিয়ে ভেবেছেন। যদি তা না করে মনগড়া কথা বলে থাকেন তো বুঝতে হবে রাজনীতি বা দলে নিয়মনিষ্ঠা বা মানা না মানার আর কোন বালাই নাই। আর যদি সবাই জানেন তাহলে আমরা ধরে নেব- মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গর্ব বা তাকে পুঁজি করে রাজনীতি করার দিন আওয়ামী লীগের আর রইলো না।
একথা সবাই জানি দেশে মূলত দুটি ধারা। একটি মুক্তিযুদ্ধের আর একটি স্বাধীনতা বিরোধী। এখানে মাঝামাঝি বলে কিছু নাই। সে জায়গায় মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তিযুদ্ধ সব সময় আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়ে এসেছে। যখনই তারা হারে বা রাজপথে থাকে তাদের মনোবল আর ভরসা এই শক্তি। এরাই বিপদের ঝুঁকি নিয়ে এই দলকে নিরাপদ রাখে। আর যখনই তারা গদিতে থাকে বা দেশশাসনের সুযোগ পাব সে অধিকার বোধে এমন সব কথা বলে বা কাজ করে যা আমাদের বিচলিত করে। আমাদের ভাবনা ও আদর্শকে পঙ্গু করে দেয়।
মনে হতে থাকে এত আত্মত্যাগ, এত বেদনা, এত আবেগ বা ভরসা আসলেই মেকি। এমন কী কোনও কারণ ছিল- যে এখন এসে এসব কথা বলতে হবে? আওয়ামী লীগ তো একতরফা রাজনীতিই করছে। তাদের না আছে কোনও প্রতিদ্বন্দ্বি না কোনও বিরোধী। এমন নির্ভয়ে রাজত্ব করার পরও হঠাৎ এই বিভেদরেখা মুছে দেবার কথা আশংকাজনক।
আমি একটা ঘটনার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই।  স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন সাধারণ মার্জনা বা মাপ করার কথা ঘোষণা দিলেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ক্ষমা পাওয়া দালালেরা একটি সভা করেছিল। সে সভায় খান এ সবুরের মতো ঘোর মুসলিম লীগারও ছিলেন। তারা সেদিন বঙ্গবন্ধুর কারণে জীবন ফিরে পাওয়ায় তাকে দ্বিতীয় পিতা বা আব্বা বলে সম্বোধন করে। কিন্তু পঁচাত্তরে মাত্র তিন বছরের মাথায় এরাই তার রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে উল্লাস করতে ভোলেনি। তারপরের ঘটনাও আমাদের জানা।
কথা একটাই। যদি এটাই দলের ভেতরের কথা হয়, তো রাজনীতিতে আর আদর্শের কথা বলার দরকার নাই। এখনো যে সব বিচার আচার চলছে এগুলোর দরকার কী? তখনতো নিজেরাই বলবেন এসব প্রহসনের মানে নাই। তারচেয়ে চালডাল মিশিয়ে খিচুড়ি বানিয়ে খাই। সবাই মিলে ভালো থাকি। অসাম্প্রদায়িকতা বা মুক্তিযুদ্ধের কবরে একটা বড় গাছ পুঁতে বলি- এইখানে তোর স্বাধীনতার কবর ডালিম গাছের তলে।
খুব মনে পড়ছে প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের কথা। ভদ্রলোক রাজনীতির শেষ প্রতিভু। কথা বলে কি যে শান্তি পেয়েছিলাম! দলের কাউন্সিলে তার একটি আবেগময় ভাষণ ইতিহাস হয়ে আছে।  তিনি রক্তের কথা বলেছিলেন। বলেছিলেন- 'তাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত। এই রক্ত বেঈমানি জানে না।'
আমরা সাধারণ মানুষ। রাজনীতি বুঝিনা। শুধু দেখি কাউয়া ঢুকে কাউয়া বাড়ে। ভরসার মানুষ বা বিশ্বাস রাখার মতো নেতারাও একসময় এসে পাল্টি খায়। জানতে ইচ্ছে করে ইতিহাস ও জন্মলগ্নে কোথাও কি ভুল ছিল আমাদের? তা না হলে আওয়ামী লীগের সম্পাদক জামায়াতের ভাষায় কথা বলবেন কোন সুখে?