‘খাদ্য নিরাপত্তায়’ হোক আন্দোলন

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 2 July 2019, 08:23 AM
Updated : 2 July 2019, 08:23 AM

'শিরোনাম'-টি  নি:সন্দেহে দেশের মানুষকে উসকে দিয়ে আন্দোলনে নামানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে ! আসলে দেশের সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে আমি কিছুটা হলেও উসকে দিতেই চাই। যদিও আমি অবরোধ-অনশনে দাবি আদায়ে পক্ষপাতি নই, তবে আমার যদি নেতৃত্বের ক্ষমতা থাকতো, তাহলে এই মুহূর্তে দেশে বড় একটা আন্দোলনের ডাক দিতাম।  আর এই আন্দোলনের ডাক দিতাম কেবল 'খাদ্য নিরাপত্তার' জন্য। নিজেদের বেঁচে থাকার লড়াইয়ে টিকে থাকার জন্য এই আন্দোলন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন।

সম্প্রতি একের পর ভেজাল-অস্বাস্থ্যকর খাবারের তালিকা দেখে শুধু অবাকই হচ্ছি না, কিছুটা ভীত। খাবারের জন্য আদিম মানুষের যে লড়াই হতো, ঠিক তেমনি এক মুঠো ভেজালমুক্ত খাবার পেতে সেই লড়াই হওয়ার উপক্রম।

গত সাড়ে পাঁচ বছর ধরে জাপানে রয়েছি। কখনো ফুড পয়জনিং হয়নি। এই দেশে প্রতি বছর ৬০০ কোটি টন খাবার ফেলে দেওয়া হয় কেবল মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার জন্য। এদেশে খাদ্য নিরাপত্তার আইন যথেষ্ঠ কড়া। কেউ যদি কোনও কোম্পানির ভেজাল কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার খেয়ে অভিযোগ করে তাহলে ভোক্তা আইন সংরক্ষণে থাকা বিভাগ সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লাইসেন্স বাতিল করার পাশাপাশি মোটা অংকের টাকা জরিমানা করে। যে কারণে, এইখানে কোনও মেয়াদোত্তীর্ণ খাবার কিংবা ভেজাল খাবার দেওয়ার সাহস কেউ পায় না।

কিন্তু আমাদের দেশে ঘটছে পুরোটাই উল্টো। এখানে ভেজাল আর মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে বাজার সয়লাব।রান্নার সামগ্রী থেকে শুরু করে বাচ্চার দুধ পর্যন্ত যে ভেজালের মিছিল শুরু হয়েছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য!

বছরের পর বছর বিজ্ঞাপনে জনপ্রিয় হওয়া আমাদের নিত্যদিনের খাদ্যতালিকায় যুক্ত খাবারের এই জীর্ণদশা দেখে যে কারও প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে আমরা খাব কী? আমাদের কোন খাবারটি তাহলে নিরাপদ থাকলো?

খাদ্যমান ঠিক রাখা যেকোনও দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। যদি নাগরিকরা সুস্থ না থাকে তাহলে সেই দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন যতই দৃশ্যমান হোক তা কাজে দেবে না। কারণ, নাগরিকরা যত বেশি সু-স্বাস্থ্যের অধিকারী হবে, অর্থনীতির উন্নয়ন ততো হবে। আমাদের দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি সব জায়গায় প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। খাবার বিষাক্ত দেখার পরও আমরা কিভাবে বসে থাকতে পারি? আর তাই দেশের সবচেয়ে বড় আন্দোলন হওয়া উচিত 'খাদ্য নিরাপত্তায়'।

নামি-দামি ব্র্যান্ডের বিজ্ঞাপনের ভাষায় 'সেরা' খাবারগুলোর 'বিষ' এর উপস্থিতি ইতিমধ্যে ধরা শুরু পড়েছে। কয়েক বছর আগেও খাদ্যে বিষক্রিয়া বলতে কেবল 'ফরমালিন' বুঝতো মানুষ। এটিই কেবল সামনে এসেছিল। কিন্তু তারও আগ থেকে খাদ্যে ভেজাল ও শরীরের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানগুলো আমাদের খাদ্যে বিদ্যমান ছিল। যেগুলো শুধু পঙ্গুত্ব আনছে না, বরং মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ভেজাল খাদ্যে যে রাসায়িনকগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে অনেকগুলোই মানুষের জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়। এইসব রাসায়িনক উপাদানের অধিকাংশ 'ফ্রি-র‌্যাডিকেল' বা 'অপরিবর্তনীয় মুক্ত মূলক' তৈরি করে। আর এই মূলকগুলো আমাদের ডিএনএ লেবেলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটিয়ে জিনের ভিন্নতা আনে। যাকে আমরা মিউটাজেনেসিস বলেই মনে করি। যার ফলে সৃষ্ট হচ্ছে ক্যান্সারের মত ভয়ানক রোগ।

কেবল ক্যান্সারই নয়, ভেজালে থাকা ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান শরীরের শারিরীকক্রিয়া সম্পাদনকারী বিভিন্ন অর্গান বা কোষ ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলছে।

যে অ্যান্টিবায়োটিক আমরা শরীরে রোগ প্রতিরোধে ব্যাকটেরিয়া নিধনে ব্যবহার করছি, সেই ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী অ্যান্টিবায়োটিক শরীরের প্রয়োজন না থাকলেও আপনাকে নিয়মিত খাদ্যের সাথে অবচেতনভাবে গ্রহণ করতে হচ্ছে। যার ফলে আমাদের দেহ ওইসব অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী হয়ে উঠছে। সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা হলো, শিশুদের। দুধে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়ার পর কোন্ বাবা ইচ্ছে করে তার সন্তানকে মেরে ফেলার জন্য এই বিষ মুখে তুলে দেবে?

মাসটিটিস রোগের জন্য গাভীকে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ানো হয়। কিন্তু সারা বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পর কিছুদিন ওইসব গরুর দুধ পান করা নিষিদ্ধ থাকলেও আমাদের দেশের নামীদামী ব্র্যান্ডের কোম্পানিগুলো খামারিদের কাছ থেকে সেই দুধ কিনে নিয়েই বাজারজাত করছে। যার ফলে মৃত্যুঝুঁকি আরো বেশি বেড়ে যাচ্ছে।

যে তাপমাত্রায় দুধ রাখতে হয়- সেই ৭ থেকে ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে দুধ কতজন দোকানে রাখতে পারেন সেটাও প্রশ্নের বিষয়। অনিন্ত্রিত তাপমাত্রা দুধে ব্যাকটেরিয়া জন্মানোর এক ধরনের মিডিয়াম হিসেবে কাজ করে। যেটা আমরা অনেক সময় ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করি।

রান্না করার অন্যতম উপাদান হলুদ ও তেল। এই হলুদে ভেজালের যে চিত্র উঠে এসেছে তা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। যে হলুদ অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হওয়া উচিত, সেই হলুদ অক্সিডেন্ট হিসেবে শরীরে রিয়াক্টিভ অক্সিজেন স্পেসিস (আওএইচ) তৈরি করছে। আর এই আরওএইচ আমাদের শরীরে ক্যান্সারের অন্যতম কারণও বটে।

সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি যখন শুনলাম হলুদের গুঁড়ায় Metanil yellow পাওয়া গেছে, যা আমরা রঞ্জক বা রং হিসেবে পোশাকশিল্পে ব্যবহার করি। যেটি শরীরে গেলে আমাদের স্বাভাবিক ক্রিয়ালাপে ব্যবহৃত আড্রোনালিন, ডোপামিন ও অ্যাসিটাইল কোলিনের মতো গুরুত্বপূর্ণ হরমোনকে বাধাগ্রস্ত করে দেয়।

কিন্তু আমরা তা দেদারচ্ছে গিলছি। মনে করছি, এইসব ভেজাল আমাদের শরীরে সয়ে গেছে। কিন্তু না। এইগুলো স্লো-পয়জেনিং। আজ হয়তো আপনার কিছু হচ্ছে না কিন্তু কয়েকদিন পর ঠিকই পেটের পীড়া কিংবা মস্তিষ্কের টিউমার নিয়ে আপনাকে বিছানাগত হতে হবে বৈকি।

টেলিভিশন খুললে যেসব জুসের দাপটীয় বিজ্ঞাপন দেখি, যে বিজ্ঞাপনে পেটের ভিতর জমে থাকা সত্যি কথা বের হয়- সেই জুসে যে ক্ষতিকর সোডিয়াম সাইক্লামেট ব্যবহার হয়ে আসছে- তা কেউ কি জানেন? বাগানের সেরা ফলের জুসের কথিত কোম্পানির বিজ্ঞাপনে যে জুসের পরিবর্তে ক্ষতিকর খাবার রং আর চিনির পরিবর্তে কৃত্রিম চিনিরুপী সোডিয়াম সাইক্লোমেট শুধু আমাদের ক্ষতিই করে না, এটা সারা বিশ্বব্যাপী নিষিদ্ধ।

যদিও কয়েক বছর আগে ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনেস্ট্রশন (এফডিএ) ক্ষতিকর এই রাসায়িনক উপাদান ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছিল, কিন্তু বিজ্ঞানীদের গবেষণার প্রেক্ষিতে সাইক্লামেট নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।

কিন্তু সম্প্রতি ঢাবির ফার্মেসি বিভাগ ও বায়োমেডিকেল রিসার্চ সেন্টার যে তথ্য দিচ্ছে তা দেখে চোখ কপালে ওঠার মতোই অবস্থা। শতকরা ৯০ শতাংশ কোম্পানিই জুসে সাইক্লামেট বা ঘনচিনি মেশাচ্ছে।

প্রশ্ন উঠবে, এইসব রাসায়িনক পদার্থ কোথা থেকে আসে? কারা এটা নিয়ন্ত্রণ করে? এর উত্তর সহজ, আমাদের দেশে রাসায়িনক পদার্থ নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী দপ্তর থেকেও নেই। তাদের অনুমতি ব্যতিত কোন রাসায়নিক পদার্থ আমদানি বা বিক্রি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তাদের জ্ঞাতসারেই ছড়িয়ে গেছে এইসব পদার্থ।

ভোজ্য তেলে যে স্যাপোনোফিকেশন বা সাবানায়ন নম্বর দিয়ে কার্যকারিতা নির্ণয় করা হয়, সেই মান পাওয়া যায়নি বাজারের তেলগুলোতে। বরং দেড়গুণ বেশি সাবানায়ন নম্বর দেখা গেছে কথিত 'বিশুদ্ধ' সয়াবিন তেলে।

পারঅক্সাইড এর মতো জারক পদার্থের তেল করেছে আরো বেশি ক্ষতি। কারণ এই অক্সাইড আমাদের শরীরের অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট কার্যকারিতা নষ্ট করে দিচ্ছে। শুধু তাই নয় আরওএইচ তৈরি করে স্বাভাবিক কোষকে মেরে অস্বাভাবিক করে তুলছে, যার কারণে বাড়ছে ক্যান্সারের মতো দূরারোগ্য ব্যাধি।

বাজারে কিছুদিন আগে ৫২ টি পণ্য নিষিদ্ধ হয়। আর সেই তালিকায় নতুন করে যোগ হবে হয়তো আরও কিছু। ইতিমধ্যে কোম্পানিগুলো আদালতে যেতে শুরু করেছে। আইনজীবীর মাধ্যমে হয়তো স্থগিত হবে 'নিষিদ্ধ' তালিকায় যাওয়া পণ্য।

অসাধুতা করে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা বা কোম্পানির লোকেরা হয়তো বিষযুক্ত খাবারের অনুমোদন দিচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তারা কি ওই বিষ থেকে রক্ষা পাবেন?

খাবারই যদি আপনার শরীরে বিষ তৈরি করে তাহলে আপনার সারাদিন পরিশ্রম করে খাদ্য জোগানের লড়াই করার কোন হেতু আছে কি?

এই অবস্থা দেখার পরও আমরা কী চুপ থাকবো? পত্রিকা আর টেলিভিশনে চটকদার বিজ্ঞাপন ও প্রচার দেখে পণ্য কিনবো কিংবা সেই প্রচারে সহায়তা করবো?

না, এইভাবে চলতে পারে না। খাদ্যের জন্য রাস্তায় নামা রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। বরং নিজেদের ও ভবিষৎ প্রজন্মকে রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব এটি। আমাদের 'খাদ্য নিরাপত্তায়' আন্দোলন সময়ের দাবি হয়ে গেছে। ভেজাল পণ্যের বিজ্ঞাপন নয় বরং এইসব পণ্য পরিহারে জন্য সচেতনতামূলক প্রচারণা জরুরি। অধিক লাভের আশায় মরিয়া ব্যবসায়ীদের লাগাম টেনে ধরা সরকারের সবচেয়ে বড় কাজ।

এরা ঋণ খেলাপী। এরা নিজেরা মরছে আমাদের সাধারণ জনগণকেও মারছে। এদের হাতে আমরা কেউ নিরাপদ নয়। ব্যবসার পবিত্রতা নষ্ট করে, তারা আজ ঘরে ঘরে রোগী তৈরি করে দিচ্ছে। ভেজাল খাদ্য, ভেজাল ওষুধ, ভেজাল মানুষে বাংলাদেশ ভরে গেছে। সময় এসেছে, এদের বিরুদ্ধে কথা বলার। নিষিদ্ধ হোক ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদানে পণ্য বিক্রিকারী কোম্পানি ও তাদের বিজ্ঞাপন। শাস্তির আওতায় আনা হোক কোম্পানিগুলোর কর্ণধারকে। নিরাপদ হোক আমাদের খাদ্য।