একটি আদর্শ নিয়ে কাজ করেছেন ঝর্ণাধারা চৌধুরী

দিল মনোয়ারা মনু
Published : 2 July 2019, 06:57 AM
Updated : 2 July 2019, 06:57 AM

গত ২৭ জানুয়ারি নোয়াখালীর সোনাইমুরী ইউনিয়নের জয়গা গ্রামের সাধারণ মানুষ আলোর এক ঝর্ণাধারায় স্নাত হয়ে মেতে উঠেছিল এক অনন্য সাধারণ গৌরব লাভের আনন্দে। আর এই আন্তর্জাতিক মর্যাদাপূর্ণ সম্মানজনক পুরস্কারটি পেয়েছেন এখানকার বাংলাদেশ গান্ধী আশ্রম ট্রাষ্টের দীর্ঘদিনের জননন্দিত নিবেদিত সংগ্রামী কর্মী সচিব ঝর্ণাধারা চৌধুরী। তিনিই প্রথম বাংলাদেশী যিনি ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মানজনক 'পদ্মশ্রী' পদকে ভূষিত হবার অনন্য গৌরবে নন্দিত হলেন। তিনি আমাদের দেশের একুশে পদকেও ভূষিত হয়েছেন। অবিমিশ্র ভালবাসায়, শ্রদ্ধার এই জনকল্যাণী মানুষটি আজ আমাদের সকলের গর্ব, অহংকার। আমরা জানি খ্যাতির শিখরে উত্তরণের পেছনে থাকে দীর্ঘ পরিশ্রম, প্রচণ্ড বাধা-বিপত্তি, লড়াই, অনেক নিদ্রাহীন রাত, অনেক ত্যাগ, অনেক না পাওয়ার বেদনা এবং তা মেনে নেয়ার সৎ সাহস। সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাতে ব্যক্তিগত জীবনের যা হারাতে হলো তার জন্য কি তার মনের মধ্যে আছে কোন দু:খ বোধ, অনুশোচনা আছে? না নেই।

সব পাওয়া না পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে একান্তভাবে মানুষের সেবায় নিবেদিত চিরকুমারী, চিরকল্যাণী এই মানুষটির কর্মযজ্ঞের পূর্বাপর জানার জন্য আজ থেকে চৌদ্দ বছর আগে আমি উদ্যমী হই। বিভিন্ন সূত্র ও সংস্থার মাধ্যমে তাঁর কাজ সম্পর্কে জেনে আমি বিস্মিত, চমৎকৃত হই। নীরবে, নিভৃতে নিরলসভাবে কাজ করা প্রচার বিমুখ এই নারী আমার প্রেরণার উৎস হয়ে যায়। আমি পাক্ষিক অনন্যা সম্পাদনার দায়িত্বে থাকায় ২০০১ সালের অনন্যা শীর্ষ দশ পুরস্কারের তালিকায় তার নাম অন্তর্ভূক্তির জন্য তার মহা কর্মযজ্ঞ নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করাই। প্রতিবেদনটি তৈরি করেছিলেন অনন্যার স্টাফ রিপোর্টার উপমা দাশগুপ্ত। সেই প্রতিবেদন পড়ে কর্তৃপক্ষও মুগ্ধ ও প্রাণিত হয়ে তাকে এই পুরস্কার প্রদানের সম্মতি দেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সে বছর শীর্ষদশ পুরস্কার প্রদানের মাধ্যমে আমরা, অর্থাৎ অনন্যা পরিবার গৌরবান্বিত হই। এই পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই তাঁর সাথে আমার পরিচয় ও জানাশোনা। খুব বেশি দেখা না হলেও ঢাকার কোন অনুষ্ঠানে এলে তার সাথে আমার দেখা হয় এবং তার ঘনিষ্ঠ জনদের কাছ থেকে তার প্রাগ্রসর জনহিতকর বহুমুখী কাজের কথা জানতে চেষ্টা করেছি।

ঝর্ণাধারা চৌধুরী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বিধ্বস্ত মানুষের সেবা এবং মহাত্মা গান্ধীর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার মহৎ আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে এক সময়ে যোগ দিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস মতবাদে দীক্ষিত কর্মযজ্ঞে। সারাজীবন তিনি গান্ধীর অহিংস মতবাদ প্রচারের একনিষ্ঠ সেবক ছিলেন। সেই থেকে কাজ করে যাচ্ছেন মানুষের জীবন মান উন্নয়নে। এ সমাজের সয়ম্ভরতা নিয়ে তিনি শুধু একজন উদ্যোগী কর্মীই নন, এর পেছনে যে তার একটি দর্শন কাজ করছে তা আমরা সকলেই জানি। বহু সম্মানে ভূষিত হয়েছেন তিনি। কিন্তু তিনি মনে করেন তার সেরা সম্মান দু:স্থ, অসহায়, দলিত মানুষের অবিমিশ্র শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও তাদের চোখের জল। দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন তিনি এদেশের নারী সমাজ বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের কাছে যারা অবহেলিত সুযোগ ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের পাশে দাড়িয়ে নীরবে নি:স্বার্থভাবে কাজ করতে চান।

১৯৯৯ সালের শেষের দিকে যখন তার সাথে আমার কথা হয় তখনই তিনি বলেছিলেন- সাফল্য, সম্মান, পুরস্কার তো অনেক পরের চিন্তা। শুরু থেকেই আমার চিন্তা ছিল কী কাজ করবো এবং কিভাবে করবো। শৈশবেই আমি বহু মহৎ মানুষের জীবন কথা পড়েছি- সেটা শুধু উনাদের বা উনাদের কাজকে জানার জন্য নয়- কার জীবন-আদর্শকে ধারণ করে আমি বড় হয়ে উঠবো, আমার কর্ম ও লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে এগিয়ে যাবো সেই তাগিদ থেকে। আমি অনেক ভেবে চিন্তে গান্ধীজী এবং তার আদর্শকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই এবং তাকে পরিপূর্ণভাবে জানার এবং উপলব্ধি করার দুর্বার এক আকর্ষণ অনুভব করি।

আমার মনে হয় ঝর্ণাধারা চৌধুরী এভাবেই জেগে উঠলেন। মহাত্মা গান্ধীর প্রেরণার উদ্বুদ্ধ হয়ে নিজেকে তৈরী করলেন এক দৃঢ় চিত্ত নারী হিসেবে। দেশ ও মানুষের সেবাকেই জীবনের লক্ষ্য স্থির করলেন।

ঝর্ণাধারা চৌধুরী মনে করেন সাফল্য হল সাধনার ফল। সাফল্য বা স্বীকৃতির জন্য তিনি কাজ করেন নি। একটি আদর্শ নিয়ে বাঁচতে চেয়েছেন। অনেক কঠিন সময় কাটিয়েছেন কিন্তু আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হননি। কাজের প্রতি তার যেমন আছে গভীর নিষ্ঠা তেমনি আছে আধ্যাত্মিকতা। আর আছে মেধা, নিয়ম-শৃঙ্খলা, পরিশ্রম এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রচণ্ড সাহস। সর্বোপরি মানুষের প্রতি প্রেম ও কাজের প্রতি নিষ্ঠা। সব জেনে শুনে তাই আমার মনে হয়েছে, তিনি মহীয়সী এক নারী। পুরস্কার পাওয়ার পর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তিনি বলেছেন- এ পুরস্কার আমার কাজের প্রতি আরো গভীর প্রেরণা জোগাবে, পাশাপাশি সমাজের অন্য মানুষকে সৎ থাকার ও ভালো কাজ করার প্রেরণা দেবে।

সময়ের পাতা উল্টালে দেখা যায় প্রচার বিমুখ নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষকে পথ দেখানো এই মানুষটি ১৯৩৮ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। বাবা প্রয়াত প্রমথ চৌধুরী ও মা আশালতা চৌধুরী। এগার ভাইবোনের মধ্যে তিনি দশম। মাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়া করেছেন চট্টগ্রাম খাস্তগীর বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে এবং উচ্চ মাধ্যমিক পড়েছেন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং স্নাতক করেছেন ঢাকা কলেজ থেকে।

১৯৬০ সালে নিজ বাড়ি ত্যাগ করে স্বেচ্ছায় বিক্রমপুর জেলার বাউতভোগ গ্রামে ঢাকেশ্বরী কটন মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সর্বশ্রী সুনীলবসু ও চারু চৌধুরীর উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত 'অম্বর চরকা' প্রতিষ্ঠানে যোগ দেন এবং সুতাকাটা, মৌমাছি পালনের প্রশিক্ষণ নেন। এ কাজের এই সফলতা সম্পর্কে এভাবে বলা যায়, সেদিন তার হাতের ছোট আগুনটা জ্বলার সাথে সাথে চারদিকে আরো অসংখ্য আগুন শিখা জ্বলে ওঠে।

১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর দাঙ্গার সময় মহাত্মা গান্ধীর নির্দেশে ওড়িশ্যা থেকে সত্য নারায়নজী দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে কাজ করেন। পরে এই কাজের অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা মানুষের সামনে তুলে ধরতে তিনি 'সত্যনারায়নজী' গ্রন্থটি প্রকাশ করেন এবং এক মহতী জীবনের আলোকপাত করে নন্দিত হন। এই বই ইতিহাসের পাতায় এক অমূল্য সংগ্রহ। তার জীবনের গভীরতম সত্য ও তৃপ্তি হলো গ্রামের মোটা কাপড় পরা মানুষ ও তাদের নিরাভরণ শিশু।

ঝর্ণাধারা চৌধুরী ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চল দিয়ে বয়ে যাওয়া সামুদ্রিক সাইক্লোনে আহত নি:স্ব গৃহহীন মানুষের পাশে দাঁড়ান। মানুষের কল্যাণের জন্য প্রতিষ্ঠিত প্রবর্তক সংঘের স্বেচ্ছা সেবকদের সাথে যুক্ত হয়ে পরম মমতায় আপনজনের মত দীর্ঘদিন এই অসহায় মানুষদের জন্য সেবা ও ত্রাণ কাজ চালান।

এরপর তিনি প্রবর্তক সংঘের বিদ্যাপীঠের চরকা ও মৌমাছি পালন কর্মসূচি বাস্তবায়নে প্রশিক্ষক পদে যোগ দেন। উদ্দেশ্য ছিল অনাদৃত, প্রায় বিস্মৃত কুটির শিল্পকে জাগিয়ে তোলা, এই শিল্পকে সম্মানের জায়গায় নিয়ে যাওয়া। সুযোগ বঞ্চিত অসহায় মানুষের মধ্যে নতুন আশার আলো মুক্তির পথের সন্ধান দেয়া। এটাই তার জীবনের ব্রত। শত শত মানুষের অবিমিশ্র শ্রদ্ধা আজো তাই ঘিরে আছে তাকে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রবর্তক সংঘ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এক শক্তিশালী ঘাঁটি। ঝর্ণাধারা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করতেন। নিজেকে তৈরি করেন সেবিকা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে। পাক বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞের সময় এই প্রতিষ্ঠানের সকল পরিচালক নিহত হলে ঝর্ণাধারা চৌধুরী জীবনের প্রচণ্ড ঝুঁকি ও প্রবল সাহসের সাথে চারশ শিশুকে ক্যাথলিক মিশনের সহায়তায় সীমান্তের ওপারে নিয়ে তাদের প্রাণরক্ষা করেন। স্বাধীনতার পর ধ্বংস হয়ে যাওয়া প্রবর্তক সংঘ, প্রবর্তক বিদ্যাপীঠ এবং প্রবর্তক শিশু সদন পুনর্গঠনে পরিপূর্ণভাবে নিজকে নিয়োগ করেন। ১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গান্ধী আশ্রমে যোগ দেন এবং গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের ক্ষতিগ্রস্ত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে শক্তিশালী ও ব্যাপকভাবে জনমুখী করার জন্য বাস্তব কর্মসূচী গ্রহণ করে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেন। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের জয়াগে অবস্থিত এই গান্ধী আশ্রম ট্রাস্টের সচিব ঝর্ণাধারা চৌধুরী আজীবন আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে এই আশ্রমে কাজ করে গেছেন। চতুর্থ বিশ্বনারী সম্মেলনে যোগ দিয়ে দেশে ফিরে তিনি নতুন উদ্যমে গান্ধী আশ্রমে কুটির শিল্প স্থাপন করে তার বিকাশ ও প্রসারের জন্য নিরলসভাবে কাজ করেন।

১৯৯০ সালে গান্ধী আশ্রমের প্রাণপুরুষ চারু চৌধুরীর মৃত্যুর পর ঝর্ণাধারা চৌধুরী সচিব পদের গুরু দায়িত্ব গ্রহণ করে জনকল্যাণমুখী এই প্রতিষ্ঠান এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে সর্বশক্তি নিয়োগ করেন। নীরবে নি:স্বার্থভাবে কাজ করা এই মানবদরদী নিজের অজান্তেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতির পর্যায়ে তার প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। ১৯৯৮ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে গ্রহণ করা আন্তর্জাতিক বাজাজ পুরস্কার, ২০০০ সালে ওয়েস্টেরি বিশ্ববিদ্যালয় শান্তি পুরস্কার, ২০০১ সালে অনন্যা শীর্ষদশ পুরস্কার, ২০০৩ সালে দুর্বার নেটওয়ার্ক পুরস্কার, ২০০৭ সালে নোয়াখালী জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে 'সাদা মনের মানুষ' হিসেবে স্বীকৃতি, ২০১০ সালে শ্রী চৈতন্য পদক এবং ঐ একই সালে চ্যানেল আই এবং স্কয়ার কীর্তিমতী নারী পুরস্কার এবং গান্ধী স্মৃতি শান্ত সদভাবনা পুরস্কার উল্লেখযোগ্য।

মানুষকে আপন করার একটি সহজাত গুণ ছিল তার। ঝর্ণাধারা চৌধুরী গান্ধী চর্চার মধ্য থেকে অফুরান জীবনী শক্তির সন্ধান পেয়েছেন। তিনি মনে করেন- কর্মই ব্রহ্ম। তিনি মনে করেন- কাজের মধ্যে এই যে বেঁচে থাকার আনন্দ, নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও মনে হয় সামনে আরো একটি দিন আছে, সেই শিক্ষা তিনি পেয়েছেন গান্ধী চর্চার আলোকে করা জনহিতকর নানা মুখী কাজের মধ্য দিয়ে। তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন এক গৌরবের সম্মানের ইতিহাস। তাই তিনি নমস্য- তাকে আমাদের প্রাণঢালা অভিনন্দন।

২৭ জুন তার চলে যাওয়া যেন এক শুদ্ধ জিনিয়াসের চলে যাওয়া, এই অন্ধ সমাজে জন্মগ্রহণ করেও তিনি প্রথা ভেঙ্গে নতুন পথ তৈরি করেছেন। নতুন সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা এই মানবিক মানুষটির  আলো ছড়ানো জীবন থেকে আমাদের অনেক শিক্ষা নিতে হবে। সময়ের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে কাজ করে যাওয়া নিবেদিত এই মানুষটিকে আমাদের অনুসরণ করে যেতেই হবে। জয়তু ঝর্ণাধারা চৌধুরী।