শতবর্ষের প্রাক্কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগোলো, না পেছালো?

আনিসুর রহমান
Published : 1 July 2019, 10:36 AM
Updated : 1 July 2019, 10:36 AM

বাংলাদেশ যে সময়ে স্বাধীনতার সূবর্ণজয়ন্তী পালন করবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একই সঙ্গে শতবর্ষও উদযাপন করবে। বছরটি খুব বেশি দূরে নয়; ২০২১ সাল। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছর ১৯২১ সাল ছিল বেনিয়া ব্রিটিশদের খপ্পরে পরাধীন শাসনামল। তারপর মাঝখানে পাকিস্তানের বিস্বাদ পেরিয়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাধীন দেশের প্রাচীনতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। বটে? এই প্রেক্ষাপটে আমার মনে কতগুলো প্রশ্ন খেলে যায়। প্রশ্নগুলো যদি তালিকা করি এরকম দাঁড়ায়:

১।    শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে গুণগত মানের দিক দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এগোলো না পেছালো?

২।    বিশ্ববিদ্যালয়টি কি ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশের সুবিধাভোগী না কি অপব্যবহারে নাস্তানাবুদ?

৩।    শতবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টির গবেষণা কার্যক্রমে কি উল্লেখ্যযোগ্য অর্জন রয়েছে?

৪।    স্বাধীনতার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যে যোগ্যতা, দেশপ্রেম, বিচক্ষণতা বা ন্যায়পরায়ণতার দৃষ্টান্ত ছিল তা কি এখনকার শিক্ষকদের মাঝে অবশিষ্ট কিছু আছে?

৫।    সান্ধ্যকালীন কোর্সের মাধ্যমে সনদ বাণিজ্যের বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয় নীতিমালার কোন ধারায় সমর্থনযোগ্য?

৬।    বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন কার্যত কি ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের ইশারা ইঙ্গিতে চলে না কি প্রশাসনের দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের ব্যক্তিত্বগুণে বিশ্ববিদ্যালয়ের তাৎপর্য সমুন্নত রেখে চলে?

৭।    বিশ্ববিদ্যালয়ের কথিত অকথিত অনিয়ম আর দুর্নীতি ঠেকানোর বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু করণীয় আছে কি?

৮।    বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রশিক্ষক গবেষক বেশিরভাগই যদি অধ্যয়ন, গ্রন্থাগার আর গবেষণা বিমুখ হয় তাহলে এর বর্তমানের হালই বা কি? এর ভবিষ্যতই বা কোথায় গিয়ে ঠেকবে?

৯।    বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ ফাঁকি দিয়ে যে হারে বেসরকারি দোকানদারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দৌড়ঝাঁপ আর টাকা কামাই নির্ভর ফরমায়েশি কাজে লিপ্ত থাকেন তারপর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যয়ন আর গবেষণার জন্যে অবশিষ্ট সময় আর সামর্থ্য কোথায়?

১০।  বিদেশের মানদণ্ডের তালিকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি নাই, সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো দেশের আমআদমীর চোখেও কি বিশ্ববিদ্যালয়টি আগের অবস্থানে আছে?

১১।  গবেষণার নামে যা হচ্ছে বিশেষ করে জার্নালের নিবন্ধ পিএইচডি বিতর্ক এসবের কি কোন সুরাহা হয়?

১২।  আদিবাসী বা প্রতিবন্ধীদের জন্যে কোটা সভ্য দুনিয়ার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বীকৃত থাকলেও পোষ্য কোঠা কি কোনো আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মানদণ্ডের পর্যায়ে পড়ে?

এরকম প্রশ্নের তালিকা আরো দীর্ঘ হতে পারে। এবার একটি গল্পের অবতারণা করব। অধ্যাপক ও লেখক কাজী মোতাহার হোসেনকে নিয়ে একটি গল্প বহুল প্রচলিত। তিনি একবার বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে দাবা খেলায় ব্যাস্ত। খুবই মনোযোগ দিয়ে খেলছেন। এমন সময় তার বয়োকনিষ্ঠ এক শিক্ষক ওনাকে সালাম দিয়ে বলছেন, স্যার আমার আরো একটা পিএইচডি হয়ে গেল। অধ্যাপক মোতাহার হোসেন নির্লিপ্ত। অই শিক্ষক আবারও আরো একটু স্পষ্ট ও দৃঢ় স্বরে বলছেন, স্যার আমার আরো একটি পিএইচডি হয়ে গেল। দুটি পিএইচডি হল এখন স্যার। এই কথা শুনে কাজী মোতাহের হোসেন নীরবতা ভেঙে বললেন, তাতে হয়েছেটা কী, গরুরও তো দুটি শিং আছে।

উনি আজ বেঁচে থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের এই বিবর্তন দেখে কী বলতে পারতেন একবার কল্পনা করে দেখতে পারি আমরা। লেখা চুরি করে নিজের গবেষণাকর্ম বলে চালিয়ে দেয়া অথবা পত্রিকায় ছাপানো প্রবন্ধ নিবন্ধকে গবেষণা নিবন্ধ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে পদোন্নতিসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা বাগিয়ে নেবার উদাহরণও কম নয়।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির উপউপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সাক্ষাৎকারে ভয়াবহ এক তথ্য দিয়েছেন। কেবল নিজের লোকদের চাকরি দেবার জন্যে- পছন্দের শিক্ষকদের বিভাগীয় প্রধান করার ইচ্ছায় একটি বিভাগের অধীনে যে পাঠ্যসূচি ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা সম্ভব সেখানে চারটি বিভাগ খোলা হয়েছে। বিভাগটি হচ্ছে- গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ।

আর এই মহান কর্মযজ্ঞটি সম্পন্ন হয়েছে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্যের দায়িত্বে থাকার সময়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের একজনের বয়ানে যদি এরকম ভয়াবহ সত্য প্রকাশ পায়, তাহলে অপ্রকাশিত আর কত জানি সত্য রয়ে গেছে।

বিভাগের প্রসঙ্গ যেহেতু এসেই গেল- এবার বিভাগগুলোর আর্থিক স্বায়ত্ত্বশাসন ও তার অপব্যবহারের কথা একটু বলি। প্রত্যেক বিভাগের জন্যে আলাদা বাজেট বরাদ্দ থাকে, তা বিভাগের প্রধান মহোদয় ক্ষেত্র বিশেষের প্রায়ই অস্বচ্ছভাবে ব্যবহার করে থাকেন।

এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হল প্রশাসন নিয়ে দুই একটি কথা বলাই যায়। একদিকে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রনেতারা ছাত্রদের আবাসিক হলকে নিজেদের রাজত্ব বা জমিদারি মনে করে গাড়ি বাড়ি করেন, হেলিকপ্টারে চড়েন। এজন্যে আলাদা করে বলার সুযোগ নাই ছাত্রলীগ বা ছাত্রদল। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠন বললেই চলে, যে যখন ক্ষমতায়। আর এই ক্ষমতার সময় দুই একটি ব্যতিক্রম ছাড়া হল প্রশাসন ছাত্রনেতাদের আজ্ঞাবহ। আর এই আজ্ঞাবহ ভূমিকায় থেকে হলের প্রাধ্যক্ষ হলের সম্পদ, হলের লোকবল নিজের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণ আর বর্ধিতকরণের কাজে ব্যবহার করার দৃষ্টান্ত নেহাত কম নয়।

কয়েক দশক হয়ে গেল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সান্ধ্যকালীন কোর্সের নামে কোচিং বা সনদ ব্যবসা শুরু করেছে। আর এর টাকা শিক্ষকদের পকেটস্থ হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের নির্ধারিত বেতন আর সুযোগ সুবিধার বাইরেও যদি এত এত সুযোগ ও চাহিদা থাকে তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চলেন কিভাবে? আর এখানে উল্লেখ্য যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সান্ধ্যকালীন কোচিং ব্যবসা শুরুর বেশ আগেই ইংরেজি বিভাগ শুক্রবারে ইংরেজি ভাষা শিক্ষার কোর্সের নামে কোচিং ব্যবসার প্রবর্তন করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশ বা প্রবিধানমালায় কোন ধারায় এ ধরণের কার্যক্রম সমর্থনযোগ্য?

কিছুদিন পরপর বিশ্ববিদ্যালয়টি থেকে মন খারাপ করা খবর আমাদের পড়তে হয়। কেউ হতাশায় আত্মহত্যা করে, কেউ বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়টি হবার কথা স্বপ্নের বাগান, আশা জাগানিয়া তীর্থস্থান। তা আর হল কই?

সাংস্কৃতিক বা সৃজনশীর কর্মকাণ্ডের তেমন বালাই নাই। শিক্ষকদের অনেকটা নিজেদের স্বার্থে ছাত্র সংসদের নির্বাচন তিন দশক ঠেকিয়ে রাখা হয়েছিল। শেষতক দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অনেকটা বাধ্য করেছে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দিতে।

বিশ্ববিদ্যালয়টিতে জ্ঞানচর্চা আর গবেষণার খুব একটা বালাই কি আছে? শিক্ষক গবেষক দুই হাজারের কাছাকাছি। অথচ গত পঞ্চাশ বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখ্যযোগ্য মৌলিক গবেষণাকর্ম কী? আমার জানা নাই।

তবে বিগত দশকগুলোতে আর কিছু না হলেও বড় বড় দালান আর স্থাপনা হয়েছে ঢের। যত ফাকা জায়গা ছিল, সব এখন উঁচু উঁচু দালান কোঠায় ভরে গেছে। একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই বড় বড় দালানকোঠা নির্মাণ করলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের উৎকর্ষতা বাড়ে না। যদিও তাতে কতিপয় লোকের পকেট ভারী হবার সুযোগ তৈরি হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে নানা অকার্যকর বিভাগ, ব্যুরো আর কেন্দ্র রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হল আন্তর্জাতিক অনুবাদ ব্যুরো। এটি যাত্রা করেছে ১৯৭৬ সালে। অথচ প্রায় পাঁচ দশকে এটি কোন অনুবাদকর্ম করেছে বলে কোন হদিস পাওয়া গেল না। বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রকাশনা সংস্থাও খুব যে কার্যকর তা বলা যাবে না। গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা সাময়িকী বা পত্রিকাগুলোও নিয়মিত প্রকাশিত হয় না। দুই এক বছর আগে অর্থনীতি বিভাগের তরুণ এক শিক্ষকের বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত একটি লেখা প্রকাশের সূত্র ধরে সাময়িকভাবে তাকে কর্মবিরতিতে পাঠানো হয়েছিল। অথচ একই বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশ কয়েক বছর আগে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ  অধ্যাপক অমর্ত্য সেন সমাবর্তন বক্তৃতায় স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার তাৎপর্য হচ্ছে তর্কবিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করা। এর বিপরীতে আমরা কি দেখি? প্রায়ই দেখি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্ধ ডজন অথবা এক ডজন শিক্ষক দেশের বহুলপঠিত একটি পত্রিকায় কয়েকশ শব্দের লেখা ছাপায়। লেখাগুলো পড়ে আমার মনে হয় তাদের আসল উদ্দেশ্য নিজেদের নাম ও ছবি ছাপানো। তাদের লেখার যদি এতই খায়েশ বা তাগদ থাকে তাঁরা অই একই বিষয়ে নিজ নিজ দৃষ্টিকোণ থেকে আলাদা আলাদা লেখা লিখলেই পারেন।

অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়টির বর্তমান ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক আখতারুজ্জামান কয়েকদিন পর পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হাসির সরবরাহ করে থাকেন। একবার সমোচা আর সিঙ্গারা নিয়ে বয়ান দিলেন। তার বয়ান নিয়ে আপত্তি নাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমোচা, সিঙ্গারা, চা সস্তা এবং উপাদেয় সন্দেহ নাই। তবে এটা নিয়ে বয়ান দেয়া উপাচার্যের কাজ নয়। তার আরো জরুরি কাজ থাকার কথা। সম্প্রতি তিনি আবার যানজট নিয়ে একটা থেরাপি দিয়েছেন। ভারপ্রাপ্ত মহোদয়ের যথেষ্ট হয়েছে এখন দরকার উপাচার্য নির্বাচনের জন্যে প্যানেল ঘোষণা করে যোগ্য প্রতিথযশা কোন শিক্ষককে স্থায়ী উপাচার্য নিয়োগ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির তাৎপর্য ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। একই সঙ্গে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি প্রক্রিয়া, পরীক্ষা প্রক্রিয়া, নিয়োগ প্রক্রিয়া, গবেষণা কার্যক্রম সকল বিষয়ের গলদ দূর করার জন্যে দেশের এবং বিদেশের দক্ষ যোগ্য আর সৎ পণ্ডিতদের সমন্বয়ে একটা সংস্কার কমিশন করা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার শতবর্ষ উদযাপনে এটা একটা মোক্ষম কাজ হতে পারে।

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক উপাচার্য থাকাকালে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের তালিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম না থাকায় তিনি বলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইটে পর্যাপ্ত তথ্যের সন্নিবেশ না থাকায় এমনটা হয়েছে। উদোর পিণ্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপালে যা হয়। তবে বাংলাদেশের যে কয়টি প্রতিষ্ঠানের দায়সারা গোছের ওয়েবসাইট রয়েছে তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট অন্যতম।

লেখাটি শেষ করার আগে একটি আশার কথা বলি। ব্যবসায় প্রশাসন প্রতিষ্ঠান (আইবিএ) বা চারুকলা অনুষদের মত দুই একটা প্রতিষ্ঠানসহ কিছু কিছু বিভাগ এখনও প্রায়োগিক বিদ্যা বা ফলিত জ্ঞানচর্চার ধারা অক্ষুন্ন রেখে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখার চেষ্টা করছে।

সামগ্রিকভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মঙ্গল হোক, বিশ্ববিদ্যালয়টি হারানো গৌরব ফিরে পাক।