উন্নয়ন ও বাস্তবতা: সত্য বনাম ক্যামোফ্লেজ

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 29 June 2019, 01:45 PM
Updated : 29 June 2019, 01:45 PM
বাংলাদেশে রাজনীতি নিয়ে মানুষ এখন আর মাথা ঘামায় না। রাজনীতি মানুষকে আর টানতে পারছে না। তাদের রাজনীতি বিমুখতা কেন বা কী কী কারণে তারা বিমুখ- এ নিয়ে গবেষণা করার দরকার নাই। সহজেই অনুমান করা যায় কেন এই হাল। রাজনীতি হয় দুই বা ততোধিক দলের ভেতর। একতরফা কখনো রাজনীতি হয় না। দেশে এখন আসলে কোন বিরোধী দল নাই। আমি যা দেখি তাতে এটা স্পষ্ট বিরোধী দলকে বাঁচিয়ে রেখেছে মূলত মিডিয়া। এমন করুণ ঘটনা আগে ঘটেনি। দুনিয়ার বহুদেশে রাজনীতি তার আগের ভূমিকা হারিয়েছে। দেশে দেশে মানুষ ব্যস্ত তাদের নিজস্ব সমস্যা নিয়ে। না সমস্যা, না সম্ভাবনা- কিছুতেই রাজনীতির তেমন কোনও জোরালো ভূমিকা নাই। আমাদের সমাজ রাজনীতিপ্রবণ । এখানে উত্তেজনার নাম রাজনীতি। মারামারি হানাহানির নাম পলিটিক্স। গঠনমূলক বলে যে কথাটি তার কোন প্রকাশই নাই।
প্রধান বিরোধী দল  আসলে কারা? খাতায় কলমে জাতীয় পার্টি হলেও বাস্তবে মানুষের সমর্থনে বিএনপি ই অগ্রগামী। এই দলটি এখন কী করছে? মাঝে মাঝে নিজেদের অফিসে বসে মাইক্রোফোনের ব্যবহার ছাড়া তাদের কাজ কী? কোন একটা সামাজিক বা দেশজ ইস্যুতে আপনি তাদের পাবেন না। বলা  উচিত এ দল এখন মৃতপ্রায়।  নেতাকে জেলে নিয়ে যাবার পর যারা একটা মিছিল করতে পারে না, তাদের আবার হুঙ্কার! খালি বলে- পুলিশি বা সরকারি বাধার কারণে নাকি তারা পারছে না! এটা যে কত বাজে কথা সেটা সবাই বুঝতে পারে। আসলে তাদের মেরুদণ্ড বলে এখন আর কিছু নাই। মানুষের কাছে যাবার মুখ বা পথ কোনটাই খোলা নাই তাদের কাছে। সত্যি বলতে  কি বিএনপি আর কোনদিন কিছু করতে পারবে বলেও মনে হয় না। বাকী যে কাগুজে বিরোধী দল তার নেতা এরশাদ এখন শেষ দিনগুলো গুনছেন। বাকীরা যে যার মত আনুকূল্য পাওয়া আর ধান্দায় ব্যস্ত। এরা কোনদিনও মানুষের হয়ে কথা বলবে না।
সামাজিক সমস্যাগুলো নিয়ে কেউ কথা বলে না।  বলার মত নেতা বা দল কিছুই নাই। আমরা যে উন্নয়ন দেখছি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার রমরমা শুনছি তার পাশেই আছে অন্ধকার দিক। একাত্তর বছর বয়স হলো আওয়ামী লীগের। এই একাত্তর বছরের দলটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দল। তারাই আমাদের উপহার দিয়েছে বাংলাদেশ। তাদের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাজউদ্দীনের মতো নেতার দল আজ আসলে কোথায় দাঁড়িয়ে ? শেখ হাসিনার ব্যাপ্তি আর উদ্ভাসের কথা আমরা জানি। তিনি আছেন বলেই বাংলাদেশ বহু ঝড় ঝাপটা থেকে বেঁচে আছি। দেশ মুক্ত আছে জঙ্গিবাদের কবল থেকে। কিন্তু এটাই সবকিছু না। আজ আপনি যদি দেশের খবর নেন তো দেখবেন মানুষের মন মানসিকতা কতটা পরিবর্তিত হয়ে গেছে। ক্রিকেট খেলার কথাই বলি। এখনো বাংলাদেশ জিতলে মিছিল হোক বা না হোক পাকিস্তান জিতলে মিছিল হয়। আফগানিস্তানের জন্য সেদিন যে মাতম হলো তার কারণ তারা ভারতের সাথে খেলছিল। এত ভারত বিরোধিতা আমরা পাকিস্তান আমলেও দেখিনি। ভারত আমাদের বন্ধু না দুশমন সে তর্কে যাবো না। তারা আমাদের সাথে সবসময় ভালো আচরণ করছে  এমন ও না। বরং তাদের অনেক কাজই আমাদের জন্য হতাশার। কিন্তু ভারত বিরোধিতার জোয়ার কি সে জন্য? না অন্ধ সাম্প্রদায়িকতা দায়ী? এ সত্য সবাই জানলেও স্বীকার করেন না। আজকের বাংলাদেশে ধর্ম যে আচরণ সর্বস্ব সেটাও আমরা জানি। কিন্তু এর ফাঁকে একটি মুক্ত জাতিকে কতটা বন্দি আর পিছিয়ে দেয়া হচ্ছে তার হিসেব কি রাখছে কেউ?
সমাজের আরো  অনেক রোগ এখন অ-নিরাময়যোগ্য। যৌনতা মানুষের স্বাভাবিক প্রবৃ্ত্তি। সে যৌনতার শুদ্ধতা এখন ভয়াবহ প্রশ্নের সম্মুখীন। মানুষের  বিয়ে বা যুগলবন্দি জীবন এখন তোপের মুখে। মুখে না বললেও সবাই জানেন ঘরে ঘরে নামমাত্র সম্পর্ক টিকে আছে। কেন? সামাজিক মিডিয়া যত খুলেছে তত মানুষ বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। সামাজিক মিডিয়ার ব্যবহারে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকা দেশ। কিন্তু এর আসল ইস্তেমাল নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাতের ঘুম হারাম করা জাতি এখন অসুস্থ। দুনিয়ার অনেক দেশে যাবার  সুবাদে একথা বলতে পারি বাংলাদেশের সামাজিক মিডিয়া মানুষের যতটা লাভ করেছে তার চেয়ে বেশি করছে লোকসান। কারণ আমরা আসলেই এর ব্যবহার জানি না। এর ভেতরের সৌন্দর্য বা বাহ্যিক আবরণ ও আজ খসে গেছে। যে কারণে সমাজে এখন যৌনতার ছড়াছড়ি।  ধর্ষণ এর মত জটিল বিষয়ও সহজ করে ফেলেছি আমরা।
সমাজের আরো কিছু বিষয় এখন মানুষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। টাকার এত লোভ আর ঘুষ দূর্নীতির এমন সামাজিকায়ন একটি দেশকে পিছিয়ে দিতে যথেষ্ট। উন্নয়নের যে জোয়ার বা ধাবমানতা সে রথ একটু থামলেই টের পাওয়া যাবে কতটা খারাপ অবস্থা। রাজনীতি নাই  একথা লিখে শুরু করেছিলাম কিন্তু এখানে রাজনীতি আছে। রাজনীতি মানে সেলটার, আশ্রয়। বলাবাহুল্য সে সেলটারদাতা এখন আওয়ামী লীগ। সরকারী দল বলে তাদের ছত্রছায়ায় বেড়ে উঠেছে এসব চক্র। যাদের হাতে আকাশ নদী সাগর মাটি কিছুই আর নিরাপদ না। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে আনতে যাওয়া পাইলট গেছেন বিনা পাসপোর্টে। ঘটনা যেভাবেই ঘটুক এতে এটা স্পষ্ট কোথাও নিয়ম মানার রেওয়াজ নাই। আর থাকলেও তা কারো কারো জন্য প্রযোজ্য না। এমন সমাজ কে পথ দেখাবে কারা?
এ কথা শুনতে খারাপ হলেও সত্য রাজনৈতিক দলগুলো আজ দিশেহারা। কারন তাদের কোন আদর্শ নাই। কোনও দলেরই তা নাই। সবাই আছে আখের গোছানোর কাজে। বারবার উন্নয়নের কথা বলে বা যেটুকু উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকাটা যদি যথেষ্ট তো বলার কিছু নাই। আর যদি আমরা চাই বাংলাদেশ তরতর করে এগিয়ে যাক তবে সামনের পথ কঠিন। দলবাজী আর একতরফা সবকিছুতে দম আটকে থাকাটা ভালো কিছু না। এর ফলাফলে নিজেরাই নিজেদের শত্রু হয়ে উঠবে একদিন। বাংলাদেশের রাজনীতি রোহিঙ্গা সমস্যার মত সমস্যা নিয়েও টালবাহানা করে। আজ আমরা স্বীকার করছি তারা পরিবেশের দুশমন। তারা পাহাড় কাটছে মানুষ মারছে ড্রাগের ব্যবসা করছে। কিন্তু যখন ঠেকানো যেতো তখন আমরা মানবিকতার নামে অন্ধ থেকেছি। বড় করে তুলেছিলাম তাদের ধর্মীয় পরিচয়। এই রোহিঙ্গা সমস্যার পরিণাম যে কত ভয়াবহ হতে পারে সময়ই তা বলে দেবে।
সব মিলিয়ে আমরা একদিকে যেমন উন্নয়নের রথে বা পথে আরেকদিকে কোথাও শান্তি নাই। মানুষের মনে বা জীবনে স্বস্তি এই আছে, তো এই নাই। তাই সরকারকে যেমন তেমন মানুষকেও নিশ্চিত করতে হবে কী চায়, কেন চায়? এই নির্ধারণ আজ জরুরী ঘরে বাইরে স্ববিরোধিতা নিজেদের জাতীয় চরিত্র সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে বাঙালি বলে গর্ব করা বেমানান। তেমনি টাকা পয়সার জোয়ার বা উন্নয়নও এক বিষয় না। আমরা চাই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন ও শান্তিতে এগিয়ে চলুক। কোন ক্যামোফ্লেজ চাই না আর।