প্রধানমন্ত্রীর চীন সফর: শিক্ষা ও গবেষণায় অগ্রগতি নতুন মাত্রা পাবে কি?

আশরাফুল আলম
Published : 27 June 2019, 01:48 PM
Updated : 27 June 2019, 01:48 PM

অর্থনীতি, সমরশক্তিতে আমূল বদলে যাওয়া গণচীনের গল্প মোটামুটি সবারই জানা। চীনের এই উত্থান বিশ্বজুড়ে যেমন আলোড়ন সৃষ্টি করে, তেমনি পিছিয়ে থাকা উদীয়মান অর্থনীতির দেশগুলো জন্য রোল মডেল। ১৯৭৫ সালে আনুষ্ঠানিক কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার বহু পূর্বেই বাংলাদেশের সাথে চীনের যোগাযোগ অনেক গভীরে প্রোথিত। ঐতিহাসিকদের মতে, এ বন্ধন প্রায় দু'হাজার বছরের বেশি।

প্রাচীন 'সিল্ক রোড' বাংলাদেশকে চীনের সাথে সংযোগ স্থাপন করে; যা সিয়ান (পূর্বে ছাংআন) থেকে সিনজিয়াং হয়ে আফগানিস্তান ও ভারতের পর বাংলাদেশের সাথে সংযুক্ত করেছিল। এরআগে আরো একটি 'সিল্ক রোড' এর সন্ধান পাওয়া যায়; যা দক্ষিণ চীনের কুনমিং থেকে মিয়ানমারের (বার্মা) মধ্যদিয়ে বাংলাদেশের সাথে যুক্ত হয়। ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান ঘটে এই সংযুক্তির মধ্য দিয়ে।

বাংলাদেশ ও চীনের জনগণকে যুদ্ধ ও দারিদ্র্যের কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। এমনকি, দু'দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের জন্য লড়াইও করতে হয়েছে। চীনা নেতৃত্বের দূরদর্শিতা, সময়োপযোগী পরিকল্পনা গণচীনকে আজ বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত শক্তিতে রূপ দিয়েছে। অন্যদিকে, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রজ্ঞা ও সাহসী নেতৃত্বেও উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে বাংলাদেশও বিশ্বমঞ্চে সমাদৃত।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের মানুষ কঠোর পরিশ্রম করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছে। দেশের প্রবৃদ্ধিও সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে চলেছে। চীন, বাংলাদেশের বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য বন্ধু ও অংশীদার হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিল্প, প্রতিরক্ষা, শিক্ষা ও সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার ধারা অব্যাহত রেখেছে। আত্মবিশ্বাসের সাথে বলা যায়, পূর্বদিকে তাকালে একটি শক্তিশালী হাত বাংলাদেশের দিকে প্রসারিত রয়েছে। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত কারণেও বাংলাদেশের প্রয়োজনীয়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ চীনের কাছে।

বাংলাদেশের তরুণদের কাছে পশ্চিমী দেশগুলোয় পড়াশুনা রীতিমতো স্বপ্নের মতো। চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে এ কথা দাবি করতে পারি যে, তরুণদের ওই ধারণায় এরইমধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। বর্তমানে চীনের শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এসেছে; যা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। গণচীনের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বের প্রখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও টক্কর দিচ্ছে এখন; গবেষণায় বিশ্ব র‌্যাংকিয়ে উল্লেখ্যযোগ্য সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে থাকছে দেশটির। এতেও চীনারা সন্তুষ্ট নয়। শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটিয়ে শীর্ষস্থান দখলে হাজার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে চীন সরকার। শিক্ষা, গবেষণা, চিকিৎসা ও বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিদেশি মেধাবীদের আকৃষ্ট করতে অব্যাহত রেখেছে সরকারিসহ বিভিন্ন ক্যাটাগরির বৃত্তি। অসংখ্য বাংলাদেশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী, গবেষক, চিকিৎসক চীনে অধ্যয়নের পাশাপাশি গবেষণা কাজে নিয়োজিত রয়েছে।

সবকিছুর পেছনে মূল চালিকা শক্তি অর্থ। অর্থায়ন প্রক্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে উৎকৃষ্টমানের গবেষণায় আগ্রহী করে তোলে। শিক্ষা ও গবেষণাক্ষেত্রে চীনের এই উত্থান হঠাৎ করে নয়। লন্ডনভিত্তিক সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করতে ১৯৯৫ সাল থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ অব্যাহত রেখেছে চীনা সরকার। একজন শিক্ষক হিসেবে দাবি করতে পারি, চীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক গবেষণায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের যথেষ্ট প্রণোদনার ব্যবস্থা রয়েছে। মোদ্দা কথা হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে এবং বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাতারে চীনা বিশ্ববিদ্যালগুলোকে অন্তর্ভূক্ত করতে যা প্রয়োজন, চীন সরকার তাই-ই করছে।

যেকোনো দেশ ও জাতির উন্নয়ন, অগ্রগতি যা-ই বলি না কেনো শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। একটি প্রজন্ম বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস পায় একমাত্র প্রায়োগিক ও উপযোগী শিক্ষার মাধ্যমে । সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই তালিকায় সন্তোষজনক অবস্থানে নেই। এসব বিষয়গুলো আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার বাস্তবচিত্রগুলো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং একজন বাংলাদেশি হিসেবে আমাকে লজ্জায় মাথা নোয়াতে হয়। সুতরাং, ভবিষ্যত প্রজন্ম, দেশের সমৃদ্ধি-অগ্রগতি এবং সর্বপরি সত্যিকার 'সোনার বাংলা' রূপায়ণে কালবিলম্ব না করে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজানো দরকার বলে মনে করি।

আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে গবেষণা ও প্রায়োগিক উপযোগী করতে হবে যাতে অভ্যন্তরীণ শ্রমবাজারের ঘাটতি পূরণ করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সুযোগ বৃদ্ধি করে। বর্তমান বাস্তবতায় শিক্ষা, গবেষণায় অব্যাহতভাবে পিছিয়ে থাকলে দেশিয় খাতগুলো বিদেশিদের দখলে চলে যাবে বলে অনুমেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সার্বক্ষণিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রবণতা অনুসরণ করতে হবে; আর এভাবেই হালনাগাদ করতে হবে পাঠক্রম ও শিক্ষকদের দক্ষতা। এছাড়া, শিক্ষাখাতের মৌলিক পরিবর্তনে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সেক্ষেত্রে চীন হতে পারে আমাদের অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

কর্মমুখী শিক্ষায় চীন অদ্বিতীয়। ইতোমধ্যে শিক্ষাক্ষেত্রে চীনের বৈল্পবিক পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ প্রকল্প অনেক অর্থায়ন করছে শিক্ষার্থীদের। ইউজিসি, বঙ্গবন্ধু শিক্ষা ও গবেষণা ফেলোশিপ এই বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনেশিয়েটিভ প্রকল্প অথবা চায়না সায়েন্স ফাউন্ডেশন (এনএসআফসি) এর সাথে যৌথ ও দ্বিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় দীর্ঘমেয়াদী কৌশল প্রণয়ন সময়োপযোগী বলে মনে করি। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে আমরা যদি উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নয়নে চীনের সাথে যৌথভাবে কাজ শুরু করি, তাহলে সেদিন হয়তো বেশি দূরে নেই যেদিন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শীর্ষে অবস্থান করে নিতে পারবে। এছাড়া, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি শিক্ষক, গবেষকদের দেশীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সাথে সংযুক্তির পাশাপাশি যথাযথ সম্মান দিয়ে দেশে ফিরে আসার প্রস্তাব দেওয়া যেতে পারে; যা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি অবিস্মরণীয় উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হবে বলে বিশ্বাস করি।

বঙ্গবন্ধু কন্যা  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুলাইয়ের ১ তারিখ চীন সফরে আসছেন। ২০১৬ সালে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বাংলাদেশ সফরের অগ্রগতি পযালোচনা এবং দেশটির ডালিয়ানে অনুষ্ঠিতব্য ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের গ্রীষ্মকালীন বৈঠকে অংশ নিবেন প্রধানমন্ত্রী। তার এই সফরে শিক্ষা ও গবেষণা বিনিময়সহ বাংলাদেশের শিক্ষাখাতের অগ্রগতিতে বিভিন্ন প্রকল্প বিষয়ে আলোচনা অনুষ্ঠিত হওয়া বাঞ্চনীয় বলে মনে করি।