আলিফ-লাইলা-১: র‌্যাংকিং সাহেবের মুখ ফসকানো বিদায়-চুম্বন

শিশির ভট্টাচার্য্যশিশির ভট্টাচার্য্য
Published : 25 June 2019, 01:32 PM
Updated : 25 June 2019, 01:32 PM

[হিন্দুস্তানের বদমেজাজি বাদশাহ শাহরিয়ার তার তথাকথিত চরিত্রহীনা বেগমের পরকীয়ায় যারপরনাই নারাজ হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যে প্রতি রাতে তিনি এক যুবতীকে নিকাহ-এ-মুতা করবেন এবং ভোর হলেই এক রাতের সেই বেগমকে কতল করবেন। কয়েক বৎসরে শত শত যুবতী বেঘোরে ইন্তেকাল ফরমালে ক্ষুরধার বুদ্ধিমতী উজিরকন্যা শেহেরজাদি করুণাপরবশ হয়ে ছোটবোন দিনারজাদির সঙ্গে সল্লা করে বাদশা শাহরিয়ারকে নিজেই নিকাহের প্রস্তাব দেন। প্রস্তাব গৃহীত হয়। জীবনের শেষ রাত্রিতে শেহেরজাদির আবদার রাখতে বাসরঘরে ডেকে আনা হয় দিনারজাদিকে। রাত গভীর হলে পূর্বপরিকল্পনামাফিক শেহেরজাদিকে এক সওয়াল জিজ্ঞাসা করলেন- দিনারজাদি: 'দিদি, সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান কেন হয় না!' কালবিলম্ব না করে শেহেরজাদি এই সওয়ালের জওয়াব বাৎলাতে আরম্ভ করলেন।]

শোনো বোন দিনারজাদি! বাংলাদেশে বর্ষাকাল সমাগত। সুতরাং একটি আষাঢ়ে গল্প দিয়ে শুরু করি। যে ইংরেজ কর্মকর্তার নামে ঢাকার র‌্যাংকিং স্ট্রিট, তিনি একবার অফিসিয়াল ট্যুরে যাচ্ছিলেন নারায়ণগঞ্জে। ফুলবাড়িয়া স্টেশনে ট্রেনের পাদানিতে দাঁড়িয়ে সাহেব প্ল্যাটফর্মে অপেক্ষমান স্ত্রীকে বিদায়চুম্বন দিতে গেলে ট্রেনের অতি দ্রুতগতির কারণে সেই চুম্বন মেমসাহেবের টসটসে গালের বদলে গিয়ে লেগেছিল নারায়ণগঞ্জ স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে র‌্যাংকিং সাহেবের জন্যে অপেক্ষমান বুড়ো চাপরাশি ইসমাঈলের থোবড়া গালে।

র‌্যাংকিং সাহেব তার মুখ-ফসকানো সেই চুম্বনসহ 'নাই' হয়ে গেছেন আজ কত বছর! কিন্তু বাঙালিরাও সেই থেকে বা তারও অনেক আগে থেকে জীবনের কোনো ক্ষেত্রে কোনো প্রকার র‌্যাংকিং-এর ধারে কাছে 'নাই'। কৃষি, শিল্প (উভয়ার্থে), সাহিত্য, প্রকাশনা, চিকিৎসাব্যবস্থা, আমলাতন্ত্র, ক্রীড়া, সেনাবাহিনী, পুলিশবাহিনী, দুদক, বিচারবিভাগ, সংসদ… কোন ক্ষেত্রটিতে তারা বিশ্বমানের? তাদের কৃষি সেকেলে। শিল্পজাত দ্রব্য তারা প্রধানত আমদানিই করে। (হুমায়ুন আহমেদ গত হবার পর?) সাহিত্যও তারা অনেকটাই হিন্দুস্তান থেকে আমদানি করে। ওদের শিল্পকর্ম বিশ্বমানের বলা যাবে না। ভাষ্কর্য, বিশেষ করে ঢাকা শহরের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা মৃণালহকীয় ভাষ্কর্যগুলোর সিংহভাগ অতি কদর্য। চিকিৎসার জন্যে ক্ষমতা থাকলে বাঙালিরা সিঙ্গাপুর যায়, আর অক্ষম হলে যায় ভারতে। খেলাধুলায়ও কি ওদের সেরা বলা যায় (যদিও ক্রিকেট তারা ইদানিং ভালোই খেলছে বটে!)?

ঘনঘন, কারণে-অকারণে আমলাদের বিদেশ পাঠায় বাংলাদেশ সরকার প্রশিক্ষণের জন্যে। কিন্তু আমলাতন্ত্রের দুরবস্থা যে কে সেই। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় রয়েছে দীর্ঘসূত্রিতা আর টাকার খেলা। বেশির ভাগ বাঙালি বুদ্ধিজীবী যে মানের প্রবন্ধ লেখে পত্রপত্রিকায়, যে মানের আলোচনা করে দৃশ্য-শ্রাব্য মিডিয়ায়, সেগুলো পড়ে-শুনে-দেখে মনে হয়, লিখবে বা বলবে কী, এরাতো এখনও চিন্তাই করতে শেখেনি। বাংলাদেশের পুলিশে ছুঁলে আঠারো ঘা। হয় ঘুস, নয় ঘুষিতেই বেশির ভাগ কাজ হয় বাংলাদেশে। যে পদ্মাসেতু বানাচ্ছে ভেবে বাঙালিরা আহ্লাদে অষ্টখণ্ড হচ্ছে, সেটি নির্মাণ করতে করতে (পরের মাথা কামিয়ে শিক্ষানবিশ ক্ষৌরকার যেভাবে কাজ শিখে) কাজ শিখছে চীনারা। বাংলাদেশ শুধু টাকার জোগান দিচ্ছে। বোন, বাংলাদেশ হচ্ছে পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে ট্রাফিক সিস্টেমের লাল-সবুজ আলো নিজের মতো জ্বলে, গাড়ি ইচ্ছেমতো চলে এবং কেউ কখনও কিছু বলে না।

কোনো কিছুই যেখানে কোন প্রকার র‌্যাংকিং-এ পড়ে না, সেখানে গত কয়েক বছর ধরে সামাজিক ও প্রথাগত গণমাধ্যমে ক্রমাগত হাহুতাশ করা হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং নিয়ে। বিশ্ব-র‌্যাংকিং দূরে থাক, এশীয় র‌্যাংকিং-এও নাকি বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধ নেই। চরিত্র কিংবা অর্জনের দিক থেকে প্রাইভেট হোক বা পাবলিক, বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই আসলে 'বিশ্ববিদ্যালয়' হয়ে ওঠেনি। এগুলো বড়সড় কলেজ মাত্র এবং সে কারণেই বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং-এ এগুলোর কোনোটিই অন্তর্ভুক্ত কথা নয়। কিন্তু আমজনতাকে সে কথা বোঝাবে কে, বিশেষত এই আওয়াম এবং আমের মৌসুমে?

বাংলায় 'গরীব' মানে ফকির, কিন্তু আরবিতে 'গরিব' শব্দের অর্থ অদ্ভুত বা অপরিচিত কোনো ব্যক্তি। দশ রকমের দু নম্বরী করে পকেটে কিছু কাঁচা পয়সা আসাতে বাঙালিকে আর 'ফকির' বলা যাবে না, কিন্তু গরিব সে অবশ্যই, মননে ও আচরণে। এমন অদ্ভুত হয়ে উঠেছে সে যে তাকে আর চেনা যায় না। তার 'ঘোরারোগ' হয়েছে, কারণে-অকারণে ঘুরতে যাচ্ছে সে এদিক-ওদিক, কাটমুণ্ডু, কোলকাতা, ব্যংকক। র‌্যাংকিং হচ্ছে গরীব বাঙালির ঘোড়ারোগ। গরীব মাত্রেই নিরীহ নয়। গরীব এবার আঙ্গুল তুলেছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে, যেটি দেশের প্রাচীনতম এবং সম্ভবত প্রধানতম বিশ্ববিদ্যালয়: 'মনু, তোমরা যে এত হম্বিতম্বি করো, দশ টাকায় ছপ-চমুচা খাও, র‌্যাংকিং-এ তোমরা নাই কেন, হেইয়ে এড্ডু বুঝায়া বলবা?'

যেহেতু সরকার তথা জনগণের টাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় চলে, সেহেতু কিছুটা জবাবদিহিতাতো থাকেই। ভাত দেবার ভাতার যদি উচিৎ সার্ভিস না পেয়ে কিল দেবার গোঁসাই হয়ে উঠে, তবে আপত্তিই বা করবেন কোন মুখে? এই মাথামোটা গোঁসাইদের বুঝিয়ে বলতে হবে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়টা বাংলাদেশের একটি ক্ষুদ্র অংশ বই নয়। স্বাস্থ্য হলে সারা শরীরে হয়, হাতটা শুধু স্বাস্থ্যবান, মাথাটা স্বাস্থ্যহীন- এমনটা হয় না। বাংলাদেশের কোনো সেক্টরেই যেহেতু মানসম্পন্ন কিছু হচ্ছে না, সেখানে হঠাৎ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মান উপচে পড়ার কথা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এর বাইরে থাকার এই হচ্ছে প্রথম কারণ।

২০১৯ সালের সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশ কয়েকটি তালিকা রয়েছে আন্তর্জালে। তার অন্তত একটিতে দেখলাম, ১০০টির মধ্যে ৮০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ইওরোপ ও উত্তর আমেরিকায়। বাকি ২০টি বিশ্ববিদ্যালয় চীন, জাপান, কোরিয়া আর সিঙ্গাপুরে অবস্থিত। এশিয়ার সেরা ১০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকায় এক আইআইটি ছাড়া ভারতের আর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই। পাকিস্তান, ব্রাজিল, থাইল্যান্ড এসব দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ও নেই সেই তালিকায়। তুমি বলতে পারো, পাকিস্তান বা থাইল্যান্ডের সঙ্গে কেন আমি বাংলাদেশের তুলনা করবো? করবো এ কারণে যে তুলনীয় দুই বস্তুর মধ্যেই তুলনা চলে। ইংল্যান্ড কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করলে কিছুই বোঝা যাবে না। ফিলিপাইন কিংবা ব্রাজিলের সঙ্গে তুলনা করলে বাংলাদেশের অবস্থানটা বোঝা গেলেও যেতে পারে। এর মানে হচ্ছে, র‌্যাংকিং-এ সেরা একশতে থাকার যে শর্তগুলো রয়েছে সেগুলো পূরণ করা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল বা গরীব দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে অসম্ভব না হলেও কঠিনতো বটেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং-এ স্থান না পাবার এটা দ্বিতীয় কারণ।

যে কোনো বিচারে অক্সফোর্ড কিংবা এমআইটি সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। এর প্রথম কারণ, এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকদের মধ্যে একাধিক নোবেল পুরস্কারধারী রয়েছেন। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মধ্যে কোনো নোবেল পুরস্কারধারী নেই শুধু নয়, কেউ ভুল করে এই এলাকায় ঢুকে পড়লেও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য অমর্ত্য সেনের মতো নাজেহাল হয়ে তিনি বেরিয়ে যেতে বাধ্য হবেন। নোবেল পুরস্কারধারী পেতে গেলে বিদ্যাচর্চার যে দীর্ঘকালীন পরিবেশ-মানসিকতা লাগে, সে পরিবেশ পূর্ববঙ্গে নেই, ছিল না কোন কালে। ভাটি বা ব-দ্বীপ অঞ্চলে চাষবাস হতে পারে, কিন্তু জ্ঞানচর্চা হয় কি? সেই পরিবেশ সৃষ্টির সামর্থ্য আমাদের নেই, কখনও ছিল না। যারা এক সময় বাংলাদেশে বিদ্যাচর্চা হতো বলে দাবি করেন, তারা মূলত 'শোনার বাংলা' রোগে ভুগছেন। এই রোগ সংক্রামক, সুতরাং সাধু সাবধান! বাংলাদেশে বিদ্যমান সার্বিক আর্থ-সামাজিক-মানসিক পরিবেশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্বসেরা হয়ে উঠতে পারে না। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং থেকে ছিঁটকে পড়ার তৃতীয় কারণ।

র‌্যাংকিং-এ সেরা একশতে থাকার অন্যতম শর্ত মাথাপিছু প্রাপ্ত সুযোগ-সুবিধা। প্যারিসের সর্বোর্ন বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি তালিকায় স্থান পেয়েছে। আমি শেহেরজাদি ও তুমি দিনারজাদি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। তোমার নিশ্চয়ই মনে আছে, ছাত্রাবাসে আমার একান্ত নিজস্ব আলাদা কক্ষ ছিল। আমি একা থাকতাম সেই কক্ষে। চেয়ার ছিল, টেবিল ছিল, বইয়ের তাক ছিল, বেসিন ছিল। পরিচ্ছন্ন গণবাথরুম, স্নানাগার ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে আমার কক্ষের সমান ক্ষেত্রফলের একটি কক্ষে জনা দশেক শিক্ষার্থী গরুছাগলের মতো পরস্পরের গায়ে লেগে শোয়। এ ধরনের কক্ষকে বলা হয় 'গণরুম'। গণরুমের মেঝেতে পাতা থাকে ক্যাম্পাসের এখান-ওখান থেকে না বলে খুলে আনা ('চুরি করা' বলছি না চক্ষুলজ্জাবশত) প্লাস্টিকের ব্যানার। ঘাম আর অনুরূপ একটি গন্ধে নরক গুলজার। বইপত্রের বালাই নেই, নোট বা গাইডবই সম্বল। সেগুলো আবার স্তুপ করে রাখা আছে বারান্দায়, পায়াভাঙা একটি প্লাস্টিকের শেলফে।

গণটয়লেট যদিও জঘন্য রকম নোংরা, তা নিয়ে কারও অভিযোগ নেই, না হাউজ টিউটর বা প্রভোস্টের, না শিক্ষার্থীদের। হতে পারে, এর চেয়ে পরিস্কার টয়লেট হয়তো তারা জীবনে দেখেইনি। অনেকের কাছে গণরুমের মতো নরককু-ও সোনার হরিণ। এখানে থাকতে গেলে দলের বড়ভাইয়ের নির্দেশে রাতবিরাতেও মিছিলে যেতে হয়। কারণে-অকারণে চর-থাপ্পর-লাথি খেয়ে হজম করতে হয়। শাস্তিস্বরূপ গণরূম থেকে বহিষ্কৃত হয়ে শীতের রাতে বারান্দায় শুতে বাধ্য হয়ে নিউমোনিয়ায় মারা যাওয়ার মতো ঘটনা একাধিক ঘটেছে।

প্যারিসে মাত্র ৫ ফ্রাঁতে পাঁচ পদ সুস্বাদু খাবার দিয়ে পেট ভরে খেতাম, আমি শেহেরজাদি যখন শিক্ষার্থী ছিলাম। চীনের ইউনান বিশ্ববিদ্যালয় যেটি র‌্যাংকিং-এর ধারে কাছে নেই, সেখানেও সামান্য অর্থে শিক্ষার্থীরা উন্নত খাবার পায়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কী খায় সাধারণ ছাত্রেরা? ছাত্রাবাসে যে সুখাদ্য পরিবেশন করা হয় না তাতে কোনো সন্দেহ নেই। হোস্টেলের ডালের গল্প কে না জানে! ছাত্রনেতারা ফাউ খাবার কারণে খাবারের মান ভালো হয় না, নাকি এর অন্য কোনো কারণ আছে জানি না। আমার মনে হয়, সুযোগ-সুবিধার অপ্রতুলতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং থেকে বাদ পড়ার চতুর্থ কারণ।

সম্প্রতি নাকি একটি হল থেকে ক্যান্টিন-চালকেরা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে, কারণ নবনির্বাচিত ছাত্রনেতারা নাকি তাদের কাছে অসহ্য রকম চাঁদা দাবি করেছে। নেতা হওয়াতে প্রচুর সময়, অর্থ ও পেশিশক্তি বিনিয়োগ করতে হয় এবং বিনিয়োগ থেকে যদি লাভ না আসে, তবে ব্যবসায়ী মানবে কেন! এই মাৎস্যন্যায় পরিবেশ, অখাদ্য খাবার, মাথাপিছু এই মানের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে সেরা একশ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় স্থান পাবার কথা স্বপ্নেও কি ভাবতে পারে কেউ?

বাংলাদেশের সরকার, জনগণ, প্রতিষ্ঠান… সবকিছু এক স্বখাত-সলিল, অসুস্থ সিস্টেমের শিকার। এক অদ্ভ'ত গোলোক-ধাঁধা বা ভুলভুলাইয়ায় আটকে আছে বাঙালিরা সবাই। এখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলছি বটে, কিন্তু আমি নিশ্চিত, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, দেশরক্ষা বিভাগ, ব্যবসা, সংস্কৃতি… বাংলাদেশের সব সেক্টরে এক অবস্থা, ফারাক উনিশ আর বিশ। অবস্থা কিংবা দূরবস্থা, যাই বলো না কেন তুমি দিনারজাদি। যতদিন লাল আলোতে গাড়ি চলবে, ততদিন অবস্থা পাল্টাবে না, পাল্টানোর কথা নয়। র‌্যাংকিংও ততদিন সোনার হরিণ হয়েই ছুটে বেড়াবে বাঙালির নাগালের বাইরে।

ততদিন জীবন কিন্তু থেমে থাকবে না। জীবনের রেলগাড়ি তীব্রবেগে ছোটার কারণে র‌্যাংকিং সাহেবের চুমু মুখ ফসকে ঈসমাইলের থোবড়া গালেই পড়তে থাকবে সুদূর নারায়ণগঞ্জে গিয়ে, আর বেচারা মেমসাহেব তার সোনার যৈবন আর টসটসে গাল নিয়ে সোনার বাংলার ফুল (Fool)-বাড়িয়া স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবেন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। 'কিংকর্তব্যবিমূঢ়' কথাটার প্রতি তোমার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, বোন দিনারজাদি। শব্দটির মানে হচ্ছে: 'এমন একজন ব্যক্তি, যে কিং বা রাজা হয়েও নিজের কর্তব্য বুঝতে পারে না, বিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বাঙালি চরিত্রের সব বৈশিষ্ট্য এই সংজ্ঞায় ফুটে উঠেছে। যে বিমূঢ়, সে কিং হলেই বা কি, কিংকং হলেই বা কি!

[বাদশা এবং দিনারজাদি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলেন। ইতিমধ্যে পূবের আকাশে সুবেহ-সাদিকের চিহ্ন ফুটে উঠলো এবং ভোরের আযান শোনা গেল। শেহেরজাদি অনতিবিলম্বে মুখে কুলুপ আঁটলেন এবং দুই বোন ফজরের নামাজ পড়ে নকশি-লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লেন। ৩০টি কারণের মধ্যে বাকি ২৬টি জানার আগ্রহ ছিল বলে শেহেরজাদির মৃত্যুদণ্ড পরের সকাল পর্যন্ত স্থগিত করে বাদশা শাহরিয়ারও ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়ে গেলেন।]