দেশে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। গবেষণাতথ্য মতে, বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ মানুষ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি। জ্ঞান বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রের উন্নতির ফলে দেশের মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। ফলে দেশে প্রবীণ জনসংখ্যার হারও বাড়ছে।
আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রবীণ অভিশপ্ত জীবন কাটান। দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হওয়া, শ্রবণশক্তি কমে যাওয়া, সঙ্গে পেশি দুর্বল, হাড়ের ক্ষয়, যকৃৎ এবং বৃক্কের কার্যক্ষমতা কমতে থাকা— বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ রকম নানা সমস্যা দেখা দেয়। শারীরিক পরিবর্তনের কারণে কিছু কিছু রোগ প্রকৃতিগতভাবে বয়স্কদেরই হয়ে থাকে। যেমন, তাদের রক্তনালি সরু হয়ে যায়। ফলে উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ প্রভৃতি হতে পারে। প্রবীণদের মস্তিষ্ক ছোট হয়ে আসে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলে 'ব্রেন এট্রফি'। এর ফলে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। কেউ কেউ আলঝেইমার বা ডিমেনসিয়ায় আক্রান্ত হন। এসব রোগে স্মৃতিশক্তি কমে যায়, আবেগ, অনুভূতি, বিচারবুদ্ধি, বিবেচনাশক্তি, চিন্তাক্ষমতা, কাজ করার ক্ষমতা ইত্যাদিতে পরিবর্তন আসে। আচার-আচরণে অনেকেই শিশুতে পরিণত হন।
এ ছাড়া মাথাঘোরা, হাত-পা কাঁপা যাকে বলে 'পার্কিনসন্স ডিজিজ' ইত্যাদি নানা ধরনের মস্তিষ্কের রোগও প্রবীণদের মাঝে দেখা যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে হাড় ক্ষয়ে যায়, যাকে বলা হয় অস্টিওপরোসিস। এতে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্যথা বোধ করেন প্রবীণেরা। মাঝেমধ্যে সামান্য আঘাতেই হাড় ভেঙে যায় তাঁদের। চোখে ছানি পড়াটাও বয়স্কদের রোগ। পুরুষদের ক্ষেত্রে প্রস্টেট গ্রন্থি বড় হয়ে প্রস্রাবের জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেক বয়স্ক ব্যক্তির শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়। ফলে তাঁদের বিভিন্ন ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। যেমন: নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা ইত্যাদি।
শুধু শারীরিক সমস্যা নয়, মানসিকভাবেও তাঁরা অনেক সময় বিপর্যস্ত থাকেন। পরিবারে অনেক সময় প্রবীণেরা অবহেলা-অযত্নের শিকার হন। কখনো কখনো নিজের সন্তানেরাও তাঁদের বোঝা মনে করেন। তাই কারও কারও আশ্রয় হয় বৃদ্ধাশ্রমে। এই প্রবীণরা এখন দেশের সবচেয়ে দুর্দশাগ্রস্ত জনগোষ্ঠী।
দেশে দুই তৃতীয়াংশ প্রবীণই দরিদ্র্, শতকরা ৫৮ ভাগ প্রবীণের মৌলিক চাহিদা পূরণের সামর্থ্য নেই। এ ছাড়া বার্ধক্যকালীন সময়ে শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তনের ফলে প্রবীণরা নানা ধরনের শারীরিক ও মানসিক রোগে ভুগে থাকেন। সব কিছু বিবেচনা করলে আমাদের দেশের প্রবীণরা এ মুহূর্তে ভালো নেই। তারা অনেকটা মানবেতর দিন পার করছেন।
অথচ আজকের যাঁরা ষাটোর্ধ্ব প্রবীন তাঁরা কিন্তু যৌবনে দেশ ও দেশের জন্য অর্থবহ অবদান রেখেছেন : কিষান-কিষানি হোন অথবা শ্রমজীবী অথবা অন্য কোনো কাজে নিয়োজিত থেকে। তাই তাঁদের সম্মান করা এবং ভদ্রজনোচিত জীবনযাপনের নিশ্চয়তা দেওয়া একটি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য ও সামাজিক দায়বদ্ধতা।
২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রশংসনীয় সামাজিক নিরাপত্তাবলয় গড়ে তোলার অব্যাহত প্রচেষ্টায় ভাতাপ্রাপ্ত প্রবীণদের সংখ্যা ৪০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৪৪ লাখে উন্নীত করার প্রস্তাব রয়েছে। এ হিসাবে কিন্তু ৯৬ লাখ প্রবীণই (এক কোটি ৩০ লাখ থেকে ৪৪ লাখ বাদ) রাষ্ট্রীয় বৃত্তির বাইরে থেকে যাচ্ছেন।
বয়স্ক মানুষেরা এখন জনসংখ্যার গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলেও তাঁদের সমস্যা এবং দাবিদাওয়াগুলি সেভাবে সরকারের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না। অথচ, প্রবীণেরা ভালো থাকলে সংসারের বাকিদের মুখে হাসি চওড়া হয়।
একদা কর্মজীবী বর্তমানে অবসর জীবনযাপনকারী অনেক প্রবীণের মূল আয় হল ব্যাংক বা পোস্ট অফিসের সুদ। দুর্ভাগ্যের হল, সুদের হার ক্রমশ কমছে। সুদের উপর করহারও ক্রমাগত বাড়ছে। তাই অবিলম্বে ব্যাংক বা পোস্ট অফিসে সিনিয়র সিটিজেনদের সুদের হার বৃদ্ধি করা জরুরি। এটা ১ বা ২ শতাংশ বেশি হতে হবে। প্রয়োজনে সরকার নিজের কোষাগার থেকে সুদ বাবদ ভর্তুকি দিক, যেমন তারা শিল্পপতি, ব্যবসায়ীদের দিয়ে থাকে। একই সঙ্গে আবশ্যিক হল, বয়স্ক নাগরিকদের সঞ্চয়পত্র কিংবা ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের সুদের উপর উৎসে আয়কর (টিডিএস)-এর সীমা কমপক্ষে ৫,০০,০০০ টাকা করলে অনেক মানুষ উপকৃত হবেন।
আমাদের দেশে বহু পরিবারে প্রবীণদের রোজগারই একমাত্র সম্বল। পেনশন হোক বা ব্যাংক, পোস্ট অফিসের সুদই ওই সব পরিবারের প্রধান অবলম্বন। ফলে প্রবীণ নাগরিকদের স্বার্থে কিছু করার অর্থ সমাজের বৃহত্তর অংশের পাশেই দাঁড়ানো। বাজেট পাসের আগে অর্থমন্ত্রী এই ভাবনাটা মাথায় রাখলে ভালো করবেন।
বয়স্কদের অনেকেই আবার জীবনধারণের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল। নিম্ন আয়ের ক্ষেত্রে মাসিক বার্ধক্য বিধবা ভাতার পরিমাণ বাড়ানো দরকার। এই ধরনের সব মানুষকে সরকারি প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসাটাও খুব জরুরি। তাতে সকলেরই মঙ্গল। পথেঘাটে, রেল স্টেশনে ভিখারিদের বড় অংশ বয়স্ক মানুষ, বিশেষ করে নারী। তাঁদের দেখে বোঝা যায়, শেষ বয়সে এসে ভিক্ষা করতে বাধ্য হচ্ছেন। তাদের পুনর্বাসনে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
এ ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন প্রবীণ-নিবাসের সংখ্যা বাড়াতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার তাগিদে প্রবীণহিতৈষী সংস্থার বাইরে বিক্ষিপ্তভাবে এখানে-ওখানে কয়েকটি 'বৃদ্ধাশ্রম' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ('বৃদ্ধাশ্রম' শব্দটি বর্জনীয়। হৃদয়বানের মতো বলতে হবে, প্রবীণালয় অথবা প্রবীণ নিবাস)। সরকারি উদ্যোগে পর্যাপ্ত সংখ্যক নিবাস বানানোর কথা ভাবা যেতে পারে।
রোজগার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বয়স্ক মানুষদের জন্য দ্বিতীয় যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে সরকারের ভাবনাচিন্তা করা প্রয়োজন, তা হল চিকিৎসা। এর জন্য একটি সুস্পষ্ট স্বাস্থ্যনীতি অবিলম্বে হওয়া দরকার। প্রবীণরা যেন সহজে এবং সুলভে স্বাস্থ্য সেবা পান, তা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের দেশে এখনো বয়স্কদের স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য বিশেষায়িত চিকিৎসাসেবা সীমিত। এই বয়সে অনেক রোগই দেখা যায়, সুনির্দিষ্ট উপসর্গ থাকে না বা বয়স্করা সেগুলো ঠিকমতো অনুভব করেন না বা ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারেন না। অনেক সময় দেখা যায়, খুব জটিল বা মারাত্মক অসুখে বৃদ্ধ রোগী সাধারণ অবসাদ, দুর্বলতা, অস্বস্তি এ ধরনের সমস্যার কথা বলছেন। এমন ক্ষেত্রে পরিবার থেকেও নজর দেওয়া হয় না, এমনকি অনেক চিকিৎসকও যথার্থ মনোযোগ দেন না, হয়তো বার্ধক্যজনিত বলে মনে করেন। এভাবে অবহেলার ফলে অনেক রোগ নিরাময় সম্ভব হয় না। এর মূল কারণ বৃদ্ধদের সমস্যা সম্পর্কে বিশেষায়িত জ্ঞানের অভাব। এ ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার।
বাজেট পাশের আগে অর্থমন্ত্রী মহোদয়কে নিচের সুপারিশগুলো বিবেচনা করতে অনুরোধ জানাই:
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আজকের নবীণ আগামী দিনের প্রবীণ। বেঁচে থাকলে প্রতিটি মানুষকেই বার্ধক্যের স্বাদ গ্রহণ করতে হবে। এটি প্রকৃতির একটি স্বাভাবিক নিয়ম। আজ যদি আমরা তাঁদের প্রতি অবহেলা করি, তাহলে আমাদেরও এই রকম অবহেলার শিকার হতে হবে। এ চরম বাস্তবতাকে আমরা কেউই যেন ভুলে না যাই।