খালিদ সায়ীদ, এক পায়ের লিমন আর সরকারের ছ্যাঁচড়ামি

আরিফ জেবতিক
Published : 14 July 2012, 03:28 PM
Updated : 14 July 2012, 03:28 PM

শব্দচয়নে আরেকটু শালীনতার পরিচয় দিতে পারলে লেখক হিসেবে আমার নিজেরই ভালো লাগত কিন্তু র‌্যাবের গুলিতে পা-হারানো লিমনের সঙ্গে সরকার যে আচরণটি চালিয়ে যাচ্ছে, তাকে অনেক চেষ্টা করেও 'ছ্যাঁচড়ামি' ছাড়া আর কিছু বলতে পারলাম না। গ্রাম্য একটি প্রবাদে বলে, 'করলো ব্যাটার লাজ নাই, দেখলো ব্যাটার লাজ!' রাস্তার মাঝখানে বসে যে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয় তার লজ্জা-শরম নেই- রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে যারা এই কাণ্ডটি দেখে তারাই লজ্জিত হয়। সরকার লিমনকে নিয়ে যে ছ্যাঁচড়ামি করছে তাতে ওরা যে লাজলজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই কিন্তু নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের এই নিষ্ঠুর আচরণ দেখে আমি লজ্জিত, ক্ষুব্ধ, মর্মাহত।

লিমন আমাদের দেশের রাষ্ট্রীয় নিপীড়নের এক প্রতীকে পরিণত হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দানবীয় শক্তি কীভাবে একজন মানুষের জীবন ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে, তার খুব আলোচিত একটা প্রমাণ এই লিমন। ২০১১ সালের ২৩ মার্চ ঝালকাঠির রাজাপুর উপজেলার সাঁতুরিয়া গ্রামে নিজ বাড়ির কাছের মাঠে গরু আনতে গেলে, র‌্যাবের ক'জন সদস্য তাকে ধরে পায়ে অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। এরপর র‌্যাব নিজেদের অপরাধ ঢাকতে স্থানীয় কিছু দুর্বৃত্তের সঙ্গে লিমনকেও আসামি করে রাজাপুর থানায় দুটি মামলা করে। এর একটি অস্ত্র-মামলা। অন্যটি বন্দুকযুদ্ধ করে র‌্যাবকে সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে করা মামলা। গরিব শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান লিমনের পঙ্গু হওয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর সারাদেশে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। সাধারণ মানুষের আর্থিক সহায়তায় তার চিকিৎসা চলে। কৃত্রিম পা নিয়ে এখন সে চলাফেরা করছে। এরই ফাঁকে চলতি বছর সে এইচএসসি পরীক্ষাও দিয়েছে।

আমাদের দেশে প্রচলিত একটি ধারণা আছে যে, কারও প্রতি অবিচারের খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হলে প্রশাসন অন্তত চক্ষুলজ্জায় এবং জনপ্রতিক্রিয়ার ভয়ে সেই অবিচারের একটি প্রতিবিধান করে। সে হিসেবে লিমনের ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়া হবে এমনটাই ছিল আমার ধারণা কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘটছে উল্টোটা। লিমনকে নানা হয়রানি করা হয়েছে গতবছর। আর এই সেদিন থেকে লিমন যখন স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার জন্য চেষ্টা শুরু করেছে, নিজের হারানো পায়ের শোক চাপা দিয়ে যখন সে পরীক্ষা দিচ্ছে, নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছে- তখনই, জুলাইয়ের প্রথমদিনে লিমনের বিরুদ্ধে নতুন করে একটি চার্জশিট দাখিল করেছে পুলিশ! অভিযোগ, সরকারি কাজে বাধা দিয়েছে লিমন- সুতরাং তার শাস্তি প্রাপ্য!

এখানেই হতাশ হতে হয়। অবাক হয়ে ভাবতে হয়, একটি রাষ্ট্র কতটা নিপীড়নকামী হয়ে উঠলে এক পঙ্গু তরুণের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষোভ প্রশমিত না হয়ে বাড়তেই থাকে!

আমি জানি অনেকেই বলবেন, লিমন যে নির্দোষ, সে যে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িত নয়, তার প্রমাণ কী? বিনয়ের সঙ্গে বলতে হয় এর প্রমাণ হচ্ছে আমাদের পুলিশী ব্যবস্থা। এখানে প্রতিনিয়ত নির্দোষ লোকেরা হেনস্থার শিকার হন। রাস্তাঘাট থেকে ধরে নিয়ে নিরীহ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণীর কতজন মানুষকে ঢাকার থানায় থানায় আটকে রাখা হয়, সেটা বুঝতে থানায় যাওয়ার প্রয়োজন নেই, নিজেদের আশেপাশে খোঁজ নিলেই যথেষ্ট। লিমনের প্রতি রাষ্ট্রীয় ক্ষোভের মূল কারণ এই লিমনকে কেন্দ্র করেই সরকারের প্রতি দুয়ো দিয়েছে সাধারণ মানুষ আর দেশের মিডিয়া। তাই লিমনকে যেভাবেই হোক সন্ত্রাসী প্রমাণ করার জন্যই আদাজল খেয়ে লেগেছে সরকার। যেন ওকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করতে পারলেই সবার মুখে চুনকালি মেখে দেওয়া যাবে। এই জেদ থেকে যে সরকার নিজেরাই নিজেদের মুখে চুনকালি মেখে সং সেজে লোকের বিরক্তি উৎপাদন করছে, এ বিষয়ে তাদের হুঁশ আছে বলে মনে হয় না।

বেশ কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে জনমনে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এ রকম কাজকর্মে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে উৎসাহ দিচ্ছে সরকার। ঢাকার রাস্তায় বের হলেই দেখা যাবে ট্রাফিক সার্জেন্টরা দরিদ্র রিক্সাওয়ালা, সিএনজিওয়ালাদের কাছ থেকে গণহারে চাঁদা আদায় করছে। এই চাঁদাবাজি চিরকালই ছিল কিন্তু ইদানি অসহনীয় হয়ে উঠছে। সেদিন এক কূটনীতিকের সঙ্গে কথা হচ্ছিল এক আড্ডায়। কথায় কথায় জানালেন, বারিধারায় গত এক বছরে যে হারে কূটনীতিকদের বাসায় চুরি-ডাকাতির কথা শোনা যাচ্ছে তাতে ভবিষ্যতে কেউ বাংলাদেশে দায়িত্ব-পালনের জন্য আসতে চাইবে কিনা সন্দেহ। গার্মেন্টের কাপড়, নির্মাণ-কোম্পানির রডভর্তি বড় বড় ট্রাক আর লরি প্রায় রাতে হাইওয়ে থেকে গায়েব হয়ে যাচ্ছে, সরকার সেগুলো ঠেকাতে পারছে না। অথচ সরকারের ফোকাস হচ্ছে ফেসবুকে কে কী স্ট্যাটাস দিল এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে সেগুলোর জন্য মামলা রুজু করা!

আমি জানি না রাষ্ট্রীয় এসব নিপীড়ন, সাধারণ মানুষদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, লিমনের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর খড়গ পরিচালনার এসব সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রের কতটা উচ্চ পর্যায় থেকে আসে। তবে যে পুলিশ ফেসবুকের স্ট্যাটাস দেখে দেখে আসামী খুঁজে বের করতে পারঙ্গম, সেই ডিজিটাল পুলিশ আর তার নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই অনলাইনে আমার এই লেখাটি পড়তে পারবেন। তাদের জন্য এখন আমি একটি কাহিনী বলব।

খালিদ সায়ীদ নামের এক তরুণের কাহিনী সেটা। ২০১০ সালের ৬ জুন আটাশ বছরের এই ছেলেটি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরের সাইবার ক্যাফেতে বসেছিল। হঠাৎ সেখানে হাজির হলো দুই পুলিশ। খালিদকে কেন যেন গ্রেপ্তার করলো ওরা, তারপর পেটাতে পেটাতে মেরে ফেললো। আজকাল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও প্রায় সবার হাতেই ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল ফোন। হয়তো এ রকম এক ক্যামেরাতে ধারণ করা মৃত খালিদ সায়ীদের ছবি ক'দিন পর বিচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেটে এখানে-ওখানে দেখা যেতে থাকে। এ রকম তো কত ছবিই ছড়ায়। কিন্তু খালিদের ছবি নাড়া দেয় দুবাই-প্রবাসী আরেক মিশরীয় তরুণকে। ওয়ায়েল ঘনিম নামের সেই তরুণটি একটি ফেসবুক পেজ খুলেন। নাম দেন 'উই আর খালিদ সায়ীদ।' সেখানে তিনি লিখেন- 'ওরা খালিদকে খুন করেছে, আজ যদি আমি চুপ করে থাকি, আগামীকাল ওরা আমাকেও খুন করবে।' এভাবেই একটি ফেসবুক পেজ আর সেখানে লাইক দেওয়া আড়াই লাখ তরুণ এরপর পাল্টে দেয় মিশরের ইতিহাস। উলটপালট করে দেয় নিপীড়নকামী সরকারকে, জন্ম নেয় মধ্যপ্রাচ্য-জুড়ে গণজাগরণের নতুন ঢেউ। ক্ষমতাসীনদের জন্য এই কাহিনীটি জানা খুব জরুরি।

মিশর থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক দূরে কিন্তু ২০১০ সাল থেকে ২০১২ সাল বেশি দূরে নয়। মিশরের তরুণরা খালিদ সায়ীদের উপর রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে ফুঁসে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের তরুণরা পা-হারানো লিমনের ওপর চলমান রাষ্ট্রীয় নিপীড়নে ক্ষুব্ধ হবে না এমনটা ভেবে নেয়া ঠিক হবে না।

আগামী ভোটের সময় ব্যালট পেপার হাতে নেয়া অসংখ্য তরুণ হয়তো আঁতকে উঠে ভাববে, তাদেরও একটি করে পা নেই, তারাই এ যুগের লিমন। মিশরের তৎকালীন সরকার খালিদ সায়ীদকে সন্ত্রাসী বানানোর অনেক চেষ্টা করেছিল, শেষরক্ষা হয়নি। বাংলাদেশের সরকারও লিমনকে সন্ত্রাসী বানানোর জন্য আদাজল খেয়ে নেমেছে, আমি জানি জনমনে সেটাকে ঠাঁই দেওয়া সম্ভব হবে না। মিশরের খালিদ সায়ীদের ঘটনা থেকে আমাদের সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তিরই শিক্ষা নেওয়ার প্রয়োজন ছিল। মূর্খরা কোনও ইতিহাস থকে কিছু শিখে না- তারা শুধু চাটুকার-পরিবৃত হয়ে ছ্যাঁচড়ামিই করে যেতে পারে।

আরিফ জেবতিক : ব্লগার ও সাংবাদিক।