বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল ও বিশ শতকের মুসলিম নারী মানস

গৌতম রায়
Published : 20 June 2019, 08:11 AM
Updated : 20 June 2019, 08:11 AM
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত  বিপ্লব, বিজ্ঞানের নয়া দিগন্তের উন্মোচন ,গোটা বিশ্বজুড়েই বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে নতুন নতুন  দিশা সৃষ্টি, ভারতের জাতীয় আন্দোলনের এক উত্তুঙ্গ পর্যায়, বঙ্গভঙ্গ  ঘিরে বাংলার স্বদেশ চেতনার নয়া দিগন্তের উন্মোচন, রবীন্দ্রনাথ নজরুলকে ঘিরে সাহিত্য-সংস্কৃতি, সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবেশ, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক সব পরিমণ্ডলে এক নব যুগের উন্মেষের মুহূর্তে ১৯১১ সালের ২০ জুন ভারতীয় উপমহাদেশের নারী মুক্তি আন্দোলনের কিংবদন্তি সুফিয়া কামালের জন্ম।
অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলার শায়েস্তাবাদ পরগনার নবাব পরিবার ছিল সুফিয়া কামালের পরিবার। ভারতের তথা বাংলার জাতীয় আন্দোলন এবং শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উনিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকেই এই পরিবার ও বরিশাল জেলার ছিল ঐতিহাসিক অবদান। বরিশাল জেলাব্যাপী সাহিত্য-সংস্কৃতি, রাজনীতিসহ গোটা সামাজিক পরিমণ্ডলের যে ইতিবাচক ধারা প্রবাহ, তার প্রভাব উনিশ সূচনালগ্ন থেকেই সুফিয়া কামালের পরিবারের উপর  খুব গভীরভাবে বিস্তার লাভ করেছিল।
বরিশাল অঞ্চলে তথা পূর্ববঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে সুফিয়া কামালের মামা ব্যারিস্টার সৈয়দ মোতাহার হোসেন অত্যন্ত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার হাত ধরেই বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার, অর্থাৎ, সুফিয়া কামালের মামার বাড়িতে স্বদেশী আন্দোলনের ঢেউ, বিশেষ করে- বিদেশি দ্রব্য বর্জনের বিষয়গুলি একটা বড় রকমের প্রভাব বিস্তার করেছিল।
ব্রিটিশ সরকার নবাব শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের উপর নানা ধরনের চাপ সৃষ্টি করলেও আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সূচনা পর্বে সুফিয়া কামালের বাবার বাড়িতে চরকা এবং তাঁতের প্রচলনে সে বাঁধা কোনো প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারেনি। তাদের বাড়ির ছেলেরা তো বটেই, মেয়েরা পর্যন্ত চরকায় সুতো কাটতেন। এই বিষয়টি নিয়ে বিশ শতকের সূচনাপর্বে শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের উপর ব্রিটিশের  নানা ধরনের দমনমূলক নীতি নেমে এলেও স্বদেশীয়ানার সেই আঙ্গিক থেকে নবাব পরিবারকে বিচ্যুত করা যায়নি কোনো অবস্থাতেই।
শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের আয়মাদারি এবং শরাফতী নিয়ম-কানুনের ভিতরে শিশু সুফিয়ার প্রাথমিক স্তরে অন্তঃপুরের জীবন শুরু হলেও স্বদেশীয়ানার যে পরিবেশ তাদের পরিবারে ছিল, সেই পরিবেশের ছোঁয়াচ প্রথম থেকেই তার উপরে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করতে  শুরু করেছিল ।
মুঘল যুগে বাংলার শাসনকর্তা শায়েস্তা খাঁর সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিবারের একটি সংযোগ গড়ে উঠেছিল সপ্তদশ শতকেই। মুঘল যুগে দিল্লি, লক্ষ্মৌ, এলাহাবাদসহ সব জায়গাতেই নবাব পরিবারসহ সওদাগর ইত্যাদি সকলেরই যাতায়াতের সব থেকে নির্ভরযোগ্য মাধ্যম ছিল জলপথ ।নবাব শায়েস্তা খাঁ সেইভাবেই জলপথে দিল্লি থেকে ঢাকা আসবার কালে এক প্রবল ঝড়ের রাতে পথ হারিয়ে ফেলেন। কিছু মানুষদের সাহায্যে শেষ পর্যন্ত এক নদী চরে উঠে তিনি জীবন বাঁচান।
স্থানীয় মানুষদের এই আচরণের শায়েস্তা খাঁ তাদের উপর অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে সেই অঞ্চলের বহু লাখেরাজ জমি স্থানীয় মানুষদের বসবাসের জন্য দান করেন। সেই থেকে শায়েস্তা খাঁ এর নাম অনুসারে বরিশালের ওই অঞ্চলের নামকরণ হয় 'শায়েস্তাবাদ'।
যেসব স্থানীয় মানুষেরা সেই ঝড়ের রাতে নবাব শায়েস্তা খানের প্রাণ রক্ষা করেছিলেন, তাদের ভিতরে  অন্যতম ছিলেন সুফিয়া কামালের পূর্বপুরুষ। সুফিয়া কামালের সেই পূর্বপুরুষের নানা গুণে মুগ্ধ হয়ে শায়েস্তা খাঁ নিজের প্রথম কন্যা পরীবানুর সঙ্গে সুফিয়ার সেই পূর্ব পুরুষের বিয়ে দেন। সেই বিয়েতে শায়েস্তাবাদ পরগনাটি সুফিয়া কামালের পূর্বপুরুষকে উপহার দিয়েছিলেন নবাব শায়েস্তা খাঁ।
বর্তমান নিবন্ধকার সুফিয়া কামালের কাছে শুনেছেন যে, শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবানুর সন্তান-সন্ততিরা শায়েস্তাবাদের প্রথম বাসিন্দা এবং শায়েস্তাবাদে সুফিয়া কামালদের পারিবারিক সমাধিস্থলে পরীবানুকে কর দেওয়া হয়েছিল। ঢাকার লালবাগে পরীবানুর সমাধি বলে যে সমাধিটি রয়েছে, অনেকেই সেটিকে নবাব শায়েস্তা খার কন্যা পরীবানুর বলে উল্লেখ করলেও সুফিয়া কামাল অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন যে, ওই সমাধিটি শায়েস্তা খাঁর কন্যা পরীবানুর আদৌ নয়।
সুফিয়া কামালের পিতা, মাতা উভয়েই ছিলেন সৈয়দ বংশোদ্ভূত। তার পিতা সৈয়দ আবদুল বারী ছিলেন কুমিল্লার বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারের সন্তান। তার মায়ের পূর্বপুরুষ সৈয়দ হাসান উদ্দিন অষ্টাদশ শতকে সিন্ধু প্রদেশ থেকে ঢাকার মানিকগঞ্জ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশ সরকার সুফিয়া কামালের পূর্বপুরুষ সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেনকে নবাব উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। সে যুগের খানদানি পরিবারগুলির বৈবাহিক সম্পর্ক বেশিরভাগটাই পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতো।
সেই পারিবারিক এবং সামাজিক বৈশিষ্ট্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেই সুফিয়া কামালের দাদু সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন কুমিল্লার বিখ্যাত সৈয়দ পরিবারের সৈয়দ মোকাররম আলীর এতিম পুত্র সৈয়দ আব্দুল বারীকে সযত্নে লেখাপড়া শিখিয়ে নিজের কনিষ্ঠা কন্যা সাবেরা খাতুনের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন।
সুফিয়ার পিতা সৈয়দ আব্দুল বারী পেশাগতভাবে উকিল ছিলেন। কুমিল্লা এবং বাজিতপুরে একটা সময় তার যথেষ্ট পসার ছিল। বহু ভাষাবিদ পণ্ডিত হিসেবেও তার যথেষ্ট খ্যাতি ছিল। তবে  তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ আধ্যাত্মিক সাধনায় মগ্ন এক সাধক। পরবর্তীতে 'ইসমে আজম' জপ করতে করতে তিনি একদম আধ্যাত্বিক পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করে নিয়েছিলেন।
আধ্যাত্মিক জগতের টানে তিনি সংসার পরিবার-পরিজন শেষ পর্যন্ত ত্যাগ করেছিলেন। পিতা যখন আধ্যাত্নিক টানে সংসার ত্যাগ করেন শিশু সুফিয়ার বয়স তখন মাত্র সাত মাস। বহু খোঁজখবরের করে স্থানীয় কিছু মানুষ পবিত্র মক্কা শরীফে সুফিয়ার পিতাকে খুঁজে বের করেছিলেন। তারা দেখেছিলেন তিনি তখন সম্পূর্ণ সন্তের জীবন-যাপন করছেন। সৈয়দ আবদুল বারী পরিচিতদের শত অনুরোধ সত্ত্বেও কোন অবস্থাতেই আর পারিবারিক জীবনে ফিরে আসেন নি। পরবর্তীকালে অনেকেই সৈয়দ আব্দুল বারীকে পবিত্র আজমীর শরীফে তীর্থযাত্রীদের তৃষ্ণা নিবারণে ব্রতী অবস্থায় দেখেছিলেন ।
পিতার আধ্যাত্মিক জীবনের একটা বড় ছায়া কিন্তু পরবর্তীকালে সুফিয়া কামালের জীবনে পড়েছিল। অনেকেরই বিশ্বাস গভীর অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, মৌলবাদবিরোধী সুফিয়া কামাল কিন্তু ব্যক্তি জীবনে আধ্যাত্মিক জগতের একটি উচ্চ স্তরে অবস্থান করতেন। সুফিয়া কামালের  জীবনবোধ এটাই দেখিয়ে দিয়েছিল যে, প্রকৃত ধার্মিক কিন্তু কোন অবস্থাতেই অপর  ধর্মের প্রতি অসহিষ্ণুতা দেখাতে পারেন না, বীতরাগ হতে পারেন না।
স্বামীর আধ্যাত্নিক জীবনে প্রবেশের ফলে নিজের  সংসার জীবন চরম দুঃখময় হয়ে ওঠে সুফিয়ার মায়ের। শ্বশুরকূলের কিছু কিছু মানুষের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়ার জেরে সুফিয়ার গর্ভধারিনী সাবেরা খাতুন  কার্যত বাধ্য হয়েছিলেন সন্তানদের নিয়ে পিতার সংসারে চলে যেতে। সুফিয়ার জীবনের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে প্রাথমিক ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল তার মা সৈয়দা সাবেরা খাতুনের যাপনচিত্রের উপর ভিত্তি করে।     মায়ের যাপনচিত্রের অনুপ্রেরণার দ্বারা সুফিয়া কামালের জীবনটিও গড়ে উঠেছিল।সুফিয়া কামাল বলতেন- তার মা ছিলেন অপরিসীম ধৈর্যশীল এক মহীয়সী নারী। ধৈর্য ও সহনশীলতার ভেতর দিয়েই যে প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল পরিবেশে রূপান্তরিত করা যায় এই শিক্ষা তিনি যে প্রথম তার মায়ের কাছ থেকে পেয়েছিলেন। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তা মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করতেন সুফিয়া।
মায়ের ভিতরে বিবি হাজেরার ধৈর্য ও সহনশীলতার যে বৈশিষ্ট্য সুফিয়া দেখেছিলেন, তা পরিবারের গণ্ডি অতিক্রম করে বাংলা তথা ভারতবর্ষের নারীর স্বাধিকার রক্ষার আন্দোলনে কিংবদন্তি হিসেবে সুফিয়া কামালকে মেলে ধরতে সাহায্য করেছিল ।
বস্তুত পবিত্র ইসলাম ধর্মের ঐতিহাসিক চরিত্র বিবি হাজেরার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের যেন জীবন্ত প্রতিমূর্তি হয়ে উঠেছিলেন সুফিয়া কামাল। বিবি হাজেরা ছিলেন হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর পত্নী এবং হযরত ইসমাইল (আ.) এর গর্ভধারিণী। নির্বাসিত অবস্থায় মরুর ভিতর পুত্র ইসমাইলের জন্ম দিয়েছিলেন বিবি হাজেরা । জন্মের অব্যবহিত পরে শিশুর তৃষ্ণাকাতর মুখের দিকে চেয়ে বিবি হাজেরার যে তৃষ্ণার জল সংগ্রহের কাতর প্রচেষ্টা শিশু ইসমাইলকে বাঁচানোর জন্য তার ধৈর্য এবং সহনশীলতা, তা সামগ্রিকভাবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারীর জীবনের এক পরম আদর্শ। এই আদর্শকেই আমরা দেখেছি সুফিয়া কামাল তার গোটা জীবনব্যাপী পরম যত্নে লালন-পালন করে গেছেন।
সুফিয়া নিজে বলতেন- এই আদর্শ তিনি পেয়েছিলেন তার গর্ভধারিণীর কাছ থেকে। নিজের জীবনের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি নিজের মাকে উৎসর্গ করতে গিয়ে সুফিয়া লিখেছিলেন- 'নির্বাসিতা হাজেরার মত মহিমাময়ী আমার মাকে দিলাম -সুফিয়া'।
সুফিয়া যেন নিজের নামের অর্থ 'শান্তি'র সঙ্গে নিজের গর্ভধারিণীর নামের অর্থ 'ধৈর্যশীলতা'র এক জীবন্ত কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন। তাই তার কলম থেকে নিঃসৃত হয়েছিল- "মাটিকে বাদ দিয়ে ফুল গাছের যেমন কোনো অস্তিত্ব নেই/ আমার মাকে বাদ দিয়ে আমার তেমন কোনও কথা নেই।" বস্তুত এই কথাগুলি যেন বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল সম্পর্কেও খুব ভীষণভাবে প্রাসঙ্গিক। সুফিয়া কামালকে বাদ দিয়ে বাঙালি নারীর কোনো অস্তিত্বই হতে পারে না।
উনিশ শতকের শেষ লগ্নে অবিভক্ত উত্তরবঙ্গে অভিজাত  মুসলিম জনজীবনের চালচিত্রের  একটি রেখাচিত্রের রেখাঙ্কন আমরা পাই বেগম রোকেয়ার (জন্ম ১৮৮০ সালের ৯  ডিসেম্বর) শৈশব-কৈশোরের দিনগুলির স্মৃতিচারণা এবং তার অনবদ্য আত্মকথনমূলক সামাজিক চিত্রকল্প 'অবরোধবাসিনী'র ভেতর দিয়ে। তার বেশ কিছুকাল পরে অবিভক্ত বাংলার দক্ষিণভাগের অভিজাত বাঙালি মুসলমান জনজীবনের অন্দরমহলের চিত্র আমরা পাই সুফিয়া কামালের শৈশব-কৈশোরের জীবনযাত্রার ভেতর দিয়ে।
এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, বাংলার সমাজ চিত্র অঙ্কনে হিন্দু অভিজাতের জীবনযাত্রার কথা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সমাজ বিজ্ঞান চর্চায় ঠাঁই পেয়েছে। এই প্রবণতাটা পশ্চিম বাংলায় সব থেকে বেশি। আজকের বাংলাদেশে বাঙালি জনজীবনের সমাজচিত্র অঙ্কনে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়েরই অন্দরমহলে সুলুক-সন্ধানের  চেষ্টা করা হলেও এপার বাংলায় সমাজবিজ্ঞান গবেষণার ক্ষেত্রে এই প্রচেষ্টায় বাঙালি মুসলমানের অন্দরমহল কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনুল্লেখিত থেকে গেছে ।
স্বাধীনতা, দেশভাগের এতোকাল পরেও পশ্চিমবঙ্গে সমাজ বিজ্ঞান চর্চা, বিশেষ করে মানবিকী বিদ্যা চর্চার ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের অন্দরমহল নিয়ে চর্চার ধারাটি কার্যত অচর্চিত থেকে যাওয়া একটি দুর্ভাগ্যজনক অধ্যায়। উনিশ-বিশ শতকে জমিদারবাড়িতে পুণ্যাহ ছিল একটি বিশেষ অনুষ্ঠান। তেমনই এক পুণ্যাহ এর দিনে  ১৯১১ সালের ২০জুন, ১৩১৮ বঙ্গাব্দের ১০ আষাঢ়, সোমবার, বেলা তিনটার সময় সুফিয়ার জন্ম। সুফিয়া দিদিমার আরব্য উপন্যাসের 'হাতেম তাই' এর কিসসা থেকে তার নাতনীর নাম রেখেছিলেন হাসনা বানু। সুফিয়া 'শান্তি' নামটি তার ঠাকুরদাদার রাখা। বড় ভাই ডাকতেন 'নাচু বানু 'বলে। আবার কেউ কেউ বলতেন 'হাসু বানু'।
শায়েস্তাবাদের নবাবী ঐশ্বর্যের এক ব্যস্তময় জীবন সুফিয়া কাটিয়েছিলেন তার শৈশবে।তিনি নিজেই লিখছেন- "আমার প্রথমে স্মরণে জাগে ঐশ্বর্যের সমারোহ। বর্তমানের পাঁচ তলা সমান উঁচু দোতলা বাড়ির দরজা, আবলুস কাঠের চিকন সরু কারুকাজের উপর রোদের আলো পড়ে চকচক করে উঠত।… শায়েস্তাবাদ পরিবার তখন মানে সম্মানে ধনে-জনে ঐশ্বর্য শিক্ষায় সহবতে তাজিম তওজ্জায়  বিখ্যাত। অন্দরমহলে পুরোপুরি মোগলাই আদব-কায়দা হালচাল, শিক্ষা-সংস্কৃতি। বাইরে ইঙ্গ- বঙ্গ ফ্যাশন, কেতাদুরস্ত হালচাল। মামারা ব্যারিস্টার, ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, নিমকের দেওয়ান, পুলিশের বড় কর্তা।"
বেগম রোকেয়ার মতোই সেকালের অভিজাত বাঙালি মুসলমান পরিবারগুলিতে কথ্যভাষা হিসেবে উর্দুর ব্যাপক প্রচলন ছিল। রংপুরের পায়রাবন্দে বেগম রোকেয়ার পরিবারে কথ্য ভাষা হিসেবে উর্দুর প্রচলন ছিল। সুফিয়ার পরিবারেও তেমনটাই ছিল ।অন্দর মহলে মেয়েদের জন্য আরবি -ফারসি শিক্ষার প্রচলন ছিল। বাংলার তেমন কোন রেওয়াজ সেকালের অভিজাত মুসলমান পরিবারগুলির অন্দরমহলে ছিল না। শিশু সুফিয়ার পরিবার কিন্তু এক্ষেত্রে অনেক রোকেয়ার পরিবারের মতনই একটা ব্যতিক্রমী ধারার প্রচলন করেছিল ।
রোকেয়া যেভাবে তার ভাইদের সাহায্যে,পরিবারের মুরুব্বিদের লুকিয়ে, সকলে ঘুমিয়ে যাওয়ার পর, মোমের নরম আলোয় বাংলা শিখতেন, সুফিয়া তেমনি বাংলা শিখেছিলেন তার মা সাবেরা খাতুনের কাছে খানিকটা লুকিয়েই। সুফিয়ার মামার ছিল একটি বিরাট লাইব্রেরি। সেই লাইব্রেরির প্রসিদ্ধি বরিশাল জেলাকে অতিক্রম করে গোটা বাংলায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সুফিয়া শিশুকাল থেকেই মায়ের প্রত্যক্ষ সাহায্যে মামার লাইব্রেরি থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে বই নিয়ে এসে পড়তেন। বাংলা শেখার চেষ্টা করতেন। বলাবাহুল্য সুফিয়ার মামার লাইব্রেরিতে ইংরেজি, বাংলা, আরবি, ফার্সি সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষারও যথেষ্ট বইপত্র ছিল ।
তবে সুফিয়ার মামা স্ত্রী শিক্ষার বিষয়ে আদৌ ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করতেন না। মেয়েদের পড়াশুনা নিয়ে নিজেদের  এই নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি স্বত্ত্বেও সেই মামারাই  কিন্তু ছিলেন শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের অন্দরমহলে বাইরের দুনিয়ার আজব খবরা-খবরের  একমাত্র জোগানদার। মামাদের এই পরষ্পরবিরোধী পরিবেশ পরিস্থিতির ভেতর দিয়েই কেমন ভাবে কেটেছিল সুফিয়ার শৈশবের দিনগুলি তার বর্ণনায় তিনি নিজেই লিখছেন- "রাতে এশার নামাজের পর মামাই আমাদের মামানি -খালাম্মাদের বাংলা উপন্যাস পড়ে শোনাতেন। খুব ভালো সংস্কৃত জানতেন আমার মামা। মেঘদূত, রাজরঙ্গিনী, রঘুবংশ সংস্কৃতে পড়ে, সেগুলো বাংলায় অনুবাদ করে তিনি আমাদের শোনাতেন। যদিও আমি তখন খুবই ছোট, তবুও আমার মামার  বই পড়ার সেই মাধুর্য যেন এখনো আমার মনের ভেতরে গুঞ্জন তোলে।"
শায়েস্তাবাদের বাড়িতে জমিদারীর কর্মচারীরা  সুর করে পুঁথি পড়তেন। ধর্মীয় অনুষ্ঠানে, মিলাদ মাহফিলে সুর করে ধর্মীয় কথাবার্তা বলতেন কর্মচারীরা। সেইসব মিলাদের  ছন্দ অতি শৈশবে শিশুর সুফিয়ার মনে এক অন্য পরিবেশ তৈরি করেছিল।জমিদারীর  কোনো কোনো কর্মচারী নিঝুম রাতে বেহালার সুরের মূর্চ্ছনা তুলতেন। সেই সুরের মূর্চ্ছনায় ভাসতো  শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবার । এভাবেই ধীরে ধীরে সুফিয়ার ভিতরে খুব  ছোটবেলা থেকেই বাংলা ভাষার প্রতি একটা প্রবল আকর্ষণ এবং কাকুতি জেগে ওঠে। সেই কাকুতির তীব্র অনুরণনে শায়েস্তাবাদের  সাধারণ মানুষ এবং বরিশালের নদী-নালা-খাল-বিলের নৈসর্গিক শোভা একটা বড় ভূমিকা পালন করেছিল ।
নবাব পরিবারের পোশাক-আশাক,আদব- কায়দা- এগুলি কিন্তু কোনদিনই ছোট্ট সুফিয়ার মধ্যে কোনো রকম আকর্ষণ জাগাতো না।
মাত্র সাত বছর বয়সে পরিবারের লোকেদের সঙ্গে সুফিয়া প্রথম কলকাতা মহানগরীতে এসেছিলেন। সেই সময় তার সঙ্গে তার জীবনের ধ্রুবতারা বেগম রোকিয়ার সাক্ষাৎও হয়েছিল। অতি শৈশবে সেই স্মৃতি সম্পর্কে সুফিয়া পরবর্তীকালে বলেছেন- "কলকাতার জীবন অন্য জীবন। বিরাট বাড়ি হলেও গাছ নেই, পুকুর নেই,পাখি নেই, ফুল নেই ।আমি যেন হাঁপিয়ে উঠতাম। আমার চেয়ে বড় আমার খালাতো ভাইয়ের মেয়েরা, আপারা আমাকে খুব আদর করতেন। খেলার সাথীও জুটেছিল। কিন্তু সবাই তো উর্দুভাষী। সবকিছু যেন কেমন পোশাকী পোশাকী। আমার নিজের দেশের বা সেই চাষীদের ও ঘরের পরিচারিকাদের মেয়েরা, জরি, ময়না, সোনা বানু, বড়দের মধ্যে সকিনা, জয়নব, আঞ্জু, ফুলি, গেদি, রহিমা, মেহের, নূরী,বুড়ি কেউ নেই। টিয়া, ময়নাগুলির গান নেই। পুতুল খেলা নেই। পৌষ মাসে শীত… কিন্তু খেজুর রস, পিঠা, আর সেই সবজি বাগানের সোঁদা গন্ধ নেই। কী যে বেখাপ্পা লাগতো।"
শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের মসজিদে গিয়ে বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা আরবি শিক্ষায় নিজেদের পারদর্শী করার চেষ্টা করত। পরিবারে মেয়েদের শিক্ষার কোন প্রচলন না থাকলেও সুফিয়া কিন্তু পারিবারিক মসজিদে গিয়ে আমপারা পর্যন্ত পড়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। অথচ পবিত্র কোরান সবক নেয়ার অবস্থা যখন তার হলো অর্থাৎ একটু বড় হলেন, তখন পরিবারের সামাজিক প্রতিপত্তির কথা চিন্তা করে বাড়ির মেয়ের মসজিদে গিয়ে পড়ার পথটিও বন্ধ হয়ে গেল। কারণ, সেই সময় যে সুফিয়া প্রায় সাত বছরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। পরিবারের লোকেরা বলল, মেয়ে বড় হয়েছে। আর অন্দরের বাইরে যাওয়া যাবে না। তাই পরিবারের ভেতরেই, অন্দরমহলে বসেই মায়ের কাছে পবিত্র কোরানের পাঠ নিতে বাধ্য হলেন সুফিয়া।
দুই
উনিশ শতকের মতই বিশ শতকের সূচনাপর্বের একটা দীর্ঘ সময় গ্রামবাংলায় অভিজাত ও  অনভিজাত- কোনো মুসলমান পরিবারেই প্রথাগত শিক্ষার রেওয়াজ ছিল না বলা যেতে পারে। অবিভক্ত বাংলার পূর্ব, পশ্চিম- দুই প্রান্তেরই প্রত্যন্ত অঞ্চলে অভিজাত  মুসলমান পরিবারগুলিতে বাড়ির মেয়েদের স্কুলে পাঠানোর কোন রেওয়াজ ছিল না। সেই সময়ের গ্রাম বাংলার মুসলমান পরিবারগুলির সমাজচিত্রের ক্ষেত্রে যেটা ধরা পড়তো সেটা হলো এই যে- ফজরের নামাজের পরই ছোট ছোট ছেলেরা মসজিদ মক্তবে যেত আরবি পড়তে। আর মেয়েরা তাদের মা, ঠাকুমার সঙ্গে হেঁশেলে ঢুকতো সকালের জলখাবার তৈরিতে। এটা মূলত ছিল অভিজাত  মুসলমান পরিবারগুলির রোজনামচা ।
সেই পরিবেশকে অতিক্রম করে বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে বাড়ির মেয়েরাও স্কুলে যাবে পড়াশুনা করতে এটা ভাবাই যেত না। এই রেওয়াজটি কিন্তু চলে আসছিল শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে।  তবে সেখানেও ব্যতিক্রম হয়ে দাঁড়ালেন সুফিয়া। তার অদম্য জেদ, তিনি স্কুলে যাবেন-ই। তখনো পর্যন্ত শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারের মেয়েদের কাছে বাইরের স্কুলে পড়তে যাওয়া একেবারেই নিষিদ্ধ বিষয় ছিল। শিশুরাও সেই নিষিদ্ধকরণের আওতার বাইরে পড়তো না। অথচ সুফিয়ার স্কুলে পড়তে যাওয়ার জেদকে  অস্বীকার করা তার পরিবারের পক্ষে শেষ পর্যন্ত সম্ভব হলো না ।
তাই শিশু সুফিয়ার ইচ্ছা পূরণের তাগিদে তাকে পায়জামা আঁচকান পড়িয়ে মাথায় টুপি দিয়ে, রীতিমত ছেলে সাজিয়ে অভিভাবকেরা পেয়ারীলাল মাস্টারের ইস্কুলে পাঠালেন।সেই সময়ের স্মৃতিচারণ করে পরবর্তীকালে সুফিয়া কামাল বলেছেন- "মনে পড়ে ভাইদের সঙ্গে স্কুলে যাওয়ার বায়না ধরেছিলাম,আমিও বাংলা পড়তে যাব। পায়জামা, আচকান, টুপি পড়ে ,অর্থাৎ, ছেলেদের পোশাক গায়ে চাপিয়ে পেয়ারীরীলাল মাস্টারের স্কুলে গিয়েছি কিছুদিন। তারপর যখন ভাইয়ারা শহরে গেলেন পড়তে ,তখনই আমার স্কুল জীবন শেষ আমার।"
বাস্তব জীবনে স্কুলে গিয়ে পড়াশুনোর ইচ্ছেটা বেশিদিন বাস্তবায়িত হতে না পারলেও স্কুলে পড়ার মানসিক ইচ্ছাটা শিশু সুফিয়া কিন্তু কোনদিনই ছাড়তে পারেননি। তাই ছোট শিশুরা যখন ঘরকন্যার খেলায় মেতে থাকে, শিশু সুফিয়া সেই সময় মেতে উঠেছিলেন 'স্কুল' 'স্কুল' খেলায়। আর এ 'স্কুল' 'স্কুল' খেলায় কিন্তু শিশু সুফিয়া বাংলাভাষার থেকে ইংরেজি ভাষাতেই বেশি কৃতিত্বের পরিচয় রেখেছিলেন। ইংরেজি ভাষায় শিশুকালে সেই কৃতিত্বের  ফলেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর 'সন্দেশ' পত্রিকার গ্রাহক হবার এক সুবর্ণ সুযোগ শিশু সুফিয়ার কাছে এসেছিল।
এ সম্পর্কে তিনি পরবর্তীকালে বলেছিলেন, "আমার পড়াশোনার আগ্রহ দেখে মামা , ভাইয়া এবং মামাতো ভাইয়েরা ওখানকার লাইব্রেরী থেকে বই পাঠাতে লাগলেন নিয়মিত। স্কুলের অনেক পাঠ্য বইও পড়তে লাগলাম। বড় ভাই, মামাতো ভাইয়েরা  ছুটিতে বাড়িতে এলে খুব হই হই আর আনন্দ হতো। আর সে সঙ্গে চলতে স্কুল স্কুল খেলা। ছেলেবেলার সই ময়না,আনজু,রুবী- সবাই মিলে প্রকাণ্ড হল ঘরকে স্কুল বানিয়ে পড়তে বসতাম। দেওয়ালকে বানানো হতো ব্ল্যাকবোর্ড। ঘণ্টা বাজানো হতো। ভাইয়ারা আমাদের পড়াতেন। বাংলা, ইংরেজি,  অংক- সবই পড়ানো হতো। ইংরেজি পরীক্ষায় আমি একশোর মধ্যে একশো পেতাম। ভাইয়ারা আমাদেরকে পুরস্কার দেবার ব্যবস্থা করলেন। সে পুরস্কার হল 'সন্দেশ' পত্রিকার গ্রাহক করে দেওয়া। ভাইয়ার বৃত্তির টাকায় প্রথম আমার নামে সন্দেশ পত্রিকা এলো। সেদিন ছিল এক খুশির দিন।"
বাড়ির মেয়ের নামে পত্রিকা আসছে নবাব বাড়িতে- এটি ছিল একটি অকল্পনীয় বিষয় ।কাউকে প্রকাশ্যে সেটা দেখানো সম্ভব নয়। একদম অন্দরমহলের বাইরে এই পত্রিকা আসার বিষয়টিও যাতে ফাঁস হয়ে না যায়, সেজন্য বাড়ির মেয়েদের চেষ্টার বিরাম ছিল না ।
সুফিয়ার বড় মামা যে বড়ই রক্ষণশীল। ভাগ্নির বাংলা শেখার বিষয়টিকে জানতে পারলে তিনি কোন অবস্থাতেই তা প্রসন্ন মনে মেনে নেবেন না। এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসার উপায় তৈরি করে দিলেন সুফিয়ারই সেই কয়েকদিন যাওয়া জুবিলী স্কুলের মাস্টার মশাই পেয়ারীলাল। নবাব বাড়ির মেয়ের নামে ডাকে বই আসছে, এটা যদি জানাজানি হয়ে যায় তাহলে ভয়ানক সামাজিক নিন্দামন্দ জুটবে। তাই ডাক ঘরে সুফিয়ার  নামে 'সন্দেশ ' আসার সঙ্গে সঙ্গেই পেয়ারীলাল মাস্টার সেই পত্রিকা নিজের তত্ত্বাবধানে রেখে দিতেন।
পরে সময়-সুযোগ করে তিনি সন্দেশ পৌঁছে দিতেন ছোট্ট সুফিয়ার হাতে। শিশু সুফিয়ার বাংলা শেখার ব্যাপারে সব রকমভাবে সহযোগিতা করতেন এই পেয়ারীলাল বাবু। এই সময় সুফিয়ার বড় ভাই সৈয়দ আবদুল ওয়ালী বরিশাল শহরের বেল ইসলামিয়া হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করতেন। তার কাছেই সেই হোস্টেলের পণ্ডিত মশাই বাদশা মিয়া (সেই সময়ের বাংলায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জন্মসূত্রে মুসলমান অথচ সংস্কৃত ভাষায় যথেষ্ট ব্যুৎপত্তি রয়েছে- এমন মানুষের অভাব ছিল না। বস্তুত স্যার আশুতোষের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য থাকাকালীন ভাষাচার্য ডক্টর শহীদুল্লাহ বেদ পাঠজনিত বিষয়টি সরস্বত সমাজে বহুল আলোচিত হলেও অবিভক্ত বাংলায় মফস্বল শহরগুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির তোয়াক্কা না করেই প্রাচীন ভারতীয় গুরুকূল পদ্ধতিতে সংস্কৃত শেখা, জন্মসূত্রে মুসলমান শিক্ষকের কিন্তু অভাব ছিল না) সৈয়দ আবদুল ওয়ালী বোন ছোট্ট সুফিয়ার বাংলা ভাষার প্রতি বিশেষ অনুরাগ দেখে নানা ধরনের বাংলা বই সংগ্রহ করে দিতেন।
বরিশাল শহর থেকে বড় ভাই যখন শায়েস্তাবাদে ফিরতেন, সকলের অগোচরে সেই বাংলা বইগুলি তিনি তুলে দিতেন আদরের ছোট বোন সুফিয়ার হাতে। এভাবেই ধীরে ধীরে নানা পারিবারিক- সামাজিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে, কার্যত বেগম রোকেয়ার  মতোই নিজের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় সুফিয়া নিজেকে শৈশব কৈশোরেই বাংলা এবং ইংরেজি ভাষাতে পারদর্শী করে তুললেন ।
 শায়েস্তাবাদের নবাব বাড়িতে ছিল কলের গান। সুফিয়ার ভাষায়- "যন্ত্রের উপর গানের রেকর্ড চাপিয়ে, চালিয়ে চাবি ঘুরিয়ে দিলে কিভাবে তা থেকে মানুষের গলার স্বর বেরিয়ে আসত ভেবে অবাক হতাম।"
সেই সময়ের সমাজ চিত্র পরবর্তীতে সুফিয়া এভাবেই এঁকেছেন- " আমাদের যুগে আমরা যখন খেলেছি পুতুল খেলা /তোমরা এ যুগে সে বয়সেই লেখাপড়া কর মেলা /আমরা যখন আকাশের তলে উড়ায়েছি শুধু ঘুড়ি/ তোমরা এখন কলের জাহাজ চালাও গগন জুড়ি।"
সুফিয়ার সাত বছর বয়সে পরিবারের মানুষদের সঙ্গে কলকাতায় আসার কথা এই নিবন্ধে আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। এই সময় কালে  শিশু সুফিয়ার সঙ্গে কিংবদন্তি বেগম রোকেয়ার প্রত্যক্ষ সংযোগ গড়ে উঠেছিল। সুফিয়া কামাল বর্তমান নিবন্ধকারকে জানিয়েছিলেন তাদের পরিবারের সঙ্গে বেগম রোকেয়ার পরিবারের একটা ক্ষীণ আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল। প্রথম সাক্ষাতেই রোকেয়া অত্যন্ত আগ্রহী হয়ে পড়েছিলেন শিশু সুফিয়াকে তার নিজের স্কুলে ভর্তি করবার জন্য। নানা পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা, সামাজিক সমস্যা, বিশেষ করে তাদের স্বল্পকালীন কলকাতা বাসের পরে আবার বরিশালের শায়েস্তাবাদে ফিরে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে রোকেয়া প্রতিষ্ঠিত সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের একদম প্রথম যুগের প্রত্যক্ষ ছাত্রী হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করা সুফিয়ার পক্ষে সম্ভবপর হয়নি ।
এই ঘটনা নিয়ে পরবর্তীকালে সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, " বেগম রোকেয়ার সাথে আমার যখন দেখা হয় তখন আমি ছোট। মাত্র সাত বছর বয়স। আম্মাকে ফুফু ডাকতেন বেগম রোকেয়া। রক্তের সম্পর্ক কি না জানি না। তবে কুটুম্বিতা ছিল।আম্মাকে বললেন- ওকে পড়াবেন। আম্মা বললেন, আমি তো কলকাতায় থাকি না ।আমি তো এসেছি। আবার মাস কয়েক পরেই চলে যাব। নয়তো তোমার স্কুলে দিতাম পড়তে। আমার খুব ইচ্ছা তখন থেকে আমি যদি পড়তে পারতাম। আমি আম্মাকে বলেছি, আম্মা স্কুলে যাব। আম্মা বলতেন- আমরা তো থাকবো না। না হলে তোমাকে স্কুলে দিতাম ।"
নানা প্রতিবন্ধকতায় রোকেয়ার স্কুলে সুফিয়ার সরাসরি ভর্তি হতে না পারার ঘটনায় ব্যথিত চিত্তে রোকেয়া সুফিয়ার গর্ভধারিণী সাবেরা খাতুনকে বলেছিলেন, "ফুফু এ মেয়েটাকে যদি পড়াতেন, তবে মেয়েটা কত লায়েক হতো।"
এই ঘটনার স্মৃতিচারণ করে জীবন সায়াহ্নে বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল বলেছিলেন, "আজ মনে হয়, যদি পারতাম লেখাপড়া করতে, যদি পারতাম মুক্ত ভুবনে বিচরণ করতে, তবে পারতাম লিখতে মনের মত সুন্দর করে। জীবনের শ্রেষ্ঠ দান রেখে যেতাম সবার জন্য। কিন্তু পারলাম না। সাধ  থাকলেও সাধ্য হলো না কাউকে কিছু দেবার।"
*কৃতজ্ঞতা: সুলতানা কামাল