দেশের বুকে ভয়ের বাসা!

হাসান ইমাম
Published : 16 June 2019, 11:49 AM
Updated : 16 June 2019, 11:49 AM

কোনো বলা-কওয়ায় যখন কিছু হয় না, তখন মানুষের মুখ বন্ধ রাখার অভ্যাস রপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। তবে মৌনতাও প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে স্বীকৃত; কখনো কখনো তা সরব প্রতিবাদের চেয়ে তীব্র হতে পারে বৈকি। কিন্তু মানুষের মধ্যে নির্বিকারত্ব পেয়ে বসে কখন? কতটা ভয়ের আবহ বিরাজ করলে, নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা কায়েম থাকলে গণনির্বিকারত্বে ডুবে থাকে দেশ?

যেন কিছুতেই কিছু আসে যায় না— এই মনোভাবে আক্রান্ত জনমন। যতক্ষণ না নিজে শিকার হচ্ছি, ততক্ষণ সবকিছু থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখাকেই 'নিরাপদ' মনে করার লক্ষণ দিনকেদিন স্পষ্ট হচ্ছে।

তাই চোখের সামনে যা-ই ঘটছে, মানুষ তার 'প্রতিক্রিয়াহীন' দর্শক-শ্রোতা হয়েই থাকছে। তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ বা প্রতিরোধে যা রুখে দেওয়া সম্ভব, অন্যরা নির্বিকার থাকায় তারও অনায়াস বাস্তবায়ন ঘটছে ঘরে-বাইরে, রাস্তাঘাটে। 'নিরাপদ' দূরত্বে দাঁড়িয়ে স্রেফ প্রত্যক্ষ করছি ঘটনার আদ্যোপান্ত।

বাড়তি বাসভাড়া আদায় নিয়ে বসচার জেরে গত ৯ জুন সালাউদ্দিন আহমদ নামের এক যাত্রীকে বাসের চাকায় পিষে মারেন এশিয়া পরিবহনের চালক রোকন উদ্দিন। বাসে ছিলেন সালাউদ্দিনের স্ত্রী পারুল আক্তারও। স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীর ওপর বাস তুলে দেওয়া হচ্ছে— এমন ভয়াবহ দৃশ্য বিকারগ্রস্তের কল্পনায়ও কি আসতে পারে? দর্শকসারিতে উপস্থিত অন্য বাসযাত্রীদের কেউ প্রতিবাদ করেছেন কি না, জানা যায়নি। পারুলের বুকচৌচির কান্না, চিৎকার, আহাজারি তাদের এতটুকু ছুঁতে পেরেছিল কিনা, তাও বোঝা দায়। নৃশংসতম এ ঘটনার আকস্মিকতার ধাক্কা কাটিয়ে ওঠার পর অন্তত চালককে তো পাকড়াও করা সম্ভব ছিল, তেমনটাও হয়নি। হত্যার চেয়ে বড় অন্যায় আর কি হতে পারে এই দুনিয়ায়? ধরেই নেওয়া যায়, সালাউদ্দিনের হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় বিনা বাধায়।

পাঁচ কিলোমিটার দূরে বাসের গতি কমিয়ে বাইরে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয় পারুলকে। পারুলের এই 'নরকযাত্রা' কোনও প্রতিক্রিয়া ঘটাতে পারেনি বাসযাত্রীদের ভেতর। এ যেন বাস্তব মানুষের 'ভার্চুয়াল' উপস্থিতি! একজন মানুষকে বাসের চাকায় পিষে মারার মতো নামানুষি ঘটনার প্রতিক্রিয়াহীন সাক্ষীদের মতো আমরাও কি সমান নির্বিকার নই?

তবে প্রতিক্রিয়া যে একেবারে হচ্ছে না, তা বলাও জায়েজ হয় না। হাতে হাতে ইন্টারনেটের সংযোগসহ মুঠোফোন থাকার কল্যাণে ঘটনার স্থির বা সচলচিত্র মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ছে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়। এতে তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনার কথা বাকি বিশ্ব জানতে পারছে বটে, প্রতিক্রিয়ায় সরগরম হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্লাটফরমও, তবে বাস্তবে এর আছর 'শূন্য' বললেও দোষের হয় না। যেখানে দরকার হাতে হাত রাখার, পায়ে পা মেলানোর, সেখানে 'লাইক', 'শেয়ার', 'হ্যাশট্যাগ' কিছুটা ভরসা হয়তো যোগায়, কিন্তু তাকে ভুক্তভোগীর পাশে দাঁড়ানো বলা চলে না। তাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতিবাদ-প্রলয়ও রাজপথের 'শান্তিপূর্ণ' পদযাত্রার সমতুল হতে পারে না।

সমাজতাত্ত্বিকের কাছে সমাজের এই অসারত্বের, মানুষের নির্বিকারত্বের ব্যাখ্যা নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সমাজরক্ষক, সংস্কারক তথা শাসক-প্রশাসকেরা এ ব্যাপারে কতটা ওয়াকিবহাল? নাকি পূর্ণমাত্রায় জানকারি আছে বলে তারাও সমান নির্বিকার?

বাদবাকি হিসাব চুলায় যাক, ক্ষমতার সরল অঙ্ক মিলে গেলে বই-খাতা তাকে তুলে রাখাই বাস্তবোচিত পদক্ষেপ। আর এটুকু বাস্তবজ্ঞান না থাকলে মসনদমুখী বন্ধুর পথে পা ফেলা অসম্ভব। তাই যতই সমাজ-সংসারের জন্য হানিকর হোক না কেন, নিজেদের টিকে থাকার পক্ষে সহায়ক 'নীতি'ই (পড়ুন 'ভীতিউৎপাদক নীতি'!) আঁকড়ে ধরেন ক্ষমতালিপ্সুরা। তবে ইতিহাস সাক্ষী, অকল্যাণকর কোনো পন্থায় ভয়-ডর দেখিয়ে শেষতক সিংহাসন দখলে রাখা সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে।

অনেকে ভুলে যান, আসনটি সিংহ চিহ্নিত; সিংহের ওপর পাতা আসন কিন্তু নয়। তবে সিংহাসনে বসা ব্যক্তিটি কর্ম দিয়ে 'সিংহ' হয়ে উঠতে পারেন বৈকি। কিন্তু তেমন 'সিংহ-মানব' সব কালে সব দেশে দেখা যায় না।

তাই ভীতির রাজ্যে যখন আর কোনো আশা বেঁচে থাকে না, তখন নির্বিকারত্ব সমাজের ভূষণ হয়ে ওঠারই কথা। গণমানুষের মানুষের চাওয়া-পাওয়া দিনের পর দিন অগ্রাহ্য করায় তারা মুখ ফিরিয়ে রাখায় অভ্যস্ত হয়ে পড়বে, এ আর নতুন কী। যখন ন্যায্য কথা বলার জন্যও দিতে হয় চড়া মূল্য, তখন নিজেকে গুটিয়ে রাখার পক্ষেই যুক্তি খাড়া করবে মানুষ। উপরন্তু ভার্চুয়াল যোগাযোগ মুখ্য হলে সমাজ নিস্তরঙ্গ হতে বাধ্য। জন্ম থেকে মৃত্যু— সব খবরাখবর ভার্চুয়ালি ভাগাভাগি করি, জিন্দাবাদ থেকে মুর্দাবাদ— সব প্রতিক্রিয়া যখন ঝুলিয়ে দিই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওয়ালে, তখন রাজপথ প্রতিবাদমুখর না হওয়াই দস্তুর। তবে এর উল্টোটাও প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলনের ট্রিগারটি কিন্তু প্রথম ভার্চুয়ালিই চাপা হয়েছিল।

তবে ভার্চুয়াল দুনিয়ায়ও 'নিয়ন্ত্রণ'-এর বাইরে নয়; সেখানেও পাতা আছে 'আইনের ফাঁদ', ভয়ের কাঁটা। সুতরাং উচ্ছ্বাস থেকে উদযাপন, প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ— সব ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হতে একধরনের 'সেল্ফ সেন্সরশিপ'-এর কবলে সবাই। এই 'সেল্ফ সেন্সরশিফ'-এর ফল গণনির্বিকারত্ব; এরই আছর পড়ছে যুগপৎ ভার্চুয়াল ও বাস্তব দুনিয়ায়।