সাংবাদিকের নবম মজুরি বোর্ড: মালিকপক্ষের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়া

Published : 15 June 2019, 01:49 PM
Updated : 15 June 2019, 01:49 PM

দেশের দৈনিক পত্রিকার মালিকদের সংগঠন 'নোয়াব' তাদের পরিচালিত বিভিন্ন পত্রিকায় সাংবাদিকদের জন্য গঠিত নবম মজুরি বোর্ডের সুপারিশ এবং সামগ্রিকভাবে সকল পেশাজীবী সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে যে বক্তব্য দিয়েছে এতে সাংবাদিক সমাজের পাশাপাশি পত্রিকার পাঠক হিসেবে আমিও বিস্মিত ও হতবাক হয়েছি।

'নোয়াব' প্রকৃতপক্ষে সাংবাদিকতা পেশার প্রতিনিধিত্ব করে না। সাংবাদিকতার ছদ্মাবরণে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা মূলত দেশের বিভিন্ন শিল্প ও ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট। পত্রিকায় দেওয়া বিবৃতির মাধ্যমে এই প্রতিষ্ঠানটি আবারো দেশের প্রচলিত আইনে পেশাজীবী সাংবাদিকদের মৌলিক অধিকারের যে নিশ্চয়তা আছে, তার বিরুদ্ধে তাদের অব্যাহত যড়যন্ত্রের আরেকবার প্রমাণ দিল।

পত্রিকার প্রথম ও ভেতরের পৃষ্ঠার বিশাল অংশ জুড়ে একতরফাভাবে খবরের আঙ্গিকে এভাবে মিথ্যা ভাষণ প্রচার সম্পাদকীয় নীতিমালার পরিপন্থি এবং পত্রিকাকে ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার নামান্তর। এর মাধ্যমে পত্রিকার মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকদেরকে তাদের স্বার্থের রিরুদ্ধে এই বিবৃতি লেখা, সম্পাদনা করা ও ছাপার কাজ করতে বাধ্য করেছেন। নোয়াব-এর এই বিবৃতির রিপরীতে আমরা সাংবাদিকদের বক্তব্য একইভাবে বিভিন্ন পত্রিকায় ছাপানোর জন্য মালিকদের প্রতি অনুরোধ রাখবো।

সাংবাদিকদের ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রের মালিকদের অবস্থান নতুন নয়। প্রতিবার নতুন ওয়েজবোর্ড গঠন ও রোয়েদাদ ঘোষণার সময় হলে পত্রিকার মালিকরা লোকসানের জিগির তোলেন। পত্রিকার ডিক্লারেশন নেয়ার সময় মালিকরা আইন অনুযায়ী সাংবাদিকদের সকল বেতন-ভাতা ও পাওনাদি দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। ওয়েজবোর্ডের চেয়েও বেশি বেতন ও সুযোগসুবিধার লোভ দেখিয়ে বিভিন্ন পত্রিকা থেকে অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের কিনে নেন। পরবর্তীতে সরকারি বিজ্ঞাপনের জন্য ডিএফপি-র রেজিস্ট্রেশন পাওয়ার পর তাদের চেহারা পাল্টে যায়। যে সাংবাদিকদের অনেক আকুতি মিনতি ও স্বপ্নের জাল বুনিয়ে অন্য পত্রিকা থেকে ভাগিয়ে আনা হয়েছিল তাদরকে ছাঁটাই করা শুরু হয়। এই দৌরাত্ম্য সাংবাদিকতা পেশা, শত শত সাংবাদিকর জীবন ও সর্বোপরি সংবাদপত্র শিল্পকে আজ চরম ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

আগে শুধু গুটি কয়েক সংবাদপত্রের মালিক সাংবাদিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার চেষ্টা করতো। দেশে প্রচলিত আইন বাস্তবায়নের শিথিলতার সুযোগে এখন দেশের বড় থেকে ছোট সকল পত্রিকার মালিক পেশাজীবী সাংবাদিকদের শ্রম শোষণ করছে।

'নোয়াব' এর বিবৃতি পড়লে যে কোনও পাঠক ধারণা পেতে পারেন সাংবাদিকরাই বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি বেতন-ভাতা ও সুবিধাভোগী পেশাজীবী শ্রেণি। তারা প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার চেয়েও বেশি বেতন এবং আরও অনেক সুযোগ সুবিধা পাচ্ছেন। যেখানে বর্তমানে একজন সাংবাদিকের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায়, শতশত সাংবাদিকের হাহাকারে প্রেসক্লাব চত্বর প্রতিদিন ভারি হচ্ছে সেখানে এই ধরনের বক্তব্য তাদের সাথে পরিহাস ছাড়া আর কিছু নয়। মালিকদের এই পর্যবেক্ষণ শুধু পোষ্য কিছু লোকের বেলায় প্রযোজ্য হতে পারে, সব সাংবাদিকের জন্য নয়।

নোয়াব-এর সদস্যভুক্ত পত্রিকার মালিকরা রক্তচক্ষু দেখিয়ে সাংবাদিকদেরকে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে অংশ নিতে দিচ্ছেন না। এটা দেশের প্রচলিত আইনের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। সংবাদপত্রের মালিকরা প্রতিনিয়ত লোকসানের কথা বলেন। নিয়মিত বেতন ভাতা থেকে সাংবাদিক কর্মচারীদের বঞ্চিত করছেন। আমরাও মনে করি যে কোন প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চাইলেই কেউ আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে পারে না। কিন্তু আমরা এও মনে করি প্রতিটি সংবাদপত্র প্রতিষ্ঠান তীব্র প্রতিযোগিতার মধ্যেও যে লাভ করে তা দিয়ে নিয়মিত বেতন-ভাতা ও অন্যান্য পাওনাদি পরিশোধ করতে সক্ষম।

আমরাও চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের মাসিক আয়-ব্যয়ের হিসাব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সাংবাদিকদের সামনে উন্মুক্ত করা হোক। লোকসান হলে আমরা মেনে নেব। লাভ হলে তার ভাগ আইন অনুযায়ী সাংবাদিক-কর্মচারীদেরও দিতে হবে। সাংবাদিকদের ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার দিতে হবে।

নোয়াব-এর দাবি নবম ওয়েজ বোর্ড-এর চেয়ারম্যান এককভাবে রোয়েদাদ ঘোষণা করেছেন। আইন অনুযায়ী মাননীয় চেয়ারম্যান এটা করেছেন। কারণ বোর্ডের সদস্য হিসেবে নোয়াব-এর প্রতিনিধিরা তাকে কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা দেয়ার পরিবর্তে বোর্ডের কার্যক্রমকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাদের সহযোগিতায় আরো ভালো একটি সুপারিশ হয়তো দেয়া যেতো। যেমনটি তারা করেছেন মহার্ঘ্যভাতা (ডিএ) ঘোষণার সময়। মালিকদের দাবির প্রেক্ষিতে ব্যতিক্রম ঘটিয়ে চেয়ারম্যান মহোদয় ওয়েজ বোর্ড প্রথম সভায় মহার্ঘ্য ভাতা ঘোষণা করেননি। পরবর্তীতে বোর্ড ৫০ শতাংশ মহার্ঘ্যভাতা নির্ধারণ করলেও নোয়াব-এর বিরোধিতায় দীর্ঘদিন পর ৪০ শতাংশ মহার্ঘভাতার গেজেট প্রকাশ করে। ওয়েজবোর্ডকে অকার্যকর করার একটি দূরভিসন্ধি নিয়ে নোয়াব শুরু থেকেই বোর্ডের কর্তৃত্বকেই চ্যালেঞ্জ করেছে।

মালিক পক্ষের আপত্তিতে সাংবাদিকদের ওয়েজবোর্ডের বিষয়টি দু'বছরেরও বেশি সময় ধরে ঝুলে আছে। মালিকদের এই ধরনের আচরণ নতুন কিছু নয়। তারা সব সময় নতুন ওয়েজবোর্ডের বিরোধিতা করেছে। এমনকি তারা আইন আদালতের মাধ্যমেও অতীতে ওয়েজবোর্ড নামক বিষয়টির অস্তিত্ব ধ্বংস করে দেয়ার চেষ্টা করেছেন।

নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন আব সার্ভিসেস) অ্যাক্ট, ১৯৭৪ অনুযায়ী ১৯৯৭ সালের ২৯ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সাংবাদিকদের জন্য ৫ম ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদ ঘোষণা করে। আট বছর পর ২০০৫ সালে ২১ এপ্রিল বিএনপি সরকার একই আইনে ৬ষ্ঠ ওয়েজবোর্ড গঠন করলেও রোয়েদাদের খসড়া রেখেই বিদায় নেয়। তাদের খসড়া ঘষামাজা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৭ সালের ৬ ডিসেম্বর একটি রোয়েদাদ প্রদান করে, যা সাংবাদিকদের প্রতিবাদের মুখেই স্থগিত করা হয়। বিএনপি সরকার ২০০৬ সালে নিউজপেপার এমপ্লয়িজ (কন্ডিশন আব সার্ভিসেস) অ্যাক্ট, ১৯৭৪ বাতিল করে এবং বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ জারি করে সংবাদপত্র শ্রমিকদের চাকুরি বিধিমালা ঠিকাদারী সংস্থা, গার্মেন্টস ও দেশের সকল শ্রমিকদের সাথে একই আইনে নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থা করে। ২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তত্ত্বাবধায়ক সরকার সাংবাদিকদের জন্য ৭ম ওয়েজ বোর্ড গঠন করে যা সাংবাদিকরা পান ৫ম রোয়েদাদের ১১ বছর পর। এই দীর্ঘ সময় সাংবাদিকরা ১১ বছর আগের নির্ধারিত মজুরি কাঠামোতে কাজ করেছেন। তাদের জীবনের ১১ বছরের এই ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার কোন ব্যবস্থা পরবর্তী ৮ম মজুরি বোর্ডের সুপারিশে ছিল না।

দেশের সাংবাদিকরা অবশ্যই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে কৃতজ্ঞ। কারণ তিনিই তাদের মজুরি ও অন্যান্য ভাতা, সুযোগ সুবিধা, কল্যাণের বিষয়টি যেভাবে ভেবেছেন এবং সমাধানের অভূতপূর্ব উদ্যোগ নিয়েছেন সেভাবে আর কেউ নেয় নি। তার দূরদর্শিতায় দেশের মিড়িয়া জগতের আজ এত বাড়-বাড়ন্ত। সংবাদপত্রকর্মীরা পেশাদারিত্বের সাথে কাজের সুযোগ পাচ্ছেন। শেখ হাসিনার সরকার ২০১২ সালে ১২ জুন বিচারপতি এবাদুল হক এর নেতৃত্বে ৮ম ওয়েজবোর্ড গঠন করে। এই কমিটি নির্ধারিত ছয় মাসের পরিবর্তে ১৫ মাসে সরকারের কাছে নতুন মজুরি কাঠামো ঘোষণা করে। এই বোর্ডের সুপারিশে বৈষম্যমূলকভাবে সংবাদপত্রের যে শ্রেণিবিন্যাস করা করা হয়েছে তা মালিকদের জন্য লাভজনক হলেও সাংবাদিকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সাংবাদিকদের ৮ম ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদ বাস্তবায়ন হয় ২০১৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে। বেতন শতকরা ১২৩ বৃদ্ধি করে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ২০১৫ সালে নতুন জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা করার পর থেকে সাংবাদিকরা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধির দাবি তোলে।

দেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সম্মেলনে দেশের অর্থনৈতিক বাস্তবতার নিরিখে সাংবাদিকদের জন্য নতুন বেতন-ভাতার দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেছিলেন এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তখন সাংবাদিকদের এই দাবি শিগগিরই পূরণের আশ্বাস দিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য তিনি তথ্যমন্ত্রনালয়কে নির্দেশও দেন। মাননীয় তথ্যমন্ত্রীও ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ এর মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ঘোষণা দেবেন বলে সাংবাদিক নেতাদের আশ্বস্ত করেছিলেন। কিন্তু এই কাঙ্ক্ষিত ঘোষণার ঠিক আগেই 'নোয়াব' সংবাদপত্র শিল্পের শ্রমিকদের জন্য 'এই মুহূর্তে নতুন ওয়েজবোর্ড ঘোষণার বিরোধিতা' করে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়েছে।

সাংবাদিকদের ৯ম ওয়েজবোর্ড গঠনের দাবির যৌক্তিকতা সৃষ্টির প্রেক্ষাপট রয়েছে। ১৯৯১ সাল থেকে অর্থাৎ দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সময়কে সূচক হিসেবে ধরলে সাংবাদিকরা পাঁচটি বেতন বোর্ড পাওয়ার কথা। কিন্তু তারা পেয়েছেন তিনটি। ষষ্ঠ ওয়েজ বোর্ডের মৃত্যু হয়েছে আঁতুরঘরেই। বাকি সময়কাল গেছে সরকার এবং গঠিত ওয়েজ বোর্ডগুলোর সময়ক্ষেপণের কারণে। ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন জাতীয় পে-স্কেল ঘোষণা করে। এর তিন বছরেরও বেশি সময় পরে সাংবাদিকদের জন্য ৮ম রোয়েদাদ দেয়া হয়। তখন পে-স্কেলের প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে একই বাজারের খদ্দের হিসেবে জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে সাংবাদিকদের নাভিশ্বাস উঠছিল। নতুন মজুরি কাঠামোর মধ্যে তারা থিতু হওয়ার আগেই ২০১৫ সালে সরকার সরকারি কর্মচারীদের জন্য অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণা করে।

৮ম মজুরি বোর্ড রোয়েদাদ প্রণয়নের সময় শ্রমিক প্রতিনিধিদের অসচেতনতার সুযোগে আমলাতন্ত্র সাংবাদিকদের মজুরি নির্ধারণের পূর্বের প্রচলিত প্রথা সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে দেয়। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময়ে সাংবাদিকদের জন্য প্রণীত প্রথম মজুরি বোর্ড রোয়েদাদে সাংবাদিকতা পেশায় আসা নতুনদের জন্য নির্ধারিত মজুরি সিভিল সার্ভিসের প্রারম্ভিক বেতনের চেয়ে ২৫ টাকা বেশি ছিল। বলা হয়, সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার এটা করেছিল এবং প্রতিটি গ্রেডে অনুরূপ প্রতিফলন ছিল। ৫ম ওয়েজবোর্ড পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা বজায় ছিল।

২০১৫ সালে প্রদত্ত জাতীয় পে-স্কেলের সাথে বেতনের বৈষম্য দেখলেই সকলেই উপলব্ধি করবেন আজ সাংবাদিকতা পেশায় মেধাবী, সৃষ্টিশীল, যোগ্যতাসম্পন্ন যুবকদের আসা কতটা দুরূহ এবং ঝুঁকিপূর্ণ। বর্তমানে দেশের জনপ্রশাসনে প্রবেশের প্রথম ধাপ নবম গ্রেড এবং সাংবাদিকতা পেশায় নবাগতদের প্রবেশ হয় ৩ন নং গ্রেডে। দেশের সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে লেখাপড়া শেষ করে এক বন্ধু জনপ্রশাসনে যাচ্ছেন, আরেকজন যাচ্ছেন সাংবাদিকতায়। বেতন বা মজুরি যাই বলি বর্তমানে কে কত পাচ্ছেন তার হিসেব নিচে দেয়া হল-

উপরোক্ত সরণী থেকে আমরা চ্যালেঞ্জ দিচ্ছি বেতন-ভাতা সহ অন্যান্য আর্থিক সুবিধাদির বিচারে সাংবাদিকরা সরকারি কর্মচারিদের ধারেকাছেও নাই। অথচ 'নোয়াব' বলছে সাংবাদিকরা দেশের প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের চেয়েও বেশি বেতন-ভাতা ও সুবিধাদি ভোগ করেন। মালিকেরা আগের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল র্আদুল মুহিতকেও তা বুঝিয়েছিলেন।

সর্বশেষ ফরাসউদ্দিন কমিশনের সুপারিশে সরকারি চাকুরিতে কর্মরত বড় আমলা থেকে পিয়ন এই পদগুলিকে ২০টি গ্রেডে ভাগ করা হয়েছে। তার ওপরে আছে দু'টি স্পেশাল গ্রেড- তাদের বেতন স্কেল ৮৬,০০০ টাকা ও ৮২,০০০ টাকা।

পরবর্তী ২০ টি গ্রেডের বেতন নিম্নরূপ:

অপরদিকে সাংবাদিদের জন্য সর্বশেষ (অষ্টম) ওয়েজবোর্ড রোয়েদাদ দেয়া হয় ২০১২ সালের জুন মাসে। বিচারপতি এবাদুর রহমানের সুপারিশ অনুয়ায়ী এখানে সাংবাদিকদের গ্রেড ৫টি। প্রথমটি স্পেশাল গ্রেড। পরের গুলো গ্রেড-১, গ্রেড-২, গ্রেড-৩, গ্রেড-৪। নীচে অষ্টম ওয়েজবোর্ড-এর সুপারিশ মতে সাংবাদিকদের বেতন স্কেল নিম্নরূপ-

এই দুই ছক থেকে পরিষ্কার একই শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে একজন সরকারি চাকুরিতে শিক্ষানবীশ হিসেবে যোগ দিচ্ছেন ২২,০০০ টাকার স্কেলে। সংবাদ পত্র জগতে যোগ দিলে পাবেন ১২,৬০০ টাকা। এটা সত্য যে সরকারি চাকুরিতে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে ঢুকতে হয়। কোন পত্রিকার মালিকও ১২,৬০০ টাকায় কোন নবীনকে তার প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেন না। তার কিছু প্রাক-অভিজ্ঞতা লাগে। ভাল পত্রিকা কিংবা সংবাদ মাধ্যমেও কোন কাঁচা হাত নিয়ে কারও প্রবেশের সুযোগ কম। অনেক বছরে এখানে সেখানে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রিপোর্টার হয়ে কাজ করে, হাতে কলমে কাজ শিখে, তারপর এই পেশায় আসতে হয়। কম মেধা, বুদ্ধি ও যোগ্যতা নিয়ে সবাই সাংবাদিকতা পেশায় আসে তা ভাবার কোন অবকাশ নেই। ব্যতিক্রম সকল পেশায় আছে এবং চরম অথর্ব কর্মকর্তা প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরেও পাওয়া যাবে।

একেবারে উপরের গ্রেড যদি ধরি তাহলে বর্তমানে একজন জেষ্ঠ্য আমলার বেতন স্কেল ৭৮,০০০ টাকা। একজন সবচেয়ে জেষ্ঠ্য সাংবাদিকের বেতন স্কেল ৩৫,৮৭৫ টাকা, যা ষষ্ঠ গ্রেডের একজন সরকারি কর্মকর্তার বেতনের সমান। তাহলে নোয়াব কীভাবে দেখলো একজন সাংবাদিক সরকারি কর্মকর্তার চেয়ে বেশি বেতন পান!

অষ্টম ওয়েজ বোর্ড রোয়েদাদে পত্রিকাকে সার্কুলেশনের পরিবর্তে বার্ষিক মোট টার্নওভারের ভিত্তিতে ৫টি ক্যাটেগরিতে ভাগ করে যে সুবিধা দেয়া হয়েছে তা নোয়াব-এর নেতারা বেমালুম ভুলে গেছেন। এখানে বিভিন্ন ক্যাটাগরি পত্রিকার সাংবাদিকদের বেতনও ভিন্ন। এ ক্যাটাগরির পত্রিকার সাংবাদিকদের বেতন কিছুটা বেশি হলেও, ই ক্যাটাগরির পত্রিকার সাংবাদিকদের বেতন অনেক কম। যেমন- এ ক্যাটাগরির পত্রিকার একজন গ্রেড-১ ও গ্রেড-২ সাংবাদিকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ৩৫,৮৭৫ টাকা ও ২৪,১০৬ টাকা। এ ক্যাটাগরির পত্রিকার সর্বনিম্ন গ্রেডের একজন সাংবাদিকের বেতন স্কেল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০,৯৩৮ টাকা। বি ক্যাটাগরির পত্রিকার সাংবাদিকের সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ৩১,৮৫০ এবং সর্বনিম্ন ৯,২৭৫ টাকা। সি ক্যাটাগরির পত্রিকার সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ২৪,১০৬ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৭,৬১৩ টাকা। ডি ক্যাটাগরির পত্রিকার সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ১৬,১০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৫,২৫০ টাকা। ই ক্যাটাগরির পত্রিকার সর্বোচ্চ বেতন স্কেল ১০,৫০০ টাকা এবং সর্বনিম্ন ৪,৭২৫ টাকা।

এছাড়া এ ও বি ক্যাটাগরির সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের যথাক্রমে ৩০,০০০ টাকা ও ২৭,০০০ টাকা বাড়িভাড়ার ব্যবস্থা আছে। অন্য সকল ক্যাটাগরির পত্রিকা ও গ্রেডের সাংবাদিকদের জন্য ঢাকা শহরে মূল বেতনের ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য শহরে ৬৫ শতাংশ বাড়িভাড়া দেয়ার কথা উল্লেখ ছিল।

নোয়াব নেতারা সংবাদত্রের বিক্রয় মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় তিনগুণ কম হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দেশের প্রথম সারির প্রায় সকল পত্রিকা প্রতিদিন যে পরিমাণ বিজ্ঞাপন ছাপায় তা দিয়ে পত্রিকার একমাসের ছাপার খরচ উঠে যায়। বর্তমানে পত্রিকার বিজ্ঞাপনের বাজার বিশাল। তাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, টেলিভিশন, অনলাইন পোর্টাল বিজ্ঞাপনের বিশাল বাজার নিয়ন্ত্রন করছে বলে যে কথা বলা হয়েছে তা ভ্রান্ত। ছাপার অক্ষরের বিজ্ঞাপন কখনো টেলিভিশন ও অনলাইনে যায় না। সরকারি বিজ্ঞাপনের টাকা দেরিতে পাওয়া গেলেও বেসরকারি ও ক্লাসিফাইড বিজ্ঞাপনগুলো নগদ টাকা ছাড়া ছাপানো হয় না। এসব বিজ্ঞাপনের রেটও অত্যন্ত বেশি। বিশেষ বিশেষ দিনে বিজ্ঞাপনের জন্য সংবাদ খুঁজে পাওয়া কষ্টকর হয়। এরপরও মালিকরা লোকসানের বাহানা দেখান। অনেক মালিক পত্রিকার আয় দিয়ে তার কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের বেতন দেন, সাংবাদিকদের বেতন বকেয়া রাখেন। দু'একজন প্রভাবশালী সাংবাদিককে কব্জার রেখে অন্যান্য সাংবাদিকদের দাবিয়ে রাখেন।

নোয়াব-এর মতে মজুরি বোর্ডে এমন কিছু বিষয় ও সুযোগ সুবিধা রয়েছে যেগুলো রুগ্ন শিল্পের জন্য বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। যে সমস্ত সংবাদপত্র রুগ্ন সেগুলো 'ই' ক্যাটাগরির পত্রিকার বেতন স্কেল দিতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। এতেও যদি অসুবিধা হয় তাহলে তাদের এই শিল্পে আর থাকার প্রায়োজন আছে কি? একজন সাংবাদিককে যদি কোন পত্রিকার মালিক নোয়াব-এর ভাষায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বনিম্ন গ্রেডের ১০/১২ হাজার টাকা বেতনও দিতে না পারেন, তাহলে এ ব্যবসায় তিনি কেন থাকবেন? রুগ্ন শিল্প নিয়েও যদি একটি পত্রিকার মালিক এ ক্যাটাগরির সুবিধা নিতে চান তাহলে তো তিনি তা পাবেন না।

অনেক প্রতিষ্ঠান দু'টি গ্র্যাচুইটি দিয়ে শ্রম আইন লংঘন করছে বলে দাবি করেছে নোয়াব। শ্রম আইনের প্রতি মালিকদের এই ভালবাসা সত্যিই হাস্যকর। কারণ তারা কোন সাংবাদিককে শ্রম আইনের মৌলিক অধিকার "সংঘ করার অধিকার" ভোগ করতে দেননা। সারা জীবন চাকরি করার পর অধিকাংশ সাংবাদিককে প্রায় খালি হাতে বাড়ি চলে যেতে হয়। কারণ এসব মালিকরা তাদের প্রতিষ্ঠানে প্রভিডেন্ট ফান্ডও চালু করেন না। নাই কোনও পেনশন সুবিধা। একজন বিদায়ী শ্রমিক এক বছর চাকরির জন্য দু'টি করে গ্র্যাচুইটি পাবেন, তাও আমাদের পাঁচ লাখ টাকা বেতন-সুবিধাদি নেয়া ও ৬০ লাখ টাকার গাড়িতে চড়া মালিকদের সহ্য হয় না।

সাংবাদিকদের আয় কর মালিককে দিতে হবে। এটা দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়। মালিকরা এব্যাপারে আদালতে ইতোপূর্বে মামলা করে হেরে গেছেন। নোয়াব এর নতুন নেতারা বিষয়টি নতুন করে সামনে আনতে চান। স্বল্প আয়ের ঝুঁকিপূর্ণ বিশেষ পেশাজীবী হিসেবে কোর্টের দেয়া এই সুবিধাও মালিকরা কেড়ে নিতে চান। তাদের মতে দেশে এমন কোন আইন থাকা উচিত নয়, যা সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য নয়। তাইলে ফৌজদারী আইনে সম্পাদকদের বিরুদ্ধে সমন জারির পরিবর্তে গ্রেপ্তারি পরোয়ানার বিধানকে কীভাবে দেখা হবে? সাংবাদিকদের ব্যবহার করে পত্রিকার মালিকরা সকল সুযোগ-সুবিধা নেন। কিন্তু সাংবাদিকদের তার কানাকড়িও দিতে চান না।

নোয়াব-এর মতে সরকার ঘোষিত কোনও শিল্পে তিন বছর পরপর একমাসের মোট বেতন এবং ৩০ দিনের বিনোদন ছুটির বিধান নাই। কিন্তু সরকারি চাকরি বিধিমালা অনুযায়ী প্রতি তিন বছর পর সরকারি/ আধাসরকারি/ স্বয়ত্বশাসিত সকল প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারিরা একমাসের বেতনের সমপরিমান ভাতাসহ ১৫ দিনের শ্রান্তি বিনোদন ছুটি ভোগ করেন। এই আইন সরকারি প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের জন্যও প্রযোজ্য।

বাংলাদেশে পত্রিকা বের করে কেউ দেউলিয়া হয় না বা হয়নি। তাই গত কয়েক বছর দেশ জুড়ে পত্রিকা প্রকাশের হিড়িক পড়েছে। আগে ঢাকা ও দেশের অন্যান্য শহর থেকে পত্রিকা বের হতো কয়েক ডজন। আর এখন প্রকাশ হয় হাজারের বেশি। তাই পাঠকের সংখ্যা বাড়লেও প্রতিটি পত্রিকার মালিক একই রকম সার্কুলেশন কীভাবে আশা করেন? প্রবীণ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকের অভাবে পত্রিকার মান কমে যাওয়ায় কিংবা পাঠকের রাজনৈতিক ও মনোচেতনার সাথে খাপ খাওয়াতে না পারায়ও অনেক সংবাদপত্রের পাঠকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।

সরকার সংবাদ মাধ্যমকে শিল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে এর বিকাশের জন্য। এজন্য সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও দেয়া হচ্ছে। সংবাদপত্র শিল্পে কাজ করা শ্রমিক এবং সরকার ঘোষিত অন্য ৪২টি শিল্পের শ্রমিক এক নয়। নোয়াব এর সদসদ্যরা এই পার্থক্য বোঝেন না বলে সংবাদপত্র শিল্পকে গার্মেন্টস শিল্পের সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন।

আগেই বলেছি স্বাধীনতার পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমাজে সাংবাদিকদের মান, মর্যাদা ও সমাজে তাদের অবদানের কথা চিন্তা করে ওয়েজ বোর্ডে সাংবাদিকদের বেতন স্কেল প্রতিটি গ্রেডে সরকারি কর্মকর্তদের স্কেলের চেয়ে কিছুটা উপরে রেখেছিলেন। এই প্রথাটি ৭ম ও ৮ম বেতন কাঠামোতেও বলবৎ ছিল। কিন্তু এখন তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বললেও আমরা অনেকে সেই মহান নেতার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে সবকিছু দেখছি না।

দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী সাংবাদিকদের জন্য ওয়েজবোর্ড ঘোষণা করা সরকারের দায়িত্ব। নোয়াব নেতাদের মালিকানাধীন পত্রিকাসহ অধিকাংশ পত্রিকা লিখিতভাবে মন্ত্রণালয়কে ওয়েজবোর্ড বাস্তবায়ন করার কথা জানিয়েছে। কিন্তু বিবৃতিতে নোয়াব এর নেতারা আবার এই তথ্য অবাস্তব বলে দাবি করেছেন। তাহলে কি নওয়াবের মালিকানাধীন পত্রিকাগুলো ডিএফপি-কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে? মিথ্যা তথ্য দিয়ে রেট কার্ড নেয়া কি সীমাহীন অন্যায় নয়? নওয়াবের অধিকাংশ সদস্য কি তাহলে এই পদ্ধতিতেই সরকার প্রদত্ত সুবিধাগুলোর ভাগ নিচ্ছেন।

আইন অনুযাযী প্রকাশিত সকল পত্রিকায় ওয়েজবোর্ড ঘোষণা করা এবং তা বাস্তবায়নের বিষয়টি তদারক করার দায়িত্ব সরকারের, সাংবাদিকদের নয়।