বাজেট না ছাই!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 14 June 2019, 11:11 AM
Updated : 14 June 2019, 11:11 AM

দুপুরে জাতীয় সংসদে বাজেট ঘোষণা হয়েছে। সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ল্যাপটপে গভীর মনোযোগ দিয়ে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতা পড়ার চেষ্টা করছিলাম। এর মধ্যে দুবার খাবার টেবিলে বসার নির্দেশ এসেছে। আমি বাজেটে কোন খাতে কত ব্যয় ধরা হয়েছে, সেটা দেখছিলাম। সর্বোচ্চ ব্যয় ধরা হয়েছে জনপ্রশাসন খাতে! চোখটা আটকে গেল। মাথাটাও কেমন ঝিম ধরে গেল। এর মধ্যে বউয়ের আবারও তাড়া, এত মনোযোগ দিয়ে কী করছো হে? খেতে ডাকছি শুনছো না?

আমি বললাম, আজ বাজেট ঘোষণা হয়েছে, জানো না? বাজেটটা একটু দেখছি!

বউ বিরক্তি মেশানো গলায় বললেন, বাজেট না ছাই! সেই তো আবার জিনিসপত্রের দাম বাড়বে! ওই ছাইপাশ দেখে কাজ নেই। খেতে বস!

এর পর আর অপেক্ষা করা চলে না। কিন্তু খেতে-খেতে ভাবছিলাম, আসলেই কি বাজেট ছাইপাশ? এদেশের বেশিরভাগ মানুষ বাজেট খায়- না মাথায় দেয়, সেটা জানে না। শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা বাজেট বলতে বোঝে জিনিসপত্রের দাম আরেক প্রস্থ বেড়ে যাওয়া। এর বাইরে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই বাজেট সম্পর্কে জ্ঞান রাখে। অথচ বাজেট জিনিসটা কিন্তু মোটেও হেলাফেলার নয়। আমাদের শাসকরা এই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় দলিলটাকে 'ছাইপাশে' পরিণত করেছেন। নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থ রক্ষার কিছু প্রস্তাব ছাড়া আদৌ বাজেটে কিছু থাকে কি?

আমাদের দেশ কাগজে কলমে 'গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ' হলেও কার্যত হচ্ছে 'কতিপয়তন্ত্রী বাংলাদেশ।' ভোটহীন গণতন্ত্রের আজব দেশে সাধারণ মানুষ বা ভোটাররা কেবলই সাক্ষী গোপাল। তালপাতার সেপাই। নিধিরাম সর্দারও বলা যেতে পারে। এখানে অল্প কিছু মানুষ দেশের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। এই অল্পরা হচ্ছেন আমলা, সেনা, পুলিশ, ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদ। আগে আমলা, সেনা, পুলিশ, ব্যবসায়ীরা রাজনীতিবিদদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। অনেক সময় তাদের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেন-দরবার করতেন। এখন এই শ্রেণির অনেকেই সরাসরি রাজনীতির মঞ্চে আবির্ভূত হয়েছেন। আমলা, সেনা, পুলিশ, ব্যবসায়ী আর রাজনীতিবিদদের মধ্যে এখন আর তেমন কোনো পার্থক্য নেই। এর সবাই একই শ্রেণির। একই মনসিকতার। নিজেদের অর্থ-বিত্ত-ক্ষমতা-ভোগ-বিলাস কীভাবে আরও বাড়ানো যায়-সারাক্ষণ তারা এই চেষ্টাই করেন। এরাই শাসক, এরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা, দেশের ভাগ্যবিধাতা। শতকরা হিসেবে এরা খুব বেশি নয়, বড় জোর ছয় থেকে সাত ভাগ! কিন্তু তাদের হাতের রাষ্ট্রীয় নীতি, সম্পদ, এমনকি ক্ষমতাও। তাদের ইচ্ছেতেই দেশ চলে। তাদের ইচ্ছেতে আইন প্রণয়ন ও কার্যকর হয়। তাদের ইচ্ছে এবং স্বার্থে বাজেটও হয়। বাকিটুকু আইওয়াশ, হয়তো আমাদের বুঝবার ভুল!

বাজেট বক্তৃতা আসলে ক্ষমতাবানদের আরও সুযোগ-সুবিধা করে দেওয়া, টিকে থাকার কৌশল উপস্থাপন। বাজেটে এক ধরনের নীতিও ঠিক করে দেওয়া হয়। যেমন এবার দেওয়া হয়েছে নতুন ভ্যাট নীতি কার্যকর করার প্রস্তাব। কোন নীতিটা ঠিক, আর কোনটা ভুল, সেটা চিহ্নিত করে দেওয়াই তো ক্ষমতার রাজনীতি। আর্থিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে কার কণ্ঠস্বর শোনা যাবে, কারটা যাবে না, সেটাও নির্ধারণ হয় বাজেটে। গত বছর আন্তর্জাতিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অক্সফাম গবেষণা করে জানিয়েছিল, বিশ্বজুড়ে ধনীরা আরো ধনী হচ্ছে। সম্পদ দিন দিন পুঞ্জিভূত হচ্ছে গুটি কয়েক ধনীর হাতে। বর্তমানে মাত্র এক ভাগ মানুষের হাতে বিশ্বের ৮২ ভাগ সম্পদ রয়েছে। এভাবে সম্পদের অসমতা বেড়েই চলেছে।

আমাদের দেশও এর ব্যতিক্রম নয়। আমাদের দেশে ঠিক এক ভাগ নয়, শতকরা পাঁচ-ছয় ভাগ মানুষের হাতেই ক্ষমতা। নীতির ঠিক-ভুল নির্ধারণের ক্ষমতা তাদেরই। বাকি ৯৫ বা ৯৬ শতাংশের জন্য পথ বেছে দেওয়ার অধিকার এই পাঁচ-ছয় শতাংশের হাতে— এটাই রাজনীতি। আর, এই রাজনীতিই স্থির করে দেয়, আমি কতটুকু কর দিব, আর তারা কতটুকু ঋণ তফশিল বা কর-রেয়াতের সুযোগ পাবেন! বিষয়টা দিনের আলোর মতো স্বচ্ছ। 'ঠিক' নীতি তা হলে কী? পাঁচ-ছয় শতাংশের মত বলবে, যে নীতি আর্থিক বৃদ্ধির বৃহত্তর স্বার্থের কথা ভাবে, সেটাই 'ঠিক'। স্বাধীনতার আটচল্লিশ বছরের মধ্যে দুই দশক তো কেটে গিয়েছে এই আর্থিক বৃদ্ধির সাধনাতেই। ফলে, শুধু আর্থিক বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঘোড়া ছোটানোই 'ঠিক' নীতি কি না, সেই প্রশ্নটাই ক্রমে অবান্তর, এমনকী অবৈধ, হয়ে গিয়েছে। অতএব, কৃষকের দুর্দশার কথা বলা, শ্রমিকের মজুরি কিংবা কর্মসংস্থানের কথা বলা, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বাজেটে আলাদা অনুচ্ছেদ যোগ করা, বিশেষ লক্ষ্যিত কর্মসূচি গ্রহণ করা, অনুন্নয়ন খাতের ব্যয় কমানো, আয়-ব্যয়ের ঘাটতির টাকা কোত্থেকে আসবে, ঋণের জালে আমরা আর কতকাল জর্জরিত থাকব-এসব প্রশ্ন তোলার তেমন কোনো মানে থাকে না। রাজনীতিকরা যে গোষ্ঠী স্বার্থে আইন-নীতি প্রণয়ন করেই থাকেন, সেটাও সমান সত্য।

যেমন সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ঋণ শ্রেণীকরণ ও সঞ্চিতি সংরক্ষণের নীতিমালায় পরিবর্তন এনে ঋণখেলাপিদের নতুন করে সুযোগ করে দিয়েছে, যা কার্যকর হবে আগামী জুন থেকে। এখন ব্যবসায়ীরা চাইলে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আরও ছয় মাস টাকা না দিয়ে খেলাপিমুক্ত থাকতে পারবেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী মোট ঋণের মাত্র ২ শতাংশ এককালীন জমা (ডাউন পেমেন্ট) দিয়ে একজন ঋণখেলাপি নিয়মিত গ্রাহক হয়ে যাবেন। বাকি ঋণ শোধ করতে হবে ১০ বছরের মধ্যে। ঋণের সুদহার ১০, ১২ বা ১৫ যা-ই থাকুক না কেন, নেওয়া হবে মাত্র ৯ শতাংশ।  ২০০৯ সালে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। আর 'খেলাপিবান্ধব' নীতির কারণে বর্তমানে তা এসে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার বেশি।

আইনে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে, যাতে কেউ ব্যাংকের টাকা মেরে পার না পেয়ে যান। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক যেভাবে খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের একের পর এক ছাড় দিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভালো ঋণগ্রহীতারাও খেলাপি হতে উৎসাহিত হবেন। খেয়াল করার কথা হলো, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল, সেই তর্কের দাঁড়িপাল্লায় 'ঠিক'-এর দিকে ঋণখেলাপির পক্ষে দাঁড়িয়েছে সরকার। এটাই ক্ষমতার গল্প। যা রাজনৈতিক ভাষ্যে ন্যায্যতার ধারণাকেই বদলে দিতে পারে।

আর্থিক বৃদ্ধির মতোই রাজকোষ ঘাটতির হার ঋণ করে কমিয়ে আনাও 'ঠিক' নীতির আর এক আরাধ্য। কেন এই বিশাল ঘাটতি, কেন জনপ্রশাসন খাতে এই বিপুল ব্যয়, সে প্রশ্নটা আর ওঠে না।

ক্ষমতার হাটে 'ঠিক-ভুল' নিয়ে প্রশ্ন অনেক। কোন খরচে জিডিপি-র পালে হাওয়া লাগতেও পারে, আর কোনটা নিতান্তই বাজে খরচ, তার বিশ্লেষণ হয় না। তার পরও বিশেষজ্ঞরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কিছু কিছু পরামর্শ দেন। অপব্যয় কমানোর কথা বলেন, অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন বরাদ্দ সংকোচন করার কথা বলেন, দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরার কথা বলেন। ভ্যাট কমিয়ে করের আওতা বাড়ানোর কথা বলেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা! জোড়াতালির প্রবৃদ্ধির পেছনে ছুটতে গিয়ে যে অসাম্য জমতে জমতে সর্বজনীন বৃদ্ধির মাপকাঠিতে অনেক পশ্চৎপদ দেশকেও আমরা ছাড়িয়ে যাচ্ছি। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর 'ছিটেফোঁটা' প্রাপ্তিতে তার ইতরবিশেষ হয় কি না, সেই প্রশ্ন অবশ্য ওঠে না কখনও।

ঘটনা হলো, সমালোচনা-পরামর্শে আমাদের দেশের নীতি-পরিকল্পনা-বাজেট অর্থনীতির কাঠামো তিলমাত্র বদলায় না। বাজেটে কেবল আকার বৃদ্ধির হারের জয়ধ্বনিই থাকে, রাজকোষ ঘাটতি কমিয়ে আনার শপথ থাকে না। সেই বাজেটও কখনও বলে না, বৃদ্ধির বদলে লক্ষ্য হোক ন্যায্য পুনর্বণ্টন। বলে না, বড়লোকের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কর আদায় করা হবে, কালো টাকা উদ্ধার করা হবে, অর্থ পাচার ঠেকানো হবে, অপব্যয় ও দুর্নীতি কমানো হবে। রাষ্ট্রীয় ভোগবিলাসের বদলে কৃচ্ছ্রতা ও সংযমের নীতি পালন করা হবে। অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি বাংলাদেশ এবার মন দেবে সত্যিকারের মানসম্পন্ন শিক্ষায় এবং সবার জন্য একটা বিশ্বমানের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার কাজে। বলে না, মাথা পিছু জাতীয় আয় কিংবা প্রবৃদ্ধি দিয়ে নয়, দেশের অগ্রগতি মাপি সব নারী ও শিশুর সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের ১৭তম বাজেটও ক্ষমতার বেঁধে দেওয়া ছকের বাইরে একটা পা-ও ফেলে না। এবারও যেমন খুব আলোচনা হচ্ছে রাজস্ব হার বাড়ানোর পরিধি নিয়ে, ভ্যাটের আওতা নিয়ে। নতুন করদাতা খুঁজে বের করে কর আদায়ের সম্ভাবনা খুব বেশি দেখা যাচ্ছে না। সেই দক্ষতা সরকারের নেই। শেষ পর্যন্ত ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারণই হবে সরকারের এক মাত্র রক্ষাকবচ। এটাও কিন্তু ক্ষমতারই যুক্তি।

তার পরেও হয়তো বাজেট নিয়ে এই মাসটায় অনেক আলোচনা হবে। বিশেষজ্ঞরা নৈর্ব্যক্তিক মুখে হিসাব কষে দেখিয়ে দেবেন, এই টাকা 'ঠিক' খাতে খরচ হলে অর্থনীতির কতখানি লাভ হত। সেই লাভ কার ঘরে যেত, সে-কথা উঠবে না!

আমার বউয়ের কথাটাই শেষ পর্যন্ত খাটে: বাজেট না ছাই!