এইচআরডব্লিউ’র প্রতিবেদন ও আমাদের সার্বভৌমত্ব

ড. মিজানুর রহমান
Published : 12 July 2012, 03:29 PM
Updated : 12 July 2012, 03:29 PM

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠান হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিবেদন দেয়। এটা ওদের কাজের একটা অংশ। তাতে আমাদের কোনও আপত্তি নেই। এরই ধারাবাহিকতায় গত ৪ জুলাই ওরা বাংলাদেশ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। তবে আমি প্রথমত ওদের একটি বিষয় নিয়ে বেশি মর্মাহত হয়েছি। এই প্রতিবেদন তৈরির সময় জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের মতামত জানার কোনও প্রয়োজন অনুভব করেনি ওরা। প্রতিবেদনটি তৈরির আগে তাদের উচিত ছিল আমাদের সঙ্গে কথা বলা। আমাদের মতামত হলো, যেহেতু বাংলাদেশে এখন মানবাধিকার নিয়ে একটি কমিশন রয়েছে, তাই এ দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে এই কমিশনের সঙ্গে অবশ্যই আলোচনা করা উচিত ছিল।

আশ্চর্যের বিষয়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ প্রতিবেদেনটি তৈরির সময় বাংলাদেশের দুটি বেসরকারি সংগঠন 'আইন ও সালিশ কেন্দ্র' এবং 'অধিকার'-এর সঙ্গে কথা বলেছে। আমরা বাংলাদেশে তাদের অবস্থান ও রিপোর্ট তৈরির বিষয়ে কিছুই জানতে পারিনি। কেবল যেদিন তারা সাংবাদিক সম্মেলন করে রিপোর্টটি প্রকাশ করে তখনই জানতে পেলাম। রিপোর্টটি তৈরি করেছেন তেজশ্রী থাপা। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া অঞ্চলের পরিচালক ব্রাড অ্যাডামস তেজশ্রীকে নিয়ে আমাদের এখানে এসেছিলেন বটে তবে সেটা রিপোর্ট প্রকাশের পরদিন। তখন তাদের আমি কমিশনের মতামতগুলো জানিয়েছি। আমার আপত্তির দিকগুলোও তুলে ধরেছি। তারা আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন। বলেছেন, পরবর্তীতে বিষয়গুলো তারা মাথায় রাখবেন।

এই রিপোর্ট প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় যে বক্তব্যটি রয়েছে তা হলো, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি বেসরকারি মানবাধিকার সংগঠন মাত্র। বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে তারা রিপোর্ট তৈরি করতে পারে কিন্তু একটি দেশের সরকার কী করবে না করবে সে বিষয়ে পরামর্শ বা উপদেশ বিতরণ করতে পারে না। মনে রাখতে হবে যে 'র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন' বা র‌্যাব একটি সরকারি সংস্থা। তাই এটিকে বিলুপ্ত করার পরামর্শ তারা দিতে পারে না। এটা তাদের অনধিকার চর্চা। আমরাও যদি যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী যারা নানাভাবে ইরাকে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে তাদের বিলুপ্ত করে দেওয়ার কথা বলি তা কি অনধিকার চর্চা হবে না? আমরা বড়জোর তাদের দ্বারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরতে পারব। এর বেশি কিছু করতে পারব না।

আসলে এটা করতে গিয়ে র‌্যাব একটি কৌশলগত ভুলও করেছে। বিষয়টি নিয়ে ব্র্রাড ও তেজশ্রীকে আমি বলেছিও। তারা যেহেতু বলতে চেয়েছেন যে, বিডিআর-বিদ্রোহ মামলায় অস্বচ্ছতা রয়েছে, তাহলে রিপোর্টের মূল ফোকাসটা ওই দিকেই থাকা দরকার ছিল। তা না করে তারা যখন র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার পরামর্শ দেন, তখন আলোচনাটা ওই দিকেই চলে যায়। সমস্ত মিডিয়া কিন্তু র‌্যাবকে বিলুপ্ত করার সুপারিশটিকেই পত্রিকার হেডলাইন করেছে। টেলিভিশনেও তাই হয়েছে। মানুষের মধ্যে আলোচনার ঝড় তুলে দিয়েছে প্রস্তাবটা। আমার কথা হলো, বিডিআর-বিদ্রোহ মামলার অস্বচ্ছতার প্রশ্নটাই যদি তাদের কাছে বড় হয়, তাহলে র‌্যাব-বিলুপ্তির প্রসঙ্গে কথা বলার কী প্রয়োজন ছিল?

যাহোক, র‌্যাব প্রসঙ্গে আমার নিজস্ব চিন্তাভাবনা নিয়ে অনেকে কথা বলেছেন। আমি বিভিন্ন সময়ে বলেছিও যে, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন। আমি চাই এটা বন্ধ হোক। এই যেমন কলেজছাত্র লিমনের সঙ্গে র‌্যাবের কিছু কর্মকর্তার নিষ্ঠুর আচরণের বিরুদ্ধে আমি সবসময়ই আছি। শুরু থেকে আমি এই নিরপরাধ কিশোরের পাশে দাঁড়িয়েছি। এখন আবার নতুন করে অনেকটা যেন চুপিসারে লিমনের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হলো। আমার প্রশ্ন হলো, এত প্রতিপত্তিশালী একটি প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্র, তার তুলনায় খুবই ক্ষুদ্র অসহায় একটি যোল-সতেরো বছরের ছেলে- শিশুর সংজ্ঞা নিয়ে চূড়ান্ত হতে যাওয়া নতুন আইনে আঠারো বছরের নিচে বয়সী সবাই শিশু- এ সব দিক থেকে দেখলে লিমনের ওপর রাষ্ট্র বা কোনও সংস্থার জেদ বা অহমিকা চরিতার্থের কী প্রয়োজন রয়েছে?

একটি কিশোরকে নিয়ে তার দরিদ্র মায়ের অনেক স্বপ্ন ছিল। মা ভাবতেন ছেলে লেখাপড়া শিখে তার সব দুঃখ ঘোচাবে। সে সব স্বপ্ন এখন ভেঙ্গে চুরমার। প্রতিদিন এই অসহায় মাকে দেখতে হয় তার কিশোর সন্তানের কাটা পা, অসহায় পঙ্গুত্ব। মেনে নিতে হয় এই বাস্তবতা। তাহলে আর কেন? যথেষ্ট তো হয়েছে!

আমি তাই লিমনকে ভরসা দিয়েছি। বলেছি, শুরু থেকেই তোমার পাশে ছিলাম। আছি। থাকব। বিচার-বহির্ভূত হত্যা বা এই ধরনের আক্রমণের বিরুদ্ধে আমি সবসময়ই আছি। আবার হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো কোনও বেসরকারি সংগঠন এসে আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে কাজ করবে এটাও আমি চাই না। তাদের প্রতিবেদনের ওই সুপারিশটির ব্যাপারে আমার আপত্তিটা ওখানেই।

আমার স্পষ্ট মতামত হলো, র‌্যাব বা যে কোনও সরকারি সংস্থার বিলুপ্তির ব্যাপরে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই আছে। এ ব্যাপারে অন্যদের মতামত দেওয়া ঠিক নয়। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অবশ্যই বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে রিপোর্ট তৈরি করতে পারে। সরকারকে কোনও সুপারিশ দিতে পারে না।

অনেকে জানতে চেয়েছেন, বিডিআর-বিদ্রোহ মামলায় অস্বচ্ছতার অভিযোগ আমরা পেয়েছি কিনা। অবশ্যই অসংখ্য অভিযোগ আমাদের কাছে এসেছে। আমরা সে সব অভিযোগ সম্পর্কে কয়েকবার কথা বলেছি বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মহাপরিচালকের সঙ্গে। তিনি প্রতিটি অভিযোগ তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন। পাশাপশি তিনি এ-ও বলেছেন, ট্রায়ালটা তো আমরা প্রকাশ্যেই করছি। এমনকি মিডিয়া সেখানে যেতে পারছে। রিপোর্ট করছে। তাহলে সেখানে কোনও রকম মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে সেটা আমরা জানতে পেতাম। তবু অভিযোগগুলো নিয়ে কাজ হচ্ছে। মনে রাখতে হবে যে, এত বড় একটি ঘটনা যেখানে নির্মমভাবে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে- সে ঘটনার বিচার হতেই হবে। তবে অবশ্যই বিচার-প্রক্রিয়াটি হবে পুরোপুরি স্বচ্ছ।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আরেকটি সুপারিশ নিয়েও আমি আপত্তি করব। তারা বলেছে, বিডিআর-বিদ্রোহ মামলার বিচারকাজটি বিডিআর আইনে না করে সাধারণ ফৌজদারি আইনে করা হোক। কথা হলো, বিলুপ্ত বিডিআর ছিল একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী। এ বাহিনীর কিছু সদস্য আইন লঙ্ঘন করেছে। তাই বিডিআর আইনেই তাদের বিচার হতে হবে। এ কথাটি মনে হয় হিউম্যান রাইটস ওয়াচের কর্মীরা ভুলে গেছেন। আসলে যে আইনের অধীনেই বিচার হোক না কেন, প্রথমত বিচার-প্রক্রিয়াটিকে স্বচ্ছ হতে হবে। এখানে কোনও রকম অন্যায় বা বৈষম্যকে প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। মিথ্যা অভিযোগে একজন মানুষও যাতে শাস্তি না পায়। দ্বিতীয়ত, এই আইনের অধীনেই একজন অভিযুক্তের প্রাপ্য সব ধরনের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। বিডিআর-বিদ্রোহ মামলার ব্যাপারে এটাই হলো আমাদের সর্বোচ্চ প্রত্যাশা।

মিজানুর রহমান : বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান।