কেমন আছে লাটভিয়া?

আনিসুর রহমান
Published : 13 June 2019, 01:53 PM
Updated : 13 June 2019, 01:53 PM

লাটভিয়া উত্তর ইউরোপের ছোট একটি দেশ। বাল্টিক সাগরের পূর্ব উপকূলে অবস্থিত আয়তন বাংলাদেশের চেয়ে অর্ধেকেরও কম; লোকসংখ্যা বিশ লাখের মত। তাও আবার চার থেকে পাঁচ লাখের মত নাগরিক পৃথিবীর নানা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেশটির একদিকে বাল্টিক সাগর, অন্যদিকে এস্তোনিয়া, লিথুয়ানিয়া আরেক দিকে বেলারুস, পূর্বে রাশিয়া। এই হলো দেশটির সংক্ষিপ্ত ভৌগোলিক বৃত্তান্ত।

এ বছরের জুন মাসের শুরুর দিকে দেশটির রাজধানী রিগায় অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় লেখক পরিষদের (ইউরোপিয়ান রাইটার্স কাউন্সিল) সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে দিন কয়েকের জন্যে দেশটিতে থেকে দেশটির পূর্বাপর রাজনৈতিক ইতিহাস আর শিল্পাসাহিত্য সম্পর্কে ধারণা লাভের পাশাপাশি দেশটির বর্তমান আর্থসামাজিক অবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেবার চেষ্টা করছিলাম।

দেশটির ইতিহাস ঘেঁটে মোটের উপর যা জানা যায় তা যেন কিছুটা বাংলাদেশের সঙ্গে মিলে যায়। দেশটা ইতিহাসের বড় একটা সময় বলা যায় জার্মান, পোল্যান্ড, সুইডেন আর রাশিয়ার উপনিবেশ হিসেবে ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে বিশেষ করে ১৯৪৪ সাল দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়নের করায়ত্তে চলে যায়। ১৯৯১ সালে দেশটি সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পুনঃযাত্রা করে।
দেশটি ২০০৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপিয়ন ইউনিয়নে যোগ দেয়।

আমার আগ্রহ ছিল ছোট এই দেশটির মানুষ সমাজবাদী সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে এসে কেমন আছে। রিগার মানুষজনের সঙ্গে কথা বলে জানলাম- তাদের সমস্যা আছে, আছে বেকারত্ব এবং একই সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধির বিয়োগান্তক হার। এ প্রসঙ্গে তরুণ কবি, অনুবাদক রাইমন্ড কিরকিসকে জিজ্ঞেস করেছিলাম- জনসংখ্যা বিয়োগান্তক হারের কারণ কি? ওর জবাব, একটা শিশুর জন্যে সরকারি মাসোহারা ভাতা মাত্র আট ইউরো। দুর্মূল্যের এই বাজারে জীবনসংগ্রামে একা টিকে থাকতেই যুবসমাজ হিমসিম খায়। তাই সহসা কেউ সন্তান নেবার ঝুঁকি নিতে চায় না।

তারপরের প্রশ্ন ছিল- তাহলে তোমরা কি সোভিয়েত ব্যবস্থায় ভাল ছিলে? না কি এখন তুলনামূলকভাবে ভাল আছ?

রাইমন্ড জানালো- ওরা এখন সোভিয়েত ব্যবস্থার চেয়ে ভাল আছে। তার কারণ সোভিয়েত ব্যবস্থায় সবকিছু ছিল মস্কো এবং কেজিবির নজরদারিতে; ব্যক্তি স্বাধীনতা বিঘ্নিত ছিল। আর অর্থনীতির ক্ষেত্রে বড় বাধা ছিল উদ্যোক্তা বের হয়ে আসার কোনও সুযোগই ছিল না। অর্থপ্রবাহ ভাল ছিল না। অর্থপ্রবাহ না থাকাতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আর জীবনের বৈচিত্র্য কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল।

তারপর রিগা শহরে অবস্থিত হোটেল রেডিসন ব্লু দেখিয়ে বলল- এই যে দেখতে পাচ্ছ বিশাল স্থাপনার হোটেলটি, তাও আবার রাজধানীর মূলরেখায়, এটি ছিল সোভিয়েত সময়ে কেজিবির নজরদারির অন্যতম দপ্তর। এখান থেকে গোটা লাটভিয়ার উপর নজরদারি করা হত, আমরা আর যাই হোক নজরদারি থেকে বাহ্যত মুক্ত।

রিগা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত স্বাধীনতা স্তম্ভটি নির্মিত হয়েছিল ১৯৩৫ সালে। ১৯৪৪ সালে লাটভিয়া সোভিয়েত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে গেলে মস্কো চেয়েছিল স্তম্ভটি ভেঙে ফেলতে। কিন্তু স্তম্ভটির স্থপতি ভাস্কর কারলিস যালে যথেষ্ট প্রভাবশালী হবার কারণে শিল্পসাহিত্যের প্রতি উদার মনোভাব প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে নিবৃত করতে পেরেছিলেন। স্তম্ভটি ঘিরে গণপরিবহনের জংশন করে রাখা হয়েছিল। যাতে জনসাধারণের প্রদর্শন করার যুতসই সুযোগ ব্যাহত করে রাখা হয়েছিল। এখন তা পরিচ্ছন্নভাবে জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত।

সোভিয়েত সময়ে দেশটির শিল্পসাহিত্য ইউনিয়নের মাধ্যমে প্রণোদনা আর পৃষ্ঠপোষকতা করলেও তা ছিল সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার একটা প্রয়াস। বলা যায় যা ছিল তাদের রাজনীতিরই অংশ।

দেশটির সঙ্গে রাশিয়ার বর্তমান সম্পর্ক কেমন? বন্ধু সহকর্মীদের সঙ্গে আলাপ করে জানলাম রাশিয়ার সঙ্গে লাটভিয়ার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মোটেও খারাপ না। আমদানি রপ্তানি ভালই চলছিল। বাধ সাধল ইউক্রেনের ক্রিমিয়া রাশিয়ার করায়ত্তে চলে যাবার পর। ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা জারির ফলে লাটভিয়া, রাশিয়া বাণিজ্যিক লেনদেন মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন নিষেধাজ্ঞার বাইরে যৎসামান্য বাণিজ্য চলমান আছে।

এখন কেমন চলছে সোভিয়েত সমাজতন্ত্রমুক্ত দেশটির সংসদীয় ব্যবস্থা? ১০০ সদস্যের জাতীয় সংসদে প্রায় সকল সদস্যই পুঁজিবাদী ডানপন্থি। গত তিন দশকে সমাজতন্ত্র, সাম্যবাদ শব্দগুলো যেন নিষিদ্ধ। তবে হাল আমলে সমাজবাদী ব্যবস্থার পক্ষে শিল্পী সাহিত্যিকদের মধ্যে কিছু কথাবার্তা শুরু হয়েছে। এমনকি সমাজবাদী ব্যবস্থার পক্ষে 'প্রগ্রেসিভ' নামে নতুন একটি দলের যাত্রাও শুরু হয়েছে। জাতীয় সংসদে যেতে হলে তাদের মোট গৃহীত ভোটের চার শতাংশ পেতে হবে। আর ইউরোপীয় সংসদে লাটভিয়ার জন্যে নির্ধারিত আট আসনে ভাগ বসাতে হলে তাদের গৃহীত ভোটের শতকরা পাঁচ ভাগ ভোট পেতে হবে। বিগত নির্বাচন দুটিতে তারা প্রায় কাছাকাছি এসে গেছে। তাদের কর্মসূচি জনগণকে কাছে টানার মত। তিন বছরের পরের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তারা জায়গা করে নিতেও পারে। এমনটাই আভাস পাওয়া গেল।

ছোট দেশ, ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী। কিন্তু সংস্কৃতির প্রসার আর সাংস্কৃতিক স্থাপনা অবাক করার মতই অগ্রসরমান। রয়েছে বিশাল আকারের জাতীয় নাট্যশালা। জাতীয় চিত্রশালা, জাতীয় চিত্রকলা একাডেমি, সাহিত্য জাদুঘর। দারুণ আশ্চর্যে ভরা আর রুচির চমৎকার সমাহার জাতীয় গ্রন্থাগার। উদ্যান আর নগর দারুণসব ভাস্কর্যে ভরা। উদ্যানে তরুণ সমাজের শুয়ে বসে বই পড়ার দৃশ্য চমৎকার, মনোমুগ্ধকর। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় একটি খাত হচ্ছে কৃষি। আমাদের দেশে কৃষিপণ্য, বিশেষ করে ধান উৎপাদনের ন্যায্য মূল্য না পেয়ে কৃষক যখন নাস্তানাবুদ, তখন আমাদের কৃষিমন্ত্রী হাসিমাখা মুখে নির্দ্বিধায় বলে দিতে পারেন সরকার এই সমস্যার ব্যাপারে অবগত হলেও অপারগ।
সরকার এবং কৃষিমন্ত্রী যখন অপারগ তখন কৃষক আর দেশটা যাবে কোথায়?

এই অবস্থায় লাটভিয়ার বন্ধুদের কাছ থেকে জানা গেল, তাদের সরকার কৃষিখাতে বড় রকমের ভর্তুকি দিয়ে থাকে। যা তাদের অর্থনীতিকে সচল রাখতে সাহায্য করে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হল দেশের স্বার্থ আর দেশের মানুষের জীবনমান ঠিক রাখতে হলে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই হোক আর সংসদীয় ব্যবস্থাই হোক কৃষিপ্রধান দেশে কৃষকের ন্যায্য অধিকারকে অগ্রাহ্য করে দেশের মঙ্গল হতে পারে না।

রিগা শহরের একমাত্র আন্ডারগ্রাউন্ড বইয়ের দোকান আর কবিতা ক্যাফেতে 'কবিতা- একটি আন্তর্জাতিক ভাষা' শীর্ষক একটা সংলাপে অংশ নেবার সুযোগ হয়েছিল। অনুষ্ঠান শেষে এর উদ্যোক্তা দিদজিস কালনিনসের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেল, তার বইয়ের দোকানে ক্রেতার ভিড় দিন দিন কমে যাচ্ছে। কারণ হিসেবে জানাল মানুষের মোবাইল নির্ভরতা আর আর্থিক টানাপড়েন। সে শঙ্কিত- হয়তো একদিন তাকে এই ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসায় চলে যেতে হবে। এই শঙ্কা কি কেবল রিগার? আমাদের শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটের দিকে তাকালেইতো প্রাণটা ছ্যাৎ করে উঠে। আমাদের সেই বইয়ের দোকানগুলো কই?

লেখাটি রবীন্দ্রনাথের একটি প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। কবি ও লেখক রাইমন্ড জানাল- রবীন্দ্রনাথের কমপক্ষে তিনটি বই লাটভিয়ান ভাষায় অনূদিত। সোভিয়েত ইউনিয়নের করায়ত্তে যাবার আগেই রবীন্দ্রনাথ লাটভিয়ার জনপ্রিয় ছিলেন, এবং তার বই অনূদিত হয়েছিল। কিন্তু গোটা সোভিয়েত ব্যবস্থা যতদিন ছিল রবীন্দ্রনাথের ব্যাপারে খুব পৃষ্ঠপোষকতা ছিল, তাকে নিয়ে তোড়জোড় ছিল। সোভিয়েত ব্যবস্থার অবসানের পরে সেই তোড়জোড়টা আর নাই। তবে রবীন্দ্রসাহিত্যের আবেদন তাদের কাছে ফুরিয়ে যায় নাই; রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতাও না।

ছবি কৃতজ্ঞতা: সাদাত হাসান নিলয়