বানানে জঞ্জাল আর কত কাল: প্রসঙ্গ ঈ, ঊ, ষ, চন্দ্রবিন্দু, অনুস্বর, বিসর্গ

তারেক খানতারেক খান
Published : 12 June 2019, 01:14 PM
Updated : 12 June 2019, 01:14 PM

প্রায় সবাই বাংলা লিখতে গিয়ে বানান নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়েন। হীনম্মন্যতায় ভোগেন অনেকে। মানসিকভাবে লাঞ্ছিত করে এবং লাঞ্ছিত হয়ে অস্বস্তিতে পড়েন আরো অনেকে! এ নিয়ে প্রায় সবার মধ্যে বিরক্তি আছে। রাগ, ক্ষোভ, হতাশা আছে অনেকের মধ্যে। তবু সমস্যা সমাধানের চেষ্টা বা আলোচনা একেবারেই নগণ্য।

এ প্রসঙ্গে 'বাংলা একাডেমি প্রমিত বাংলা বানানের নিয়ম' নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা ও ব্যক্তিগত মতামত:

বছর ত্রিশ আগে প্রকাশের পর অতিক্ষুদ্র এই পুস্তকটি বানান শৃঙ্খলায় দারুণ ভূমিকা রাখে। অনেক এলোমেলো বিষয় তারা নির্দিষ্ট করে দেন। তবে এর প্রণেতারা উদারভাবে নিয়ম বেঁধে দিলেও কৃপণ থেকেছেন ব্যাখ্যার ব্যাপারে।

যেমন, ১.০২-এ তারা বলছেন, যেসব তৎসম শব্দে ই, ঈ বা উ, ঊ উভয়ই শুদ্ধ সেসব শব্দে কেবল ই বা উ হবে।

কেন তারা ই/উ বেছে নিলেন? ঈ/ঊ কী দোষ করল?

আরো প্রশ্ন, একই শব্দে ই, ঈ বা উ, ঊ উভয়ই শুদ্ধ হয় কিভাবে? বিষয়টা যেমন কৌতুকের তেমনি বিভ্রান্তিকর।

বিকল্প কমিয়ে আনতে চান বলে তারা একটি দোহাই দিয়েছেন বটে, কিন্তু বিকল্প নিয়ে যে সংকট তা খুবই সামান্য।

পুস্তকটিতে এসব ব্যাখ্যা থাকলে ভাল হত। তাহলে হয়ত ঈ-ঊ বাহুল্য প্রমাণিত হত। ওই পুস্তকের প্রণেতারা অবশ্য শুরুতেই বলে রেখেছেন, বানান সংস্কার তাদের উদ্দেশ্য না। তারা ভয়ে ভয়ে এ-ও বলে রেখেছেন, এই নিয়মে "ব্যাকরণের বিধান লঙ্ঘন করা হয়নি!"

কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যেতেই মানুষ যা ভয় পায়! আর সেখানে ব্যাকরণের বিধান! হয়ত এ কারণে তারা ব্যাখ্যার ঝক্কিতে যেতে চাননি।

তবে আমরা এভাবে ভাবতে পারি:

অন্য অনেক চিত্রের মত শব্দ (word) একটা চিত্র বৈকি। সেখানে চোখের দেখাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে চিত্রটা মানুষ দেখতে অভ্যস্ত তার হঠাৎ পরিবর্তন চোখ মেনে নিতে পারে না। কোনো রচনায় 'জিবন' লেখা দেখলে আমরা বিরক্ত হই। রাগ হওয়াও অস্বাভাবিক না। কিন্তু ধীরে ধীরে চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায়। শিশুকে যদি 'জিবন' লিখতে শেখান, বড় হয়ে সে 'জীবন' দেখলে বিরক্ত হবে। রাগও হতে পারে।

এককালে বাড়ী, গাড়ী ইত্যাদি লেখা হত। যখন বাড়ি, গাড়ি লেখা শুরু হল, প্রথমে অনেকেই মানতে পারেননি। এখন কোনো প্রতিষ্ঠান বাড়ী, গাড়ী লেখে না।

ঈ-ঊ মহা-আপদের মত বোঝা হয়ে আছে। যারা একে ছাঁটতে চান না তারা কোনো শক্ত যুক্তি/তত্ত্ব/দর্শন যে হাজির করেন তাও না। তারা আসলে বদ্ধ অস্থায় আছেন। একটা জায়গায় আটকে আছেন। মুক্ত হতে পারছেন না।

শব্দের উৎস-ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী বানান লিখতে হবে—সব ক্ষেত্রে এই বিধানের কোনো শক্ত ভিত্তি নাই। যুক্তি/তত্ত্ব/দর্শনও নাই।

তবু ক্ষেত্রবিশেষে আমরা উৎস-ভাষার ব্যাকরণ অনুযায়ী কিছু শব্দের বানান লিখতে পারি। যেমন যুক্ত বর্ণগুলো। বাংলায় বহু যুক্ত বর্ণ ভেঙে লিখলে স্পেস বেড়ে সৌন্দর্য নষ্ট হবে, এটা একটা যুক্তি।

কিন্তু ঈ, ঊ, ষ, ঁ, ঃ, ং—এগুলো একেবারেই বাহুল্য। বিসর্গ বাদ দিলে 'দুঃখ' ইত্যাদি শব্দগুলো কিভাবে লেখা হবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু দেখি না। 'সূক্ষ্ম' 'রুক্ষ' ইত্যাদি যেভাবে লেখা হয় সেভাবেই 'দুক্ষ' লেখা যায়। আবার 'দুখ' লিখলেও চলে! ব্যতিক্রম ত বাংলা ভাষায় আছেই।

উৎপত্তি-ব্যুৎপত্তি নিয়ে যে টেনশন—সে রকম বহুত অযৌক্তি বদমায়েশি বাংলা ভাষায় আছে। ইংরেজিতে আছে। পুস্তকে পড়েছি, অন্য বহু ভাষায়ও এই বদমায়েশি বহুল পরিমাণে আছে!

চন্দ্রবিন্দু (ঁ) একেবারেই একটা উটকো চিহ্ন। 'ঙ' দিয়ে সব কাজ চমৎকার চলে। আবার 'ষ'-এর সব কাজ চলে 'স' দিয়ে। কোথাও কোনো রকম বিভ্রান্তির বিন্দুমাত্র আশঙ্কা নেই। তাহলে কেন আমরা এসব জঞ্জাল বয়ে বেড়াচ্ছি? এতে কি সময়-শ্রম কম যাচ্ছে?

প্রশ্ন আছে, এসব বর্ণ ছেঁটে ফেললে আগের পুস্তকগুলো পড়ব কিভাবে?

উত্তরও আছে, মাত্র আড়াই শ বছর আগে যখন হাতে পুথি লেখা হত, সেসব পড়ার জন্য এখন আমাদের আলাদাভাবে সে আমলের বর্ণগুলো শিখতে হয়। মুদ্রণযন্ত্র না থাকায় সেকালের লিপিকারদের হাতে অনেক বর্ণই নানা রকম রূপ নিত।

অতীতের রচনাগুলো বেশি লোক পড়ে না। যারা পড়বেন তারা ওই বর্ণগুলো আলাদাভাবে শিখে নিতে পারেন। তাদের পক্ষে শেখা কঠিন না। পক্ষান্তরে বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য একটা সরল-সুন্দর নিয়ম পাবে বাংলা ভাষা।

ভুল বানানে ক্ষুব্ধ লোকের সংখ্যা বহুত। প্রায়ই তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখি। এই দলে বিশেষজ্ঞরা ত আছেনই, প্রতি লাইনে দু-একটা ভুল করেন এমন অনেক শিক্ষক-সাংবাদিকও আছেন!

তবে তাদের বিরোধী পক্ষ যারা বানানকে 'কঠিন/বিদঘুটে' মনে করেন, তাদের দলই বড় এতে সন্দেহ নেই। হা, তারা 'অজ্ঞ, মূর্খ, বইবিমুখ' প্রজাতি!

তাহলে দেখা যাক প্রকৃত অবস্থাটা কী:

বাংলা একাডেমির ওই পুস্তকটায় ডজন দুই নিয়ম আছে। এগুলো একেবারেই মৌলিক কিছু নিয়ম। শুদ্ধ বানান লেখার জন্য মোটেও যথেষ্ট না। যথেষ্ট করার জন্য কয়েক শ পৃষ্ঠার গাইড লিখেছেন অনেকে।

আর বানানের নিয়ম হচ্ছে এমন এক বিষয় যা দু-চারবার পড়লে হয় না। একেবারে মুখস্থ করে রাখতে হয়। ওই নিয়মগুলো কে কতক্ষণে আয়ত্ত করতে পারে, কার পক্ষে কতক্ষণ মনে রাখা সম্ভব, আপনিই চিন্তা করে দেখুন।

তাছাড়া শুধু নিয়ম জানলেই হচ্ছে না। বাংলা একাডেমি ওই পুস্তকে যেসব নিয়ম বেঁধে দিয়েছে তার মধ্যে কয়েকটা একেবারেই আতঙ্কজনক। তা হল, নিয়ম প্রয়োগের জন্য আপনাকে শব্দের উৎস-পরিচয় জানতে হবে! অমুক শব্দটা সংস্কৃত—সুতরাং এই নিয়মে লিখতে হবে। তমুকটা তৎসম, অর্ধ-তৎসম, তদ্ভব বা বিদেশি—সুতরাং এই নিয়মে লিখতে হবে, ইত্যাদি।

আমি শ খানেক শিক্ষক-সাংবাদিককে দেখেছি যারা শুদ্ধ বানান লেখার যুদ্ধে নেমে পরাজিত হয়েছেন। আরো কয়েক শ বাংলায় এমএ পাস লোকের কথা জানি যারা উদ্যোগ নিয়েও বেশি দিন চেষ্টা করতে পারেননি। কারণটা হয়ত এই যে ভাষা শেখার ক্ষমতা সবার এক রকম না। যে লোক ইতিহাস-অর্থনীতি বা অন্যান্য বিষয়ে ভাল, তিনি বানানও ভাল শিখতে পারবেন তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। জৈবিক সীমাব্ধতা থাকতে পারে। সামাজিক বা অন্যান্য কারণে মনের গতি যেকোনো দিকে চালিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা নেই মানুষের—এটাও একটা কারণ হতে পারে।

প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান অবস্থায় বাংলা লিখতে গিয়ে শুদ্ধ ও সুশৃঙ্খল বানানশৈলী নিশ্চিত করতে হয় কিভাবে, একটি ছোট্ট লেকচার দেখুন:

অভিধান থেকে যা শিখেছেন কেবল তাই লিখুন। প্রতিটা শব্দ লেখার সময় মনে করুন, এটা কি আপনি অভিধান থেকে শিখেছেন? অভিধানে শব্দটা যেভাবে আছে সেভাবে মনে না পড়লে অভিধান খুলুন।

অন্য কোনো বইতে শব্দটা যেভাবে আছে সেভাবে মনে পড়লেও লেখা যাবে, যদি আপনি নিশ্চিত হন যে ওই বইয়ের শতভাগ বানান শুদ্ধ।

প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে নিয়মের কী দরকার?

নিয়ম হল মনে রাখার সুবিধার জন্য। কোনটা কোন ধরনের শব্দ তা জানার জন্য! এসব না জানলে আপনি বেশি শব্দ মনে রাখতে পারবেন না। বারবার বিভ্রান্ত হবেন।

ভাল প্রক্রিয়াটা হল, নিয়ম-কানুন শেখার পর অভিধানের প্রতিটা শব্দের ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে যাওয়া। কিভাবে, কত বার বুলাবেন তা নির্ভর করছে আপনার মনে রাখার ক্ষমতার ওপর। সবার ক্ষমতা এক রকম না তা ত আপনি জানেনই।

আর শেষ পর্যন্ত অভিধান থেকে আপনার মুক্তি নেই। শুদ্ধ বানান লিখতে হলে অভিধান আপনাকে খুলতেই হবে। কারণ সময়-অসময় একেকটা শব্দ স্মৃতিতে ঝাপসা হয়ে যায়!

সবার পক্ষে শুদ্ধ বানান লেখা সম্ভব না। এ কারণেই পেশাদার প্রুফ রিডার দরকার হয়। বাংলায়ও ইংরেজিতেও। নিশ্চয় অন্য সব ভাষায়ও। এবং এ বাবদ প্রকাশককে বেশ ভাল পরিমাণ ব্যয় করতে হয়। ইউরোপ-আমেরিকায় ইন্টেলেকচুয়াল পেশা হিসেবে এটি একটি দামি কাজ।

আমার মনে হয়, ভুল নিয়ে সাধারণ লোকের ইতস্তত করার কিছু নেই। হীনম্মন্যতায় ভোগার কারণ নেই। লাঞ্ছিত না করা বা লাঞ্ছিত না হওয়ার দিকে বিশেষ নজর রাখা উচিত। বিরক্তি-রাগ-ক্ষোভ-হতাশার কোনো মানে নেই।

বাংলা বানান কিছু সংস্কার করতে পারলে সেটা হতে পারে অনন্য-অসাধারণ। যেমন, ঈ, ঊ, ষ, ঁ, ঃ, ং ছেঁটে ফেললে বহু নিয়ম ঝরে যাবে। আর 'ণ' ও 'ন' থেকে একটা বেছে নিলে বহু নিয়ম ঝরে যাবে। তাহলে বহু শব্দের বানান ও উচ্চারণ একই দাঁড়াবে বলে অসাধারণভাবে 'ভুলের' পরিমাণ কমে যাবে। এতে যেমন সময়-শ্রম বাঁচবে তেমনি বানান নিয়ে মাথা ঘামানোর বদলে লেখার বিষয়ে বেশি করে মন দেওয়া যাবে।

যারা উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লিখতে চান তারাই 'ণ' ও 'ন' দু-ই রাখার পক্ষে। উচ্চারণ অনুযায়ী বানান লিখতে হবে এই আবদারের কোনো ভিত্তি নাই। যুক্তি বা তত্ত্ব কিচ্ছুই নাই। এখানে দর্শনেরও কোনো কারবার নাই। উচ্চারণ এক রকম আর বানান আরেক রকম এমন ভূরি ভূরি দৃষ্টান্ত বাংলা ভাষায়। ইংরেজিতেও আছে।

এটা কেন করা উচিত?

ভাষার একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে যোগাযোগ। তাকে যত শক্তিশালী করা যাবে তত বেশি খাতে ব্যবহার করা সম্ভব হবে। লেখার সময় খেয়াল রাখতে হয় এটা কত বেশি লোক বুঝতে পারবে। কত সহজে বুঝতে পারবে। যদি কেউ বুঝতে না পারে তাহলে ওই ভাষার কোনো ক্ষমতা নেই।

পত্রপত্রিকায় যারা লেখা পাঠান তাদের অনেকের লেখা (লেখার ভাষা) সম্পাদকরাও বুঝতে পারেন না! তার মানে ওই ভাষার কোনো ক্ষমতা নেই। কিছু লেখা কেবল অল্পকিছু সম্পাদক বুঝতে পারেন। তার মানে ওই ভাষার সামান্য একটু ক্ষমতা আছে। সম্পাদক হয় ওটা ফেলে দেন না হয় পাঠকের জন্য উপযোগী করে তোলেন।

ভাষা নিজেও শিল্প হতে পারে। কিন্তু এর উদ্দেশ্য শিল্প হওয়া না। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের খোয়াবনামা, শহীদুল জহিরের সে রাতে পূর্ণিমা ছিল, জেমস জয়েসের ইউলিসিস, গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের নিঃসঙ্গতার একশ বছর, ইত্যাদি উপন্যাসে ভাষার নান্দনিক প্রয়োগ। তারা বিশেষ ভাষাশৈলী সৃষ্টি করেছেন। সেখানে বানানের কোনো কারিকুরি নেই। সেটা হল শব্দ ও বাক্যের ক্যারিশ্মা। সেখানে ই নাকি ঈ, উ নাকি ঊ, ঙ নাকি ং, ষ নাকি স, ণ নাকি ন, ঃ আছে কি নেই, ঁ আছে কি নেই—এসব মোটেও ধর্তব্য না।