মমতার লক্ষ্য কি গৃহযুদ্ধ?

গৌতম রায়
Published : 11 June 2019, 11:58 AM
Updated : 11 June 2019, 11:58 AM

সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে ফলাফল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এ কথা বলতেই হয় যে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে এ রাজ্যে সামাজিক ভিত্তি নির্মাণের কাজটি করতে সব রকমভাবে সাহায্য করেছেন স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বস্তুত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের নগ্ন রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে কার্যত তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই যেভাবে সাম্প্রদায়িক বিজেপি এবং তাদের মূল চালিকা শক্তি আর এস এস কে এ রাজ্যে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্র বিস্তারের জায়গা করে দিয়েছেন তার পরিপূর্ণ সুযোগ সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলি দীর্ঘদিন ধরে নিয়েছে। সেই সুযোগের অভিশ্রুতি এবারের লোকসভা নির্বাচনে দেখতে পাওয়া গেল।

তারপরও এ রাজ্যে বস্তুত নির্বাচনের পর নিজের দলের বিপর্যয়কে সামনে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন কিছু আচরণ এবং কথাবার্তা বলে যাচ্ছেন যার জেরে বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সামাজিক ভিত্তির যে পটচিত্র নির্মাণ বাকি ছিল সেই নির্মাণকে কার্যত নিজের হাতে সম্পূর্ণ করে দিচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর নিজের হাতে স্বরাষ্ট্র দপ্তর থাকা সত্ত্বেও তাঁর নিজের দল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মীরা কিভাবে ঘর ছাড়া হয়েছে, কোথায় গেল রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা– এসব প্রশ্নকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলা নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন নির্বাচন কমিশনের হাতে ছিল– এই অর্ধসত্য প্রচার করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজের প্রশাসনিক অপদার্থতাকে ঢাকবার সবরকম চেষ্টা করে চলেছেন।

বস্তুত মমতা অর্ধসত্য প্রচার করছেন যে নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন রাজ্য প্রশাসন তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হাতে কোন ক্ষমতা ছিল না। প্রকৃত বিষয় হল এই যে, রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার দৈনন্দিন বিষয়বস্তুর যাবতীয় দায়দায়িত্ব কিন্তু নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন ও রাজ্য মন্ত্রিসভার হাতেই, রাজ্য প্রশাসনের হাতে ন্যস্ত ছিল। সেই দায়িত্ব পালনে মমতা চূড়ান্ত ব্যর্থ হয়েছেন। নিজের সেই ব্যর্থতা ঢাকতে মমতা নির্বাচন কমিশনের ঘাড়ে সব দায়িত্ব চাপিয়ে দিতে চাইছেন।
এইভাবে সাধারণ মানুষের মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করে সাংবিধানিক সংস্থা নির্বাচন কমিশন সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মনে ঘোরতর সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি নৈহাটিতে তাঁর দলের কর্মী-সমর্থকরা ঘরছাড়া এমন অভিযোগ তুলে অবস্থানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করলেন। তাঁর নিজের হাতেই প্রশাসনের যাবতীয় দায়-দায়িত্ব। তিনি পুলিশ মন্ত্রী, অথচ তাঁর দলের কর্মী-সমর্থকরা নাকি ঘর ছাড়া– এই অভিযোগ তুলে কার্যত নিজের প্রশাসনের বিরুদ্ধে অবস্থানে বসার সিদ্ধান্ত নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

সেই সিদ্ধান্ত মোতাবেক নৈহাটি আসার পথে ভাটপাড়া সন্নিহিত এলাকায় তাঁর কনভয়ের আশেপাশে কিছু মানুষের রাজনৈতিক স্লোগানকে ঘিরে মমতা গাড়ি থেকে নেমে পড়ে যে আচরণ প্রকাশ করলেন, যে দেহভঙ্গিমার পরিচয় দিলেন, মুখনিসৃত যে অমৃত বাণী উচ্চারণ করলেন– তা নিন্দা করবার ভাষা নেই ।কার্যত এখানে প্রশ্ন তুলতেই হয়, রাজ্যের নাগরিকদের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কি মনে করেন? 'তোদের খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি'– এই যে শব্দগুলি তিনি উচ্চারণ করলেন, তার ভেতর দিয়ে তিনি কি বোঝাতে চাইছেন?' তোদের' বলতে তিনি কাদেরকে বোঝাতে চাইছেন?

হিন্দিভাষীদেরকে 'তোদের' বলে আলাদা করে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার যে অপচেষ্টা মমতা চালাতে শুরু করলেন তার পরিণতি কতদূর পৌঁছতে পারে, সে সম্পর্কে কি মমতার আদৌ কোনো ধারণা আছে? পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যটাকে কি মমতা তাঁর ব্যক্তিগত জমিদারি বলে মনে করেন? তিনি রাজ্যের নাগরিকদের 'খাওয়াচ্ছি, পরাচ্ছি' বলে তাঁদের প্রতি সম্ভাষণ করেন কোন অধিকারে?

একদা মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মুখে তথাকথিত 'আমরা, ওরা' শুনে বিদ্দৎসমাজের যেসব মানুষরা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিলেন, আশ্চর্যের বিষয় হলো, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজ্যের গরিব গুর্বো খেটে খাওয়া হিন্দি ভাষী মানুষদের প্রতি এই অশ্লীল, অমর্যাদাকর, অসাংবিধানিক, অশালীন শব্দ ব্যবহার সম্পর্কে কিন্তু আজ পর্যন্ত একটি শব্দ উচ্চারণ করেননি। 'জয় শ্রীরাম' শব্দটিকে বিজেপি দল তাঁদের রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করেন। এই স্লোগান ব্যবহারের সঙ্গে আদৌ কোন আধ্যাত্মিকতা, ধর্মীয় ধ্যান-ধারণার সম্পর্ক কিন্তু নেই। সেই স্লোগানটিকে ঘিরে মমতার যে আপত্তি সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের প্রচারকাল থেকে দেখা যাচ্ছে, তাতে বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই এই প্রশ্ন তীব্র হয়ে উঠছে যে, বাজপেয়ী জামানায় মমতা যখন বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার মন্ত্রী ছিলেন, তখন যখন বিজেপি কর্মী সমর্থকরা এই 'জয় শ্রীরাম' স্লোগান দিতেন, তখন তো মমতা একবারের জন্য এই স্লোগান ঘিরে তাঁর আপত্তির কথা জানাননি।

তাহলে আজকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর কনভয়ের পাশে যদি কেউ এই শ্লোগান ব্যবহার করে, তাহলে সেই শ্লোগানকে কার্যত 'গালাগালি' বলে সম্বোধন করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেভাবে বিজেপি বা তাঁদের রাজনৈতিক ধ্যান-ধারণার কাছাকাছি মানুষদের সুবিধা করে দিচ্ছেন সেই বিষয়টিকে ঘিরে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দেওয়া দরকার। বস্তুত মমতা বিজেপির সুবিধে করে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই, বিজেপির সামাজিক ভিত্তিকে আরও শক্ত করে দেয়ার উদ্দেশ্যেই তাঁদের রাজনৈতিক স্লোগান 'জয় শ্রীরাম'কে ঘিরে এই ধরনের আপত্তি জানাচ্ছেন।

বিপক্ষের রাজনৈতিক স্লোগান শুনে কোনো রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান রাস্তায় নেমে এসে বিপক্ষ দলের কর্মী সমর্থকদের উদ্দেশ্যে তুই-তোকারি করে কোমর বেঁধে ঝগড়া করছেন– এমন দৃশ্য কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ কেন, গোটা ভারতবর্ষের কোথায় দেখতে পাওয়া যায়নি। নির্বাচন প্রক্রিয়া চলাকালীন আমরা দেখেছি, কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর কনভয়ের সামনে কিছু মানুষ নরেন্দ্র মোদির প্রতি সদর্থক স্লোগান দিয়েছিলেন। প্রিয়াঙ্কা অত্যন্ত শান্তভাবে, কনভয় থেকে নেমে এসে স্লোগানকারীদের দিকে এগিয়ে যান। তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন, কুশল বিনিময় করেন। আমাদের এই রাজ্যেও যাদবপুর লোকসভার বাম প্রার্থী বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্যের সামনে মমতার দল তৃণমূল কংগ্রেসের কর্মী সমর্থকরা একাধিকবার তাঁদের দলীয় স্লোগান দিয়েছেন। বিকাশ বাবু কিন্তু একটিবার ক্ষিপ্ত না হয়ে, স্লোগানকারীদের দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন, কুশল বিনিময় করেছেন।

এই রাজনৈতিক সংস্কৃতির ধারে পাশ দিয়ে হাঁটতে জানেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রশ্ন হল, মমতা এই পথে হাঁটতে জানেন না, না ইচ্ছে করেই তিনি হাঁটছেন না– সেটাই বড়ো প্রশ্ন। তিনি কি বিজেপিকে আলাদা রকমের মাইলেজ পাইয়ে দিতে তাঁদের রাজনৈতিক স্লোগান 'জয় শ্রীরাম'কে ঘিরে প্রকাশ্যে রাজপথে নেমে এই ধরনের অপ্রকৃতিস্থ মানসিকতার পরিচয় দিচ্ছেন?

ভাটপাড়ায় দাঁড়িয়ে স্লোগানকারীদের উদ্দেশ্যে মমতা যে আচরণ এবং কথা বলেছেন তাতে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বলতে হয় যে, মমতা প্রকাশ্যে বিজেপির ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতাকে আরো তীব্র করে তুলতে, তাকে আরো ভয়াবহ আকার দিতে এ রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গা সৃষ্টিতে নিজে সরাসরি উস্কানি দিচ্ছেন।ভাটপাড়া দাঁড়িয়ে তিনি প্রকাশ্যে বলেছেন, এ রাজ্যকে নাকি তিনি গুজরাট বানাতে দেবেন না।

প্রশ্ন হল, নরেন্দ্র মোদী যখন মহাত্মা গান্ধীর গুজরাট, উমাশঙ্কর যোশীর গুজরাটকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক গুজরাটে পর্যবসিত করছেন– কই তখন তো বাজপেয়ী মন্ত্রিসভার মন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটিও প্রতিবাদের শব্দ উচ্চারণ করেননি। বরঞ্চ 'গুজরাট গণহত্যার' রক্ত হাতে মেখে নরেন্দ্র মোদী যখন গুজরাট বিধানসভা নির্বাচনে জিতে আসেন, তখন এই নরেন্দ্র মোদীকেই অভিনন্দন জানাতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফুলের তোড়া পর্যন্ত পাঠিয়েছিলেন।
সেদিন কেন তাঁর কাছে গুজরাট সাম্প্রদায়িক ছিল না, আর সেই গুজরাট আজ কেন মমতার কাছে সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠল এই জটিল তত্ব বুঝতে কোনো শিশুর পক্ষেই এতোটুকু অসুবিধা হয় না।

ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের শ্রমজীবী দরিদ্র হিন্দি ভাষী মানুষের একটা বড় অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তাঁর দলকে সমর্থন করেননি সদ্য সমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে। কেন এমন ঘটনা ঘটল তার কারণ অনুসন্ধান না করে কার্যত এই হিন্দিভাষী মানুষদের প্রতি যে ধরনের বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা প্রকাশ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভাটপাড়া রাস্তায় দাঁড়িয়ে উচ্চারণ করলেন, যার প্রেক্ষিতে বৈদ্যুতিন গণমাধ্যমকে পর্যন্ত খোদ মুখ্যমন্ত্রীর মুখনিঃসৃত অমৃত ভাষণকে 'বিপ' শব্দ দিয়ে ঢেকে দিতে হলো, তার প্রেক্ষাপটটা আমাদের গভীরভাবে ভেবে দেখা দরকার।

বিজেপির সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে আরো শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যেই যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজ্যে ভাষা ভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে জাতিদাঙ্গায় পর্যবসিত করার জন্যে প্রশ্রয় ভাটপাড়াতে দাঁড়িয়ে দিচ্ছেন– সেটা বুঝতে এখন কারো পক্ষে অসুবিধা হচ্ছে না। তাঁর এই আচরণ থেকে এটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায়, সাম্প্রদায়িকতাকে বিজেপি তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ব্যবহার করে সেই রাজনৈতিক কর্মসূচিকে যাতে আরো নানাভাবে শক্তিশালী করে তুলতে পারে, তার জন্য মমতা কিন্তু এখন আদা জল খেয়ে নেমে পড়েছেন।

অনেকের মনেই প্রশ্ন তীব্র হয়ে উঠছে যে, সারদা-নারোদাসহ মমতার যে হাজারো রকমের দুর্নীতি, সেই দুর্নীতি ঢাকতেই, সেই দুর্নীতির হাত থেকে বাঁচতেই কি মমতা বিজেপিকে এইভাবে জাতিগত দাঙ্গার পরিবেশ তৈরি করে, সাম্প্রদায়িকতার প্রচার-প্রসারের মধ্যে দিয়ে আরো বেশি শক্তি অর্জন করতে পেছনের দরজা দিয়ে সাহায্য করতে চলেছেন?

উনিশ শতকের মধ্যভাগ থেকে প্রায় ২০০ বছর ধরে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষ মূলত শ্রমজীবী মানুষ কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, গায়ে গা লাগিয়ে বাস করছে এই ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে। হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি এই অঞ্চলে আমাদের জাতীয় আন্দোলনের সূচনালগ্নে কি ধরনের সাম্প্রদায়িক বিভাজন করবার চেষ্টা করেছিল তার ঐতিহাসিক বিবরণ সমরেশ বসু রেখে গেছেন তাঁর বিখ্যাত 'শ্রীমতি ক্যাফে' উপন্যাসটির ভেতরে। পরবর্তী সময়ে এই আঞ্চলটিতে জোরদার শ্রমিক আন্দোলন, রুটি রুজির লড়াই সাধারণ মানুষের ভেতরে ধর্ম ও জাতপাত, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে, ভেদাভেদ-বিভাজন রেখাকে, কোনো অবস্থাতেই থাবা বসাতে দেয়নি।

সেই অঞ্চলে সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনের পর সাম্প্রদায়িক বিজেপির জয়লাভের প্রেক্ষিতে প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কানি দিয়ে মমতা যে নিন্দনীয় ভাষা, নিন্দনীয় আচরণ– এখানকার প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে করলেন, তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী হতে বাধ্য। মমতার তৈরি করে দেওয়া এই রাস্তাতেই বিজেপি ইতিমধ্যে মমতারই জাতিবিদ্বেষী আচরণের প্রতিবাদে স্থানীয় থানায় ধর্ণার কর্মসূচি নিয়েছে। এই পরিস্থিতি যে কেবল ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলে তৈরি হল তা নয়। ব্যারাকপুরে জয়ী বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংয়ের প্রতি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের জায়গা থেকে প্রকাশ্য রাজপথে নেমে এসে মমতা যে জাতিবিদ্বেষী ভাষা, হিন্দি ভাষা বিদ্বেষী আচরণ দেখালেন তার প্রভাব ভাটপাড়া বা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলকে অতিক্রম করে রাজ্যের অন্যান্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়বে না তার গ্যারান্টি কে দিতে পারে? কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গে নয়, মমতারই জাতিবিদ্বেষী, ভাষা বিদ্বেষী আচরণের প্রভাব পশ্চিমবঙ্গের বাইরে হিন্দি বলয়ের যে সমস্ত রাজ্যে পেটের তাগিদে বাঙালিরা কর্মরত রয়েছেন, তাঁদের ওপরে পড়বে না তার গ্যারান্টি কি কেউ দিতে পারেন?

বস্তুত মমতা এক আগুন নিয়ে খেলা খেলতে নেমেছেন। তিনি একদিকে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক বিজেপিকে এবং তাদের মূল চালিকা শক্তি আরএসএসকে এ রাজ্যে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সংসদীয় রাজনীতিতে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সব রকমভাবে অনুঘটকের ভূমিকা পালন করছেন।অপরদিকে তাঁদের রাজনৈতিক কর্মসূচি 'সাম্প্রদায়িকতা'কে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে নিজে সরাসরি 'প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা'র রাস্তায় নেমে পড়েছেন।

নৈহাটিতে নিজেরই সরকারের অপদার্থতাকে আড়াল করতে তথাকথিত ধর্ণায় বসে আরএসএসের মোকাবিলায় তিনি জয় হিন্দ বাহিনী এবং বঙ্গ জননী বাহিনী গড়বার কথা ঘোষণা করেছেন। এই জয় হিন্দ বাহিনীর হাতে নাকি রবীন্দ্রনাথের ছবি সম্বলিত লাঠি থাকবে সেকথাও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ্য সভা থেকে ঘোষণা করেছেন।

এই পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে, এই সব কর্মসূচির ভেতর দিয়ে কার্যত মমতা পশ্চিমবঙ্গকে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছেন সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আজ মমতার আরএসএসের মোকাবিলায় তথাকথিত বাহিনী তৈরি করবার কথা মনে পড়ছে। প্রশ্ন হলো ক্ষমতায় আসার ৮ বছরের ভেতরে কেন তিনি আরএসএসের রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক বা সামাজিক মোকাবিলা করেননি– এর উত্তর কি মমতা একবারও দেওয়ার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেছেন?

কিভাবে মমতা প্রশাসনের সহায়তায় এবং তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেসের ইন্ধনে এ রাজ্যের আনাচে-কানাচে আরএসএস তাদের সংগঠন বিস্তার করেছে তার জবাব তো মুখ্যমন্ত্রী মমতাকেই দিতে হবে। কিভাবে গোটা রাজ্যে আরএসএস মুসলিম বিদ্বেষ ছড়িয়েছে, আর সেই মুসলিম বিদ্বেষকে সম্বল করেই মমতা ভেকধারী মুসলিমপ্রেমী পরিচয় রেখেছেন, যার জেরে আজ মুসলমান সমাজও এক ভয়াবহ সংকটের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে– এসব পরিস্থিতি তৈরির দায় থেকে তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনো অবস্থাতেই অব্যাহতি দেয়া যায় না।

মমতা আজ আরএসএসের মোকাবিলায় দলের ঠেঙ্গাড়ে বাহিনী তৈরি করতে চাইছেন। কেন কিভাবে পুরুলিয়া জেলায় আদিবাসী তপশিলি জাতি ও উপজাতির মানুষদের প্রতি এই মমতা প্রশাসনেরই চরম অবহেলা, ঔদাসীন্য, বঞ্চনা শোষণের পাল্টা হিসেবে সেখানে আরএসএস, তার শাখা সংগঠন 'বনবাসী কল্যাণ আশ্রম' এর মাধ্যমে হাজারটা সামাজিক কেন্দ্রের ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছে, সে সম্পর্কে কি আদৌ মমতা কোন কথা বলবেন?

যেভাবে পুরুলিয়া জেলায় আনন্দমার্গের নানা সংগঠন নানা ধরনের তথাকথিত সামাজিক কর্মসূচির ভেতর দিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে জায়গা করে দেওয়ার জন্য সর্বাত্মকভাবে প্রয়াসী হয়েছেন, কেন তাদের মোকাবিলায় রাজনৈতিক বা সামাজিক বা প্রশাসনিকভাবে মমতা উদ্যোগী হননি, তার জবাব তো খোদ মমতাকেই দিতে হবে। জেনে রাখবেন মমতা, জনতা জনার্দন কিন্তু আপনাকে ছেড়ে কথা বলবে না। ইতিহাস আপনাকে ক্ষমা করবে না।