তলস্তয়ের গল্প ও আবুল বারকাতের বাজেট

মাজহার সরকারমাজহার সরকার
Published : 10 June 2019, 01:57 PM
Updated : 10 June 2019, 01:57 PM

লিও তলস্তয়ের 'টোয়েন্টি থ্রি টেলস' বইয়ে 'এলিয়াস' নামে একটা ছোটগল্প আছে। এলিয়াস এক পশুপালক পরিবারের সদস্য। বাবা মারা যাওয়ার পর উত্তাধিকার সূত্রে সে সাতটি মাদী ঘোড়া, দুটি গাভী ও বিশটি মেষ পায়। পরের পঁয়ত্রিশ বছর অনেক পরিশ্রম করে দুই শ ঘোড়া, দেড় শ গরু-মহিষ আর বারো শ মেষের মালিক হয় এলিয়াস।

অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হলেও এলিয়াসের মানবিক স্বভাব-চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয় না। সে ও তার স্ত্রী শাম-শেমাগি আগের মতোই অতিথিদের যথাসাধ্য সেবা করে, প্রতিবেশীদের খোঁজখবর নেয়, অলস বসে থাকে না, সকাল থেকে রাত অবধি কাজ করে। ক্রমে এলিয়াসের অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ হতে থাকে। তার এক ছেলে বিবাদে মারা যায়, আরেক ছেলে বাড়ি থেকে চলে যায়। এছাড়া দুর্ভিক্ষ আর মহামারীতে তার পোষা পশুগুলো মারা যায় ও তার সবচেয়ে ভালো ঘোড়াগুলো ডাকাতি করে নিয়ে যায় কিরবিজ উপজাতি। বুড়ো-বুড়ি অবশেষে সব সম্পত্তি বেঁচে শুধু একটি গাঁটরি বগলে নিয়ে বের হয়ে যায়, অন্যের বাড়ি-বাড়ি কাজ করে খাবার যোগায়।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে এলিয়সের স্ত্রী শাম-শেমাগি জানায় তারা এখন আগের থেকে অনেক ভালো আছে। তারা এখন সত্যিকারের সুখ খুঁজে পেয়েছে। ঈশ্বরের নাম নিতে পারছে। এখন তাদের আর কোনো দুশ্চিন্তা নেই। যখন ধনী ছিল তখন লোকনিন্দার ভয়ে অথিতিদের সেবা করতে হতো, শ্রমিক-মজুরেরা ফাঁকি দিচ্ছে কিনা তাতে কড়া নজর রাখতে হতো, পশুরা ঠিক মতো আছে কিনা ভেবে সারারাত নির্ঘুম যেত,এমনকি মাঝে মাঝে পারিবারিক অশান্তিও হতো। তাই ধন-সম্পদ নয়, বরং ৫০ বছর সাধনা করে অবশেষে তারা সত্যিকারের সুখ খুঁজে পেয়েছে।

এই হলো গল্পের সারাংশ। আমি মনে করি এই গল্পটা যে কোনো দেশের অর্থনীতির মূল আখ্যানবস্তু হতে পারে। জনগণকে ভোগবাদিতা নয়, লোভের বিনাশ বা নির্বাণের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা। এ পর্যন্ত কোনো বাজেট হিসাবী এবং দ্বান্দ্বিকতা মানুষকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছে কিনা জানি না। এই অবস্থায় আসন্ন ২০১৯-২০ অর্থবছরের জন্য বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার বিকল্প বাজেট ঘোষণা করেছে অর্থনীতিবিদদের পেশাদার সংগঠন 'বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি' (বিইএ)। ২০১৫-১৬ অর্থবছর থেকে নিয়মিত এ প্রস্তাবনা দিয়ে আসছে উন্নয়নশীল বিশ্বে সরকারের বাইরে বিকল্প বাজেট ঘোষণাকারী একমাত্র এ সংগঠনটি।

১৩ জুন জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত বাজেট পেশ করার কথা রয়েছে অর্থমন্ত্রীর। তার ১৮ দিন আগে ২৫ মে সকালে রাজধানীর তোপখানা রোডে সিরডাপ ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স হলে এ বিকল্প বাজেটের প্রস্তাব দেয় অর্থনীতি সমিতি। ঢাকাসহ দেশের ২৬টি জেলা শহরে একই দিনে একই সময় এটি অনুষ্ঠিত হয়। 'বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০১৯-২০' শিরোনামে এক সংবাদ সম্মেলনে সমিতির পক্ষে এ প্রস্তাবিত বাজেট উত্থাপন করেন সমিতির সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত। এ বাজেটের অন্যতম অঙ্গীকার হলো 'বৈষম্যহীন অর্থনীতি ও সমাজ গড়া'। 'বৈষম্যহীন সমাজ' বলতে আসলেই কিছু আছে কিনা আমার সন্দেহ আছে, বৈষম্য না থাকলে (গাণিতকভাবে শূন্য) সমাজের ধারণাই টেকে না। তবে এর অর্থ যখন ধরে নিই'বৈষম্য তৈরি করে এমন চর্চা বিমুখ সমাজ' তখন অধ্যাপক আবুল বারকাতের বাজেট তলস্তয়ের এলিয়াস ও তার স্ত্রী শাম-শেমাগির পঞ্চাশ বছর পরের উপলব্ধিকে মনে করিয়ে দেয়- সমাজবদ্ধ মানুষের কাজই সুখ,ব্যক্তিগত সম্পদের পাহাড় তৈরি নয়।

সমিতির প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ ধরা হয়েছে ১২ লাখ ৪০ হাজার ৯০ কোটি টাকা যা অর্থমন্ত্রীর সম্ভাব্য প্রায় ৫ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা বাজেটের কমপক্ষে দ্বিগুণ। প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ১০ লাখ ২ হাজার ৫১০ কোটি টাকা যার মধ্যে ৬৯ শতাংশ হবে প্রত্যক্ষ কর ও ৩১ শতাংশ হবে পরোক্ষ কর, অর্থ্যাৎ মোট বাজেট বরাদ্দের প্রায় ৮১ শতাংশের যোগান দেবে সরকারের রাজস্ব আয়।

আবুল বারকাত বলেন, "আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আয়ের উৎস হিসেবে ২০টি নতুন উৎস নির্দিষ্ট করেছি যা আগে ছিল না। এর মধ্যে অর্থপাচার রোধ, কালো টাকা উদ্ধার ও সম্পদ কর এই তিনটি নতুন উৎস থেকেই সরকার মোট ৯৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে পারেন। আর এ টাকা দিয়ে প্রতি বছর তিনটি পদ্মাসেতু করা সম্ভব।"

তিনি বলেন, "সমিতির প্রস্তাবিত বাজেট অর্থায়নে কোনো বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন হবে না, প্রস্তাব অনুযায়ী বাজেটের আয় কাঠামোতে মৌলিক গুণগত রূপান্তর ঘটবে। আমাদের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতি ২ লাখ ৩৭ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা, কেউ হয়তো বলবেন অনেক বড় ঘাটতি। এক্ষেত্রে বলতে চাই জাপানে বাজেট ঘাটতি ২৫৬%। ঘাটতি বাজেটে অসুবিধা হলে এক পয়সাও ঘাটতি না রেখে আমাদের প্রস্তাবিত রাজস্ব আয় দিয়েও মোট বাজেট প্রস্তুত করতে পারেন। আজকের উন্নত দেশের প্রায় সবাই যখন উন্নতি করছিলো ১৯৩০-১৯৭০ দশক পর্যন্ত সময়ে তখন তাদের সবারই সরকারি ব্যয় বরাদ্দ ছিলো বেশ বেশি, প্রবৃদ্ধির হারও ছিলো বেশি।"

অর্থনীতি সমিতির অগ্রাধিকার ভিত্তিতে খাতওয়ারি সর্বোচ্চ বরাদ্দ প্রস্তাব করেছে 'শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে', মোট ২ লাখ ৮৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। লিও তলস্তয়ের 'এলিয়াস' গল্পে আবার ফিরে যাই, এলিয়াস বিয়ে করার মাত্র এক বছরের মাথায় তারা বাবা মারা যায়, ছেলের জন্য তেমন সম্পদ রেখে যেতে পারেননি। কিন্তু এলিয়াস মোটামুটি ভালো ব্যবস্থাপক, লোকজ ধ্যান-ধারণায় হয়তো কিছুটা দীক্ষিতও। সে ও তার স্ত্রী সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে, সবার আগে ঘুম থেকে জাগে ও সবার পরে ঘুমাতে যায়।তাদের পরিশ্রম ছিল, ছিল না শিক্ষা ও প্রযুক্তি। অর্থাৎ সমাজের একজন উৎপাদনশীল সদস্য হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভের জন্য যে সব পদ্ধতিগত দক্ষতা প্রয়োজন সেগুলোতে তাদের ঘাটতি ছিল। শ্রমিকদের বিশ্বাস করতে পারতো না তারা, সম্পদের সুষম বণ্টন ছিল না। পরিশ্রম ও আপাত সততাগুণে তারা উন্নয়ন করলেও তা ছিলো অস্থায়ী উন্নয়ন।

ব্যক্তিগত জীবনে তলস্তয় জমিদার ছিলেন, তবু তিনি ছিলেন জমিদারপ্রথার বিরোধী। শুধু তাই নয়, তার জমিদারির বিশাল অংশ উনি দান করে দিতে চেয়েছিলেন, এ নিয়ে তার স্ত্রী ও সন্তানদের সঙ্গে তার বিবাদ ছিল। ভূমি সংস্কার নিয়েও তলস্তয়ের মৌলিক চিন্তাপদ্ধতি ছিল। ভূমি সমস্যার সমাধান চেয়ে ১৯০৭ সালে রুশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছিলেন তিনি। নিজের বিপুল ব্যক্তিগত সম্পত্তির এক অংশ নামমাত্র খাজনায় দিয়ে দেন কৃষকদের, বাকি সম্পত্তি বেঁচে দেন।

এবার দেখুন এমন একটি বিষয় যা প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে থাকে এবং ক্ষমতায় এলে সবার আগে ভঙ্গ হয় সে অঙ্গিকার। কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার। বিকল্প বাজেটে এ বিষয়ে আবুল বারকাত বলেন, "আমরা মনে করি যে প্রস্তাবিত বাজেট বছরেই কৃষি ও কৃষক ভাবনার যথার্থতা বিচারে ১ লাখ ভূমিহীন পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ২ লাখ বিঘা কৃষি খাস জমি বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব, আর পাশাপাশি ২০ হাজার জলাহীন প্রকৃত মৎস্যজীবী পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে ৫০ হাজার বিঘা খাস জলাশয় বন্দোবস্ত দেওয়া সম্ভব।বিষয়টি বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে এ লক্ষ্যে ৩ হাজার কোটি টাকার বাজেট বরাদ্দসহ বাস্তবায়ন কৌশল সংশ্লিষ্ট পথনির্দেশনা দেওয়া জরুরি।"

এ বাজেট হতে হবে বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের ২১-টি অঙ্গীকার বাস্তবায়ন উদ্দিষ্ট বাজেট (যার মধ্যে অন্যতম বিশেষ অঙ্গীকার হল: "আমার গ্রাম আমার শহর", "তারুণ্যের শক্তি বাংলাদেশের সমৃদ্ধি"); এ বাজেট হতে হবে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশ এবং তা থেকে উন্নত দেশে রূপান্তরের পথনির্দেশক দলিল; এ বাজেট মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালের বাজেট। আসন্ন অর্থবছরের বাজেটে প্রতিফলিত হতে হবে মুক্তিযুদ্ধের দু'টি মূল চেতনা: বৈষম্যহীন অর্থনীতি, সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং অসাম্প্রদায়িক মনন-সমৃদ্ধ আলোকিত সমাজ বিনির্মাণ।

১৮৮৫ সালে লিও তলস্তয়ের 'মানুষ কেন বেঁচে থাকে ও অন্যান্য গল্প' শিরোনামে একটি বই প্রকাশিত হয়।এ বইয়ের একটি গল্প 'থ্রি কুয়েশন্স' বা 'তিনটি প্রশ্ন'। এক রাজার মনে হঠাৎ তিনটি প্রশ্ন এলো। রাজা ভাবলেন,যদি এ তিনটি প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যেতো তাহলে তাকে কখনই কোন কাজে ব্যর্থ হতে হতো না, কোনো সমস্যায় পড়তে হতো না।

প্রশ্নগুলো হলো- কোন কাজটি ঠিক কখন করা উচিত সেই উপযুক্ত সময়টি যদি জানা যেতো, ঠিক কোন ব্যক্তির কোন কথা শুনতে হবে তা যদি আগের থেকেই জানা যেতো বা কোন ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে হবে তা আগে থেকেই বুঝা যেতো এবং কখন কোন কাজটি করা সবচেয়ে প্রয়োজন তা যদি আগে থেকে জানা যেত!

এ ভাবনা থেকেই রাজা তার পুরো রাজ্যে ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি এ তিনটি বিষয়ে রাজাকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে শেখাতে পারবে তাকে বড় পুরস্কার দেওয়া হবে। রাজ্যের বিভিন্ন প্রদেশ ও অঞ্চল থেকে বাঘা বুদ্ধিজীবী,জ্ঞানী-গুণী আর সেরা চিন্তাবিদরা আসতে লাগলো রাজার কাছে। কিন্তু তারা প্রত্যেকে রাজার প্রশ্নের ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দিলো।

কিন্তু রাজা উত্তর না পেয়ে ছদ্মবেশ নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে গেলেন, দেখা পেলেন এক সন্ন্যাসীর। তিনি পর্যায়ক্রমে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে রাজার প্রথম দুটি প্রশ্নের উত্তর দিলেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় হলো- এটা, যা বর্তমান। বর্তমানই হলো একমাত্র সময় যখন তোমার হাতে ক্ষমতা আছে ভালো ভালো কাজ করার।সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হলো বর্তমানে তুমি যার সঙ্গে আছো। কেউই বলতে পারে না ভবিষ্যতে আমরা আবার তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবো কিনা।

নোবেল বিজয়ী দুই অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ ও পল ক্রগম্যান এবং সেইসাথে বুদ্ধিবৃত্তিক জগতের গুরু নোয়াম চমস্কি- সবাই এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বলছেন, 'of 1%, by 1%, for 1%' এসব খুবই মারাত্মক 'উন্নয়ন' প্রবণতা। এই ব্যবস্থায় বিশ্বের নেতৃত্ব ও সব ক্ষমতা ও বিশ্বসম্পদের সিংহভাগ থাকছে উন্নত বিশ্বের হাতে আর জাতি-রাষ্ট্র পর্যায়ে একটি ক্ষুদ্র ক্ষমতাধর রেন্ট-সিকার শ্রেণির হাতে চলে যাচ্ছে রাষ্ট্রের,রাজনীতির ও অর্থনীতির সর্বময় কর্তৃত্ব। তারা হয়ে উঠছেন কতিপয়তন্ত্রে কর্তৃত্ববাদী আধিপত্যবাদী।

আবুল বারকাতের প্রস্তাব হলো- সামগ্রিক উন্নয়ন প্রক্রিয়াটি হতে হবে প্রবৃদ্ধির সাথে বণ্টন ন্যায্যতা নিশ্চিতকরণের, দ্রুত ভিত্তিতে বৈষম্য হ্রাসকরণের, কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের, মানব সম্পদ দ্রুত বিকশিতকরণের, শিল্পায়ন ত্বরান্বয়নের, ক্ষুদ্র-মাঝারি উদ্যোগসহ আত্মকর্মসংস্থান বিকশিতকরণের, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির সর্বোচ্চ-সর্বোত্তম ব্যবহারকরণের, তরুণ প্রজন্মকে আত্মবিশ্বাসী ও আলোকিতকরণের, নারীর বহুমুখী ক্ষমতায়ন নিশ্চিতকরণের, জলবায়ু পরিবর্তনের সাথে খাপ খাইয়ে স্থায়ীত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিতকরণের এবং সর্বোপরি সমগ্র প্রক্রিয়ায় জনগণের স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণের।

কৃষি ফসলের উৎপাদন অঞ্চল গঠন ও কৃষককে কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য দেওয়ার প্রস্তাব করে বারকাত বলেন, "এ বছর বোরো ধানে কৃষকের প্রকৃত লোকসান হবে কমপক্ষে ৫০০ টাকা। এ নিয়ে সরকারের চিন্তিত হবার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা মনে করি কৃষককে তার উৎপাদিত কৃষিপণ্যের ন্যায্য বাজারমূল্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য জরুরিভাবে কয়েকটি পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারিভাবে সংগ্রহের ক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কমপক্ষে ২০ শতাংশ বাড়াতে হবে, সেক্ষেত্রে এ বছরের বোরো ধানের মণপ্রতি বিক্রয়মূল্য হতে হবে কমপক্ষে ১২০০ টাকা।"

দেশে প্রতিবছর ৩০ লাখ মানুষ শ্রমবাজারে প্রবেশ করে কিন্তু তার মধ্যে ২০ লাখ মানুষেরই কর্মসংস্থান হয় না উল্লেখ করে ক্রমবর্ধমান মানব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা দূরীকরণ, শিক্ষা ব্যবস্থার মূলধারার অধিকহারে বৈষম্য রোধ, কর্মসংস্থান বাড়ানো ও বেকারত্ব কমাতে অন্যান্য অনেক কিছুর পাশাপাশি 'জাতীয় কর্মসংস্থান পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন কোষ' গঠন, যুবকদের উদ্যোক্তা ও উদ্ভাবক হতে উৎসাহিত করতে স্টার্ট আপ পুঁজি সরবরাহ এবং শিক্ষাখাতে জিডিপির কমপক্ষে ৫% বরাদ্দের প্রস্তাব দেন আবুল বারকাত।

শিক্ষার সব স্তরে বাংলা ভাষাকে জ্ঞানচর্চার মূল ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে তিনি বলেন, "সমগ্র শিক্ষা কাঠামোকে ঢেলে সাজাতে হবে। এর অর্থ এই নয় যে আমরা অন্য কোনো ভাষা শিখবো না।অবশ্যই শিখবো। উচ্চশিক্ষা স্তরে সব শিক্ষার্থীর জন্য কমপক্ষে দুটি বিদেশি ভাষাশিক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে।"

নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে তাঁর অন্যতম প্রস্তাবগুলো হলো, "দরিদ্র নারীদের সরকারিভাবে ক্ষুদ্র-অনুদান, প্রশিক্ষণ, গার্মেন্টসসহ কর্মজীবী নারীদের আবাসন ও ডে-কেয়ার সেন্টার স্থাপন, একশভাগ নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট বরাদ্দ ৪ গুণ বাড়ানো, ক্রীড়া খাতে মেয়েদের জন্য বরাদ্দ ৪ গুণ বাড়ানো,মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের বিজ্ঞান শিক্ষায় বরাদ্দ ৩ গুণ বাড়ানো এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধসংশ্লিষ্ট বরাদ্দ এখনকার তুলনায় কমপক্ষে ৩০ গুণ বাড়ানো।"

আগামী ৩ বছরের মধ্যে কমপক্ষে ৫ লাখ ভ্যাট লাইসেন্সধারীকে ভ্যাটের আওতায় আনার প্রস্তাব করে বলা হয়,এনবিআর ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে বাংলাদেশের ভ্যাট লাইসেন্সধারীর সংখ্যা প্রায় ৯ লাখ। কিন্তু পরিতাপের বিষয় যে বড়জোর ১ লাখ লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে (মোট ভ্যাট লাইসেন্সধারীর ১০%) বর্তমানে ভ্যাট আদায় হয়।

সমিতির আরও কয়েকটি প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে- ব্যক্তি পর্যায়ে কর হার কমিয়ে ৩ শতাংশ থেকে ১০ শতাংশ রাখা, ৫০ শতাংশ নিম্নতর কর দেবার যোগ্য কমপক্ষে ৫০ লাখ টিআইএন ধারী মানুষের সংখ্যা বাড়ানো, বছরে কমপক্ষে ১ কোটি টাকা বা তার বেশি ব্যক্তিগত আয়কর দেবার যোগ্য মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ৫০ হাজারে বাড়ানো, ৩০ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণ কালো টাকা উদ্ধার, অর্থপাচার রোধ থেকে আগামী অর্থবছরে ৩৫ হাজার কোটি টাকা আদায়, নদী দখল ও দূষণ প্রতিকার, প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট উপখাতভিত্তিক কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া, নিরাপদ ও ভেজালমুক্ত খাদ্য, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা, ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষকদের জন্য সুদবিহীন ঋণ ও বীমা, রেমিটেন্স প্রবাহকে ফলপ্রদ উৎপাদনশীল বিনিয়োগে ব্যবহার এবং প্রবাসে কর্মীদের আনুষ্ঠানিক ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে সম্পৃক্তকরণ, সার্বজনীন পেনশন,প্রবীণ মানুষদের জন্য 'প্রবীণ নীড়' (বৃদ্ধাশ্রম নয়) গড়ে তোলা,  পেনশনভোগীদের পেনশনের অর্থ বিনিয়োগের আয় থেকে সব ধরণের আয়কর, কর, শুল্ক সম্পূর্ণ রহিত করা।

খেলাপী ঋণ প্রসঙ্গে আবুল বারকাত প্রস্তাব করেন, "অভ্যাসগত ঋণখেলাপীদের মোকাবেলার জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে তাদের পূর্ণউদ্যমে চালু শিল্প প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা ঠিক হবে না। সমস্যাটি জটিল তবে সমাধান সম্ভব বলে মনে করি।"

তলস্তয়ের একটা কথা আছে, 'প্রত্যেকেই বিশ্ব বদলে দেওয়ার চিন্তা করে, কিন্তু নিজেকে বদলানোর চেষ্টা কেউ করে না কেউ।' তলস্তয়ের এলিয়াসের মতো কেউ হোক আমরা তা চাই না। এলিয়াস সম্পদ হারিয়ে ধার্মিক হয়ে উঠেছিল, সম্পদহীন হয়ে ঈশ্বরের আনুকুল্য প্রত্যাশাই হয়েছিলো তার কথিত সুখ। তার খামারে কাজ করা শ্রমিকদের খোঁজও সে রাখেনি। এলিয়াসের মতো রাষ্ট্রও দার্শনিকভাবে রুগ্ন এবং সেই অর্থে ধর্ম আশ্রিত হয়ে পড়ুক আমরা চাই না। তলস্তয়ের 'তিনটি প্রশ্ন' গল্পে রাজার তিন নাম্বার প্রশ্নের উত্তর দিলেন সন্ন্যাসী, 'সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো বর্তমানে তুমি যে মানুষের সঙ্গে আছো তার ভালো করা।কারণ মানুষকে যে পৃথিবীতে পাঠানো হয়েছে তার একটাই কারণ- মানব উন্নয়ন।'