বাংলা দ্বিতীয় জাগরণের অগ্রদূত কাজী আবদুল ওদুদের জন্মের ১২৫ তম বার্ষিকী এই বছর পালিত হচ্ছে। কাজী আবদুল ওদুদ অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার বাগমারা গ্রামে ১৮৯৪ সালের ১০ এপ্রিল, শুক্রবার জন্মগ্রহণ করেন। মতান্তরে তার জন্ম মাতুলালয় অবিভক্ত নদীয়া জেলার জগন্নাথপুরে, যেটি এখন কুষ্টিয়া জেলার অন্তর্গত। ওদুদের পিতামহ কাজি ইয়াসিন আলি প্রথাগত শিক্ষার আওতাভুক্ত মানুষ না হলেও স্থানীয় স্তরে প্রজ্ঞা এবং মননশীলতার জন্য বিশেষভাবে সমাদৃত ছিলেন। সচ্চরিত্র পরিশ্রমই এবং নির্বিরোধী মানুষ হিসেবে কাজি ইয়াসিন আলি বাগমারা সন্নিহিত এলাকায় যথেষ্ট সমাদৃত হতেন।
ওদুদের মাতামহ পাঁচু মোল্লা ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন মানুষ। বাগমারা থেকে প্রায় তিন মাইল দূরে পদ্মার তীরে হোগলা গ্রামের ছিল তার বাড়ি। সে যুগে পাঁচু মোল্লা তার পুত্র-কন্যাদের আধুনিক শিক্ষার বিষয়ে বিশেষ রকম ভাবে উৎসাহিত করেছিলেন। পাঁচু মোল্লার সর্বকণিষ্ঠ কন্যা ছিলেন ওদুদ সাহেবের গর্ভধারিণী। নিজের শিক্ষার্জনের ক্ষেত্রে মামার বাড়ির প্রভূত সাহায্য ওদুদ সাহেব পেয়েছিলেন।
ওদুদ সাহেবের পিতা কাজী জহির উদ্দিন ছিলেন রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার। ওদুদের পিতৃদেব সম্পর্কে পরবর্তীকালে কাজী মোতাহার হোসেন লিখেছেন- তিনি অত্যন্ত মিশুক এবং রসিক লোক ছিলেন। গ্রামে এলেই সবার বাড়িতে এসে দেখা করতেন ,আর অনেক গল্প গুজব করতেন । তার কথাবার্তার ঢং ছিল অতিশয় স্পষ্ট আর মতামত অতিশয় দৃঢ় ও সুনির্দিষ্ট।
পিতার চরিত্রের এই বৈশিষ্ট্যগুলি ওদুদ সাহেবের ভিতরে প্রথম থেকেই অত্যন্ত স্পষ্ট ছিল। নিজের আত্মপরিচয় দিতে গিয়ে ওদুদ সাহেব লিখছেন- "পিতৃকুল ও মাতৃকুল দুই-ই মধ্যবিত্ত। মাতৃকুল কিছু সঙ্গতিসম্পন্ন ।পূর্বপুরুষেরা অসাধারণ কেউ ছিলেন না। প্রায় নিরুদ্বেগে গ্রাম্য জীবনযাপন করেছেন। আমার পিতামহ লেখাপড়া জানতেন না। ভদ্রলোকের ছেলে তাই নিজের হাতে চাষ করতেন না। তবে জীবিকা নির্বাহ করতেন কৃষি সাহায্যেই। চিন্তাভাবনা ধার ধারতেন না। ঋণ করে ইলিশ মাছ খেতে তার বাঁধতো না। ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে পরিশ্রমের ফাঁকে নিরুদ্বেগে নিদ্রা উপভোগ করতেন। আমার পিতামহী ছিলেন অসাধারণ পার্সি জানা মৌলবির মেয়ে, কিন্তু ধর্মভীরু, বুদ্ধিমতী, কর্মকুশলা ও কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্না তার চাইতে অনেক বেশি ।"
"আমাদের পরিবারের তীক্ষ্ণতা সঞ্চারিত হয়েছে তাঁর শোণিত থেকে- এমন মনে হয়। পিতা ছিলেন বুদ্ধিতে একান্ত খেয়ালী, কিন্তু অতি স্নেহময় অন্তঃকরণের, আত্মীয় স্বজনের দুঃখ আদৌ সহ্য করতে পারতেন না। আয় সামান্য কিন্তু পরিজনদের দান করতে মুক্তহস্ত । কিন্তু এই ঢিলেঢালা মানুষটির আত্মসম্মানবোধ ছিল অসাধারণ। রেলওয়েতে চাকরি করতেন সাহেবদের সঙ্গে মারামারি করে চাকরি ছেড়েছেন বহুবার। দরিদ্র আত্মীয়দের সঙ্গে প্রাণখুলে মিশতেন। বড়লোক আত্মীয়দের গ্রাহ্য করতেন না।"
"আমার বুদ্ধিমত্তা তিনি পছন্দ করতেন। কিন্তু আমি যে শান্তশিষ্ট এটি খুব পছন্দ করতেন মনে হয় না। আমি যদি আরও অনেক বেশি উপার্জন করতে পারতাম, আত্মীয়-স্বজনকে দিতে পারতাম- তবে তিনি খুশি হতেন। আমার মা ছিলেন অতিশয় দৃঢ় চরিত্রের ও প্রপর বুদ্ধিসম্পন্না, কিন্তু কর্তৃত্ব ও অবিলাসিনী। তার বুদ্ধিমত্তা ও কর্মদক্ষতা দেখে আমার ঠাকুরমা তাকে সংসারের কর্তৃত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন তার বিবাহের অল্পকাল পরেই। আমৃত্যু শাশুড়ি বৌ ভাব ছিল।" (আমার জীবন কথা- কাজী আবদুল ওদুদ )
১৯১২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে দশম শ্রেণিতে ভর্তি হন কাজী আবদুল ওদুদ। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় তিনি দশ টাকার একটি ডিস্ট্রিক্ট স্কলারশিপ পেয়েছিলেন । প্রবেশিকা পাশ করার পর মামার নাজির উদ্দিনের পরামর্শে কাজী আবদুল ওদুদ কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে আইএ ক্লাসে ভর্তি হন। সেই সময় রূপগঞ্জ থানার ছোট দারোগার শ্বশুর মশায়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতেন ওদুদ সাহেব। সেখানে একদিন তিনি শুনতে পেলেন, যার বাড়িতে তিনি আছেন, সেই ভদ্রলোক এবং তার বন্ধুরা রবীন্দ্রনাথের 'গীতাঞ্জলি 'থেকে গান গাইছেন।
গানের কথা আর সুর শুনে ওদুদ মুগ্ধ হয়ে গেলেন। 'গীতাঞ্জলি' কিনে এনে গান গাওয়ার অভ্যাস শুরু করলেন ওদুদ। গ্রাহক হলেন সবুজপত্র পত্রিকার ।এই সময় কালে সবুজপত্র প্রকাশিত রবীন্দ্রনাথের 'বিবেচনা ও অবিবেচনা' প্রবন্ধটি ওদুদ সাহেবের রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী হয়ে পড়ার ক্ষেত্রে এক বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এরপর তিনি থাকতে শুরু করলেন সরকারি বেকার হোস্টেলে। সেখানে তখন থাকতেন শান্তিপুরের কবি মোজাম্মেল হকের বড় ছেলে মোহাম্মদ আফজাল উল হক। পরবর্তী সময়ে হক সাহেব মুসলিম পাবলিশিং হাউজ এবং মুসলিম ভারত পত্রিকার প্রতিষ্ঠা এবং প্রকাশ করেছিলেন।
এই হোস্টেলে থাকার সময় হাতে লেখা পত্রিকার ভেতর দিয়ে ওদুদ সাহেবের লেখালেখির হাতে খড়ি। 'শ্রী দীক্ষিত' ছদ্মনামে ওই পত্রিকায় ওদুদ সাহেব লিখতেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় ওদুদ সহপাঠী হিসেবে পেয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র বসু , দিলীপ কুমার রায়, রমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নীরেন্দ্রনাথ রায় প্রমুখকে। এই সময় বেকার হোস্টেলেই তার সঙ্গে আলাপ হয় মুজাফফর আহমেদের। সেই আলাপের প্রসঙ্গ নিয়ে মুজাফফর আহমেদ পরবর্তীকালে দেশ পত্রিকায় লিখছেন: "কাজী আবদুল ওদুদের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯১৩ সালে। তিনি চৌকস ছাত্র ছিলেন কিন্তু সাহিত্যের প্রতি, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্যের প্রতি তার বিশেষ আকর্ষণ ছিল (দেশ- ১২ আষাঢ়, ১৩৭৭ বঙ্গাব্দ)।
১৯২৭ ওদুদ সাহেব প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তার পাঠ্যসূচির অন্যতম বিষয় ছিল সংস্কৃত। স্কুলের বাইরে শিখেছিলেন আরবি-ফারসি। ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন ওদুদ।
কলেজে পড়ার সময় সুভাষচন্দ্র বসু, দিলীপ কুমার রায় প্রমুখের সংস্পর্শে ওদুদের ভিতরে দেশপ্রেম এবং সেবার মনোভাব প্রবল হয়ে ওঠে। সেই সময় তিনি নিজে ঠিক করেছিলেন যে, কারো চাকরি করবেন না ,দাসত্ব করবেন না। তার এই সময়ের মনোভাবের পরিচয় তিনি ১৯৪৯ সালে লেখা 'সুভাষচন্দ্র' কবিতায় ব্যক্ত করেছেন। ওদুদ লিখছেন: "একদিন কাঁধে হাত রেখে বলেছিল সে অনুচ্চ কণ্ঠে- ত্যাগ করতে হবে ভোগবিলাসের পথ, হতে হবে ফকির, ফকির হয়ে করতে হবে দেশের সেবা, দশের সেবা, তাতেই জীবনের সার্থকতা।"
গত শতকের তিন ও চারের দশকে ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে 'মুসলিম সাহিত্য সমাজ' এবং তার মুখপাত্র 'শিখা' আর তাদের নেতৃত্বে 'বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন', যাকে অন্নদাশংকর পরবর্তীকালে অভিহিত করেছিলেন ,'বাংলা দ্বিতীয় জাগরণ' হিসেবে, সেই আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ ।
বহুমুখী সাহিত্য প্রতিভার জন্য কাজী আবদুল ওদুদ বাংলার সারস্বত সমাজের কাছে অত্যন্ত আদরণীয় একটি নাম ।তার পাশাপাশি বাংলার সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কাজী আবদুল ওদুদ এক অবিস্মরণীয় নাম। মননশীল প্রবন্ধ, সমালোচনার পাশাপাশি সুজন ধর্মী লেখা, গল্প, উপন্যাস, কবিতা, নাটক স্বচ্ছন্দে লিখেছেন কাজী আবদুল ওদুদ । 'ভারত বর্ষ' পত্রিকায় ১৩২৩ বঙ্গাব্দের চৈত্র সংখ্যায় শরৎচন্দ্রের 'বিরাজ বৌ' উপন্যাসের উপরের আলোচনা লেখেন কাজী আবদুল ওদুদ। সম্ভবত ছাপার অক্ষরে সেটি ছিল তার প্রথম লেখা।
এই প্রথম লেখার ভেতর দিয়েই তিনি সারস্বত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। এমএ ছাত্র হিসেবে অধ্যায়নরত অবস্থাতে ১৩২৫ বঙ্গাব্দে কাজী আবদুল ওদুদের গল্পগ্রন্থ 'মীর পরিবার' প্রকাশিত হয়। এর ঠিক এক বছর পরে ১৩২৬ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয় তার উপন্যাস 'নদীবক্ষে '। এই দুটি গ্রন্থই রবীন্দ্রনাথ,শরৎচন্দ্র, শশাঙ্ক মোহন সেন থেকে শুরু করে সমাজের প্রায় সমস্ত স্তরের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
'মীর পরিবার' গ্রন্থটি পাঠ করে পড়ে মুগ্ধ শরৎচন্দ্র কাজী আবদুল ওদুদ-কে লিখেন, "আপনার কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করা যায় তা বলাই বাহুল্য।"
এই 'মীর পরিবার' গল্পগ্রন্থের পাঁচটি গল্পে মুসলমান সমাজের সামাজিক সাংসারিক যে চিত্র কাজী আবদুল ওদুদ এঁকেছিলেন ছিলেন তা আজও সমান বাস্তবতার, প্রাসঙ্গিকতার দাবি রাখে। ১৩২৭ বঙ্গাব্দের বৈশাখ সংখ্যা 'বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা'য় 'মীর পরিবার' প্রসঙ্গে লেখা হয়, "কাজী আবদুল ওদুদ সাহেবের এই প্রথম পুস্তকে চাপা আগুনের মতো এমন এক স্পষ্ট প্রতিভার পাওয়া যায়, যা আর কোন মুসলমান লেখকদের মধ্যে পাইনি।"
'মীর পরিবার' পড়বার পর পাঠক প্রতিক্রিয়া জানিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ১৩২৬ বঙ্গাব্দ ১৫ বৈশাখ একটি চিঠিতে কাজী আবদুল ওদুদকে লেখেন, "এই উপন্যাসটিতে মুসলমান চাষী গৃহস্থের জীবনের ছবিখানি নিপুণভাবে আঁকা হয়েছে, তা স্বাভাবিক ও অভিনব সরস ও অভিনব।" এই উপন্যাস পাঠ করে যে তিনি বিশেষ আনন্দ লাভ করেছিলেন সে কথা ওদুদকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে জানিয়ে ছিলেন ।
এমএ পাশ করবার পর ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির বাড়িতে থাকতে শুরু করেন কাজী আবদুল ওদুদ । সেই সময় তার সঙ্গে কাজী নজরুল ইসলাম, মোজাফফর আহমেদ, পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, মোহিতলাল মজুমদার, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, হেমেন্দ্রকুমার রায়, গোলাম মোস্তফা, মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ প্রমুখ মানুষজনদের ঘণিষ্ঠ সাহচর্য গড়ে ওঠে।
সামাজিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ওদুদ সাহেবের সব থেকে বড় অবদান হলো বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম নেতৃত্ব প্রদান। এই প্রসঙ্গে ওদুদ নিজেই লিখছেন- "১৩৩২ বঙ্গাব্দে ১৯২৬ সালের সূচনায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডলে মুসলিম সাহিত্য সমাজ নামে একটি সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান জন্ম হয়। তার মূলমন্ত্র ছিল বুদ্ধির মুক্তি।"
এই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মুখপত্র 'শিখা' মূলবাণী ছিল- "জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।"এই বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে আবুল হোসেন, কাজী মোতাহার হোসেন চৌধুরী, কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল ফজল আব্দুল কাদির প্রমুখ যুক্ত ছিলেন।
বস্তুত সমাজ সাহিত্য সংস্কৃতির এমন কোন জায়গা নেই যেখানে কাজী আবদুল ওদুদের তীক্ষ্ণ বিশ্লেষণী দৃষ্টি পড়েনি। তার সমসাময়িক কাল, অতীত এবং ভবিষ্যতে দৃষ্টিবাহী সবকিছুই ওদুদ সাহেবের চিন্তা চেতনায় স্থান পেয়েছিল। তাকে কার্যত এক জীবন্ত বিশ্বকোষ হিসেবে তার সমকালে অভিহিত করা হতো। মুসলমান সমাজের গোঁড়ামি এবং রক্ষণশীলতার প্রতি কাজী আবদুল ওদুদ অত্যন্ত নির্দয় ছিলেন। তার পাশাপাশি প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের অনুদারতা এবং কুপমণ্ডুককেও কষাঘাত করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেননি কাজী আবদুল ওদুদ।
তার মতো মুক্ত চিন্তা এবং সংস্কারবিহীন,অকপট, নির্ভীক, ধার্মিক অথচ পড় ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল, ঘোরতর সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদবিরোধী, গণতন্ত্রিক চিন্তা চেতনার প্রতি গভীর আস্থাশীল মানুষের জীবন, সৃষ্টি, চিন্তা -চেতনার চর্চা আজকের এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময় বিশেষভাবে জরুরি ।
কাজী আবদুল ওদুদ আচারে নিষ্ঠাবান এবং পোশাকে মুসলমান ছিলেন। অথচ কোনোরকম ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা বা অপর ধর্মের প্রতি বিন্দুমাত্র বাতরাগ তার চিন্তার জগতে মুহূর্তের জন্যও ঠাঁই পায়নি।
রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে বিশ্বভারতীতে নিজাম বক্তৃতা 'হিন্দু মুসলমানের বিরোধ'- শিরোনামে দেন কাজী আবদুল ওদুদ। বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের সমস্যা বুঝতে ওদুদ সাহেবের ওই মূল্যায়ন একটি শাশ্বত সত্য। সামাজিক, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে দেশের মানুষের ভেতরে সুস্থ সংস্কৃতি গড়ে তোলা যায় তার লক্ষ্যে ওদুদ সব থেকে বেশি জোর দিয়েছিলেন কর্ম বিনিয়োগ এবং ক্ষুধা মুক্তির উপরে। তার কাঙ্খিত ছিল তেমন সমাজ ব্যবস্থা যেখানে হিন্দু মুসলমানের পোশাক এবং নামের ব্যবধান থাকবে না, অথবা অস্বীকার করা হবে ।
তিনি চেয়েছিলেন, সামাজিক আদান-প্রদান, বিবাহ ইত্যাদি সব জায়গায় সহজ হবে ধর্ম এবং আইন। এই প্রসঙ্গে কাজী আবদুল ওদুদ মনে করতেন, যেটি সেই সময়ের পক্ষের সংগত এবং যে আইন সকলের পক্ষে মান্য তাই প্রচলিত থাকবে। কাজী আবদুল ওদুদের এই উদার এবং গভীর চিন্তাশীল ভাবনা কেবলমাত্র বিস্ময়ের বিষয় তাই নয়, আজকের দিনেও তা গভীরভাবে ভাবনার দাবি রাখে ।
ভারতবর্ষের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে 'গৃহ যুদ্ধের প্রাক্কালে' নামক এক প্রবন্ধে নেতারা বাংলার মুসলমানের সঙ্গে পাঞ্জাবের মুসলমানের যোগ ঘটাতে গিয়ে অনর্থ ঘটিয়েছিলেন বলে দ্বিধাহীন কণ্ঠে কাজী আবদুল ওদুদ বলেছিলেন ।
তার প্রতি ছিল অন্নদাশঙ্কর রায়ের অসামান্য শ্রদ্ধা। অন্নদাশংকর মনে করতেন, কাজী আবদুল ওদুদের স্বরূপটি ক্রিটিক্যাল হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত ক্রিয়েটিভ। ১৩৫৮ বঙ্গাব্দে নিজের 'প্রত্যয়' গ্রন্থটি কাজী আবদুল ওদুদকে উৎসর্গ করে অন্নদাশংকর লিখেছিলেন, "কাজী আবদুল ওদুদ শ্রদ্ধাষ্পদেষু, সমস্ত প্রতিকূল প্রমাণ সত্ত্বেও আমি বিশ্বাস করি যে, জনগণ এক ও অভিন্ন। সমস্ত প্রতিকূল প্রমাণ সত্বেও আমি বিশ্বাস করি যে জনগণ অহিংস।"
অন্নদাশংকরের ভাষায় কাজী সাহেব শেরওয়ানি-চুরিদার পরে দ্বীপ্ত ভাবে চলাফেরা করতেন। সবাইকে জানান যে তিনি মুসলমান। তিনি ছিলেন অকুতোভয়। সবাই চিনতো- তিনি কে। তাই সমীহ করত। সেই সঙ্গে তিনি ছিলেন সাহসী বাঙালি।
দ্বিখণ্ডিত ভারত বা দ্বিখণ্ডিত বাংলা কাজী আবদুল ওদুদ অন্তর থেকে কোনওদিন মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি দেশভাগের পর কলকাতার পার্ক সার্কাস অঞ্চলে তারক দত্ত রোডে নিজের বাড়িতে পত্নী বিয়োগের পর দীর্ঘদিন নিঃসঙ্গ একাকিভাবে জীবন যাপন করে গেছেন। সেখানেই ১৯৭০ সালে তার মৃত্যু।
আজ পশ্চিমবঙ্গ তথা গোটা ভারত বর্ষ যখন ধর্ম ও জাতপাত ভাষার ভিত্তিতে আড়াআড়িভাবে বিভাজিত, তখন কাজী আবদুল ওদুদ মানুষের যাপন চিত্র এবং তার রচনার ক্রম যেমন- হিন্দু মুসলমানের বিরোধ, শাশ্বত বঙ্গ, পথ ও বিপদ, আজিকার কথা, নজরুল প্রতিভা, বাংলার জাগরণ, রবীন্দ্র কাব্য পাঠ, কবিগুরু গ্যেটে ইত্যাদি পাঠের ভেতর দিয়ে আমরা এই অশুভ সময় থেকে উত্তরিত হওয়ার দিশা খুঁজে পেতে পারি।
কাজী আবদুল ওদুদকে নিয়ে এই প্রবন্ধের ইতি টানা যায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের অসামান্য মূল্যায়নের ভেতর দিয়ে ।
অন্নদাশংকর লিখছেন, "কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন জাতিতে ভারতীয়, ভাষায় বাঙালি, ধর্মে মুসলমান, জীবন দর্শনে মানবিকবাদী, মতবাদে রামমোহনপন্থী, রাজনীতিতে গান্ধী ও নেহরুপন্থী, অর্থনৈতিক শ্রেণি বিচারে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক, সামাজিক ধ্যানধারণায় ভিক্টোরিয়ান লিবারেল। কোনও চরমপন্থায় তার বিশ্বাস ছিল না।"