২০২১ সালেই কি তিস্তা পানি চুক্তি ও গঙ্গার পানি চুক্তি নবায়ন হবে?

স্বদেশ রায়
Published : 4 June 2019, 01:16 PM
Updated : 4 June 2019, 01:16 PM

ভারতের বিজেপি সরকার বা প্রধানমন্ত্রী নরেদ্র মোদি বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা পানি চুক্তি করায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসও তিস্তা পানি চুক্তি করার পক্ষে। মনমোহন সিং প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন এ চুক্তি করার জন্যই বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি না আসায় সে সময়ে মনমোহন সিং-কে সিনেটে একটি চমৎকার ভাষণ ও বাঘ রক্ষার চুক্তি করে চলে যেতে হয়।

মোদি সরকার আসার পরে ল্যান্ড মার্ক ল্যান্ড বাউন্ডারি চুক্তি হয়েছে। বিরোধী দল কংগ্রেসের স্বল্প আসন থাকা সত্ত্বেও পার্লামেন্টে তারা অকুণ্ঠ সমর্থন জানায় ওই চুক্তিকে। কিন্তু শেখ হাসিনা অনেক দেরিতে ফিরতি সফরে গেলেও দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ওই তিস্তা চুক্তি করাতে সমর্থ হননি। মমতা ব্যানার্জি রাজি হননি।

মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে যখন ক্ষমতায় আসেন তখন কেন্দ্রে কংগ্রেসের মনমোহন সিং সরকার। তখন ভারতের অনেক পলিটিক্যাল অ্যানালিস্ট এমনটি ধারণা করেছিলেন, মমতা ব্যানার্জি লোকাল গভর্মেন্ট নির্বাচন হয়ে গেলে তিস্তা চুক্তিতে রাজি হবেন। কারণ গজলডোবা এলাকায় যেখানে তিস্তার পানি ধরে রাখা হয় ওই এলাকায় কংগ্রেসের আধিপত্য। মমতা ব্যানার্জি লোকাল গভর্মেন্ট নির্বাচনে সেখানে জিতলে তিনি রাজি হয়ে যাবেন তিস্তা পানি চুক্তিতে। লোকাল গভর্মেন্ট নির্বাচনে মমতা জেতেন বটে, কিন্তু তিনি মনমোহন সিং-কে বেইজ্জতই করেন। মনমোহন সিং অনেকটা ঢাকায় নেমেই জানতে পারেন মমতা ব্যানার্জিকে বাংলাদেশ সফরে তার সফরসঙ্গী হচ্ছেন না। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানতে পারেন প্রায় রাত একটার দিকে। সে আরেক অধ্যায়। সে অধ্যায় এ কলামে নন। যাহোক, মনমোহন সিং নিরবে চলে যাবার পরে অনেক পানি তিস্তা দিয়ে গড়িয়ে যায়। এর পরে মোদি ক্ষমতায় আসেন। বিশাল ম্যান্ডেটের এই সরকার তিস্তা পানি চুক্তি করতে শতভাগ আন্তরিক থাকা সত্ত্বেও আবারও মোদির অবস্থা মনমোহনের মতো করে ছাড়েন মমতা ব্যানার্জি। যেহেতু ভারতীয় সংবিধানে রাজ্য সরকারের তার পানিসহ অনেক সম্পদের ওপর অধিকার রয়েছে তাই ওই সংবিধান বলে কেন্দ্রকে বুড়ো আঙুল দেখান মমতা ব্যানার্জি। পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধু শুধু নয় উপকারী রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের নায্য পাওনা তিস্তার পানি থেকে গত দশ বছর বঞ্চিত করে রেখেছেন মমতা ব্যানার্জি।

এখনও ভারতের পলিটিকিক্যাল অ্যানালিস্টরা মমতাকে ঘিরে তিস্তার পানি চুক্তি নিয়ে নানান হিসাব-নিকাশ করেন। তারা নানান আশা খোঁজেন মমতার কাজের মধ্যে যার ভেতর দিয়ে তারা তিস্তা পানি চুক্তির একটা আশা দেখেন। কিন্তু তারা এই হিসেবটি করেন না যে, আর যাই হোক মমতা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি শান্তিপূর্ণসহ অবস্থান চাইলেও তার নিজস্ব কিছু এজেন্ডা আছে। যার ভেতর আছে, বাংলাদেশের জঙ্গিরা তার দেশে আশ্রয় নিলে অনেকটা ওভারলুক করা। অনেকে বলেন, মমতা পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম ভোটের জন্যে একাজ করেন। কারণ, বাংলাদেশের জঙ্গিরা ওখানে মুসলিম প্রধান এলাকাতে গিয়ে কোনও না কোনও মুসলিম জঙ্গির আশ্রয় নেয়। মমতা তার প্রশাসনকে সেখানে ইচ্ছাকৃত উদাসীন রাখেন একটি মাত্র কারণে সেটা তার রিজার্ভ ভোট। যে কারণে সাঈদীর সপক্ষে কোলকাতায় মিছিল হলে মমতা তখন গণতন্ত্রী হয়ে যান। তার প্রশাসন সেটা বাধা দেয় না। যে কারণে ইসলামাবাদ ও কোলকাতায় সাঈদী ও মতিউর রহমান নিজামীর জন্যে মিছিল হয়। মমতার এমনি সার্বিক আচরণ মিলে এটা এখন প্রমাণিত সত্য, তিনি আর যাই হোক তিস্তার পানি চুক্তি করার পক্ষে কখনই মত দেবেন না। মমতা যে সময়ে তিস্তা নিয়ে এই খেলা খেলছেন তখন বাংলাদেশের সামনে আরেকটি চুক্তি দরজায় কড়া নাড়ছে তাহলো গঙ্গা পানি চুক্তির নবায়ন। ২০২১ সালে গঙ্গা পানি চুক্তির নবায়ন।

২০২১ সাল যেমন বাংলাদেশের জন্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তেমনি মমতা ব্যানার্জির জন্যও। কারণ, ২০২১ এ মমতার রাজ্য সরকারের বিধান সভা নির্বাচন। ওই নির্বাচনের জয় পরাজয়ের ওপর নির্ভর করছে মমতা ২০২১ সালে রাজ্যে সরকার গঠন করতে পারবেন কি পারবেন না?

আসলে কি ২০২১ এ মমতা সরকার গঠন করতে পারবেন? মমতা ২০২১ এ রাজ্য সভা নির্বাচনে যাবেন কিন্তু তার আগেই ২০১৯ এ ভারতের লোকসভা নির্বাচনের ফল নির্ধারণ করে দিয়েছে ২০২১ এ  পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে মমতাকে কাদের সঙ্গে লড়তে হবে। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের ৪২টি আসনের মধ্যে বিজেপি পেয়েছে ১৮ টি আসন, কংগ্রেস ২টি আর মমতা বিশটি। আর সব জায়গাতেই মমতাকে লড়তে হয়েছে বিজেপির সঙ্গে। এমনকি লোকসভার সঙ্গে বিধান সভার চারটি উপ নির্বাচনেও জিতেছে বিজেপি। তাই আগামী বিধান সভা নির্বাচনে মমতার প্রতিপক্ষ নরেদ্র মোদির বিজেপি।

২০২১ এর নির্বাচনে কী ফল হতে পারে সেটা খুঁজতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভা নির্বাচনের একটু অতীতে যেতে হবে। ২০০৯ এ পশ্চিমবঙ্গ বিধান সভা নির্বাচনে মমতা ও তার এসওএস জোট মিলে ২০টি আসন পায়। আর তার বিপরীতে ১৬টি আসন ছিলো বামফ্রন্টের। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার মনে করেছিলো লোকসভা নির্বাচনের এই ফল ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনের ওপর কোনও প্রভাব ফেলবে না। সে সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাম নেতা ও তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ট সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেও তারা বলেছেন, বিধান সভায় এর কোন প্রভাব পড়বে না। বাস্তবে লোকসভা নির্বাচনের প্রভাবই পড়েছিল বিধানসভায়। বামফন্ট্রের সিট ২৩৩ থেকে নেমে ৬২তে এসে দাঁড়ায়। ২০০৯ এ মমতার জোটের আসন ছিল ২০ আর তার ধাক্কাতেই ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গের বিধান সভার ২৯৪ আসনের ভেতর বামফ্রন্ট পায় মাত্র ৬২টি। ঠিক ২০০৯ এর চিত্রটি আবার ফিরে এসেছে ২০১৯ এ। এবার পশ্চিমবঙ্গের লোকসভায় বিজেপির সিট ১৮টি। আর তার পরে প্রতিদিনই তৃণমূল থেকে দলে দলে লোক ও নেতারা যোগ দিচ্ছেন বিজেপিতে। তাই ২০০৯ এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে বলা যায়, ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন ২০১১ এর বিধানসভা নির্বাচনের একটি ঈংগিত দিচ্ছে।

২০২১ যদি ২০১১ এর ঈংগিতকে কার্যকর করবে তেমনি একটি পরিবেশ এখন পশ্চিমবঙ্গে। তাদের সাধারণ মানুষের বক্তব্য, সাংবাদিকদের বক্তব্য এবং মিডিয়ার নানান রিপোর্ট ও লেখার ভেতর দিয়ে সেটাই বের হয়ে আসছে। আর তাই এখন বলা যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে বড় কোনও অঘটন না ঘটলে ২০২১ এ বিজেপিই হবে ২০১১ এর তৃণমূল। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ সেদিকেই হাঁটছে। এমনকি যারা অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পক্ষে তারাও এখন আর মমতার ভেতর অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কিছু দেখছে না বরং কিছু স্ট্যান্টবাজি দেখছে। তাই ২০২১ এ পশ্চিমবঙ্গে পট পরিবর্তন এখন অনেকে সময়ের বিষয় বলে মনে করছেন। আর যদি এই পট পরিবর্তন হয় তার ফলে পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন, ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠা কীভাবে হবে সেটা তাদের বিষয়। বাংলাদেশের জন্যে দুটো সুখবর তখন এক সঙ্গেই আসবে বলে আশা করা যায়। কারণ, নরেদ্র মোদি জনগণের সামনে কমিটমেন্ট করেছেন, তিনি তিস্তা পানি চুক্তি করবেন। তাই মমতা রঙ্গমঞ্চ থেকে সরে গিয়ে সেখানে বিজেপি এলে নরেন্দ্র মোদির জন্য আর কোন বাধা থাকে না। পাশাপাশি ২০২১ এ গঙ্গা পানি চুক্তির নবায়ন। সেখানেও মোদির জন্যে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কোনও বাধা হবে না। বাংলাদেশ সহজেই গঙ্গার পানি পাবে। তবে এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ না হয়েও একজন সাধারণ সাংবাদিক হিসেবে আমি মনে করি দুই দেশকে গঙ্গার ওপর এই ফারাক্কা বাঁধ নিয়ে ভাবতে হবে। বাঁধ ভেঙ্গে ফেলার দরকার নেই। তবে চুক্তিটা এমন হতে পারে ফারাক্কার সব গেইট খোলা থাকবে বারো মাস। এটা কোনও বাড়তি বন্ধুত্বের জন্যে নয়। বাস্তবতা মেনে নেবার জন্যে। কারণ ফারক্কা বাঁধ কোলকাতা বন্দরকে কোনও বাড়তি পানি দেয়নি। হলদিয়া বন্দরকে সুখ সাগরে ভাসায়নি। শুধু তাই নয় অতিরিক্ত লবনের কারণে আমাদের সুন্দরবনের মতো তাদের সুন্দরবনও আজ বিপন্ন। আর বাংলাদেশ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত তা উত্তরবঙ্গের মরা পদ্মা ও মাটির নিচের পানি কমে যাওয়া বলে দেয়।  তাই আর গেইট বন্ধ নয়, বরং খুলে দেয়া হোক সব গেইট। ভেবে দেখতে পারেন বিশেষজ্ঞ ও দুই দেশের রাজনীতিকরা।