উৎসবের অর্থনীতি

মোহাম্মদ আবদুল মজিদ
Published : 2 June 2019, 07:20 AM
Updated : 2 June 2019, 07:20 AM

সাম্য ও সামাজিক সংহতির ধর্ম ইসলামের ধর্মীয় উৎসবগুলির মধ্যে ঈদ উৎসবের মূল তাৎপর্য হলো আত্মশুদ্ধি ও আত্মোৎসর্গের কঠোর ত্যাগ সাধনার প্রেক্ষাপটে আনন্দঘন সম্মিলন। এ সম্মিলনের আর্থ সামাজিক তাৎপর্য ব্যাপক। গরীব দুঃখীদের মধ্যে দান খয়রাত করা, ভেদাভেদ ভুলে সকলের সাথে এ সম্মিলনে শরীক হওয়া, পারষ্পরিক শুভেচ্ছা বিনিময় ও কোলাকুলি করার মাধ্যমে সামাজিকতার বাহ্যিক প্রকাশ ঘটে থাকে। ঈদের এই আনন্দ উৎসবে শরীক হওয়ার সামর্থ্য সকলের সমানভাবে থাকে না। সে জন্য ইসলামে সমাজের ধনী ও বিত্তবান সদস্যদের ওপর দরিদ্র ও বিত্তহীনদের মধ্যে জাকাত ও ফিতরা প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। পবিত্র কোরআনে সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয়েছে 'বিত্তবানদের সম্পদের ওপর বিত্তহীনদের হক আছে।' (৫১ সংখ্যক সূরা আয যারিয়াত, আয়াত ১৯) কোরআনের এই অমোঘ নির্দেশ ঈদুল ফিতরের প্রাক্কালে জাকাত ও সাদকা প্রদানের মাধ্যমে কার্যকর হয়ে থাকে। বিধান রয়েছে, ঈদের নামাজ আদায়ের আগেই জাকাত ও ফিতরা প্রদান করতে হবে। এটা ঈদুল ফিতরের গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক তাৎপর্য। উন্মুক্ত ময়দানে ধনী দরিদ্র উঁচু-নিচু, সাদা-কালোর সকল ভেদাভেদ ভুলে ঈদের জামাতে সামিল হওয়ার বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্মিলনে পাড়া-পড়শি থেকে শুরু করে সকল পরিচিত অপরিচিতের সাথে একত্রিত হওয়ার সুযোগ ঘটে। নামাজ শেষে কোলাকুলির মাধ্যমে সবাই সকল ভেদাভেদ ও মনোমালিন্য ভুলতে চেষ্টা করে। ঈদের দিনে সকলে সাধ্যমতো নতুন পোশাক পরিধান করে। পুরাতন বিবাদ-বিসংবাদ দুঃখ কষ্ট থেকে নতুনতর জীবনবোধ ও সম্পর্ক স্থাপনের প্রতীকী প্রকাশ ঘটে থাকে এর মধ্যে। একে অন্যের বাসায় পালাক্রমে দাওয়াত খাওয়া যাতায়াতের মাধ্যমে সামাজিক সখ্যতার ভিত্তি আরো দৃঢ় হয়।

সাড়ে ষোল কোটি মানুষের দেশে যেখানে বর্তমানে মাথাপিছু জিডিপি ১৮৭৪ মার্কিন ডলার সেদেশে প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদ উল ফিতর উদযাপনে লক্ষ-কোটি টাকার নগদ লেনদেন হয় শুধু নতুন পোশাক ও বিশেষ খাদ্য সামগ্রী ক্রয়ে, এক অষ্টমাংশ মানুষের স্বজনদের সাথে যোগ দিতে যাতায়াতে, গরীব ও অসহায়দের মাঝে জাকাত বিতরণে এবং বেতনের সমপরিমান বোনাস বিতরণে। বাজারে একসাথে নগদ টাকার এত চাহিদা বাড়ে যে গ্রাহকের দাবি মেটাতে ব্যাংক ও আার্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কল মার্কেট থেকে কঠিন সুদে টাকা জোগাড়ে নামতে হয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তার নগদ নতুন নোটের খাজাঞ্চিখানার দুয়ার খুলে দিতে হয় ।

ঈদকে ঘিরে চাঙ্গা হয় দেশের অর্থনীতি। 'বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতি'র হিসাব মতে, সারাদেশে প্রায় ২৫ লাখ দোকান (মুদি দোকান থেকে কাপড়ের দোকান) রয়েছে। এসব দোকানে বছরের অন্য সময় প্রতিদিন ৩ হাজার কোটি টাকার পণ্য বিক্রি হলেও রোজার মাসে সেটা তিনগুণ বেড়ে হয় ৯ হাজার কোটি টাকা। সে হিসাবে রোজার এক মাসে এই ২৫ লাখ দোকানে ঈদ পোশাক থেকে শুরু করে ভোগ্যপণ্য বিক্রি হবে প্রায় ২ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার। ঈদ উল ফিতরে সবচেয়ে বেশি টাকা লেনদেন হয় পোশাকের বাজারে। পোশাকের দোকানেই ঈদের কেনাকাটা এবার ৮০ হাজার কোটি টাকারও বেশি হবে বলে জানান দোকান মালিক সমিতির নেতারা। ঈদকে ঘিরে অর্থনীতির সব খাতেই গতি ফিরে আসে। চাকরিজীবীরা এবার ১২ হাজার কোটি টাকার ঈদ বোনাস তুলেছে। এর প্রায় পুরোটাই গেছে ঈদবাজারে।

জাকাতকে ঘিরে গরিব-অসহায় মানুষের মাঝেও ঈদ অর্থনীতির ছোঁয়া লেগেছে। সারা বছরের মধ্যে রমজান ও ঈদকে ঘিরে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স আসে সবচেয়ে বেশি। যার সিংহভাগই চলে যায় গ্রামীণ মানুষের হাতে। ঈদের মাসে যেমন সারাদেশের শপিংমল বা মার্কেটগুলো গতিশীল হয়, তেমনি সারাদেশের কুটির শিল্প, তাঁত শিল্প, দেশীয় বুটিক হাউসগুলোয় যেমন বাড়ে কর্মচাঞ্চল্য, তেমনি বাড়ে আর্থিক লেনদেন। বড় উৎসব তাই সবার বিরাট আয়োজন। বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে অর্থনীতিতে বড় ধরনের গতিশীলতা আসে। ব্যাংকিং খাতে লেনদেন বাড়ে ব্যাপক হারে। ঈদ উপলক্ষে রেকর্ড গতিতে দেশের অর্থনীতিতে জমা হচ্ছে প্রবাসীদের রেমিটেন্স। শুধু মে মাসে ১২৬ কোটি ৭৬ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছে, যা চলতি অর্থবছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর চলতি জুন মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত রেমিটেন্স এসেছে ৭২ কোটি ৪৪ লাখ ডলার। আশা করা হচ্ছে এবার জুন মাসে রেমিটেন্স ১৫০ কোটি ডলার ছাড়াতে পারে। ব্যাংকিং খাতে লেনদেন বেড়েছে ব্যাপক হারে।

ঈদের কেনাকাটায় এটিএম বুথে প্রতিদিন ১৫ কোটি টাকার বেশি উত্তোলন করছে গ্রাহকরা। এ ছাড়া মোবাইল ব্যাংকিং প্রতিদিন গড়ে লেনদেন হচ্ছে হাজার কোটি টাকার বেশি। মোবাইলে লেনদেন প্রতিদিনই বাড়ছে। এদিকে মানুষের চাহিদা পূরণে বাজারে অতিরিক্ত ২৫ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট ছেড়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। দৈনন্দিন কর্মব্যস্ততা ও যানজটের ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দেশের অনলাইন বাজার। নিত্যনতুন পণ্যের সমাহার, বিভিন্ন ছাড় ও উপহারের কমতি নেই ভার্চুয়াল এই বাজারে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছে, ঈদ সামনে রেখে জমজমাট অনলাইনের ঈদবাজারও। রোজার আগে অর্থনীতিতে এক ধরনের প্রভাব থাকে। আর রোজা শুরুর পর থাকে আরেক ধরনের। রোজার আগে অর্থনীতি সচল থাকে ভোগপণ্যকেন্দ্রিক। এ মাসে সব ধরনের ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুণ। রোজা শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে থেকেই মূলত শুরু হয় রোজাকেন্দ্রিক অর্থনীতি। কেন না, রোজার মাসের জন্য পণ্য আমদানি কার্যক্রম অনেক আগেই শুরু করতে হয় ব্যবসায়ীদের। এমনকি সরকারি পর্যায়েও অনেক পণ্য আমদানি করতে হয়। আর রোজার এক সপ্তাহ আগে থেকে মূলত শুরু হয় ভোগ্যপণ্যের বেশি বেচাকেনা। এরপর শুরু হয় পোশাকের কেনাবেচা। আর এর প্রভাব একেবারে শহর থেকে গ্রাম পর্যায়ে চলে যায়। ঈদের বাজারে সবচেয়ে বড় অংশজুড়েই রয়েছে বস্ত্র ও খাদ্যসামগ্রী। বস্ত্রের মধ্যে পায়জামা, পাঞ্জাবি, সালোয়ার-কামিজ, ফতুয়া, শাড়ি, লুঙ্গি ও টুপি প্রধান। এরপর রয়েছে জুতা, প্রসাধনী, স্বর্ণালঙ্কার। আর উচ্চবিত্তের জন্য রয়েছে সোনা, ডায়মন্ডের অলঙ্কার ও গাড়ি। সবার জন্য অপরিহার্য হিসেবে রয়েছে সেমাই, চিনি, ছোলা, ডালসহ অনেক পণ্য। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের ব্যাংকিং খাতে মোট আমানত এবং ঋণের অংশ হিসেবে গ্রামের অংশ শহরের তুলনায় অনেক কম। গ্রাম থেকে যতটুকু আমানত নেওয়া হচ্ছে, তার অর্ধেক বিনিয়োগ হচ্ছে শহরে। কিন্তু ঈদ উপলক্ষে এ চিত্র একেবারে উল্টে যায়। শহরের মানুষ হয় গ্রামমুখী। আর সারা বছর স্তিমিত হয়ে থাকা গ্রামের হাটবাজার কয়েক দিনের জন্য দারুণ চাঙ্গা হয়ে ওঠে।

ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের এক তথ্য মতে, ঈদে পোশাকসহ যাবতীয় পরিধেয় খাতে ৬০-৭০ হাজার কোটি টাকা, জুতা-কসমেটিক্স ৩ হাজার কোটি, ভোগ্যপণ্য ৭ হাজার কোটি, জাকাত-ফিতরা ও দান-খয়রাত ৩৮ হাজার কোটি, যাতায়াত বা যোগাযোগ খাতে ১০ হাজার কোটি, সোনা-ডায়মন্ড ৫ হাজার কোটি, ভ্রমণ খাতে সাড়ে ৫ হাজার কোটি, ইলেকট্রনিক্স ৪ হাজার কোটি, স্থায়ী সম্পদ ক্রয় ১ হাজার কোটি, পবিত্র ওমরা পালন ৩ হাজার কোটি ও আইনশৃঙ্খলাসহ অন্যান্য খাতে লেনদেন হয় ১ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া অর্থনীতির আরও অনেক খাত রয়েছে যেখানে ঈদকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের বাণিজ্য হয়ে থাকে। বিশেষ করে ফার্নিচার, গাড়ি ও আবাসন শিল্পে বড় ধরনের কেনাকাটা হয়ে থাকে। তবে অনেকে ঈদের কেনাকাটা করতে ভারতে যাচ্ছে। এর প্রভাব রয়েছে বাজারে। ধর্মীয় অনুশাসনের কারণে বিত্তশালীরা ১৫ হাজার কোটি টাকা জাকাত প্রদান করবে। যার পুরোটাই ব্যয় হবে ঈদ উৎসবে। এ ছাড়া উচ্চবিত্তের প্রায় ১ লাখ মানুষ দেশের বাইরে ভারত, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ডসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেনাকাটার জন্য পাড়ি জমাবে। গড়ে এদের ৫০ হাজার টাকা খরচ হলেও তাতে ৫শ' কোটি টাকা ব্যয় হবে। এ ছাড়া দেশের অভ্যন্তরে ঘুরে বেড়ানো, বিভিন্ন আনন্দ বিনোদন বাবদ আরও দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকা খরচ হবে এই ঈদে।

অন্য সাধারণ মাসগুলোর তুলনায়, সেবা ও রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর এসময় কর্মতৎপরতা চোখে পড়ার মতো সেখানে ইনফরমাল আর্নিং বেড়ে যায় নানান উপায়ে, এমনকি ফর্মাল বখশিসের পরিমানও যৎসামান্য নয়। ঈদ আসবে বলে রোজা শুরুর আগে থেকে ইলেকট্রনিক প্রিন্ট মিডিয়ায় তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় স্পন্সর খোঁজাখুঁজিতে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ আর বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজনে। এই মওশুমে সব মহলে সৃজনশীল হওয়ার ধুম পড়ে যায়। এমনকি নগদ টাটকা কাগজি নোটের সরবরাহ বাড়াতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক কে নকল নোটের জোয়ার ঠেকাতে। গোটা অর্থনীতি যেন জেগে ওঠে। শুধু জেগে ওঠা নয় রীতিমত দৌড়ঝাপ শুরু হয়ে যায়। মূল্যস্ফীতির মাত্রা পরিসংখ্যান ব্যুরোর ফিতায় মাপা না গেলেও, তবুও সচল সজাগ সজীব থাকে কেনাকাটা , যাতায়াত যোগাযোগের ।

এটি প্রণিধান যোগ্য যে অর্থনীতিতে মুদ্রা সরবরাহ মুদ্রা লেনদেন, আর্থিক কর্মকাণ্ডের প্রসারই অর্থনীতির জন্য আয়। কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মুদ্রা সরবরাহ গতিশীলতা আনয়ন। ঘূর্ণায়মান অর্থনীতির গতিপ্রবাহে যেকোনও ব্যয় অর্থনীতির জন্য আয়। দেশজ উৎপাদনে এর থাকে অনিবার্য অবদান। যেকোন উৎসব অর্থনেতিক কর্মকাণ্ডে গতিশীলতা আনয়ন করে, মানুষ জেগে উঠে নানান কর্মকাণ্ডে, সম্পদ বন্টন ব্যবস্থায় একটা স্বত:প্রণোদিত আবহ সৃষ্টি হয়। এই আবহকে স্বত:স্বাভাবিক গতিতে চলতে দেয়ায় দেখভাল করতে পারলে অর্থাৎ সামষ্টিক ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও পারঙ্গমতা দেখাতে পারলে এই কর্মকাণ্ড এই মুদ্রা সরবরাহ, ব্যাংকের এই তারল্য তারতম্য, পরিবহন খাতের এই ব্যয় প্রবাহ একে স্বাভাবিক গতিতে ধরে রাখতে পারলে অর্থনীতির জন্য তা পুষ্টিকর প্রতিভাত হতে পারে। এখানে বিচ্যুতি বিভ্রান্তি ও বিপত্তি সৃষ্টি হলে একটা স্বাভাবিক সিস্টেম লস এর সাফল্যকে ম্লান করে দিতে পারে। বর্ডার ট্রেডে বাঞ্ছিত নিয়ন্ত্রণ ও পরিবীক্ষণ জোরদার করে, ঘাটে ঘাটে চাঁদা , দুর্নীতি ও দালালী, সকল প্রকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করে, কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঈদের অর্থনীতিকে জিডিপিতে যোগ্য অবদান রাখার অবকাশ নিশ্চিত হতে পারে।