ব্রিটিশ রাজনীতিতে ব্রেক্সিট খাঁড়া!

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 30 May 2019, 08:32 AM
Updated : 30 May 2019, 08:32 AM

লৌহমানবী হতে চেয়েছিলেন তিনি। ব্রেক্সিট-ঝামেলা ঠিকঠাকমতো ম্যানেজ করতে পারলে হয়তো লৌহমানবীর পাশাপাশি ইতিহাসের সবচেয়ে নন্দিত প্রধানমন্ত্রীর তকমাও পেতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। শেষপর্যন্ত রাজনীতির পাশাখেলায় পরাজিত হয়ে চোখের জলে তাকেও ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিতে হয়েছে।

পদত্যাগের কথা ঘোষণা করার সময়ে প্রায় কেঁদে ফেলেন ঘটনাবহুল তিন বছরের ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। কথা বলতে বলতে মুখ-চোখের ভাব পাল্টে যায়। গলা ধরে আসে। কোনও মতে কথা শেষ করে দ্রুত নিজের বাসভবনে চলে যান। কিন্তু এই চোখের জল ইতিহাসে ব্যর্থ কান্না হিসেবেই গণ্য হবে। কারণ তিনি যা করতে চেয়েছিলেন, তা পারেননি। আর রাজনীতিতে সব পক্ষকে ম্যানেজ করে চলতে না পারলে প্রবল শক্তি কিংবা তীব্র আবেগের কোনো মূল্য থাকে না। গণতান্ত্রিক ব্রিটিশ রাজনীতিতে তো নয়ই। থেরেসা মে সেটাই প্রমাণ করে গেলেন।

দলীয় নেত্রীর পদ থেকে তিনি ৭ জুন সরে যাবেন বলে জানিয়েছেন মে। তার এই পদত্যাগের ঘোষণার পরপরই নতুন নেতা নির্বাচনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। জুলাই মাসের মধ্যে নেতা ঠিক হয়ে যাবে। ততদিন কার্যনির্বাহী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কাজ চালিয়ে যাবেন টেরেসা মে।

২০১৬ সালে ব্রেক্সিট ইস্যুতে গণভোটের ফল বিপক্ষে যাওয়ায় পদত্যাগ করেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন। এর পর ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন কনজারভেটিভ নেত্রী টেরেসা মে। পদে এসেই বলেছিলেন, ''ব্রেক্সিট মানে ব্রেক্সিট। আমরা ২৯ মার্চ (২০১৯) ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছেড়ে বেরিয়ে যাব।'' প্রথম দিকে তার উদ্যোগ-আয়োজন দেখে মনেও হয়েছিল, হ্যাঁ তিনি পারবেন। কিন্তু ইইউয়ের সঙ্গে টানা তিন বছর টানাপড়েনে তাঁর কেবিনেট থেকে একের পর এক মন্ত্রীদের পদত্যাগ আর তাঁর ব্রেক্সিট বিলের খসড়া বারবার পার্লামেন্টে নাকচ হওয়ার পরে সময়টা ক্রমশই কঠিন হয়ে পড়ে প্রধানমন্ত্রীর জন্য। আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে সীমান্ত চুক্তির মতো কয়েকটি বিষয় নিয়ে দলের কট্টর ব্রেক্সিটপন্থীদের মন তিনি কিছুতেই জয় করতে পারেননি। ব্রিটেন ২৯ মার্চ ইইউ থেকে বেরোতেও পারেনি। ব্রিটিশ রাজনীতির সংকট বিবেচনায় নিয়ে ইইউ আগামী ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৬ মাস সময় বাড়িয়েছে। এর মধ্যে ইইউ থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ থাকছেই।

টেরেসা মের সরে যাওয়া এক রকম অনিবার্যই হয়ে উঠেছিল। তবে তিনি হাল ছাড়েননি।  বিরোধীদের কাছ থেকেও সমর্থন জোটানোর চেষ্টা করেছেন। বারবার বৈঠক করেছেন লেবার দলের নেতা জেরেমি করবিনের সঙ্গেও। চতুর্থবারের জন্য ব্রেক্সিট বিলের খসড়া এনে শেষ চেষ্টা করে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কিছুই কাজে দেয়নি। বিরোধী লেবার এবং তাঁর দলের ব্রেক্সিটপন্থীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা ওই খসড়ারও বিরোধিতা করবেন। ফলে সরে যাওয়া ছাড়া টেরেসার সামনে আর কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার পরে ব্রেক্সিটের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে আবারও জোর প্রশ্ন উঠেছে।

থেরেসা মের পদত্যাগের ঘোষণা স্বেচ্ছায় নয়, বরং দলের অন্য নেতারা তাকে এই ঘোষণা দিতে বাধ্য করেছেন। তিনি দলের নেতাদের আনুগত্য অর্জন করতে পারেননি। এটা তার সবেচেয়ে বড় ব্যর্থতা। অথচ তিনি নিজে বহুবার বলেছেন, তাঁর আদর্শ দেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী 'লৌহমানবী' মার্গারেট থ্যাচার। 'দ্বিতীয় থ্যাচার' হতে চেয়েছিলেন তিনি। ভেবেছিলেন, ব্রিটেনকে ব্রেক্সিট 'উপহার' দিয়ে যাবেন। সেটাই হবে তাঁর উত্তরাধিকার। কিন্তু ঘরে-বাইরে সাঁড়াশি চাপের মুখে পড়ে সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হল না। এক সময় বিশ্ব শাসন করা ব্রিটিশরা নিজেদের রাজনীতির ব্যাপারে অত্যন্ত হিসেবি ও স্পর্শকাতর। এ ক্ষেত্রে লেবার পার্টির চেয়ে কনজারভেটিভরা বেশি 'কঠোর'। কোনও নেতা যখন লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়ে দলের 'বোঝা' হয়ে দাঁড়ান, তখন তাঁর প্রতি নির্মম হতে তারা দ্বিধাবোধ করেন না। সে নজির আছে থ্যাচারের সময় থেকেই। ১৯৯০ সালে থ্যাচারকেও এক রকম 'টেনেহিঁচড়ে' ১০ ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। তাদের তখন মনে হয়েছিল, থ্যাচার দলের জন্য সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছেন। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও 'ক্ষমা' করা হয়নি থ্যাচারকে। তাঁর জায়গায় এসেছিলেন জন মেজর। পদত্যাগের ঘোষণা প্রদান করার সময় চোখের জল ফেলেছিলেন 'ম্যাগি' থ্যাচারও।

ব্রিটিশ রাজনীতি এমনিতেই নিষ্ঠুর। রাজনীতিবিদদের জন্য ততোধিক নিষ্ঠুর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে ব্রেক্সিট। এর আগে ব্রেক্সিটের খাঁড়ায় কাটা-পড়া প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের এক আলোচনায় বলেছিলেন, ব্রেক্সিট একটা ভুল, মহাদুর্যোগ। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ছাড়লে যতটুকু ক্ষতি হবে বলে মনে করা হয়েছিল, আসলে ততটুকু নয়, এর প্রভাব আরও অনেক ব্যাপক। ক্যামেরনের কথাই সত্যি বলে মনে হচ্ছে। এক ব্রেক্সিট তিন বছরে দু'জন প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করল!

ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ব্রিটেনের বিচ্ছেদ (ব্রেক্সিট) প্রশ্নে এক গণভোট খেয়েছিল ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরনের ক্ষমতা। গণভোটের পরাজয়ে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। সেই ব্রেক্সিট ছোঁয়াচে রোগ এখন সংক্রমিত হয়ে ব্রিটিশ রাজনীতিকে গ্রাস করেছে। তেরেসা মেকেও একই পথে চলে যেতে হলো।

ইউরোপীয় ইউনিয়নে থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত, যুক্তরাজ্যের জনগণ যতটা সহজভাবে নিয়েছে, তা কার্যকর করাটা ব্রিটেনের রাজনীতিবিদদের জন্য ততটাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পার্লামেন্টে নিশ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে নিজ দল কনজারভেটিভ পার্টির এমপিদের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারেননি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে 'ব্রেক্সিট চুক্তির' বিষয়ে মতের মিল না হওয়ায় ২০১৭ সাল থেকে মন্ত্রিসভা থেকে ৩৬ জন পদত্যাগ করেন, যাঁদের ২১ জন শুধু ব্রেক্সিট বিরোধের জের ধরে পদত্যাগ করেছেন। এক ব্রেক্সিট ভূমিকম্পে ১৯২০ সালের পর ব্রিটিশ রাজনীতিতে 'শতাব্দীর সেরা ধস' দেখা দিয়েছে।

ব্রেক্সিটের খাঁড়া কিন্তু এখনও কাটেনি। যদিও থেরেসা মের উত্তরাধিকার কে হবেন, তা নিয়ে দলটির মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান কেবিনেটের অন্তত আটজন সদস্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে আছেন। কিন্তু ব্রেক্সিট তাদের জন্য খুব একটা স্বস্তির কারণ হবে বলে মনে হয় না। তারপরও প্রতিযোগিতা থেমে নেই। তবুও ক্ষমতার মোহ নাহি মানে পরাভব!

তবে এই মোহ শেষ পর্যন্ত চোখের জলে বিদায়কে ত্বরান্বিত করবে কি না কে জানে! ব্রেক্সিট কিন্তু বড়ই নির্মম ও ছলনাময়ী!