এত কোটিপতি দিয়া দেশ কি করিবে? 

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 22 Dec 2011, 05:48 AM
Updated : 28 May 2019, 09:35 AM

গত পাঁচ বছরে কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৩৬ হাজার। ব্যাংকগুলোতে জমা থাকা এবং আগাম অর্থের হিসাবে দেশে কোটিপতির সংখ্যা ১ লাখ ১৪ হাজার ২৬৫ জন।

আশংকাজনকভাবে কোটিপতির সংখ্যা বাড়ছে দেশে। হুম, আশংকাজনক ই বলবো। কারণ আর্থিক প্রগতি কোটিপতির সংখ্যা দিয়ে বিবেচনা করা হয় না। আমরা জানি দুনিয়ার অনেক দেশে কোটিপতি উপচে পড়ছে। কিন্তু সেখানে শান্তি নাই। সাউথ আফ্রিকার মতো দেশে আপনি একা সন্ধ্যায় বের হলে কোন বিপদে পড়বেন বলা মুশকিল। মানিব্যাগ কেড়ে নেবে না চাকুর শিকার হয়ে জান হারাবেন কেউ জানে না। জানেন নিশ্চয়ই ব্রাজিলে দেয়াল আছে। সমাজ ব্যবধানের দেয়াল। সাল পাওলোর একদিকের জনগণ আরেকদিকে যেতে ভয় পায়। একদিকে ধনীদের স্বর্গ। আরেকদিকে মধ্যবিত্ত গরীবের হাটখোলা। এমনও আছে একদিকের মানুষ যায় আরেকদিকে বডিগার্ড নিয়ে। এটাই দস্তুর। এমন কোটিপতি তার দেশেও ভালোভাবে নিরাপদে থাকতে পারে না। সেদিক থেকে আমরা কিছুটা হলেও ভালো আছি। কিন্তু জানেন কি কিভাবে সমাজে মোটামুটি সাম্য বজায় আছে দেশে? আমি বলি ধর্ম এখানে নিয়ামকের কাজ করছে। যদি পরকালে বিশ্বাস না থাকতো যদি গরীব না জানতো ভালো কাজ করলে বেহশতে যাওয়া যায়, অতপর ভালো জীবন পাওয়া যায় আমি নিশ্চিত এতদিনে রক্তের বন্যা বয়ে যেতো হয়তো। তারা ধৈর্য ধরে আছে সে জীবনের আশায়।

তারপরও কত মনখারাপের ঘটনা ঘটে। একদিকে সেতু উড়ালপুল রাস্তায় উন্নয়নের ছড়াছড়ি। আকাশচুম্বি দালানের সমারোহ। ঢাকার ভবনগুলো চোখ ধাঁধানো। এদের সৌন্দর্য বিদেশের ভবনগুলোকেও হার মানায়। অথচ এরসাথেই আছে বস্তি। আছে হাহাকার। হুমায়ূন আহমেদ নাই ঢাকার ফুটপাতে ষ্টেশানে বাস টার্মিনালে লঞ্চঘাটে রাতে শুয়ে থাকা মানুষগুলোর ছবিও কেউ তোলে না। তুললে বোঝা যেতো এখনো অনেক ফাঁক। অনেক ব্যবধান। এই যে লিচু খাওয়াতে না পেরে এবং ঈদে জামা কিনে দিতে না পারার জন্য পিতা তার দু কন্যাকে গলাটিপে হত্যা করেছে। এমন একটা খবর দেখলাম জাতীয় মিডিয়ায়। ঘটনা সত্য হলে এটা মারাত্মক আর বড় বেদনার খবর। আমরা তো জানি যে, দেশ আর্থিকভাবে তরতর করে এগিয়ে চলেছে। ইফতারের যেসব খবর বা ছবি ছাপা হয় সেগুলো দেখলে তো এই বিদেশেও নিজেদের ফকির মনে হয় আমাদের। দেশের টিভি চ্যানেলে এমনও দেখি রোজ নানা রেঁস্তোরায় গিয়ে হানা দিচ্ছে মিডিয়ার মানুষ। দোকানীরা বেশ আদবের সাথে জানাচ্ছে, আরে না না। দাম বেশী না মাত্র হাজার বারশ টাকা দিলেই আপনি পাবেন একশ পদের ইফতার। সেসব ইফতারে লিচু থাকে। খেতে খেতে ক্লান্ত মানুষের অনেকে লিচু ফেলেও যায় তারপরও এক দরিদ্র পিতা লিচুর জন্য কন্যার জান নিলো এটা কেমন কথা? খবরটা মিথ্যা হোক এটাই আশা করি।

কিন্তু এমন খবর কি একটা? আমার জানামতে এমন সব মানুষ আছেন যারা এখনো সারাদিন রোজা রাখার পর কোন রকমে ইফতার করে রোজা ভাঙেন। মধ্যবিত্তদের অনেকে মাসে একটা দিন হয়তো ভালো কিছু ম্যানেজ করে বাকী সব কটা দিন খুব সাধারণ খাবার খায় তারা। এই যে ইফতারের দাওয়াত বড় বড় ভবনে মেহমানদারী এগুলো কমিয়ে এনে একদিন সে টাকায় দেশের সব গরীব শিশুদের লিচু খাওয়ানো যায় না? এতে আর যাই হোক লিচুর জন্য হত্যা এমন নিউজ তো আর হবে না। একদিন কি সবাইকে ডেকে সাধারণ পোশাক দেয়া যায় না? যেসব গার্মেন্টস মালিকরা বিদেশে ঈদ করবেন তারাও তা করতে পারেন। কত আর একসপ্তাহ বিদেশ সফরের খরচ হয়তোবা।

বেদনা আরও প্রগাঢ় হয় যখন নামকরা মানুষজন সুশীলরা বড় বড় জায়গায় দাওয়াত পেয়ে ইফতারীতে যাবার আগে সবাইকে মনে করিয়ে দিতে থাকেন এই যে যাচ্ছি। আপনি তো যেতে পারলেন না। বা যারা সেসব খাবার কোনোদিন খেতে পারবেন না তাদের ফটো দেখিয়ে প্রলুব্দ করে তোলেন। সাম্য মানবতা সমবেদনা বা অংশীদার হয়ে দুঃখ কষ্ট ভাগ করার কথা কি সব মুখে মুখে? বলছিলাম হতভাগ্য পিতার কথা। হয়তো ঘটনাটা সত্য হয়তো পিতা অভাবে অভাবে মানসিক রোগী বলে এমনটা করেছে। তারপরও এতো নিদারুণ। এইতো দুদিন ও হয়নি কাজী নজরুলের জন্মদিন পালন করলাম আমরা। কি ভয়ংকর স্বপ্নদ্রষ্টা কবি রা। কবেই লিখে গেছেন "লিচু চোর" কবিতা। আমরা কি লিচু চুরি করে সন্তানদের খাওয়ানোর সমাজ দেখতে চাই আসলে?

উন্নতির সাথে সাথে ব্যবধান কমার কাজ কি হচ্ছে? সবকিছু কেমন যেন গোলমেলে। মানুষের নাকি টাকার অভাব নাই। আবার যখন যাকাত দেয়ার সময় আসবে আমরা কি নিশ্চিত যে পদদলিত মানুষের লাশ দেখবো না আমরা? আমরা কি দেখবো না দরিদ্র মানুষ ফটকে মাথা ঠুকছে একটা প্যাকেটের জন্য? বা একটা জামার জন্য হাত বাড়িয়ে আছে অজস্র কিশোর কিশোরী। এই দৃশ্য উন্নয়নের সাথে যায় না। মানতে হবে দেশে কোটিপতি বাড়ছেই। কিন্তু তারা কারা? মনে আছে পাকিস্তান আমলের কথা। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা পূর্ব পাকিস্তানে এসে হাভাতে মানুষ দেখে বলেছিলেন: ইয়ে আদমীলোগ ভাত কি লিয়ে এয়স্যা কিউ করতা? ভাত নাই তো পোলাও খাও টাইপের সাজেশান দিয়ে হাসির খোরাক যোগানো সে নেতার দেশের হাল বড় খারাপ এখন। সে তুলনায় আমরা কাগজে কলমে এগিয়ে। কিন্তু সমাজ এখনো মাথা তুলতে পারেনি। সত্যি পারেনি। সংস্কৃতি বিনোদন সাহিত্য খাবার পোশাক সবকিছুতে কি চলছে কেন চলছে কেউ জানে না। তারপর ও মানুষ চুপ। কারণ মানুষ খেয়ে বেঁচে আছে। আর বললেই বা শুনছে কে? বলবেই বা কার মাধ্যমে তারা বার্তা পাঠাবে?

তারচেয়ে ঢের ভালো সবাই মিলে মাঝামাঝি ভালো থাকা। সবাইকে নিয়েই তো সমাজ। এত স্বার্থপর আপনস্বার্থে মগ্ন কোটিপতি নিয়ে দেশ কি করবে? যারা কথায় কথায় বিদেশ যায়, যাদের ভ্রমণ আনন্দ বাজার চিকিৎসা সব বিদেশে আর উপার্জনের জন্য দেশ- তাদের দিয়ে কি দেশের কিছু হয়? বঙ্গবন্ধু হোক তাজউদ্দীন হোক বিজ্ঞানী হোক সাহিত্যিক হোক খেলোয়াড় হোক আর বেকার হোক সে হোক দেশের মাটিতে গড়া দেশের মানুষ। বিদেশের বাঙালিদের যারা দুচোখে দেখতে পারেন না তাদের বলি প্রবাসীদের বেশীরভাগই বরং দেশ দেশ করে অস্হির। আর দেশের ধনী কোটিপতিদের স্বর্গ স্বপ্ন আদর্শ বিদেশ। এমন কোটিপতির বদলে সবার জন্য মায়াময় একটা সমাজ কামনাতেই স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। আমরা কি সে জায়গা থেকে সরে যাচ্ছি ক্রমশ??