শিশুর বিকাশ: পথিককে পথ তৈরি করতে দিন

উপমা মাহবুবউপমা মাহবুব
Published : 26 May 2019, 12:01 PM
Updated : 26 May 2019, 12:01 PM

আমার কন্যা প্রমিতিকে যখন স্কুলে দেই তখন তার বয়স সাড়ে তিন বছর। আমরা স্বামী-স্ত্রী দুজনই চাকরি করি। তাই আমাদের মনে হয়েছিল সারাদিন বাসায় গৃহসহকারীদের কাছে থাকার চেয়ে স্কুলে একটা ভালো পরিবেশে দুঘন্টা থাকলে তার সামাজিকীকরণ হবে, বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারবে, দু-একটা গান বা কবিতা শিখতে পারবে। যা ভাবা তাই কাজ। প্রমিতিকে এলাকার মোটামোটি পরিচিত একটা বাংলা মিডিয়াম স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলাম।  সেই স্কুলে প্রমিতির সঙ্গেই আরেকটি মেয়ে পড়তো। তার মাকে দেখতাম কোলে এক-দেড় বছরের একটি ছেলে শিশুকে নিয়ে মেয়ের হাত ধরে স্কুলে আসতে। ওনার চুল সবসময় উস্কোখুশকো থাকতো। গায়ে বাসায় পরার জামা। চেহারায় রাত জাগার স্পষ্ট ছাপ। আমার খুব খারাপ লাগতো। ভাবতাম – আহা বেচারা দুটো বাচ্চা পালতে গিয়ে কী অমানুষিক পরিশ্রম করেন। নিজের যত্ন নেওয়ার সময়ই পান না। তো একদিন ঐ আপা আর আরেকজন অভিভাবকের কথোপকথন কানে ভেসে এলো। আপা বলছেন -আচ্ছা, মিসরা কেন কী পড়ায় তা লিখে দেয় না? তাহলে আমি প্রতিদিন সন্ধ্যায় মেয়েকে একটু পড়াতে পারতাম। ওনার এই কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। দুই বাচ্চা নিয়ে উনার এমনিতেই ত্রাহি মধুসূদন অবস্থা। দিনে এক মিনিট অবসর পান বলেও মনে হয় না। তারপরও সাড়ে তিন বছরের বাচ্চার পড়াশোনা নিয়ে উনার চিন্তার শেষ নেই!

প্রমিতির স্কুলটাও ছিল বেশ অদ্ভুত। প্রথমদিন ক্লাসে অনেক খেলার জিনিসপত্র রাখা ছিল। পরদিন সেগুলো সব সরিয়ে নিয়ে পড়ানো শুরু হলো। পরবর্তী তিন বছর গাদা গাদা পড়ালেখা চললো। অনেক বাচ্চা প্রাইভেট পড়া শুরু করলো।  তাদের বয়স তিন থেকে ছয় বছরের মধ্যে। আমরা প্রমিতিকে বাসায় কিছুই পড়াই না। শুধু প্রতিদিন একঘন্টা পড়ার টেবিলে বসার অভ্যাস করালাম। এই সময় সে নিজে নিজে কিছু বাড়ির কাজ করতো। আর আমি একদম বেসিক মানে অ, আ পড়াতাম। বিপত্তি বাধলো কেজি টুতে উঠার পর। সেটা ছিল ঐ স্কুলে তার তৃতীয় বছর। কিছুদিন ধরে প্রমিতি কিছুতেই স্কুলে যেতে চায় না। কান্নাকাটি করে। বলল, মিস বকা দেয়। স্কুলে গেলাম, ম্যাডামদের সঙ্গে কথা বললাম। তারা বলেন, প্রমিতি খুব লক্ষী, শুধু পড়তে চায় না। অনেক গবেষণা করে যা বুঝতে পারলাম তা হলো অন্য বাচ্চারা অনেক কিছু পারে। তারা শব্দ লিখতে পারে, ছোট বাক্য এমনকি কবিতাও লিখতে পারে। প্রমিতি এখনো বেসিক-এ আটকে আছে। এখনো উল্টো সাত লেখে। ইংলিশ লেখার সময় বি কে ডি লেখে। ফলে সে মানসিকভাবে চাপে আছে। পড়া না পারতে পারতে তার মনে ভয় ঢুকে গেছে। মিসও অধৈর্য প্রকাশ করছেন। অথচ ওনার ক্লাসে কখনোই দশজনের বেশি উপস্থিতি দেখিনি। এত অল্প শিক্ষার্থী থাকার পরও তিনি চাইলেই প্রমিতির মতো পিছিয়ে পরা শিক্ষার্থীকে একটু আলাদা সময় দিয়ে শিখিয়ে নিতে পারেন কিন্তু সেটা তিনি করেননি।

অতএব, বুঝতে পারলাম আমরা যে শিক্ষাব্যবস্থার মধ্যে আছি তাতে শিশুকে একটা বয়স না হওয়া পর্যন্ত কোন লেখাপড়া করাবো না এই সিদ্ধান্ত সবসময় সঠিক নাও হতে পারে। উল্টো শিশুর উপর মানসিক চাপের কারণ হতে পারে। দুই সপ্তাহের মিশন নিলাম। একটু একটু করে বেসিক অক্ষর, শব্দ শিখালাম। হাতে নাতে ফলাফল মিললো। প্রতিদিন সকালের কান্নাকাটি বন্ধ হয়ে গেলো। স্কুলের খাতায় দু-একটা স্টার পাওয়া শুরু হলো। তাতেই প্রমিতি বেজায় খুশি।

আমরা দেশের শিক্ষাব্যবস্থার নিয়মিত পিন্ডি চটকাই কিন্তু নিজেরাই আবার সন্তান প্রথম না হয়ে দ্বিতীয় হবে সেটা মানতে পারি না। তাই শিক্ষামন্ত্রীকে বকতে বকতে একদম ছোট শিশুকে কোচিং করাই। এটা ঠিক না। প্রমিতি এখন বেশ স্বনামধন্য একটি স্কুলে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। সেখানেও অনেক পড়ার চাপ। কিন্তু এক ক্লাসে অনেক বাচ্চা তাই শিক্ষকরা কাউকেই বেশি সময় দিতে পারেন না। আমরা স্বামী-স্ত্রী নিজেরাই প্রমিতিকে পড়াই। এত ছোট মানুষকে পড়াতে বেশি সময় লাগে না কেন না তাকে ভালো ছাত্রী বানানো আমাদের টার্গেট না। সে মোটামোটি একটা ফলাফল করলেই হলো। প্রমিতি প্রচুর খেলাধুলা করে। ছবি আঁকার স্কুলে যায়। বই পড়ে। মোবাইলে গেইমও খেলে। কিছুদিন হলো আলোহাতে ভর্তি হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। সেখানেও হয়ত দিয়ে দিবো। মোদ্দা কথা হলো – পথ পথিক তৈরি করে না, পথিকই তার মতো করে পথ তৈরি করে। এক সময় প্রমিতিকে নিজেকেই ঠিক করতে হবে সে কী করতে চায় – পড়ালেখা, গানবাজনা নাকি খেলাধুলা। জীবনটা তার, তাই সিদ্ধান্তও তাকেই নিতে হবে। আমরা শুধু তাকে যতগুলো সম্ভাব্য পথ আছে সেগুলো দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছি।

সন্তানদের নিয়ে

কাহলিল জিবরান

 

তোমার সন্তানেরা তোমার সন্তান নয়।

জীবনের নিজের প্রতি নিজের যে তৃষ্ণা, তারা হলো তারই পুত্রকন্যা।

তারা তোমাদের মাধ্যমে আসে, তোমাদের থেকে নয়।

এবং যদিও তারা থাকে তোমাদের সঙ্গে, কিন্তু তাদের মালিক তোমরা নও।

তুমি তাদের দিতে পারো তোমার ভালোবাসা,

কিন্তু দিতে পারো না তোমার চিন্তা, কারণ তাদের নিজেদের চিন্তা আছে।

তুমি তাদের শরীরকে বাসগৃহ জোগাতে পারো, কিন্তু তাদের আত্মাকে নয়।

কারণ তাদের আত্মা বাস করে ভবিষ্যতের ঘরে। যেখানে তুমি যেতে পারো না,

এমনকি তোমার স্বপ্নের মধ্যেও নয়।

 

তুমি তাদের মতো হওয়ার সাধনা করতে পারো, কিন্তু

তাদের তোমার মতো বানানোর চেষ্টা কোরো না।

কারণ জীবন পেছনের দিকে যায় না, গতকালের জন্যে বসেও থাকে না।

তোমরা হচ্ছো ধনুক, আর তোমাদের সন্তানেরা হচ্ছে ছুটে যাওয়া তীর।

ধনুর্বিদ অনন্তের পথে চিহ্নের দিকে তাকিয়ে থাকেন। যেন তার তীর ছোটে

দ্রুত আর দূরে।

তুমি ধনুক, তুমি বাঁকো, ধনুর্বিদের হাতে তোমার বেঁকে যাওয়া যেন আনন্দের জন্য হয়।

তিনি কেবল চলে যাওয়া তীরটিকে ভালোবাসেন তা-ই নয়,

তিনি তো দৃঢ় ধনুকটিকেও ভালোবাসেন।

 

কবিতার অনুবাদ: আনিসুল হক