উন্নয়ন, ‘অন্যায়ন’ ও কতিপয় স্বপ্নবাজ

হাসান মাহমুদহাসান মাহমুদ
Published : 20 Dec 2011, 07:57 AM
Updated : 23 May 2019, 09:17 AM

১. উন্নয়ন

নিঃসন্দেহে দেশের বিভিন্ন বস্তুগত উন্নয়ন হয়েছে প্রচণ্ড গতিতে। সবাই তা দেখছেন, উদাহরণের দরকার নেই। অলক্ষ্যে যে সুদূরপ্রসারী উন্নয়ন হয়েছে তা হল জাতির আত্মবিশ্বাস। পাকিস্তান আমল থেকে আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং আমরা সত্যি সত্যিই গভীরভাবে বিশ্বাস করতাম বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ টাকা না দিলে আর পাকিস্তানী প্রভুরা করে না দিলে আমরা কিছুই করতে পারব না, এমনকি গ্রামের ছোট্ট ব্রিজটা পর্যন্ত বানাতে পারব না। অর্ধশতাব্দী প্রাচীন সেই হীনমন্যতার কারাগার ভেঙে বিশ্বের সামনে মাথা উঁচু করে প্রবল গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসী বাংলাদেশ। পরের সাফল্য একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও শাস্তি। আমরা যারা একাত্তরের আগুনের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসেছি, এই এত বছর পরেও আমরা জাতীয় পতাকায় কয়েক লক্ষ রক্তাক্ত শাড়ী দেখি, জাতীয় সংগীতে কয়েক লক্ষ আর্তনাদ শুনি, এখনো এই বুকে অনেক আদরে খেলা করে কয়েক হাজার যুদ্ধশিশু। বুক ভেঙে গিয়েছিল যখন চোখের সামনে একাত্তরের অপরাধীরা মন্ত্রী হয়ে সংসদে বসেছিল, পতাকা ওড়ানো গাড়ীতে চড়েছিল। আশা ছিল না সেই ভয়াবহ গণহত্যা গণধর্ষণের বিচার ও শাস্তি দেখে যেতে পারব, মনে হচ্ছিল এই ভাঙা বুক নিয়েই দুনিয়া ছেড়ে যেতে হবে। এখন তৃপ্তির হাসি ঠোঁটে নিয়ে পরম শান্তিতে চোখ বন্ধ করতে পারব।

এখন সময় উন্নয়নের প্রায়োরিটি রক্ষার। আমাদের শিক্ষকেরা কয়েক'শ টাকা বেতন বাড়ানোর দাবীতে অনশন করবেন আর আমরা হাজার কোটি টাকার যুদ্ধবিমান কিনব, এ তো ঘরে আগুন লাগার সময় চাইনিজ খেতে যাবার মতো হল। উদাহরণ, প্রত্যেকের জন্য সীমিতভাবে হলেও জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা চালু করা দরকার যা পদ্মা সেতু বা স্যাটেলাইটের চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। সেটা ছোট্ট দেশ শ্রীলংকা পারলে আমরা পারব না কেন? দেশে তিনমাস বেতন না পাওয়া ডেসপারেট বাবা যখন ক্ষুধার্ত বাচ্চার জন্য দুধের কৌটো চুরি করেন, তখন সেই দিকনির্দেশ চমৎকার দিয়েছেন মাহমুদ হাসান তাঁর ফেসবুকে:- "মেট্রোরেল আর ফ্লাইওভার ছাড়াও আমার আপাতত চলবে, একজন পিতার সন্তানের দুধের কৌটা ছাড়া আমার একটা মূহুর্তও চলবে না"।

২. 'অন্যায়ন'

দেশ সর্বগ্রাসী অন্যায়ের কবলে পড়ে গেছে সবাই দেখছেন, উদাহরণের দরকার নেই। "মগের মুল্লুক", "হরিলুট", "নির্লজ্জ্ব" এসব শব্দ এখন যথেষ্ট নয়, বর্তমান অবস্থা বোঝাতে হলে নতুন শব্দ আবিস্কার করতে হবে। মানুষের নাগরিক অধিকারের সমতা নেই কারণ যাদের ক্ষমতা আছে তাদের মমতা নেই। অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দুর্বলরা, সংখ্যালঘুরা, নারীরা আর শিশুরা। ব্যাপক 'অন্যায়নের' করাল গ্রাসে আজ প্রতিটি প্রতিষ্ঠান। রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্মনীতির অনেক গুরু তো বটেই, এমনকি সাধারণ মানুষও সাধারণ মানুষের ওপরে এমনকি বাচ্চাদের ওপরেও অবিশ্বাস্যভাবে হয়ে উঠেছে নির্মম নৃশংস। কিছু ব্যতিক্রমও লক্ষ্যনীয়। কিছু শক্তিশালী দুর্বৃত্ত বিচারের সম্মুখীন হচ্ছে, প্রাণপণে কাজ করে যাচ্ছে দুদক কিন্তু সেগুলো "প্রয়োজনের তুলনায় কিছুই নয়" বললেও কম হবে। জাতির মূল্যবোধ যেভাবে কাটা ঘুড়ির মতো গোত্তা খেয়ে অতলগহ্বরে পড়েছে সেখান থেকে উঠে আসতে শতাব্দী লেগে যেতে পারে।

৩. কতিপয় স্বপ্নবাজ

জীবনে ৯৯% মানুষের ৯৯% স্বপ্ন সফল হয় না কিন্তু তবু স্বপ্ন থাকতে হয় কারণ স্বপ্নই জীবনের মূল চালিকাশক্তি। মানবসভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছেন প্রধানত: স্বপ্নবাজ সাধারণেরাই। বাংলাদেশেও দেশের আনাচে কানাচে নিঃশব্দে এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়ে চলেছেন অদম্য স্বপ্নবাজেরা। জাতির হ্যাণ্ডবুক "একাত্তরের ঘাতক দালালেরা কে কোথায়" লিখেছিলেন তরুণ স্বপ্নবাজ শফিক আহমেদ, কোনো বিখ্যাত সুশীল নন। গ্রামের নারীরা হাতে বানানো নানা ডিজাইনের টুপি মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানী করছেন, হাঁস-মুরগী গরু-ছাগল মাছ পালন করে গ্রামের পর গ্রাম স্বাবলন্বী করছেন, অর্ধশিক্ষিত যুবক সৌদি থেকে খেজুরের বীজ এনে চাষ করে লক্ষপতি হয়েছেন, নাটোরের কৃষক আজ কোটিপতি শুধু সুষ্ঠু প্ল্যানমতো নানারকম ফলচাষ করে। আঠারো বছরের দুঃসহ বয়সে বন্ধ ঘরে ছোট্ট কম্পিউটার সম্বল করে অদম্য স্বপ্নবাজের "ভাষা হোক উন্মুক্ত" শ্লোগানের অভ্র ফন্টের অনন্য উপহার জাতিকে ফ্রি দিয়েছেন প্রচারবিমুখ ড. মেহেদী হাসান। অভ্র ছাড়া দুই বাংলার বাঙ্গালী জাতি আজ পঙ্গু হয়ে পড়বে। কোন সরকারই একুশে পদক দেয়নি তাঁকে, হু কেয়ারস? যুগস্রষ্টা এই স্বপ্নবাজে পদকের উর্দ্ধে।

অসাধারণের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন সাধারণেরা। উদাহরণ অজস্র, ক'টার কথা বলব? পথশিশু ও সুবিধাবঞ্চিতদের জন্য কাজ করছে "পথশিশু সেবা সংগঠন", "আমরা পথশিশু", "স্বপ্ন সারথি", "মোহন পথশিশু সেবা সংগঠন", "স্ট্রিট ল্যাম্প", "হাসিমুখ", "মানবতার আলাপন", "আমরা সবাই ফাউন্ডেশন", "শিশু কিশোর বয়েজ ক্লাব" ইত্যাদি বহু সংগঠন যেখানে প্রায় সবাই স্বেচ্ছাকর্মী। গাজীপুরের শিল্প প্রতিষ্ঠানে চাকরী দেয়া হয়েছে এক হাজার শ্রবণ, বাক ও দৃষ্টি প্রতিবন্ধীকে (হানিফ সংকেত ভিডিও)। এই রোজার মাসে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন ও সবুজবাগ থানার বৌদ্ধ মহাবিহার সুবিধাবঞ্চিত হাজারো মানুষের জন্য ইফতার তৈরি করে পৌঁছে দিচ্ছে প্রতিদিন। আছেন ব্যারিষ্টার সায়েদুল হক সুমন যাঁর দিকদর্শন ভিডিওগুলোর সাড়ে দশ লক্ষ ভক্ত, মামলা করেছেন রূপপুরের বালিশ কেলেঙ্কারী আর নুসরাত রাফি মামলার দুর্বৃত্ত পুলিশের বিরুদ্ধে, গরীবদের জন্য ফ্রি চিকিৎসা থেকে শুরু করে গ্রামান্তরে ২২তম ব্রীজ বানানো, শহরে বর্জ্য ফেলা, দুর্ঘটনার আশংকায় পুরান ঢাকা ইত্যাদি শত বিষয়ে ভিডিও বানিয়ে জাতিকে সচেতন করে চলেছেন এই অক্লান্ত কর্মদানব।

আর আছেন "পারি ফাউন্ডেশন"-এর প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মালেকের মত দুর্দান্ত স্বপ্নবাজ। আমি অনেকবার তাঁর সাথে ফোনে কথা বলেছি। ফেসবুকে তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ড ধরা আছে, দেখলে শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসবে, পাশে দাঁড়াতে ইচ্ছে হবে। রোহিঙ্গা বস্তি থেকে কমলাপুর ষ্টেশনের প্ল্যাটফর্ম হয়ে যেখানেই যে কোনো দুঃস্থের খবর পান সেখানেই ছুটে যান। অসুস্থ পথশিশুকে কোলে করে নিয়ে যান হাসপাতালে, সুস্থ হলে আবার কোলে করে ফিরিয়ে আনেন। প্রতিবন্ধীর জন্য হুইলচেয়ার সংগ্রহ, শীতবস্ত্র বিতরণ, বড়লোকদের অনুষ্ঠানের বেঁচে যাওয়া খাবারের ফোন এলে ছুটে যান মাঝরাতেও, সেগুলো পরদিন খাওয়ান পথশিশুদের। আরও অনেকে অনেক বিষয়ে অবদান রেখে যাচ্ছেন কোন ফায়দা ছাড়াই যেমন নানা বিষয়ে ইন্টারেস্টিং ভিডিও ও শর্ট ফিল্ম বানিয়ে ইউটিউবে ফ্রি দিয়ে গণসচেতনতা সৃষ্টি। হেলথ টিপস, সৌন্দর্য্যচর্চা বা শুটকি রান্না কি নেই সেখানে!

বিদেশেও অনেকে নীরবে প্রচুর কাজ করছেন। কতটুকুই বা জানি কিন্তু আমার জানা তালিকাটাই এত লম্বা যে লেখা সম্ভব নয়। লন্ডনের শিক্ষক কতই বা বেতন পান? ফরিদা ইয়াসমিনা জেসী সেখানে বসে পাঁচ হাজার মাইল লম্বা হাত বাড়িয়ে টাঙ্গাইলে অটিস্টিকদের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছেন "লার্ন এন্ড লিভ" স্কুল যেখানে তারা পড়াশুনার সাথে হস্তশিল্পে কিছু বানায় যা বিক্রি হয়। শুরু করেছিলেন একা, আজ তাঁর পাশে আরো কিছু স্বপ্নবাজ। আরেকজন প্রতিষ্ঠা করেছেন মেয়েদের এতিমখানা, আরেকজনের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি ও ইতিহাস শেখানো হয়, আরেক সংগঠন গরীব দুই ছেলে ও এক মেয়ের পড়াশুনার খরচ চালিয়েছে বহু বছর। এখন তারা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছে, হয়তো একদিন ওরা হবে ডাক্তার বা বিচারক বা কোনো কোম্পানীর সি-ই-ও। অথচ এই সাহায্যটুকু না পেলে ওরা হতো বাসের হেলপার বা কোন বাড়ীর চাকরাণী।

দীর্ঘ প্রবাসজীবনে আমি দেখেছি টাকা অনেকের কাছেই আছে দেবার হৃদয়ও আছে কিন্তু কর্মব্যস্ত জীবনের চাপে দেয়া হয়ে ওঠে না। এরকম স্বচ্ছল ও হৃদয়বান প্রবাসীদের জন্য আমাদের শবনম শায়লা তনুকা ফেসবুকে লিখেছে –

"আমি একটি বুদ্ধি বের করেছি। কারো বিয়ে, বিবাহবার্ষিকী বা জন্মদিনে তাদের একটি কার্ড দেব আর তাতে লিখে দেব যে আপনার এই শুভদিনটি উপলক্ষে আমি অমুক দরিদ্রকে আপনার নামে এতো টাকা সাহায্য করেছি। চেষ্টা করবো প্রমাণস্বরূপ কিছু একটা অ্যাটাচ করে দিতে"।

স্বচ্ছল ও হৃদয়বান মেজবানেরা এতে নিশ্চয় খুশীই হবেন। এই পদ্ধতি দুনিয়াময় আমাদের প্রবাসী সমাজে নিঃসন্দেহে সফল হবে, চলুন আমরা এটা শুরু করি। সরকার কবে কি করে দেবে সেজন্য বসে না থেকে চলুন আমরাও নেমে পড়ি কিংবা কোনো স্বপ্নবাজ কর্মদানবের পাশে দাঁড়াই। যত যা-ই হোক,

কোটি প্রভাতের কিরণ ধন্য – কোটি গোধুলিতে ম্লান বিষন্ন,

পুষ্পে পুষ্পে অলি পুঞ্জিত – দোয়েল কোয়েলে কুহু কুঞ্জিত,-

কোটি পূর্ণিমা জ্যোৎস্না প্লাবিত – পদ্মা মেঘনা যমুনা ধাবিত,

আলো ঝলমল হরিৎবরণী – স্নেহময়ী মাতা, হৃদয়হরণী,

আমাদের প্রিয় পবিত্র জন্মভূমি, মাতৃভুমি !!