মুক্তিযোদ্ধার ভাবমূর্তি, সনদ, সুবিধা ও খণ্ডিত দৃষ্টিভঙ্গি

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 20 May 2019, 02:50 PM
Updated : 20 May 2019, 02:50 PM

এই তো কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে গেলেন মুক্তিযোদ্ধা শিরিন বানু মিতিল। জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র তিনি মৃত্যুর পূর্ব পযর্ন্ত হাতে পাননি। এ রকম অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আছেন, যাঁরা সনদপত্র পাননি কিংবা নেননি! তাঁদের কথা ভাবতে গিয়ে এই প্রসঙ্গে আরও কিছু বিবেচনাবোধ অনুরণিত হচ্ছে আমাদের মাঝে!

আমাদের চোখের সামনে দেখছি, আমাদের অনেকের চেয়ে অনেক কম ভূমিকা রেখেও মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে ভাতা তুলছেন, সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করছেন। অথচ এঁদের অনেকে অর্থনৈতিকভাবে বেশ স্বচ্ছল ও সমাজে অনেক দিক থেকে সুবিধাপ্রাপ্ত! কতজন যে প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও মুক্তিযোদ্ধার সনদপত্র নিয়ে সংবর্ধনা নিচ্ছেন, তাও আমাদের চোখের সামনে দেখেছি বা দেখছি! আরও দেখলাম প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধ করার পরও অনেকের সনদপত্র নেই। আমরা ভাবছি 'মুক্তিযোদ্ধা' কারা?

কিছুদিন আগে পাঁচ সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিল করেছে সরকার। প্রশাসনের এই শীর্ষ কর্মকর্তারা মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। তাদের নাম উল্লেখ করতে চাই না। অভিযোগ রয়েছে, শুধুমাত্র চাকরির মেয়াদ বাড়ানোর লক্ষ্যে তারা মুক্তিযোদ্ধা সনদ ব্যবহারে উদ্যোগী হয়েছিলেন! সনদ বাতিলের ফলে তাঁরা আরও এক বছর বাড়তি চাকরি করার সুবিধা পাননি। চাকরির শেষ সময়ে মুক্তিযোদ্ধা সনদ নেওয়ার হিড়িক পড়েছিল বলে পত্রপত্রিকায় খবরও এসেছিল!

জানা যায়, এ পর্যন্ত মোট মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়েছে প্রায় এক লাখ ৫২ হাজার। গত পাঁচ বছরে অর্থাৎ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের সময়ে সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশার মোট ১১ হাজার ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়েছেন। এর আগের সরকারের আমলে আরও ৪০ হাজার সনদ দেওয়া হয়। তবে অনেক প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা এখনো সনদ নেননি।

মহাজোট সরকার ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মচারীদের অবসরের বয়সসীমা ৬০ বছর নির্ধারণ করে। এর আগে ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তাঁদের অবসরের বয়সসীমা ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ বছর করা হয়। অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২১ হাজার মুক্তিযোদ্ধা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাঁদের সনদ প্রত্যয়নের জন্য মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেন। প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানা যায়, এর মধ্যে প্রায় সাত হাজার সনদে গলদ পাওয়া যায়, মন্ত্রণালয় সেগুলো প্রত্যয়ন করেনি। এ ছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে এক হাজার ৬৬৮ জনের সনদে গলদ ধরা পড়ে। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ১৫২ জনের মুক্তিযোদ্ধা সনদ সঠিক নয় বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। তবে ভুয়া সনদধারী কারও বিরুদ্ধে এখনো আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

ক'দিন আগে খবর বেরিয়েছে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষরিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সাময়িক সনদ আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছে। ৪৭ হাজার 'মুক্তিযোদ্ধা'র এই সনদ রয়েছে, তাঁদের ভাতাও স্থগিত রাখা হয়েছে। ২০০৮-০৯ সালে ১ লাখ মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেলেও ২০১৭-১৮ সালে ভাতা দেওয়া হয় ১লাখ ৮৬ হাজার জনকে। ২০০৯ সালে সম্মনী ভাতা ছিল ৯০০ টাকা। এখন সেই ভাতা বাড়িয়ে হয়েছে ১০ হাজার টাকা, দুটি উৎসব ভাতাও দেওয়া হয়। বহু রকমের তালিকাকে ভিত্তি করে মুক্তিযোদ্ধা সনদ দেওয়া হয়। আমরা জানি, যাঁরা প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদের প্রায় অর্ধেকেই আর এসময়ে বেঁচে নেই!

আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বহুমাত্রিক। মুক্তিযুদ্ধ তো সাধারণ মানুষই করেছে। মুক্তিযুদ্ধ মানেই গোলাগুলি শুধু নয়। মুক্তিযুদ্ধে কতজনের কত রকমের ভূমিকা–কতজনের কত ধরনের আত্মত্যাগ! কতভাবে অংশগ্রহণ! গুটি কয়েক লোক ছিল, যারা চিহ্নিত রাজাকার-আলবদর ও মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারী! আর অন্যরা বহুভাবে বহুস্তরে অংশ নিয়েছেন! সেসব বিস্তৃত ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের কণ্ঠলগ্ন হয়ে আছে। যিনি আহত হয়েছেন, যিনি স্বজন হারিয়েছেন, যাঁর ঘর-বাড়ি লুঠ হয়েছে, সর্বস্ব হারিয়ে হয়েছেন সর্বহারা, যে খাদ্য দিয়েছেন–আশ্রয় দিয়েছেন নিরাশ্রয়দের, যিনি অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন–তাঁদের কি কোনো অবদান নেই মুক্তিযুদ্ধে? বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানেই হলো বেশিরভাগ মানুষের সম্মিলিত অংশগ্রহণ। আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ মানে প্রথম থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ গণমানুষের অংশগ্রহণের দৃঢ় অবস্থানের ইতিহাস, তা শুধু ক'জনের নয়। একদিক থেকে তাঁরা সকলেই মুক্তিযোদ্ধা। জনগণের সেই সম্মিলিত ও বিস্তৃত ভূমিকাকে খণ্ডিত করে শুধু কিছু 'সনদপত্র'র আওতায় মধ্যে সীমাবদ্ধ করে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাকে বিবেচনা করা মুক্তিযুদ্ধের বহু বিস্তৃত পটভূমি ও তাৎপর্য় অনেকাংশে সঙ্কুচিত ও ম্লান করা হয় বলে আমাদের মনে হয়। বিংশ শতাব্দীর ইতিহাসে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল অনন্য ও গণমানুষের গণযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধকে সংকীর্ণ ও একরৈখিকভাবে মূল্যায়ন করা কোনোক্রমেই ঠিক নয়।

যখন থেকে সনদপত্র নির্ভর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় টেনে নিয়ে সুবিধা বিলানোর উদ্যোগ নেওয়া হলো–তখন থেকে মুক্তিযুদ্ধকে সংকীর্ণ গলির মধ্যে ঠেলে দেওয়া হলো! আর এই কারণে পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে যারা ক্ষমতা দখল ও ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার চেষ্টা করেছে–তারাই প্রধানত 'মুক্তিযোদ্ধার সাইনবোর্ড' ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে। এক্ষেত্রে সুবিধাবাদী 'মুক্তিযোদ্ধা' নামধারী কিছু লোক ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষমতার পাটাতনে বসা লোকদের স্বার্থে। এই প্রবণতা এখনো থেমে থাকেনি। মুক্তিযোদ্ধার অর্ন্তনিহিত মানে হলো দেশমাতৃকার জন্য আত্মত্যাগ, জনগণের মুক্তির জন্য লড়াই করে জীবন দান করার মানসিকতা ও গৌরবময় ভূমিকা পালন করার ইচ্ছে ইত্যাদি, এটাই তো তাঁর ভাবমূর্তি। এই ভাবমূর্তির বাইরে 'মুক্তিযোদ্ধা'র নামে কিছু আমলা ও সুবিধাভোগীরা আরও সুবিধা নিয়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাবমূর্তিকে কাদামাখা করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংকীর্ণ পোষাকী অবস্থানে ঠেলে দিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সীমাবদ্ধ করা সমীচীন নয়, তা মানাও যায় না! এর ফলে আত্মত্যাগের মহিমাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুবিধামুখী প্রতিকৃতির পরিচয় মেলে ধরে, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভূমিকাকে নতুন প্রজন্ম ও ইতিহাসের কাছে ছোট করা সমীচীন নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধার গৌরবের ভাবমূর্তিকে কাদামাখা করে ছোট পরিসরে নিয়ে যাওয়ার অধিকারও কারও নেই, ইতিহাসের সত্য সেটাই বলে!