বিএনপির রাজনৈতিক অপমৃত্যু

সাঈদ ইফতেখার আহমেদসাঈদ ইফতেখার আহমেদ
Published : 19 May 2019, 02:48 PM
Updated : 19 May 2019, 02:48 PM

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য ছিল তার ইতিহাসে সবচেয়ে কঠিনতম পরিস্থিতিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। এর পূর্বে এরকম কঠিন অবস্থার মধ্যে বিএনপিকে আর কোনও নির্বাচনে অংশ নিতে হয়নি। এমনকি, ১/১১ সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের নির্বাচনও তাদের জন্য এতটা প্রতিকূল ছিল না। নির্বাচনে অংশগ্রহণের পূর্বে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে আকস্মিক ভাবে সংলাপে বসবার সিদ্ধান্ত নেয়।

সংলাপে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত বিএনপির সমর্থকসহ অনেককেই বিস্মিত করেছিল। তখন অনেকেই ভেবেছিলেন বেগম খালেদা জিয়াকে জেলে রেখে দলটি প্রধানমন্ত্রীর সাথে সংলাপে বসবে না। তারপরেও অনেকে ধরে নিয়েছিলেন কৌশল হিসাবে দলটি সংলাপে গেলেও সংলাপের মূল এজেন্ডা থাকবে দলীয় প্রধানকে মুক্ত করে আনবার বিষয়টি।কিন্তু দেখা গেল, দুই-দুইবারই সংলাপে বিএনপি খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখল।

দ্বিতীয়বার সংলাপে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহাসচিব মির্জা ফখরুলের স্বাস্থ্যের অবনতি দেখে উদ্বিগ্ন হন, তার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নেন এবং এর কারণ জানতে চান। মির্জা ফখরুলও প্রধানমন্ত্রীকে জানান দলীয় কাজের চাপসহ নানাবিধ কারণে তার স্বাস্থ্য ভালো যাচ্ছে না।

দ্বিতীয় দফার সংলাপের যে ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছিল তাতে দেখা গিয়েছিল দুই হাতে ফাইল ধরে ফখরুল প্রধানমন্ত্রীর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। ফখরুলের দাঁড়াবার এ ভঙ্গিটি দেখে তখনই কারও কারও মনে হয়েছিল, বিএনপি বোধহয় নির্বাচনে যাচ্ছে। যদিও বিএনপির সমর্থকসহ তৃণমূলের বড় অংশটি তখনও ধরে বসেছিল যে, খালেদা জিয়াকে ছাড়া দলীয় নেতারা নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত নিবেন না।

দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটা অংশও খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবার বিরোধী ছিলেন। খালেদার মুক্তির প্রশ্নটি উত্থাপিত না হওয়ায় দ্বিতীয় সংলাপে গয়েশ্বর রায় অংশগ্রহণ করেননি। গয়েশ্বর রায়সহ দলীয় নেতৃত্বের একটা অংশ সংলাপ বা নির্বাচনের মাধ্যমে দলীয় প্রধানের মুক্তি ঘটানো যাবে না, এরকম একটা অবস্থান নেন, এবং আন্দোলন গড়ে তোলবার বিষয়টার উপর জোর দেন।

এরকম অবস্থা মহাসচিব হিসাবে মির্জা ফখরুলকে এক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি করে। প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকে এতদিন পর্যন্ত দলীয় গুরুত্বপূর্ণ সব সিদ্ধান্ত এককভাবে দলীয় প্রধানই নিয়ে এসেছেন। দলের ভালো-মন্দের দায়িত্ব এককভাবে অন্য কোনও নেতাকে নিতে হয়নি। অন্য নেতারা ক্ষেত্র বিশেষে দলীয় প্রধানকে বড় জোড় সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করেছেন।

দলীয় প্রধানের সব সিদ্ধান্তই কেন্দ্র থেকে তৃণমূল, এক বাক্যে, বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছে। তার সব সিদ্ধান্তকেই তারা সঠিক মনে করেছেন। তিনি কখনো ভুল করতে পারেন বা ভুল সিদ্ধান্ত দিতে পারেন, এটা তারা কখনোই বিশ্বাস করেননি। এ ধরনের কোন সংস্কৃতিও দলে গড়ে উঠেনি।

১৯৮১ সাল থেকে আওয়ামী লীগও একইভাবে সব সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব দলীয় প্রধানের উপর দিয়ে বসে আছে। তারাও বিএনপির মতো মনে করে যে,তাদের দলীয় প্রধানও কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না বা কোন বিষয়ে ভুল করতে পারেন না। তবে, সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রধান শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার মধ্যে একটা বড় দাগে পার্থক্য রয়েছে।

দল এবং সরকার দুই জায়গাতেই শেখ হাসিনাকে সব সময় দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে দেখা গেছে। এর বিপরীতে খালেদা জিয়া অনেক সময়ই সিদ্ধান্ত হীনতায় ভুগেছেন,যার প্রভাব দলটিতে পড়েছে সব সময়।খালেদা জিয়ার অনুপস্থিতিতে এটা আরো বেশি অনুভূত হয়েছে। খালেদার মুক্তির প্রশ্নে আন্দোলন,সংলাপ,নির্বাচন,সংসদে যাওয়া না যাওয়ার প্রশ্ন ইত্যাদি সব কিছুতেই দলের নেতৃত্বকে দোদুল্যমান মনে হয়েছে।

এখানে একটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়। খুব অদ্ভুত শোনালেও বাস্তবতা হচ্ছে, বিএনপি, আওয়ামী লীগ দুটো দলই নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করলেও, উভয়েই পরিচালিত হয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং গণচীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতো এক ব্যক্তির নেতৃত্বে।

এক ব্যক্তির নেতৃত্বে পরিচালিত হয় বলেই সেই নেতার অনুপস্থিতি দলগুলোতে এক ধরনের দিশেহারা অবস্থা তৈরি করে। তাই যখন সংলাপের বিষয়টা আসল তখন বিএনপি কার নেতৃত্বে সংলাপে যাবে এ প্রসঙ্গটাও চলে আসে। একক নেতৃত্বের দলগুলো নেতা নয় মূলত অনুগামী তৈরি করে। ফলে, সংলাপে নেতৃত্ব দেবার জন্য বিএনপির নেতা খুঁজে বের করবার প্রয়োজন হয়।

মওদুদ আহমেদ, মির্জা ফখরুলের মতো নেতা থাকা সত্ত্বেও দলটিতে আত্মবিশ্বাসের প্রবল অভাব দেখা দেয়। তাদেরকে গণফোরামের মতো একটি সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলের দ্বারস্থ হতে হয়, যাতে দলটির প্রধান ড. কামাল হোসেন সংলাপে নেতৃত্ব দিতে পারেন। এ দলটি গঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ, সিপিবি এবং ন্যাপের (মোজাফফর) কয়েকজন দলছুটের হাত ধরে,যার কথা সাম্প্রতিক সময়ে অনেকেই ভুলে গিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য যে, এক অর্থে একাদশ সংসদ নির্বাচনে সবচেয়ে লাভবান দল হলো গণফোরাম। যে দলের কারও পক্ষে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন করে জিতে আসবার সম্ভাবনা নেই, সে দলটিই বিএনপির কাঁধে ভর করে একটি বিতর্কিত নির্বাচনে দু'টি আসন বের করে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে। ড. কামাল হোসেনের রাজনৈতিক জীবনে নিজ নেতৃত্বে এটি সবচেয়ে বড় অর্জন বললে বোধহয় ভুল হবে না।

বিএনপির অনেকটা যুগ সন্ধিক্ষণে এককভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারবার অনভিজ্ঞ মির্জা ফখরুলসহ দলটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের উপরে দায়িত্ব বর্তায় নির্বাচন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবার। তৃণমূলে অনেকটা এ প্রস্তুতিই ছিল যে, বিএনপি এবারও নির্বাচন বর্জন করতে যাচ্ছে। কিন্তু, তৃণমূলের আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে গিয়েই দলকে নির্বাচনে যাবার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

এককভাবে আন্দোলন গড়ে তুলতে অক্ষম বিএনপির সামনে নির্বাচন সংক্রান্ত যতগুলো বিকল্প ছিল এর সবগুলিই ছিল আত্মহত্যামূলক। নির্বাচনে না গেলে দলের নিবন্ধন বাতিল হত। বিএনপির মতো দলের পক্ষে নিবন্ধন বাতিল হলে সিপিবি বা জামায়াতের মতো দল টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হত না। এর মূল কারণ হচ্ছে, সিপিবি বা জামায়াতের মতো বিএনপি একটা বিশেষ মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে রাজনীতি করে না।

সামরিক শাসকের ক্ষমতা ধরে রাখবার মাধ্যম হিসাবে, রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়,ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে দলটি গঠিত হলেও, দলটি ক্রমান্বয়ে ভোট নির্ভর,গণ রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়েছে। এ ধরনের দল আত্মগোপনে যেয়ে বা নিবন্ধন বাতিল করে সাধারণত টিকে থাকতে পারে না। তাই, বিএনপি নেতৃত্বের পক্ষে দল টিকিয়ে রাখবার স্বার্থে নির্বাচনে যাওয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না।

একটা বিষয় বিএনপির নেতৃত্ব বুঝতে পেরেছিলেন, মুখে যতই আন্দোলন বা খালেদার মুক্তির কথা বলুক, এককভাবে আন্দোলন গড়ে তুলবার কোন ঐতিহ্য দলটিতে না থাকবার ফলে আন্দোলনের মাঠে তৃণমূলের কাউকে তেমন ভাবে পাওয়া যাবে না। মির্জা ফখরুল তার দলের কর্মীদের এ একটি জায়গায় হয়ত সঠিক ভাবে বুঝতে পেরেছিলেন। তার দলের কর্মীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আন্দোলন,খালেদার মুক্তি,সরকার পতন, বিএনপির ভবিষ্যত ইত্যাদি ইস্যুতে যতটা কল্পনাবিলাসী,মাঠের লড়াইয়ের প্রশ্নে ততটাই নীরব—যা গুণগতভাবে আওয়ামী লীগের সাথে দলটির কর্মীদের পার্থক্যের একটা মাত্রা তৈরি করেছে।

এরশাদ এবং ১/১১সরকারের আমলে,বিএনপি তার সহযোগী হিসাবে পেয়েছিল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য দলগুলোকে। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তারা একটা দীর্ঘসময় জামায়াতকে পেয়েছে মাঠের সহযোগী হিসাবে।

জামায়াত বৈধ, অবৈধ নানা পন্থায় চেষ্টা করেছে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করে দলের নেতাদের মুক্ত করে আনা। কিন্তু,দলীয় নেতাদের সাজা হয়ে যাবার পর জামায়াত প্রতিরোধের পথ থেকে সরে এসে পাকিস্তান আমলের বামদলগুলির মতো পুরো সংগঠনকে আত্মগোপন অবস্থায় নিয়ে যায়, প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দলকে টিকিয়ে রাখবার কৌশল হিসাবে।

এমতাবস্থায়, বিএনপি রাজনীতির মাঠে অনেকটাই একা হয়ে যায়। তার সহযোগী হিসাবে থাকে কিছু ছোট এবং সাইনবোর্ড সর্বস্ব দলসমূহ। এর বিপরীতে প্রতিপক্ষ শুধু আওয়ামী লীগের মতো বড় রাজনৈতিক দলই নয়, এর সাথে যুক্ত হয় সরকার এবং রাষ্ট্রযন্ত্র।

আওয়ামী লীগের দুই পর্বের ধারাবাহিক শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্র, সরকার ও দল যেভাবে একে অপরের পরিপূরক এবং পারষ্পারিক অঙ্গীভূত হয়েছে, তাতে অনেক সময় একে অন্যের মাঝে পার্থক্য করা দুষ্কর হয়ে উঠে। সরকার, রাষ্ট্র এবং দলের এ ধরনের আন্তঃসম্পর্ক সাধারণত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থাতে দেখা যেত, যেমন বর্তমানে দেখা যায় গণচীন এবং উত্তর কোরিয়ায়।

এসব কিছু বিবেচনায় মির্জা ফখরুল সঠিক ভাবেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, যেখানে দলীয় প্রধানের গ্রেপ্তারের পরেও তৃণমূলে তার মুক্তির প্রশ্নে তেমন সাড়া মেলেনি, সেখানে তাদেরকে নিয়ে নির্বাচন বর্জন করলে আন্দোলন কেন, কোনও কিছুই করা সম্ভব হবে না। এতে,দলের অনেকেই হয়ত বেরিয়ে যেয়ে স্বতন্ত্র বা অন্য প্ল্যাটফরম থেকে নির্বাচন করবে।

তবে, এ নির্বাচনের সিদ্ধান্ত জায়েজ করবার জন্য ফখরুলসহ নেতাদেরকে খালেদা জিয়ার নাম ব্যবহার করতে হয়েছে। তারা দাবি করেছেন, জেলে বন্দি খালেদা জিয়া তাদেরকে নির্বাচন করবার অনুমতি দিয়েছেন বলেই তারা নির্বাচন করেছেন।

নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলে দল ক্ষমতায় যাবে না এটা তারা নিশ্চিত ছিলেন। তবে, সম্মানজনক আসন না পেলেও, দল দ্বিতীয় অবস্থানে থাকবে বলেই বিএনপি নেতৃত্ব ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু, কয়েকটি আসন পেয়ে দল যদি তৃতীয় অবস্থানে চলে যায় তাহলে দলের রাজনীতিকে কী করে ধরে রাখতে হবে, এ ধরনের কোনও চিন্তা নির্বাচনের পূর্বে তাদের কারো মাথায় আসেনি। কেউই তখন ভাবতে পারেননি যে, দলের এ ধরনের শোচনীয় বিপর্যয় ঘটবে, মির্জা ফখরুল বাদে দলের কোনও নেতাই জিতে আসতে পারবেন না।

তারা এটাও ভাবতে পারেননি যে, এতটা প্রতিকূল অবস্থায় তাদের নির্বাচনী প্রচার চালাতে হবে। যদিও,এ কঠিন অবস্থার মাঝেও, যেখানে দল টিকিয়ে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ, সেসময়ও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের কাছ থেকে অভিযোগ আসে, কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের নির্বাচনী বাণিজ্যের।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগ শুরু থেকেই সতর্ক অবস্থানে ছিল। তারা কোনও ঝুঁকি নিতে চায়নি। আওয়ামী লীগের দশ বছরের শাসনামলে ব্যাপক অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি রোধ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাদের পক্ষে সম্ভব হয় নাই বিপুল পরিমাণ অর্থপাচার রোধ করাও। সমালোচকরা বলেন, তারা এ ব্যাপারে সেরকম সচেষ্টও ছিলেন না। তদুপরি, এ দশ বছরে আওয়ামী লীগ উন্নয়নের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল, দুর্নীতি এবং অন্যান্য কারণে তারা সে জায়গায় দেশকে নিয়ে যেতে পারেনি। ফলে, দলটির জনপ্রিয়তা থাকলেও, আস্থার সঙ্কট ছিল প্রবল।

শতভাগ বিশুদ্ধ নির্বাচন হলে দলটি ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে কিনা, নেতৃবৃন্দ নিশ্চিত হতে পারছিলেন না। তাঁরা ভরসা রাখতে পারছিলেন না নানা জরীপের উপর, যেগুলিতে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী দেখান হয়েছিল।

২০০১ এর নির্বাচনী অভিজ্ঞতা- যেখানে তারা ভেবেছিলেন যে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় ফিরে আসবেন, তাদের মাঝে প্রবল আস্থার সঙ্কট তৈরি করে। কোনও কারণে তারা বিজয়ী হতে না পারলে, তাদেরকে আবার ২০০১—০৬ এর কঠিন অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হতে পারে, এ আশঙ্কা তাদের পেয়ে বসে। ফলে, তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী মাঠ দখলে রাখবার উদ্যোগ নেয়। কোনওভাবেই মাঠে বিএনপি যাতে দাঁড়াতে না পারে তারা সে চেষ্টা করে।

এ কাজে অনেক জায়গায় তারা সহযোগিতা পায় রাষ্ট্রযন্ত্রের (প্রশাসন)। অপরদিকে, জামায়াতকে সাথে নিয়ে দুই দুইবার পেট্রোল বোমা সন্ত্রাস নির্ভর আন্দোলন এবং আওয়ামী লীগের নিজের ২০০১-০৬ এর অভিজ্ঞতার ফলে—২০০৯ এ ক্ষমতায় এসে শুরু থেকেই আওয়ামী লীগ মামলা, হুলিয়া, জেল ইত্যাদি নানা ভাবে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নেয়।

ক্ষমতার কেন্দ্রে জন্ম নেয়া, তুলনামূলক বিচারে আয়েশী রাজনীতিতে অভ্যস্ত বিএনপি এ চাপ মোকাবেলা করতে না পেরে এমনিতেই কোণঠাসা অবস্থানে ছিল। তাদের অবস্থা এতটাই নাজুক ছিল যে দলীয় প্রধানের মুক্তির দাবি করে তারা সরকারের চাপ অগ্রাহ্য করে একটা মিছিল পর্যন্ত করতে পারেনি। নির্বাচনী প্রচার শুরু হবার পর তাই আওয়ামী লীগ যখন সারা দেশে মাঠ দখল রাখবার কৌশল নেয়, এর বিপরীতে বিএনপির প্রতিরোধ গড়ে তোলাতো দূরের কথা, বরং অনেক জায়গায় নূন্যতম প্রচারের কাজ থেকেও সরে আসে। এর চেয়ে কর্মীরা অনলাইনে নিরাপদ জায়গায় বসে নির্বাচনে কারচুপি ঠেকাবার অলীক স্বপ্নে বিভোর থাকে।

এ অলীক স্বপ্নের ফল হলো নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্তও বিএনপির অনেকে ভাবতে শুরু করেছিলেন, যেকোনও ভাবে বিএনপি হয়তো নির্বাচনী বৈতরণী পার হয়ে যাবে। কিন্তু, নির্বাচনী ফল বিএনপির নেতাকর্মীদের স্তম্ভিত, কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেয়। তাৎক্ষণিকভাবে তারা নির্বাচনী ফল প্রত্যাখান করে সংসদে না যাওয়ার ঘোষণা দেয়।

তৃণমূল তো বটেই জনগণের একটা বড় অংশও ধরে নিয়েছিল যে, আর যাই করতে পারুক, না পারুক, ছয়টি আসন নিয়ে বিএনপি অন্তত তৃতীয় দল হিসাবে সংসদে যাবে না। তবে, বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে যারা ওয়াকিবহাল তাদের মনে সন্দেহ ছিল সংসদে না যেয়ে বিএনপির মতো দল তাদের সাংসদদের ধরে রাখতে পারবে কিনা। অথবা যারা সংসদে যাবে তাদের বাদ দিয়ে রাজনীতি করবার মত নৈতিক মনোবল দলটির আছে কিনা।

এ নৈতিক মনোবল যে বিএনপির নেই সংসদে যোগদানের সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে দলটি সেটিই বরং প্রমাণ করল। ক্ষমতার কেন্দ্রে জন্ম নেয়া বিএনপির নেতাকর্মীরা ক্ষমতার আশেপাশে থাকতেই পছন্দ করেন। এ সংসদে যাবার প্রশ্নে কেন্দ্র থেকে প্রান্ত পর্যন্ত বিএনপির নেতা কর্মীদের মাঝে স্পষ্ট দ্বিধা-বিভক্তি ছিল। যারা নির্বাচিত হতে পারেন নাই তারা তো বটেই, দলের বেশির ভাগের অবস্থান ছিল সংসদে না যাওয়ার পক্ষে।

ফলে,মির্জা ফখরুলকে অত্যন্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে দিয়ে সাংসদদের সংসদে যোগদানে সায় দিতে হয়েছে এবং তা জায়েজ করবার জন্য ব্যবহার করতে হয়েছে তারেক রহমানের নাম। যদিও অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে তিনি নিজে সংসদে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কেননা, এতে তিনি নিজ দল থেকে পুরো বিছিন্ন হয়ে যেতেন, যার পরিণতিতে তিনি হয়ত তার মহাসচিব পদটি হারাতেন। তবে, তিনি তার কর্মীদের সামনে ব্যাখ্যা করতে পারেননি সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সঠিক হলে তিনি নিজে কেন গেলেন না। অর্থাৎ,নানা অস্পষ্টতা বিএনপির রাজনীতিতে এখন প্রকট।

আর এ অস্পষ্টতার সবচেয়ে বড় দিকটি যা দলমত নির্বিশেষে দেশবাসীকে অবাক করেছে সেটি হলো বিএনপি কেন তাদের দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য কোনও আন্দোলন করল না। যে দলটি কারণে অকারণে এত হরতাল করল, দুই দুইবার পেট্রোল বোমা নির্ভর 'আন্দোলন' করল, সে দলটি কেন তাদের দলীয় প্রধানের মুক্তির জন্য আধাবেলা হরতালও ডাকল না। যেখানে জাতীয় পার্টির মতো দল খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে এরশাদের মুক্তির প্রশ্নে সব সময় রাজপথে তাদের সীমিত সামর্থ্য নিয়ে সক্রিয় থেকেছে, সেখানে বিএনপির মতো বিপুল জনসমর্থন ভিত্তিক বড় দল তাদের দলীয় প্রধানের মুক্তির প্রশ্নে কেন এরকম নীরব— এ বিষয়টা জনগণের অনেকের মনেই একটা বড় প্রশ্নবোধক হয়ে রয়েছে।

অস্পষ্টতার আরেকটি দিক হলো কেনই বা বিএনপি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গিয়ে সংসদে যোগ দিলো। যে দল থেকে বিভিন্ন সময়ে বহু নেতাকর্মী বেরিয়ে গেছে, সে দলের জন্য পাঁচজন সাংসদকে ধরে রাখা কি খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ফলে,বিশ দল এবং ঐক্যফ্রন্টের শরীকদের পাশাপাশি, বিএনপির অনেকের মাঝে এ সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করেছে, বিএনপি নেতৃত্বের একাংশ সরকারের সাথে  আপসের পথে হাঁটছেন কিনা, ব্যক্তিগত এবং অন্যান্য সুবিধার বিনিময়ে।

খালেদার জিয়ার মুক্তির বিষয়টিকে ব্যবহার করে সংসদে যেয়ে প্রথম দিন সাংসদ হারুনুর রশীদকে খালেদার জিয়াকে মুক্তি দেবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন নিবেদন করে দীর্ঘ বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। জাতীয় পার্টি, এমনকি সিপিবির মতো ছোট দলও তাদের নেতা মোহাম্মদ ফরহাদকে জিয়া সরকারের সময় জেল থেকে মুক্ত করবার জন্য আন্দোলন গড়ে তোলবার উপর জোর দিতে দেখা গেছে। কিন্তু, দেখা যাচ্ছে সাংসদদের পাশাপাশি বিএনপি নেতৃত্বের একটি অংশও এখন প্রকাশ্যে বলতে শুরু করেছেন সরকারের সাথে আপস করেই দলীয় নেত্রীকে মুক্ত করে আনতে হবে।

কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের একটি অংশ পরিষ্কার করে দিচ্ছেন যে, খালেদার মুক্তির দাবিতে তারা ন্যূনতম কোনও আন্দোলন করবেন না। বিচার বিভাগ নয়, খালেদার মুক্তির বিষয়টি তারা সরকার প্রধানের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির উপর ছেড়ে দিতেই আগ্রহী। এর পূর্বে বাংলাদেশের কোনও রাজনৈতিক দলকে তাদের নেতাদের মুক্তির ব্যাপারে এরকম নতজানু অবস্থান নিতে দেখা যায়নি।

১/১১ এর সময়ও সাবেক মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, সাইফুর রহমান, মেজর (অবঃ) হাফিজ প্রমুখ বিভিন্ন দলছুটদের নিয়ে গঠিত হওয়া বিএনপিকে সংস্কারের নামে বিলুপ্ত করে 'কিংস পার্টি'র অংশে পরিণত করতে চেয়েছিলেন। সেসময় অসুস্থ অবস্থায় খন্দকার দেলোয়ার যদি শক্ত অবস্থান না নিতেন, তাহলে দলটিকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হত।

খন্দকার দেলোয়ারের উত্তরাধিকার মির্জা ফখরুলের সামনেও আজকে বাংলাদেশের মাটিতে বিএনপির রাজনীতি টিকিয়ে রাখা যাবে কিনা এ কঠিন চ্যালেঞ্জ উপস্থিত। তারেক রহমানের নেতৃত্বের প্রজ্ঞার উপরে তৃণমূলের প্রায় সবার আবেগী আস্থা থাকলেও, বাস্তবতা হচ্ছে রাজনীতির জটিল সমীকরণ বুঝতে তিনি চূড়ান্ত ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।

সংসদে যোগদানের মধ্যে দিয়ে বিএনপি ইতিমধ্যে নির্বাচনের বৈধতা দেয়াসহ আওয়ামী লীগ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর পাশাপাশি আইনগতভাবে তৃতীয় দল হিসাবেও তারা নিজেদের মেনে নিয়েছে। এমতাবস্থায়, বিএনপির রাজনৈতিক অস্তিত্বের প্রশ্নটি অনেকাংশেই নির্ভর করছে একটি উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ন্যূনতম আন্দোলন তারা গড়ে তুলতে পারবে কিনা তার উপর। উচ্চ প্রবৃদ্ধির অর্থনীতিতে জনগণ এমনিতেই আন্দোলন বিমুখ থাকে।

দলের এ কঠিনতম মুহূর্তে মির্জা ফখরুল এ চ্যালেঞ্জ কতটুকু মোকাবেলা করতে পারবেন তার উপর দাঁড়িয়ে আছে দলটির রাজনৈতিক ভবিষ্যত। তিনি যদি ব্যর্থ হন তাহলে বিএনপিকেও তাদের আদর্শগত পূর্বসূরি মুসলিম লীগের মতো অপমৃত্যুর পরিণতি বরণ করতে হতে পারে।

এ পরিণতি বরণ করলেও, মুসলিম লীগের যে উত্তরাধিকার বিএনপি বহন করে চলছে তার ধারাবাহিকতা আরও দীর্ঘদিন সমাজে থাকবে। তবে, বিএনপির প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে এ রাজনীতিকে হয়তো আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না।