মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ

জিল্লুর রহমান রতন
Published : 11 July 2012, 07:39 AM
Updated : 11 July 2012, 07:39 AM

মাদকের ব্যবহার ক্রমশ বাড়ছে উদ্বেগজনকভাবে। এ সমস্যা এখন আর শুধু শহরে সীমাবদ্ধ নেই, ধনী-দরিদ্র, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তৃণমূল পর্যায়ে বিস্তৃত হয়েছে। মাদকের সহজলভ্যতা ও বিজ্ঞান সম্মত চিকিৎসা সুযোগের অভাব এর অন্যতম কারণ। আর মাদকসেবীদের একটি বড় অংশ বয়সে তরুণ যাদের উপর দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল। কিন্তু বিপুল এই জনগোষ্ঠী যদি সৃজনশীল কর্মকান্ডের পরিবর্তে মাদক ব্যবহারে ঝুঁকে পড়ে তাহলে এর থেকে বড় আর সর্বনাশ আর কিছু হতে পারে না।

মানবসভ্যতার আদিকাল থেকেই মাদক-ব্যবহারের প্রচলন ছিল। কিন্তু সেটি ছিল সীমিত আকারে। এখন এর ব্যাপ্তি সমাজের সর্বস্তরে। আমাদের দেশে গাঁজা, ফেনসিডিল, হেরোইন, ইয়াবা, মদ (দেশি ও বিদেশি), ঘুমের ও ব্যথানাশক ওষুধ (পেথেডিন ও মরফিন) এখন বহূল ব্যবহৃত মাদকদ্রব্য যা সহজলভ্য। মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহৃত এ সব বস্তুর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো মস্তিস্কের বিশেষ বিশেষ স্থানকে উদ্দীপ্ত করে যার ফলে সাময়িকভাবে তীব্র ভালোলাগার অনুভুতি হয়। কিছুদিন ব্যবহারের পর সহনীয়তা তৈরি হয় যার ফলে একই মাত্রায় আর আগের মতো ভাললাগা বোধ থাকে না। এজন্য মাদক-ব্যবহারের পরিমাণ ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে থাকে যার ফল হয় দীর্ঘমেয়াদী আসক্তি।

আসক্তি হওয়ার পর সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এরপর মাদক ব্যবহার না করলে প্রত্যাহারজনিত বিভিন্ন রকমের অসহনীয় শারীরিক ও মানসিক সমস্যা হয় যার কারণে মাদকাসক্ত ব্যক্তি একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে পড়ে যায় এবং চাইলেও সে সহজে এর থেকে নিস্তার লাভ করতে পারে না। এ জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবার যখন বলে 'তুই ভালো হয়ে যা; চাইলেই পারবি'- এ বিয়টি তখন অলীক আশায় পরিণত হয়। তবে মাদক ছাড়ার জন্য ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ইচ্ছাশক্তি (প্রেষণা) একটি অপরিহার্য বিষয়। আর শারীরিক ও মানসিক আসক্তি তৈরি হওয়া নির্ভর করে মাদকদ্রব্যের ধরনের ওপর। যে কোনও বস্তু যখন এ ধরনের বৈশিষ্ট্য বহন করে তখন তা মাদক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যেমন, রং তৈরির বিভিন্ন রাসায়নিক গন্ধ শুঁকে আসক্তি যাদের তাদের গ্লু øিফার বলা হয়। এ ছাড়াও অদ্ভূত সব জিনিস (অল্পমাত্রার সাপের বিষ, আপেলের বীজ ইত্যদি) মাদকাসক্ত ব্যক্তি উদ্ভাবন করে বা বিভিন্ন জিনিস মিশ্রিত করে ব্যবহার করে থাকে।

মাদকাসক্ত একজন ব্যক্তির একটি দিনের প্রায় বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয় মাদক সংগ্রহ ও মাদকের কারণে সৃষ্ট শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দূরীকরণে । এর ফলে দৈনন্দিন স্বাভাবিক কাজকর্ম, পড়াশুনা, চাকরি, ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবন মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চাকরি ও ব্যবসা হারিয়ে বেকার হয়ে পড়ে। মাদকের ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে অনেকে চুরি, ছিনতাই এমনকি মাদক ব্যবসায়ের মত অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ে। পরিবারে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তি সেই পরিবারের জন্য কতটা অশান্তির কারণ তা ভুক্তভোগীরা খুব ভালো করেই জানেন। অনেক সময় মাতাপিতাকে সন্তানের মৃত্যু কামনা করতে কিংবা পুলিশ হেফাজতে দেওয়ার মতো চরম সিদ্ধান্ত নিতে দেখা যায়। অনেক মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে জোরপূর্বক বেঁধে রাখা হয় যার ফলে প্রত্যাহারজনিত সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করে ও বাধ্য হয়ে তখন ছেড়ে দিতে হয়।

মাদক ব্যবসায়ের সঙ্গে জড়িতদের ছাড়া অন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের কখনওই অপরাধী হিসেবে গণ্য করা যাবে না। মাদকাসক্তি একটি মানোসামাজিক ও জনস্বাস্থ্য সমস্যা । এ জন্য মাদকাসক্ত ব্যক্তির বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা জরুরি।

মাদকের সহজলভ্যতা মাদকাসিক্তর অন্যতম কারণ হলেও একমাত্র কারণ নয়। মাদকাসক্তির কারণ সম্পর্কে একটি প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণা হচ্ছে ব্যক্তিগত হতাশা, ব্যর্থতা ও অপ্রাপ্তির কারণে মাদকাসক্তি। বিষয়টি এ রকম হলে প্রায় সবাই মাদকাসক্ত হওয়ার কথা। বাস্তবে ব্যাপারটি অন্যরকম। ব্যক্তিত্বের বিশেষ বৈশিষ্ট্য, যেমন শৈশবে অপরাধ-প্রবণতা ও আইন অমান্য করা, স্কুলপালানো ও ডানপিটে স্বভাব ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ ও বেপরোয়া আচরণ মাদকগ্রহণের প্রবণতা বাড়িয়ে দেয়। অতি-কৌতুহলী কিশোর ও তরুণ অনেকসময় মাদকাসক্ত বন্ধুর অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারে না। মাদকাসক্তির জন্য আরেকটি ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ হচ্ছে ধূমপান। গবেষণায় দেখা যায়, মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের প্রায় সবারই (শতকরা ৭০-৮০ ভাগ) ধূমপায়ী। এ জন্য ধূমপানকে মাদকগ্রহণের অন্যতম সোপান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। অথচ তরুণসমাজে ধূমপানকে একটি অনুকরণীয় ও নিজেকে প্রকাশ করার আদর্শ আচরণ (আইডল) হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

ধূমপানবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা সত্বেও তরুণসমাজে এর আকর্ষণ কতটুকু কমেছে তা বলা মুস্কিল। অনেক সময় দেখা যায় তরুণ প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি, যেমন ব্যান্ড মিউজিকের স্টার সার্চ বা মাদকবিরোধী কনসার্টের পৃষ্ঠপোষকতা করছে নামকরা সিগারেট কোম্পানি। এ সব কনসার্টে উপস্থিত কিছু তারকার সম্পর্কে অনেক সময় মাদকগ্রহণের অভিযাগের কথা শোনা যায়। ব্যাপারটা অনেকটা 'সর্প হইয়া দংশন করো, ওঝা হইয়া ঝাড়ো" এর মতো। মাদকাসক্তির আরও অনেক কারণ আছে; যেমন, অপরাধপ্রবণ ও মৌলিক সুবিধাবঞ্চিত সামাজিক পরিবেশ, খেলাধুলা ও সুস্থ বিনোদনের অভাব, সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয় ইত্যাদি। অভিভাবক ও পরিবারের যে কোনও সদস্যের মাদকাসক্তির সমস্যা থাকলে অন্যদের ঝুঁকি বেড়ে যায় বহুগুণ। বাবা ও ছেলের একই সময়ে মাদকাসক্তি চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ভর্তির ঘটনা হরহামেশাই দেখা যায়।

মাদকাসক্তের প্রকৃত সংখ্যা বলা কঠিন কারণ এ বিষয়ে কোনও জাতীয় পরিসংখ্যান নেই। তবে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের দুটি জরিপে দেখা যায় প্রাপ্তবয়স্কদের শতকরা ০.৬ ভাগ ও শিশু-কিশোরদের ০.৮ ভাগ মাদকাক্তির সমস্যায় ভুগছে। এটুকু বলা যায় এ হার বাস্তব অবস্থার খন্ডচিত্র মাত্র। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রয়ণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী এ সংখ্যা প্রায় অর্ধকোটি যাদের শতকারা ৮০ ভাগের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরেরে মধ্যে (ক্রোড়পত্র ২৬ জুন, ২০১২)। বিপুল এ জনগোষ্ঠীর চিকিৎসাসেবার জন্য সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র আছে শুধুমাত্র ঢাকা, চট্রগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, যশোর ও কুমিল্লায় যা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য। অথচ প্রত্যেকটি জেলায় এ ধরনের সরকারি নিরাময় কেন্দ্র থাকা জরুরি। বেসরকারি চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোর বড় অংশের সরকারি অনুমোদন নেই এবং চিকিৎসার জন্য ন্যূনতম সেবার পরিবেশ ও মনোচিকিৎসক নেই। লাইসেন্সবিহীন বেশিরভাগ এ সব নিরাময় ও তথাকথিত পুর্নবাসন কেন্দ্র পরিচালনা করে থাকে সাবেক মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা যাদের এ বিষয়ে কোনও দক্ষতা ও জ্ঞান নেই।

তৃণমূল পর্যায়ের মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা কীভাবে প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা ও তথ্য পাবে সে বিষয়ে বর্তমানে কোনও দিকনির্দেশনা নেই। এ জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সিটিজেন চার্টারে অন্যান্য রোগের মতো মানসিক রোগ ও মাদকাসক্তি বিষয়টিও অর্ন্তভূক্ত হওয়া জরুরি। আশার কথা হচ্ছে সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসেনসিয়াল সার্ভিস ডিপার্টমেন্ট কর্তৃক নার্স, প্যারামেডিক্স ও সাকমোদের (পূর্বনাম চিকিৎসা সহকারী) জন্য মানসিক রোগ বিষয়ক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে মাদকাসক্তি বিষয়টি অর্ন্তভূক্ত করা হয়েছে যা তৃণমূল পর্যায়ে মাদকাসক্তি চিকিৎসা ও প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। আর চিকিৎসাপ্রাপ্তি সহজ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় করা প্রয়োজন।

মাদকাসক্তি চিকিৎসার প্রথম ধাপ হচ্ছে চিকিৎসাগ্রহণের প্রয়োজনীয়তা ব্যাখা করে চিকিৎসাগ্রহণে মাদকাসক্ত ব্যক্তি ও পরিবারকে উদ্বুদ্ধ করা। অনেকসময় জোরপূর্বক চিকিৎসাগ্রহণে বাধ্য করা হয়ে থাকে যেটি খুব একটা ফলপ্রসূ হয় না। তবে এভাবে চিকিৎসাসেবার আওতায় নিয়ে আসতে পারলে অনেক সময় মাদকাসক্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিতে উদ্ধুদ্ধ হয়। পরবর্তী ধাপে মাদকের ধরন অনুযায়ী ধীরে ধীরে অথবা তাৎক্ষণিকভাবে মাদক পরিহারের পরিকল্পনা নেয়া হয় যেটিকে ডিটক্সিফিকেশন বা শরীর থেকে মাদকের বিষক্রিয়া দূরীকরণ বলা হয়। অনেক সময় (বিশেষত ওপিয়েটস জাতীয় মাদক হেরাইন, ফেন্সিডিল ইত্যাদি) মাদকাসক্তি নিরাময় হাসপাতালে ভর্তি ছাড়া এ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা যায় না। পরিবারের একটি ভ্রান্ত ধারণা থাকে যে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর (ডিটক্সিফিকেশনের পর) সে মাদক ছেড়ে দেবে। আসলে এটি মাদক-চিকিৎসার একটি প্রাথমিক ধাপমাত্র। এ রকম দেখা যায় যে, হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার কিছুদিন পর সে আবার মাদক নিচ্ছে।

পুর্নবার মাদকগ্রহণের জন্য হঠাৎ তৈরি হওয়া তীব্র আকাঙ্ক্ষা, মাদকগ্রহণ ও সংগ্রহের স্থান, ব্যক্তি বা সহযোগীর সঙ্গে দেখা হওয়া কিংবা মোবাইল ফোনে কথা বলা, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক সমস্যা, মানসিক রোগ যেমন উদ্বেগ, বিষণ্নতা, ও জটিল ধরনের মানসিক রোগ, যৌন-অক্ষমতা, বেকারত্ব ও পরিবারের সদস্যদের সন্দেহ-অবিশ্বাস ইত্যাদি কারণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য মাদকাসক্তি চিকিৎসার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ পুর্নবাসন। প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদী ও জটিল। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব প্রয়োজন। পুর্নবাসন-প্রক্রিয়ার সাফল্য নির্ভর করে এ বিষয়গুলোর সমাধানের ওপর। মনোসামাজিক চিকিৎসা (সাইকোথেরাপি ও কাউন্সেলিং) দীর্ঘমেয়াদী এ পুর্নবাসন প্রক্রিয়ার জন্য জরুরি। মাদকাসক্ত ব্যক্তি সুস্থ হওয়ার পরও সামাজিক নিগ্রহের শিকার হন যে কারণে সে সমাজ-বিচ্ছিন্নতায় ভোগে। এ জন্য সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন জরুরি। কারণ সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণ পুর্নবাসন-প্রক্রিয়ার একটি অনুষঙ্গ।

মাদকাসক্তি নিরাময় প্রক্রিয়াটি জটিল, ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য হওয়ায় প্রতিরোধই কার্যকর পন্থা। মাদকাসক্তি প্রতিরোধে মাদকের কুফল সম্পর্কে আরও জনসচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে যে তার সন্তান কার সঙ্গে চলাফেরা করছে, শিক্ষা-কার্যক্রমে নিয়মিত আছে কিনা। অনেকে সন্তানের হাতখরচের জন্য মাত্রাতিরিক্ত অর্থ দিয়ে থাকেন কিন্তু সেটি কী কাজে ব্যয় হচ্ছে তার কোনও খোঁজ নেন না। অভিভাবকদের সন্তানের সঙ্গে দূরত্ব কমিয়ে এনে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং তার মতামত ও সমস্যার কথা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। আভিভাবকত্বের বিষয়টি ভারসাম্যপূর্ণ হওয়া দরকার কারণ অতি-শাসন অথবা লাই দিয়ে মাথায় তোলা, দুটোই ক্ষতিকর।

যদি দেখা যায় ছেলে বা মেয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ অতিমাত্রায় রাগারাগি ও উত্তেজনা প্রকাশ করছে, দৃশ্যমান কারণ ছাড়াই অতিরিক্ত টাকা দাবি করছে ও না পেলে ভাঙচুর ও মারামারিতে জড়িয়ে পড়ছে, সারারাত জেগে থেকে সারাদিন ঘুমাচেছ, যখন-তখন অকারণে বাইরে যাচ্ছে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা, বেশভূষা ও স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি হচ্ছে, বেশি বেশি নতুন ও অজানা বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে চলাফেরা করছে, তাহলে মাদকাক্তির বিষয়টি সন্দেহের তালিকায় রাখতে হবে। নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরও খোঁজ নিতে হবে। প্রয়োজনে মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে মূত্রপরীক্ষা করাতে হবে। বেশ কিছুদিন আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের মা তার ছেলের মাদকাসক্তিজনিত সন্দেহজনক আচরণের কথা জানালে তাকে মনোচিকিৎসকের কাছে দেখা করার পরমর্শ দিলে সে তা প্রত্যাখ্যান করে ও সেই সঙ্গে ড্রাগ টেস্ট করাতেও অসম্মতি জানায়। এর কিছুদিন পর তাকে তার বন্ধুসহ মাদকসেবনরত অবস্থায় পুলিশ গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে তার অভিভাবককে জানায়। ভবিষ্যতে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি, চাকরিতে নিয়োগ ও পদোন্নতি, বিদেশগমন, বিয়ের জন্য পাত্র-পাত্রী নির্বাচনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগ্রহণের জন্য এ ধরনের ড্রাগ স্ক্রিনিং বা মাদকাসক্তি নির্ণয়ের পরীক্ষা অপরিহার্য উঠবে এ কথা বলা যায়। আর দ্রত মাদকাসক্তি নির্ণয় করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা গেলে এটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।

মাদকের পাচার রোধ ও এর কুফল সম্পর্কে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জাতিসংঘের মাদকবিরোধী সংস্থা ১৯৮৭ সাল থেকে প্রতি বছর ২৬ জুন মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার ও অবৈধ পাচার-বিরোধী দিবস পালন করে আসছে। এ সংস্থাটি 'বিশ্বব্যাপী মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলা' কার্যক্রম চালু করেছে। প্রতিবছরের মতো এবারও আমাদের দেশে দিবসটি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় পালিত হয় মাদকবিরোধী র‌্যালি, ক্রোড়পত্র প্রকাশ, সেমিনার ও আলোচনা সভা আয়োজনের মধ্য দিয়ে। মিডিয়াকে এ ব্যাপারে আরও সক্রিয় ও দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। তরুণ প্রজন্মকে মাদক থেকে দূরে রাখতে হলে তাদের জন্য খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকান্ড ও সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রাখা প্রয়োজন। ঢাকা শহরের ক'টি বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে খেলার মাঠ রয়েছে এ নিয়ে একটি জরিপ করা যেতে পারে। আর যুবসমাজের একটি বড় অংশ বেকার যারা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে অবস্থিত যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আত্মকর্মসংস্থানে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে। সম্প্র্রতি বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণী (নাম উল্লেখের প্রয়োজন নেই কারণ তারা এখন জাতীয় বীর) এভারেষ্ট জয় করে প্রমাণ করেছেন অ্যাডভেঞ্চারকে সুস্থ ও সৃজনশীল পথে পরিচালিত করা সম্ভব যা আমাদের দেশের যুবসমাজের জন্য একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত।

সীমান্তে মাদক-চোরাচালান রোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও তৎপর, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। কারণ আমাদের দেশ মাদক-চোরাচালানের রুটগুলোর মাঝামাঝি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের (১৯৯০) ধারাগুলো সময়োপযোগী করে এর যথাযথ প্রয়োগ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা গেলে মাদকের অপব্যবহার অনেকাংশে রোধ করা সম্ভব। মাদক-ব্যবসায়ী ও চোরাচালানকারীরা দেশ ও জাতির সবচেয়ে বড় শত্রু । এদের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন। মাদকব্যবহারের ধ্বংসাত্বক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং মাদকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে সমগ্র দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মাদকের করাল গ্রাস থেকে রক্ষা করতে মাদকমুক্ত সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার কোনও বিকল্প নেই।

ডাঃ জিল্লুর রহমান রতন: সহকারী অধ্যাপক, শিশু-কিশোর মানসিক রোগ বিভাগ, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।