দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে "মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই রাজনীতি প্রিয় প্রাণী" আর তাই বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে প্রিয় বিষয় রাজনীতি। মহল্লার চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কর্পোরেট অফিসের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ সর্বত্রই চলে এই রাজনীতি বিষয়ক আলোচনা। তবে এই রাজনীতি বিষয়ক আলোচনাগুলো বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই হয় নেতিবাচক আলোচনা। আলোচনা শুরু হয় রাজনীতি কতটা খারাপ সেই বিশ্লেষণ করে এবং শেষ হয় রাজনীতি থেকে আমাদের কতটা দূরে থাকা উচিৎ তা দিয়ে। খুব স্বাভাবিকভাবেই একজন শিশু ছোটবেলা থেকে রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক আলোচনা শুনতে শুনতে বড় হয় এবং তরুণ বয়সে এসে উপলব্ধি করে রাজনীতি থেকে তার কতটা দূরে থাকা উচিৎ। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করা তো দূরের কথা সেই তরুণের মধ্যে বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক সচেতনতাবোধ তৈরি হয় না। রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করাকে সে একধরনের অপরাধ বলে ভাবতে শেখে। রাজনীতি সচেতন হবার জন্য দুটি প্রশ্নের উত্তর সর্বপ্রথম জানা প্রয়োজন। এক, রাজনীতি কি? এবং দুই, রাজনৈতিক সচেতনতা বলতে কি বুঝায়?
প্রথমে বোঝার চেষ্টা করি রাজনীতি কি? রাজনীতি হচ্ছে সরকার পরিচালনার নিমিত্তে সমাজের ভিতর থেকে উদ্ভুত বিজ্ঞানভিত্তিক সংস্কৃতি, যার দ্বারা একটি নির্দিষ্ট সংস্থা বা কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্র পরিচালনা করে। রাজনীতির ইংরেজি "Politics" শব্দটি গ্রীক শব্দ "Politiká থেকে উদ্ভুত। এর সরল অর্থ, নগর বিষয়ক নীতিমালা বা বিষয়, যার দ্বারা মানবগোষ্ঠী কর্তৃক পরিচালিত হয় রাষ্ট্র এবং যা সমাজের মানুষের মাঝে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করে ও ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা করে। এক কথায় বলা যায়, রাষ্ট্র চালনার জন্যে কিছু নীতির প্রয়োজন রয়েছে, সেই নীতিগুলোই হল রাজনীতি।
এবার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হল রাজনৈতিক সচেতনতা কি? মোটা দাগে রাজনৈতিক সচেতনতা বলতে আমরা বুঝি রাজনীতি সম্পর্কে মৌলিক পড়া-শোনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো অধ্যয়ন এবং সমসাময়িক ঘটনা বিশ্লেষণ করে নিজের মধ্যে একটি রাজনৈতিক মতামত সৃষ্টি করা। তবে বর্তমানে অনেকে রাজনৈতিক সচেতনতা বলতে বুঝে থাকেন নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে সেই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের আদর্শ, চেতনা ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করাকে। এটি একেবারেই ভুল ধারনা। একটি বিষয় মনে রাখতে হবে যে, রাজনীতি সচেতনতা এবং রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন হওয়া জরুরী; কিন্তু একজন রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিকে রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা জরুরী নয়। তিনি তার অবস্থান থেকে যোগ্য ব্যক্তিকে ভোট প্রদানের মাধ্যমে রাজনীতিতে গুণগত মান পরিবর্তনে সহায়তা করতে পারেন।
রাজনৈতিক অসচেতনতার কুফল ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্র সবাইকে সমভাবে বহন করতে হয়। রাজনৈতিক অসচেতনতার কুফল বর্ণনা করতে গিয়ে প্লেটো বলেন "রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করার জন্য একটি দণ্ড হচ্ছে যে আপনি আপনার চেয়ে কম যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তি দ্বারা শাসিত হবেন"। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যেকোনোভাবে করা যায়। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পরোক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সামিল। একজন মেধাবী তরুণ যখন রাজনৈতিক অসচেতনতা কারণে রাজনীতিবিমুখ হয়ে যাচ্ছেন তখন ফলশ্রুতিতে একজন কম যোগ্যতা সম্পন্ন তরুণ রাজনীতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নীতিনির্ধারক পর্যায়ে চলে আসছেন। আর কম যোগ্যতা সম্পন্ন সেই নীতিনির্ধারক ব্যক্তি খুব স্বাভাবিকভাবে অপেক্ষাকৃত দুর্বল নীতি প্রণয়ন করছেন। সেই দুর্বল নীতির কারণে মেধাবী ব্যক্তিরা হতাশ হয়ে অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। ফলে মেধা পাচার এবং দুর্বল নীতির ভার সইতে হচ্ছে সমাজ এবং রাষ্ট্রকে।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অবশ্যই রাষ্ট্র পরিচালনা করবেন রাজনীতিবিদেরা। এই গুরুদায়িত্ব তাদেরই যারা জনসেবা ও মানবকল্যাণকে ব্রত হিসেবে নিয়েছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়, যে পদ্ধতিতে জনগণের সম্মতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়, রাজনীতিবিদেরাই জনপ্রতিনিধি হিসেবে শাসনকার্য পরিচালনা করবেন। তবে 'প্রতিনিধিত্বশীল' গণতন্ত্রের পরিবর্তে 'অংশগ্রহণমূলক' গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রশাসনের সকল স্তরে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণও নিশ্চিত করা আবশ্যক।
রাজনীতি হলো মানবকল্যাণ সাধনের পরীক্ষিত পদ্ধতি। এটিকে 'আর্ট অব কম্প্রোমাইজ' বা সমঝোতায় পৌঁছার কলাকৌশল হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। রাজনৈতিক প্রক্রিয়াতেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নীতিনির্ধারণী ও নীতি বাস্তবায়নসংক্রান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছা যায়। এই ধরনের সিদ্ধান্ত জীবন-জীবিকা ও নিরাপত্তাসহ নাগরিকের জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। তাই এগুলো নিয়ে মাথা ঘামানো নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত। প্রসঙ্গত, একটি স্বাধীন দেশে নাগরিকের শুধু অধিকারই থাকে না, তার দায়িত্ব-কর্তব্যও থাকে। রাজনীতিকে কার্যকর ও জনকল্যাণমুখী করে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে অবদান রাখা যার অন্যতম দায়িত্ব-কর্তব্য। আর এই লক্ষ্যে উদ্যোগ নেওয়াও এই দায়িত্ব-কর্তব্যের আওতাভুক্ত। তাই যত বেশিসংখ্যক মেধাবী তরুণ রাজনৈতিক সচেতনতাবোধের ভিত্তিতে মতামত প্রকাশ ও কার্যকর উদ্যোগ নেবেন, রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের জন্য তত বেশি মঙ্গলকর হবে।
তবে তরুণদের মধ্যে এই যে রাজনীতির প্রতি অনীহা বা বিমুখতার দায় তা কি শুধু তরুণ সম্প্রদায়েরই? অবশ্যই না, এর দায় রাষ্ট্র নিজেও কখনও এড়াতে পারে না। ছাত্র সংসদ নির্বাচন বন্ধ করে শিক্ষাঙ্গনে গণতান্ত্রিক চর্চা ব্যহত করা, ছাত্র রাজনীতির নামে দলীয় লেজুড়বৃত্তি, শক্তি প্রদর্শনের মহড়া, টেন্ডারবাজী, ছাত্র রাজনীতির নেতৃত্ব অছাত্রদের হাতে তুলে দেয়া, বেকারত্ব বৃদ্ধি, কর্মসংস্থানের অভাব প্রভৃতি বিষয়গুলো তরুণদের করেছে হতাশ, করেছে রাজনীতি বিমুখ। রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় এই সব অনাকাঙ্ক্ষিত সংস্কৃতি চালুর দায় রাষ্ট্র কখনই এড়াতে পারে না।
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মূল ফ্যাক্টর হবে দেশের তরুণ ভোটাররা। নবম সংসদ নির্বাচন থেকে এ পর্যন্ত ভোটার তালিকায় যুক্ত হওয়া ২ কোটি ৩৫ লাখের বেশি তরুণ ভোটারের হাতেই আগামী দিনের ক্ষমতার চাবি। তাই দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই তরুণদের নির্বাচিত নেতৃত্বের উপর। সঠিক নেতৃত্ব তখনই নির্বাচন করা সম্ভব হবে যখন তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। তরুণরা যখন রাজনৈতিকভাবে আরও সচেতন হবে তখন স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাদেরকে নিয়ে আরও গভীরভাবে ভাবতে শুরু করবে। তরুণ সম্প্রদায়ের ভোট পাবার আশায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ইশতেহারে তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য জন-বান্ধব ও দেশ-বান্ধব কর্মসূচি দিতে বাধ্য হবে। ফলে রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক আমূল পরিবর্তন আসবে।
পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোকেও উপলব্ধি করতে হবে যে, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের নেতৃত্ব এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব এই তরুণরাই দিবে। তাই বাংলাদেশের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার স্বার্থে এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের অস্তিত্বের স্বার্থে মেধাবী তরুণদের রাজনীতিতে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ অংশগ্রহণ করা খুব জরুরী। আজ যারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ পর্যায়ে রয়েছেন তাদের বেশিরভাগই হয় ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করা অথবা ১৯৯০ সালে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করা রাজনৈতিক সচেতন প্রজন্ম থেকে উঠে এসেছেন। তাই মেধাবী তরুণদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করাতে রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে তরুণদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, নিজের পায়ে দাঁড়াতে বিশেষ ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা, বেকার ভাতাসহ নানা প্লাটফর্মে তরুণদের কাজে লাগানোর সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা উল্লেখ করা থাকতে হবে।
এ কথা অনস্বীকার্য যে, যেই রাজনৈতিক দলে যত বেশী মেধাবী তরুণের সন্নিবেশ ঘটবে সেই রাজনৈতিক দল তত বেশী সমৃদ্ধ হবে এবং তাদের ক্ষমতায় যাবার পথ তত বেশী সুগম হবে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের স্বার্থে হলেও উচিৎ রাজনীতিতে মেধাবী তরুণদের অংশগ্রহণের পথ সুগম করা।
সবশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের তরুণদের রয়েছে গৌরবজ্জল ইতিহাস। বাংলাদেশের প্রতিটি আন্দোলন, প্রতিটি অর্জনের পিছনে রয়েছে তরুণ সম্প্রদায়ের অবদান, তাদের আত্মত্যাগের ইতিহাস। আবার এই তরুণ সম্প্রদায়কে ভুল পথে পরিচালনার নজীরও রয়েছে। কখনও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে , কখনও বা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে এই ভুল পথের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালারা তরুণদের করেছে বিপথগামী। তাই সিদ্ধান্ত তরুণ সম্প্রদায়কে নিতে হবে তারা কেমন বাংলাদেশ দেখতে চায়? কেমন নেতৃত্বের কাছে সঁপে দিতে চায় আগামীর বাংলাদেশকে? এই তরুণ সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করছে আমাদের বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।