বিএনপির সঠিক সিদ্ধান্ত ও অভ্যন্তরীণ টানাপড়েন

স্বদেশ রায়
Published : 14 May 2019, 01:43 PM
Updated : 14 May 2019, 01:43 PM

২০০১ এ বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় যাবার পরে বিএনপির অনেকটা মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তারা একের পর এক ভুল সিদ্ধান্ত নিতে থাকে। সেখান থেকে বলা যেতে পারে ২০১৮ এর নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্তের আগে তারা যত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সবই হঠকারী রাজনীতির সিদ্ধান্ত ও অনেকগুলো সন্ত্রাসী রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্ত।

যাহোক, ২০১৮ এর ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে যাবার সিদ্ধান্ত ছিল তাদের জন্যে একটি পজিটিভ রাজনীতির সিদ্ধান্ত। নির্বাচনে তাদের ফল যা হয়েছে, সেটা বিশ্লেষণ না গিয়ে বলবো, তারা আবার ভুল করতে যাচ্ছিল সংসদে না যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে। নির্বাচনের পরে তারা যে শপথ নিয়ে একশ দিনের বেশি দেরি করেছে এটা কোনও বিষয় নয়। এমনকি নির্বাচনের পরে পরেই তারা সংসদে না যাবার কথা বলেছিল- এটাও কোনও ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। কারণ, ওটাই ছিল বাস্তবতা।

নির্বাচনে অমন খারাপ ফল করার পরে স্বাভাবিকই ওই সময়ে তাদের কর্মীরা ছিল বিধ্বস্ত ও বিক্ষিপ্ত মনের। ওই অবস্থায় কোনও নেতার পক্ষে বলা সম্ভব থাকে না তারা সংসদে যাবে। তারা কিছুটা সময় নিয়েছে। কর্মীদের একটু থিতু হতে সময় দিয়েছে- এটা তারা যথার্থই করেছে। এমনকি কোনও নেতা আগের থেকে না বলে তাদের সংসদ সদস্যরা যে নিজেরাই শপথ নিতে গেছে এটাও সঠিক। কারণ, কোনও নেতা আগের থেকে যদি বলতেন, তাদের সংসদে যাবার সিদ্ধান্ত হয়েছে তাহলে অন্য অনেক নেতা তাকে দলের ভেতর সরকারের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করতেন। এ কারণে তারা যেভাবে কাজটি করেছে তা অনেক স্মার্ট পথই বলা যায়। একজন আগে শপথ নিয়েছেন।

তার শপথের ভেতর দিয়ে কর্মীদের মানসিক অবস্থা তারা বুঝে নিয়েছে। তারা দেখতে পেয়েছে, সময় চলে যাওয়াতে কর্মীদের মন অনেক থিতু হয়েছে। কর্মীরা বড় ধরনের বা ভয়ংকর ধরনের কোনও প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। এমনকি ফেইসবুকের মতো সোশাল মাধ্যমেও তারা নিরব ছিল। এর পরে নেতারা মিটিং করে সংসদে না যাবার সিদ্ধান্ত জনসম্মুখে এনে এমন একটি  পরিবেশ সৃষ্টি করেছে যে নেতারা কেউ সংসদে যাবার পক্ষে নয়। অর্থাৎ কোনও নেতা তাদের কর্মীদের সামনে এ দায় ঘাড়ে নেননি। নির্বাচিত চার জনের ওপর দায় চাপান। আবার তারা শপথ নেবার সঙ্গে সঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক সংবাদ সম্মেলন করে সকলকে জানিয়ে দেন এটা তাদের মূল নেতা তারেক রহমানের সম্মতিতে ঘটেছে। তার ফলে বিষয়টি দলের সিদ্ধান্ত হিসেবেই চিহ্নিত হয়েছে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, দলের মহাসচিবকে শপথ নেয়া থেকে বিরত রাখা হলো কেন? এর উত্তরও খোঁজা যেতে পারে এইভাবে- দলের ভেতর সংসদে না যাবার পক্ষে বড় একটি অংশ ছিল। কর্মীদের ভেতরও তাই। এই দুইয়ের রোষানলে যাতে দলের মহাসচিব না পড়েন, এ জন্যে এ ব্যবস্থা। যতদূর শোনা যাচ্ছে, তারেক রহমানকে যেমন তাদের দলের একটি বুদ্ধিজীবী মহল বুঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন যে এ মুহূর্তে সংসদে যাওয়া উচিত। তারেক পরে সম্মতি দিয়েছেন।

তেমনি হয়তো মহাসচিবও তারেক রহমানকে বোঝাতে পেরেছেন, তার সংসদে যাওয়া উচিত হবে না। সংসদে গেলে তিনি এক গ্রুপের মহাসচিব হয়ে যাবেন। আর সংসদে না গেলে তিনি সকলের মহাসচিব থাকতে পারবেন। তারেক রহমান কোনটা বুঝেছেন, সেটা  বলতে পারবো না। তবে যতদূর জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব যা কিছু করেছেন তারেক রহমানের সম্মতিতে করেছেন। আর এর থেকে প্রমাণিত হয় মহাসচিবের ওপর তারেক রহমানের এখনও আস্থা আছে।

মহাসচিবের প্রতি তারেক রহমানের এই আস্থা অবশ্য দলে তারেকপন্থি বিশেষ করে পল্টনকেন্দ্রিক রিজভী গ্রুপকে বেশ আশাহত করেছে। তবে তারাও যে একেবারে আশাহত হয়েছে তা নয়। কারণ, তারা ইতোমধ্যে দেখতে পাচ্ছে তারেক রহমান মহাসচিবকে কোনও কিছু না জানিয়ে দলের নানান স্তরে স্কাইপেতে যোগাযোগ করছেন। আর তারেক রহমান যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন, তাদের অধিকাংশই গ্রাসরুটের এবং তারা বয়সে নবীন। মহাসচিব ও দলের সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে বা তাদেরকে কোনও কিছু না জানিয়ে সরাসরি তারেক রহমানের এই যোগযোগ মহাসচিব ও দলের সিনিয়র নেতারা মোটেই ভালোভাবে নিচ্ছেন না। তারা এটাকে দলের 'চেইন অব কমান্ড' নষ্ট হিসেবে দেখছেন। অথচ তারা তারেক রহমানকে কিছু বলতে পারছেন না। মহাসচিব সহ দলের সিনিয়রদের এই অসহায় অবস্থাকে অবশ্য মহাসচিব বিরোধী গ্রুপ তাদের এক ধরনের বিজয় হিসেবে দেখছে।

বিএনপির ভেতরে মহাসচিবসহ সিনিয়রদের নিয়ে এই টানাপড়েনের পাশাপাশি  আরো একটি টানাপড়েন এখন বেশ মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে তাহলো, ড. কামালকে নেতা মেনে ঐক্যফ্রন্ট করে নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে। দলের সাংগঠনিক সভায় এখন প্রকাশ্যে ড. কামালের নেতৃত্বে নির্বাচনে যাওয়া ভুল ছিল বলছেন অনেকে। এমনকি এক দল বলছেন, ড. কামাল মূলত এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। কেউ কেউ বলছেন, তিনি সরকারের এজেন্ট আর কেউ কেউ বলছেন ইন্ডিয়ার এজেন্ট। তাদের অনেকে এখন বলছেন, ঐক্যফ্রন্ট ভেঙ্গে দেবার জন্যে। তাছাড়া ঐক্যফ্রন্ট নিয়ে তাদের মহাসচিবের কী লাভ সে প্রশ্নও তারা তুলছেন? তাদের বক্তব্য হলো. বিএনপির মত একটি বড় দলের মহাসচিব কেন ড. কামাল, রব বা মান্নার মতো জনসমর্থনহীন নেতাদের পাশে গিয়ে কর্মীর মতো বসে থাকেন। তারা বিএনপির নিজস্ব একটি অস্তিত্ব খুঁজতে চায় বা সেটা গড়ে তুলতে বলে।

তবে এইসব নেতা ও কর্মীরা দেশের মানুষের পালস বুঝতে ভুল করছেন, না বিএনপির মহাসচিব ভুল করছেন- সেটা নিয়ে একটা বড় প্রশ্ন থেকেই যায়! বিএনপির নেতা কর্মীরা তাদের গত প্রায় তের বছরের অবস্থা দেখার পরে এখনও যদি মনে করেন তারা তাদের অতীতের অর্থাৎ জামায়াত-বিএনপির মিলিত জঙ্গি রাজনীতি নিয়ে রাজপথে এগিয়ে যেতে পারবেন তাহলে তারা ভুল করছেন। কারণ, যে দেশে এখন পয়সা ছাড়া জনসভায় লোক পাওয়া যায় না, সেখানে জামায়াত বিএনপির জঙ্গি কর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষ রাজপথে জঙ্গি আন্দোলন করতে যাবে- এমনটি ভাবার কোনও যুক্তি নেই। আর জামায়াত বিএনপির জঙ্গি কর্মীদের কোমর যে বর্তমান সরকার একেবারে ভেঙ্গে দুই টুকরো করে দিতে পেরেছে এ নিয়ে দ্বিধায় থাকারও কোন কারণ নেই। তাছাড়া জামায়াত ও বিএনপি ২০১২, ১৩, ১৫ যে জ্বালাও-পোড়াও করেছে তাতে তাদেরকে যে কোনও ভদ্রস্থ মুখের আড়ালে যেতে হবে, নাহয় নিজেদের একটা ভদ্রস্থ মুখ তৈরি করতে হবে এটাই স্বাভাবিক। এই ভদ্রস্থ মুখের খোঁজে তারা হয়তো ড. কামাল, রব, মান্না ও কাদের সিদ্দিকীর দ্বারস্থ হয়েছিল। তাতে কোনও লাভ হয়নি এখন সেটা প্রমাণিত হয়ে গেছে।

এই সত্য বুঝেই বিএনপি সংসদে গেছে। তাছাড়া তারা যে মনে প্রাণে সংসদে গেছে তা বোঝা যাচ্ছে এখন তাদের মহিলা এমপি এর দৌড় দেখে। কারণ তারেক রহমানের পক্ষে উচ্চকণ্ঠ রুমিন ফারহানা, জেবা খান যেমন- তেমনি তারেক সমালোচক পাপিয়া আবার তাদের ঢাকার জনপ্রিয় নেত্রী আফরোজা আব্বাস সবাই এখন মহিলা এমপির দৌঁড়ে। এদের ভেতর থেকে একজন এমপি হবেন। অবশ্য সেটা বড় কথা নয়। যারা তাদের ফরেন রিলেশন কমিটিতে বসে দুদিন আগেও বিদেশিদের বোঝানোর চেষ্টা করেছেন এই নির্বাচন ও সংসদ যথার্থ নয়। তারা এখন সংসদে যাবার জন্যে দিন রাত ছোটাছুটি করছেন। তাদের এই দৌড় দেখে বোঝা যায়, বিএনপি সংসদকেই এ মুহূর্তে তাদের মূল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ধরছে।

বিএনপি যদি সংসদকে তাদের মূল রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ধরে তাহলে তারা সংখ্যায় যাই থাকুক না কেন, এটা তাদের জন্যে সঠিক রাজনীতি। কারণ, ১৯৭৯ আওয়ামী লীগের মাত্র ৩৯ জন সংসদ সদস্য ছিলেন পার্লামেন্টে। সে সময়ে আসাদুজ্জামান, ইয়াজুদ্দিন প্রামানিকসহ অনেকেই প্রতিদিন সংবাদ হতেন সংসদ চলাকালে। শুধু তাই নয়, ওই পার্লামেন্টে তারা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন জিয়াউর রহমানের সবুজ বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, খাদ্যাভাবে উত্তরবঙ্গে মেয়েরা পতিতাবৃত্তিতে নাম লেখাচ্ছে। তার ডকুমেন্টস সংসদে উপস্থিত করেছিলেন। এবং সে সময়ের গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র সংবাদ ও ইত্তেফাকে সে নিউজ ছাপা হয়েছিল। যতদূর মনে পড়ে আজাদ পত্রিকায়ও ছাপা হয়েছিলো। এছাড়া জিয়াউর রহমান মারা গেলে তার যে সুইস ব্যাংকে টাকা ছিল, সেটার অ্যাকাউন্ট নম্বরসহ প্রমাণ হাজির করেন সংসদ সদস্য সুধাংশ শেখর হালদার। তাই সংসদ অনেক বড় ও পাওয়ারফুল জায়গা। বিএনপি নিজেদের টানাপড়েন সঙ্গে নিয়েও যদি জোট বা ফ্রন্ট এ সব খেলায় না মেতে, এভাবে সংসদের পথে হাঁটে নিশ্চয়ই এটা তাদের সঠিক সিদ্ধান্ত।