বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং নিয়ে কেন আস্ফালন?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 13 May 2019, 02:33 PM
Updated : 13 May 2019, 02:33 PM

বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং নিয়ে গত কয়েকদিন বাংলাদেশে ব্যাপক আলোচনা চলছে। গণমাধ্যমে আসা একটি খবর নিয়ে 'বিশ্ববিদ্যালয় গেল গেল' বলে চারিদিকে রব উঠেছে।

বলা হচ্ছে, এই র‌্যাঙ্কিংখ্যাতিতে ধস নামায় আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা উচ্ছন্নে গেছে। শিক্ষকরা সিঙ্গারা নিয়ে গর্ব করলেও বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গর্ব করার সুযোগ কম পাওয়ায় আমাদের এই দৈন্যতা এনে দিয়েছে।

আর কত যে কথাবার্তা চারিদিকে ছড়িয়ে গেছে তার কোন ইয়ত্তা নেই। আমাদের আলোচনার ধরন দেখে যে কেউ বলবে, মনে হয় কয়েকদিন আগেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাঙ্কিং সূচকে এগিয়ে ছিল, আর এখন সেই তালিকায় নেই।

আসলে কি তাই? বাংলাদেশের কবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় কোন খ্যাতির জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের র‌্যাঙ্কিং নাম তুলেছে শুনি? কেন এই বিষয়টা নিয়ে আমাদের আহামরি আলোচনার খোড়াক জোগাচ্ছে? বাংলাদেশের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং কতটা জরুরি? এইসব বিষয় আলোচনার আগে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় বিষয়ক র‌্যাঙ্কিং ধারণার স্বচ্ছতা থাকা প্রয়োজন। তা না হলে, চিলে কান নিয়ে গিয়েছে, বলে চিলের পিছনে ছুটতে থাকবো।

বিশ্বে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে র‌্যাঙ্কিং প্রকাশ করে তাদের মধ্যে অন্যতম হলো 'টাইমস হাইয়ার এডুকেশন (টিএইচই বা দি), চীনের সাংহাই বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক 'অ্যাকাডেমিক র‌্যাঙ্কিং অব ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটিস (এইআরডব্লিউইউ বা আরু), ওয়াল্ড ইউনিভার্সিটি র‌্যাঙ্কিং (কিউএস), ইউএস নিউজ র‌্যাঙ্কিং এবং ওয়েবমেট্রিক্স র‌্যাঙ্কিং।

এইসবের মধ্যে সম্প্রতি সারা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি পরিচিতি পেয়েছে টাইমস হাইয়ার এডুকেশন (টিএইচই বা দি)। আর তাদের গত পহেলা মে সর্বশেষ করা এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে বেশি। বলা হচ্ছে, দি-জরিপে এশিয়ার চারশোর অধিক বিশ্ববিদ্যালয় নিজেদের নাম উঠাতে পারলেও বাংলাদেশের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় স্থান পায়নি। পক্ষান্তরে পাকিস্তান, নেপাল এই তালিকায় নাম তুলে শিক্ষার চৌদ্দগোষ্ঠি উদ্ধার করেছে।

২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের কর্মচারীদের (সিবিআই) নেতা রিচার্ড ল্যাম্বার্ড তার 'the Lambert Review of Business-University Collaboration' এক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কি বিষয়ক ধারণা দেন। মূলত  এরপর থেকে র‌্যাঙ্কিং  নিয়ে সারা বিশ্বে মাতামাতি।

২০০৪ সালে সর্ব প্রথম টাইমস হাইয়ার এডুকেশন যাত্রা শুরুর পর তাদের সর্বশেষ পঞ্চাদশ সংখ্যায় (২০১৯) বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং করেছে তার মধ্যে প্রথম ২০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে ৬০টি, যুক্তরাজ্যের ২৯টি, জার্মানির ২৩, নেদারল্যান্ডস এর ১২টি,  অস্ট্রেলিয়া ও কানাডার ৯টি করে, চীন ও সুইজারল্যান্ডের ৭টি করে এবং জাপানের ২টি বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, হংকং ৫টি বিশ্ববিদ্যালয় ও তাইওয়ানের ১টি বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও আমাদের প্রতিবেশী ভারতের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ই নেই।

আমরা সব সময় সুপারফিশিয়াল কিংবা আবছা আবছা কথা বলতে বেশি পছন্দ করি। ভিতরে যাওয়ার চেষ্টাটুকু করি না। আমাদের গণমাধ্যমগুলো সেই জায়গায় গিয়ে সুরসুরি দেয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং নিয়ে আস্ফালনের ডামাডোলে আমাদের শিক্ষা বিষয়ক আলোচনাটাই গোড়ায় মারা পড়ে। ফলে, আমরা দুইদিন পর পর র‌্যাঙ্কিং রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ি।

টাইমস হাইয়ার এডুকেশন (টিএইচই বা দি) যে কৌশলে তাদের তালিকা প্রকাশ করে সেই কৌশলের ধারকাছে আপাতত কয়েক দশকের মধ্যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যায়নি কিংবা যাওয়ার চেষ্টা করেনি। সুতরাং বলা চলে আপাতত র‌্যাঙ্কিং নিয়ে মাতামাতি করার কোনও প্রশ্নেই আসে না।

টাইমস হাইয়ার এডুকেশন (টিএইচই বা দি) যেসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তালিকা প্রকাশ করে সেইগুলো কয়েকটি ক্যাটাগরিতে প্রকাশ করে। সারা বিশ্বের র‌্যাঙ্কিং, ইউরোপীয় র‌্যাঙ্কিং কিংবা এশিয়ার র‌্যাঙ্কিং নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ চমকপ্রদ তথ্য উপস্থাপন করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে।

বিশ্বের ২০ হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এই তালিকায় হিসেব করা হয় বড়জোড় ৭০০ কিংবা ৮০০ বিশ্ববিদ্যালয়কে। তাই বলে বাকী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মূল্যহীন?

মোটেই নয়। টাইমস হাইয়ার এডুকেশন (টিএইচই বা দি) উদ্দেশ্যে হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ নিতে যাওয়া শিক্ষার্থীদের কাছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান আগেই পরিচয় করে দেয়া। আর সেই লক্ষ্য নিয়ে র‌্যাঙ্কিং নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সচেতন হয়ে পড়ে।

আপনি যদি 'কিএস' করা বিশ্ব র‌্যাঙ্কিং দেখেন ( হাইপার লিংক https://www.topuniversities.com/university-rankings/employability-rankings/2019)  তাহলে সেখানে গিয়ে দেখবেন বর্তমানে মাসাচুয়েটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি বা এমআইটি প্রথম স্থানে রয়েছে। অপরদিকে টাইমস হাইয়ার এডুকেশনে করা তালিকায় এমআইটিকে রাখা হয়েছে চার নম্বরে।

অন্যদিকে টাইমস হাইয়ার এডুকেশনে (হাইপারলিংক  https://www.timeshighereducation.com/world-university-rankings/2019/world-ranking#!/page/0/length/25/sort_by/scores_overall/sort_order/asc/cols/scores)  প্রথম স্থানে রয়েছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, যা কিএস তালিকায় গিয়ে ১০ নাম্বারে ঠেকেছে।

ঠিক তেমনি কিএস মত এমআইটি ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম ও দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও আরু করা তালিকায় প্রথম স্থানে এসেছে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর দ্বিতীয় স্থানে স্ট্যামফার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ( হাইপার লিংক-http://www.shanghairanking.com/ARWU2018.html)

আর এইসব তালিকায় যে তিন বা চারশ বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম তোলা হয়, সেই নামগুলো প্রায় সবগুলো র‌্যাঙ্কিং প্রতিষ্ঠানে থাকে বৈ কি।

এখন স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে, র‌্যাঙ্কি নিয়ে কেন এতো হেরফের? কেন সব তালিকায় একই হয় না?

তার উত্তর অতি সহজ। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের একটি নিদিষ্ট নীতিমালা বা বিধি রয়েছে, সেই বিধিবিধানের আলোকে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যলয়ের র‌্যাঙ্কিং করা হচ্ছে।

আর পহেলা মে দি এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে তালিকা প্রকাশ করে সেখানে এশিয়ার সেরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে চীনের 'সিনহুয়া বিশ্ববিদ্যালয়' তালিকার শীর্ষে রয়েছে।  'ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর' দুই নম্বর অবস্থানে। তৃতীয় স্থানে রয়েছে 'হংকং ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি'। এছাড়াও চীনের ৭২টি, ভারতের ৪৯টি, তাইওয়ানের ৩২টি, পাকিস্তানের ৯টি, হংকংয়ের ৬টি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উঠে এসেছে।

টাইমস হাইয়ার এডুকেশনে বিশ্বের 'বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং' করার নিয়ম ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলে,  পাঠদান, গবেষণা, সাইটেশন বা প্রকাশিত গবেষণার অনুসরণ সংখ্যা, প্রতিষ্ঠানের আয় এবং আন্তজার্তিক পরিধিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচিতি। ১০০ নাম্বার নির্ধারণ করে ওইসব ক্যাটাগরিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং করা সহ সার্বিক তালিকা প্রকাশ করা হয়। আর এই জরিপে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‌্যাঙ্কিং করা হলেও বাংলাদেশ সেখানে 'নেই'।

পাঠদানে আবার শতকরা ২৫ নাম্বার, গবেষণায় ও সাইটেশনে ৩০ করে এবং প্রতিষ্ঠানের আয় এবং আন্তজার্তিক পরিধিতে সেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচিতিতে ৭ দশমিক ৫ করে নাম্বার ভাগ করে দেয়া হয়েছে।

শিক্ষায় পঠন-পাঠনের পরিবেশকে মূল্যায়ন দিতে গিয়ে তারা ২৫ শতাংশকে আবার ভাগ করে মানসম্পন্ন জরিপে ১০, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর অনুপাত শতকরা ৪ দশমিক ৫, পিএইচডি ও স্নাতকের অনুপাত ২ দশমিক ২৫, পিএইচডি প্রাপ্ত কর্মকর্তাদের হার ৬ এবং প্রতিষ্ঠানের আয়ের উপর ২ দশমিক ২৫ নম্বর দিয়ে এই ক্যাটাগরির মূল্যায়ন করতে বলেছে।

তাহলে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‌্যাঙ্কিং নেই? উত্তরটা সহজ, আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের যদি ৩০ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য ১২শ শিক্ষক থাকে তাহলে তার অনুপাত হবে ২৫ করে। আর শতকরায় ফেলালে তা দাঁড়াবে ০.৪। আর পিএইচডি শিক্ষার্থীদের অনুপাত বাদই দিলাম। সেটা যে লাজুক অবস্থায় তা বলবার অপেক্ষা রাখে না।

অপরদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডিধারী শিক্ষকদের সংখ্যা শতকরা কতজন তা হিসেবের বাহিরে। মাস্টার্স পাস করে যেখানে শিক্ষকতার সুযোগ মেলে সেখানে পিএইচডি ধরার মধ্যে পড়ে না।

এই তো গেল এক দিকে। গবেষণার জন্য যে শতকরা ৩০ নম্বর ধরা হয়েছে তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা করতে গিয়ে টাইমস হাইয়ার এডুকেশন বলছে, গবেষণার জন্য মানসম্পন্ন জরিপে শতকরা ১৫, গবেষণা থেকে প্রাপ্ত আয়ে ৭ দশমিক ৫ আর গবেষণার সাফল্যের জন্য ৭ দশমিক ৫ ভাগ।

সুতরাং আপনি বলুন আমাদের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন ৩০ নম্বর পাবে? আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে যেসব গবেষণা সাময়িকীগুলোতে প্রকাশ করা হয় তার সিংহভাগই আন্তজার্তিক মান ধারণ করে না। ভারতের সাময়িকী ভিত্তিক প্রকাশনাগুলো কেবল পদোন্নতির জন্য করা হয়। নেচার, সায়েন্স এর কথা বাদ দিলাম। আর গবেষণা থেকে আয়? সেটা কবে হয়েছে শুনি? আর আমাদের মান নিয়ে কবে কোন জার্নাল জরিপ করেছে?

এইসব শূন্যতাকে ঘিরে আপনি স্বপ্ন দেখেন আপনার বিশ্ববিদ্যালয় চারশো বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হতে পারলো না কেন?

আর সাইটেশনে যে ৩০ নাম্বার বরাদ্ধ করা হয়েছে সেটা কি আদৌও আমাদের ৪২টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন বিশ্ববিদ্যালয় টপকানোর ক্ষমতা রাখে? আপনার কোন গবেষণা প্রকাশের পর সেই গবেষণার মূল্যায়ন হয় মূলত অন্য কোন গবেষক আপনার গবেষণার প্রাপ্তিগুলো তার গবেষণায় ব্যবহার করছে কি না। আর সে যদি ব্যবহার করে, তবে অবশ্যই তা সাইটেশন বা রেফার করতে হয়।

২০১৩ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত গবেষণার সাইটেশনের উপর ভিত্তি করে তারা ২৫ নম্বর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেই ক্ষেত্রে 'দি' এলসিভার স্কুপাস থেকে সংরক্ষিত গবেষণাপত্রের সাইটেশন বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাঙ্কিং ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছে।

আর আন্তজার্তিক অঙ্গনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারা কতটা পরিচিতি লাভ করছে সেটাতে ৭ দশমিক ৫ নম্বর দিয়েছে। অথাৎ আমাদের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বাহিরের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে কতটা জড়িত তার মূল্যায়ন উঠে আসে সমন্বিত গবেষণা প্রকাশের মাধ্যমে। আর এই ক্যাটাগরিতেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উপস্থিতি তলানিতে।

আর আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আয়ের ধারা নেই বললেই চলে। সরকারের কাছ থেকে প্রতি বছর বরাদ্দ নেওয়ার সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আয় দেখালেও তা পরবর্তীতে ঘাটতিতে পরিণত হয়। কারণ, আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশনি ফি নেয়ার রীতি খুব কম। ১৫/৩০ টাকায় মাসিক বেতনে পড়াশুনা করার সুযোগ বিশ্বের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আছে।

তাই আয়ের খাতায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গড়ের মাঠ বটে।

সব হিসেব কষে কী মনে হচ্ছে আপনার? আমরা কি আদৌও এইসব র‌্যাঙ্কিং ফ্যাকিং যাওয়ার যোগ্যতা রাখি? মোটেই না।

যারা বলছে, আমরা মানসম্মত শিক্ষা দিই, শিক্ষকদের সংখ্যাও ভাল তারা হয়তো জানে না কাকে মানসম্মত শিক্ষা বলে? পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে উত্তরাধিকসূত্রে পাওয়া কয়েক যুগের প্রশ্ন কমন দেয়া হয়। আর তা পড়ে সিজিপিএ পারদ চড়ে যায়। সেই জায়গায় যদি বলেন, মানসম্মত শিক্ষা তাহলে আর বলার কিছু নেই?

গবেষণা? আমরা কি সত্যি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান তৈরির কারখানা মনে করি? যদি মনে করতাম, তাহলে আমাদের শিক্ষকরা কিভাবে রাত বিরাতে টকশো, রাজনৈতিক স্লোগান আর চাটুকারিতায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে? গবেষণায় উদাসিনতার দরুন তারা আজ 'শিক্ষক রাজনীতি' নিয়ে মানসম্মত শিক্ষা দেয়ার কথা মুখে চড়ায়।

৬০ কোটি টাকা যদি ৪২ টি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার জন্য বরাদ্ধ দেয়া হয় তাহলে সেখান থেকে কয়েক লাখ শিক্ষার্থী কিভাবে গবেষণা করার সুযোগ পাবে বলুন? দেড় কোটি টাকা দিয়ে তো একটি আন্তজার্তিক প্রজেক্ট নামানোই দুরূহ, সেখানে কিভাবে ৫২টি বিভাগে গবেষণা চলবে শুনি?

র‌্যাঙ্কিং স্বপ্ন আমাদের জন্য নয়। আমরা র‌্যাঙ্কিং ওঠার জন্য যোগ্য নই। আমাদের নড়বড়ে মেশিন দিয়ে বৃহৎ বগি টানা সম্ভবপর হবে না। কারণ, আমরা গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ বলতে পত্রিকায় লেখা কলামকে বুঝি। আমরা পিএইচডি বলতে, বিদেশিদের গবেষণাকে নিজের নামে চালিয়ে দেয়াকে বুঝি। সৃজনশীল মানুষ গড়ার পরিবর্তে আমরা মুলত এমন একটি সমাজ গড়তে চাচ্ছি 'যেখান সহমত ভাই' বলে নিজেদের জ্ঞানের চর্চা করে ফেলছি।

তাই র‌্যাঙ্কিং নিয়ে বুক ফুলিয়ে তোলার পরিবর্তে সিঙ্গারা বিক্রিতে দক্ষতা অর্জন করে ফেলছি। এইগুলো আমাদের প্রাপ্য ছিল না। আমাদের অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার কথা। আমরা নিজেদের কারণে নিজেরা পিছিয়ে পড়ছি। র‌্যাঙ্কিং নিয়ে ভ্রান্ত ধারণা আমাদের ভিতর ঢুকে পড়ছে। এটা নিয়ে আপাতত আমাদের চুপ থাকাই শ্রেয়।

আজকে র‌্যাঙ্কিং করলে দেখা যাবে আমাদের কোন এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে টপকিয়ে গেছে। তখন কেউ মানবে না, যে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের এতো বাঘা বাঘা নামি-দামি শিক্ষকরা তাহলে কী করেন?

সময় এসেছে সাবধানতার। শিক্ষার মান নিয়ে নাকানিচুবানি ইতিমধ্যে আমরা খেতে শুরু করেছি। রাজনৈতিক দুষ্টাচারে শিক্ষকদের 'মানদণ্ড' যেমন তলানিতে গিয়ে ঠেকছে তেমনি আমাদের শিক্ষার্থীরাও এই বলয়ের বাইরে নয়।

সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বের দরবারে নিজেদের পরিচিতি তুলতে হলে সরকারকে গবেষণাখাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। ইতিমধ্যে সরকারের কিছুটা সুমতি আসছে, আগামীতেও তা ধরে রাখতে হবে। আমাদের মেধাবী ছেলে-মেয়েরা দেশের বাহিরে যদি নিজেদের সেরাটা দেখাতে পারে তাহলে আমাদের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে পারবে না? আসুন র‌্যাঙ্কিং নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান নিয়ে কথা বলি, গবেষণার ফল নিয়ে আলোচনা করি।