নেদারল্যান্ডসে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারাগার, আর বাংলাদেশে বাড়ছে!

গোলাম কিবরিয়া পিনুগোলাম কিবরিয়া পিনু
Published : 10 May 2019, 01:51 PM
Updated : 10 May 2019, 01:51 PM

অপরাধী না থাকার কারণে এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে নেদারল্যান্ডসে কারাগারগুলো। অপরাধীর সঙ্কটে এ পর্যন্ত মোট ১৮টি কারাগার বন্ধ করে দিয়েছে সরকার। আশ্চর্য মনে হলেও এমন উদাহরণ সৃষ্টি করেছে ইউরোপের দেশ নেদারল্যান্ডস!

আর আমাদের বাংলাদেশে নতুন নতুন কারাগার তৈরি করেও স্থান সংকুলান হচ্ছে না কয়েদির! এইতো কিছুদিন আরও একটি বড় কারাগার কেরানীগঞ্জে চালু হলো। কিছুদিন আগের এক পরিসংখ্যানে জানা যায়- বর্তমানে দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার ৩৪ হাজার ৭৯৬ জনের বিপরীতে ৬৯ হাজার ৭৭৪ জন বন্দি রয়েছেন। তবে তা প্রতিদিন বেড়ে চলেছে। বিশেষ সময়ে বিশেষ অভিযানে হাজার হাজার বন্দির জায়গার সংস্থান করতে হয় আবার কারাগারে!

নেদারল্যান্ডস ও বাংলাদেশের উল্লিখিত এইসব পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিচার থেকে থেকে বোঝা যায়, আমাদের দেশে অপরাধপ্রবণতা কতটা সামাজিক ক্ষত হিসেবে জায়গা দখল করে আছে! আমরা কতটা সভ্য ও উন্নত হয়ে এখানে জীবনের স্বাদ গ্রহণ করছি। আমাদের নাগরিক দায়িত্ব ও কর্তব্যের জায়গাটা কতটা নৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। রাষ্ট্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও সমাজের অন্যান্য সংগঠন আমরা কতটা আমাদের গড়ে তুলছি- সুসভ্য মানুষ হিসেবে!

নেদারল্যান্ডসে এমনি এমনি এটা হয়নি। এর পেছনে দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও উদ্যোগ রয়েছে। জেলে পচিয়ে শাস্তি  দেওয়ার দিকে না ঝুঁকে বরং দোষীকে সামাজিক কাজেই ব্যবহার করেই তাকে মূল স্রোতে ফেরানো হয়। নেদারল্যান্ডসে প্রযুক্তির সাহায্যে অপরাধীদের ওপর নজর রাখা হয়। অন্যদিকে সামাজিক এবং দৈনন্দিন কাজে উৎসাহ দেওয়া হয় দোষীদের। শুধু তাই নয়- নেদারল্যান্ডসের মানুষের মধ্যে সামাজিক অভিন্ন কিছু দৃষ্টিভঙ্গি দৃঢ়ভাবে তৈরি হয়েছে, নৈতিকবোধ তাদের মধ্যে উন্নত ও দৃঢ়, যা তাদের মধ্যে অপরাধ প্রবণতা কমিয়ে ফেলেছে। এছাড়া ব্যক্তির শৃংখলাবোধ ও ব্যক্তির স্বাধীকারবোধ এবং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের দায়, ঠিক তেমনি ব্যক্তির প্রতি রাষ্ট্রের দায়, যা সমন্বিতভাবে একীভূত হয়ে সামগ্রীকভাবে মানুষের কল্যাণের পথকে প্রশস্ত করেছে।

নেদারল্যান্ডস গণতন্ত্রের চর্চায় দীর্ঘদিন হলো এক ধরনের শাসনব্যবস্থায় এগিয়ে চলেছে, এই শাসনব্যবস্থায় উচ্চশ্রেণি ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমঝোতায়- এক ধরনের সামাজিক ও মানবিকবোধের ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছে। এর ফলে তাদের মধ্যে রাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে ওঠার জন্য দায়িত্ব ও কর্তব্যের পাশাপাশি অধিকার চেতনাও কাজ করেছে। মনস্তাত্ত্বিকভাবে নিজেদের মধ্যে এক ধরনের বন্ধন তৈরি করে- কালের চাহিদা ও পরিবর্তনকে স্বাগত জানানোর মতো সহনশীল পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা দীর্ঘকাল ধরে চলছে। নেদারল্যান্ডসে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়মনীতিও স্থায়ীভাবে জনগণের আচরণের সাথে সমন্বিত হয়ে কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে আধুনিক যুগের পরিবর্তিত শিক্ষা, প্রযুক্তি, অর্থনীতি, আবিষ্কার ও অন্যান্য দিককেও সফলভাবে উন্নতস্তরে নিয়ে নিজেদের জীবনকে বিকশিত করতে পারছে। বাংলাদেশে এই পরিস্থিতি এখনো সেভাবে বিকশিত হতে পারেনি বলেই- গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক নিয়ে মানুষও সন্তুষ্ট নয়, মানুষের কল্যাণও গণতান্ত্রিকভাবে সেভাবে বিকশিত হচ্ছে না।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দলে গণতন্ত্র, নির্বাচন কমিশন ঢেলে সাজানো ও নির্বাচন-বিধি পরিবর্তন ছাড়াও নতুন রাজনৈতিক শক্তি ও নেতৃত্ব প্রয়োজন। আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যকর করার জন্য জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাও প্রয়োজন। শুধু অতীত-আশ্রয়ী না হয়ে ভবিষ্যৎমুখী উদ্যোগ গ্রহণে সক্রিয় হওয়ার মানসিকতা জরুরি হয়ে পড়েছে। আজকের সময়কালে জগতের রূপান্তর ঘটেছে, মানুষ এগিয়েছে। মানুষের  মনোজগতের পরিবর্তন হয়েছে- আশা ও আকাঙক্ষারও। চাহিদা বেড়েছে প্রবহমান জীবনে। মানুষের দাবি মেটানোর জন্য বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার কতটুকু প্রস্তুত ও সামর্থ্য রাখে- তাও বিবেচনায় এনে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি, জনগণের কল্যাণ ও সমর্থনের প্রতিফলন ঘটানো আমাদের দেশে বড় একটা  চ্যালেঞ্জ।

আরও একটি পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, বিভিন্ন দেশে অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে আটক ও বিচারাধীন বাংলাদেশি নাগরিকের সংখ্যা ১৩ হাজারের উপর। তবে আরও কিছু বাংলাদেশি নাগরিক বিভিন্ন অপরাধজনিত কারণে বিদেশের কারাগারে আটক থাকতে পারেন।  শুধু বড় বড়  চোখ ধাঁধানো অব কাঠামোর উন্নতি করলে চলবে না, আমাদের অপরাধমুখী প্রবণতা কমানোর দিকে সবার নজর দিতেই হবে- নাহলে অর্থনৈতিক উন্নতির কোনও বিশেষ তাৎপর্য মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারবে না! নেদারল্যান্ডসের কারাগার বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিভিন্ন অনুঘটকের  প্রভাব ও ধারণাগুলো আমরা বিশ্লেষণ করে তা থেকে অভিজ্ঞতা গ্রহণ করে আমরাও উপকৃত হতে পারি।