গালগল্প তত্ত্ব, ভাষা এবং মানব সভ্যতা

সাজ্জাদুল হাসান
Published : 7 May 2019, 12:10 PM
Updated : 7 May 2019, 12:10 PM

পৃথিবী নামক এই গ্রহে বিজ্ঞানীরা এখন পর্যন্ত ১২ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, অনধিক ৭০ লক্ষ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণীর অস্তিত্ব রয়েছে আমাদের এই পৃথিবীতে! খালি চোখে দেখা যায় না এমন প্রাণী যেমন আছে তেমনি আছে ১১০ ফুট লম্বা অতিকায় নীল তিমি। এই সুবিশাল প্রাণী রাজ্যে মানুষ নামক এই প্রাণীটি কিভাবে সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে উঠল তা নিঃসন্দেহে এক অপার বিস্ময়ের জন্ম দেয়। গল্পটার শুরু: সে অনেক অনেক দিন আগের কথা……

আনুমানিক প্রায় ১৩৫০ কোটি বছর আগে এক মহা বিস্ফোরণের মধ্যে দিয়ে এই মহাবিশ্বের সৃষ্টি। এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি বিগ ব্যাং (Big Bang) হিসেবে সমাধিক পরিচিত। তারও প্রায় ৯০০ কোটি বছর পরে বিভিন্ন ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পৃথিবী নামক এই গ্রহের আবির্ভাব। অর্থাৎ এখন থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি বছর পূর্বে সৃষ্টি হয় আমাদের প্রিয় এই পৃথিবীর। প্রাণের অস্তিত্ব এই গ্রহকে করেছে অন্য সব গ্রহ থেকে আলাদা। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন জাগে কখন এবং কিভাবে প্রাণ তথা জীবের আবির্ভাব হয় অনিন্দ্য সুন্দর এই আবাসস্থলে? অদ্যাবধি প্রাপ্ত বিভিন্ন গবেষণা থেকে এই তথ্যটা মোটামুটি অনুমিত যে, প্রায় তিনশ আশি কোটি বছর আগে পৃথিবীতে জীবের আবির্ভাব ঘটে। পরবর্তীতে জীব জগতে ঘটতে থাকে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন।

আজ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর আগে সর্বপ্রথম পৃথিবীতে মনুষ্য সদৃশ প্রাণীর অস্তিত্বের সন্ধান পাওয়া যায়। পূর্ব আফ্রিকাতে আবির্ভূত আমাদের এই পূর্বপুরুষেরা অস্ট্রালোপিথেকাস গণের অন্তর্ভুক্ত। ধারণা করা হয়ে থাকে প্রায় বিশ লক্ষ বছর আগে প্রাচীন এই মানুষদের একটি অংশ খাদ্য কিংবা নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পরে। বিশ্বের বিভিন্ন অংশে আবহাওয়া ও জলবায়ুর ব্যাপক তারতম্য ও ভিন্নতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকার এক প্রাণান্তকর লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয় মানুষকে। এরই ফলশ্রুতিতে পৃথিবীর একেক প্রান্তে থাকা মানুষদের বিবর্তন সাধিত হয় একেকভাবে। আকার, আকৃতি, গায়ের রঙ এমনকি স্বভাবেও তাদের মধ্যে ব্যাপক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। বিজ্ঞানীরা এদের প্রত্যেককে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার নিরিখে পৃথক পৃথক নামে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন: পূর্ব এশিয়ায় বসবাসরত তৎকালীন মানুষরা পরিচিত হোমো ইরেক্টাস নামে। হোমো নেয়ান্ডার্থালেনসিস নামে পরিচিতি লাভ করে ইউরোপ ও পশ্চিম এশিয়ার মানুষেরা। ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপে বসবাস ছিল হোমো সোলোয়েনসিস নামক মানুষদের। এমনি ভাবে ফ্লোরেস দ্বীপে বসবাস করা প্রাচীন মানুষেরা হোমো ফ্লোরেসিয়েন্সিস হিসেবে পরিচিত। এরকম আরও কিছু মনুষ্য প্রজাতির অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানিরা। বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় প্রায় দুই লক্ষ বছর পূর্বে হোমো স্যাপিয়েন্স নামক মানব প্রজাতির আবির্ভাব। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত ফসিল সমূহ বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞগণ এই মত প্রকাশ করেন যে, আজ থেকে ১০,০০০ বছর আগেও এই পৃথিবীতে একাধিক মানব প্রজাতির অস্তিত্ব ছিল।

নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ঘটনা-দূর্ঘটনা, বিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত টিকে যাওয়া একমাত্র মানব প্রজাতি হলো হোমো স্যাপিয়েন্স। কেবল টিকে থাকাই না, সমস্ত পৃথিবীর উপর তার একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ। পৃথিবীর সীমা ছাড়িয়ে তারা এখন ব্যস্ত  মহাবিশ্ব জয় করার এক মহা কর্মযজ্ঞে। অথচ সৃষ্টির একদম শুরুতে দীর্ঘ সময়কাল পর্যন্ত মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীকুলের মধ্যে জীবনাচরণে তেমন কোনও পার্থক্য ছিল না। বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ইয়ুভাল নোয়াহ হারারি তার জনপ্রিয় গ্রন্থ 'স্যাপিয়েন্স' এ বলেছেন, লক্ষ লক্ষ বছর জীবন ধারণের জন্য মানুষ নির্ভর করেছে ফলমূল আর ছোট ছোট প্রাণী শিকারের উপর। অন্যদিকে, তারা নিজেরা হতো বৃহৎ প্রাণীদের শিকার। তাদের অবস্থান ছিল খাদ্য শিকলের (food chain) মাঝামাঝি পর্যায়ে। আজ থেকে এক লক্ষ বছর পূর্বে সেই মানুষই পৌঁছে যায় খাদ্য শিকলের শীর্ষে।

মানুষের এই অভূতপূর্ব সাফল্যের রহস্য নিয়ে অব্যাহতভাবে চলছে ব্যাপক গবেষণা, আলোচনা বা সমালোচনা। কোন সেই জাদুর কাঠি যার স্পর্শে প্রাণীকুল তথা পারিপার্শ্বিক পরিবেশের উপর মানুষ ধীরে ধীরে তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়? বিশিষ্ট বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইনের মতে, "ভাষা" হচ্ছে  মানুষ কর্তৃক উদ্ভাবিত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এটি এমন একটা বিষয় যা মানুষকে করেছে অন্য প্রাণীদের থেকে আলাদা। প্রখ্যাত নৃবিজ্ঞানী  ম্যালিনস্কি মানব সভ্যতার বিকাশে ভাষার গুরুত্ব সমন্ধে ব্যাখ্যা করতে যেয়ে বলেন, যোগাযোগের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ  মাধ্যম হচ্ছে ভাষা;  মানুষে মানুষে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টির অপরিহার্য উপায় এটি, যা ছাড়া একীভূত সমাজ কাঠামো অসম্ভব। এই সমাজবদ্ধভাবে বসবাসের কারণে পারস্পরিক সহযোগিতার যে সম্পর্ক গড়ে উঠে, মানুষের টিকে থাকার লড়াইয়ে তা এক মুখ্য ভূমিকা রাখে। অ্যারিস্টটলের মতে, যুক্তি দিয়ে কোনো কিছু বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা মানুষকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে; আর এই ক্ষমতা মানুষ অর্জন করেছে ভাষার মাধ্যমে।

মানুষের ভাষার আর এক বিশেষত্ব হলো, অল্প কিছু ধ্বনি এবং চিহ্ন ব্যবহার করে অসংখ্য শব্দ এবং অর্থবহ বাক্য গঠন সম্ভব, যার মাধ্যমে মানুষ পরস্পরের সাথে নানা রকম তথ্যের আদান প্রদান এবং তা সংরক্ষণ করার সক্ষমতা অর্জন করে। ভাষা আবিষ্কারের পূর্বে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গোত্র বা দলে বিভক্ত ছিল প্রাচীন মানুষ। আন্তঃযোগাযোগ স্থাপনে এক নজিরবিহীন সম্ভাবনার দ্বার উন্মচিত হলো ভাষার কারণে। অবিরাম ভাবের আদান-প্রদান পারস্পরিক আস্থা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে যার কারণে ছোট দল বৃহৎ দলে পরিণত হয়েছে।  এই বৃহৎ ঐক্য মানুষকে সাহায্য করেছে আরও অধিক শক্তি ও ক্ষমতা অর্জনে।

সময়ের সাথে সাথে সমৃদ্ধ হতে থাকে ভাষা।  আর এর পিছনে  কার্যকরী ভূমিকা রাখে পারস্পরিক ভাব বিনিময় বা গালগল্প। এ ধরণের গালগল্প অনেক ক্ষেত্রেই অপ্রয়োজনীয় বিষয়ের উপর হতো এবং তা  হয়ত দীর্ঘ সময় ধরে চলতো। প্রচলিত পরিভাষায় যাকে আমরা আড্ডা বলে থাকি। জগতে মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রাণী যারা অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে অন্তহীনভাবে কথা বলতে ভালবাসে। এটা ভাবার কোনও অবকাশ নেই যে, গালগল্প কেবল অলস মানুষদের কাজ। সমাজে যারা অগ্রসর, জ্ঞানী কিংবা বুদ্ধিমান হিসেবে স্বীকৃত এরকম ব্যক্তিবর্গ যখন এক সাথে বসেন তাঁদের আলোচনার বিষয়বস্তু শুধু মাত্র তথাকথিত বিষয় ভিত্তিক হয় না বরঞ্চ সাধারণ মানুষদের মত তাদের আলোচনায় নানা রকম মুখরোচক, মশলাদার বিষয় যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হয়। অবধারিতভাবে পরচর্চা, পরনিন্দা বা অন্যদের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে অযাযিত কৌতূহলের বিন্দুমাত্র কমতি থাকে না এ ধরণের আড্ডায়।

এই গালগল্প করার প্রবণতা যেমন অতীতে ছিল তেমনি বর্তমানেও এই ব্যস্ত সময়কালে তা ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, বিশিষ্ট নৃবিজ্ঞানী রবিন ডানবার ১৯৯৭ সালে করা "মানুষের কথোপকথন আচরণ (Human Conversational Behavior)" নামক গবেষণায় দেখিয়েছেন, বাজার কিংবা কোনো উন্মুক্ত স্থান বা কাজের বাইরে মানুষ যখন কথা বলে তার ৬৫ শতাংশ জুড়ে থাকে নিছক গালগল্প।

অধ্যাপক রবিন তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ " গ্রুমিং, গসিপ এন্ড দ্য ইভলিউশন অব ল্যাঙ্গুয়েজ" এ বলেছেন, গালগল্পের মাধ্যমে আমরা আমাদের আশেপাশের জগৎ সম্পর্কে অবগত হই, গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদান প্রদান করি, যার কারণে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি কাকে বিশ্বাস করা যায় এর ফলে আমাদের মধ্যে পারিবারিক এবং বন্ধুত্বের বন্ধন আরও সুদৃঢ় হয়। তিনি বিষয়টিকে "গালগল্প তত্ত্ব" (Gossip Theory) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক ডক্টর জেনিফার কোল গালগল্পের উপর বেশ কিছু গবেষণা করেছেন। তাঁর মতে, সামাজিক যোগাযোগ ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ আর এই যোগাযোগ রক্ষায় গালগল্পের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তিনি আরও বলেন, "আমরা জানি যে, অন্য কারো গোপনীয়তা লঙ্ঘন করছি এবং এরকম আচরণ  ভদ্রতার সংঘে সাংঘর্ষিক। অথচ কেউ যদি গালগল্প না করে আমরা তাদের পছন্দ করি না, সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখি। যারা গালগল্প করে আমরা বরঞ্চ তাদের পছন্দ করি।"

অধ্যাপক হারারি এই গালগল্পে মত্ত থাকা বা আড্ডাবাজদের প্রাচীন মানব সমাজের 'চতুর্থ স্তম্ভ' অর্থাৎ সাংবাদিক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন যারা সমাজকে ভাল-মন্দ, সত্য-মিথ্যা ইত্যাদি নানা বিষয়ে অবহিত করত এবং অনেক ক্ষেত্রে এ থেকে সমাজ বেশ উপকৃত হত। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, গালগল্প নেতিবাচক সামাজিক আচরণ প্রতিরোধে এবং সে সাথে মানসিক ধকল হ্রাসে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। মিশিগান বিশবিদ্যালয় কৃত আরেক গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, গালগল্প নারীদের শরীরে প্রোজেস্টেরোন হরমোনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় যা উদ্বেগ এবং ধকল কমাতে সাহায্য করে।

আধুনিক সমাজে প্রযুক্তির অভাবনীয় উৎকর্ষতার কল্যাণে গালগপ্লের মাত্রা বেড়েছে বহুগুণ। বর্তমানে দৈহিকভাবে অনুপস্থিত থেকেও অনায়েসে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় আড্ডা। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইমেইল ইত্যাদি নানা রকম মাধ্যম এ ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে চলেছে। ভাষার ক্ষেত্রেও এ সামাজিক যোগাযোগের রয়েছে এক প্রত্যক্ষ প্রভাব। একটি ছোট্ট পরিসংখ্যান এ দাবির যথার্থতা প্রমাণ করতে সক্ষম হবে। ইংরেজি ভাষায় বর্তমানে প্রায় ৫,৪০,০০০ শব্দ রয়েছে যা শেক্সপিয়ারের সময়কালের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি!

একবার কল্পনা করুন তো সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন কেউ কারও সাথে কথা বলছে না! কেমন হবে সেই পৃথিবী? আর যাই হোক নিশ্চয়ই আপনি সেখানে বাস করতে চাইবেন না।  গালগল্প বা আড্ডা মানুষের স্বভাবজাত। সভ্যতার বিনির্মাণে, মানুষের সৃষ্টির সেরা জীব হয়ে উঠার পিছনে ভাষা নিঃসন্দেহে রেখেছে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। আর ভাষা ক্রমাগতভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে এবং হচ্ছে বাধাহীন গালগল্পের কারণে।